বিসর্জন অথবা আগমন

 প্রকাশিত: ২০১৫-১০-০৯ ১৫:৫৩:২৪

ছবি: সংগৃহীত

মিশু মিলন:

এক

মাধাই পাগলার কড়া পড়া বীভৎস কালো অন্ডকোষের মতো অন্ধকার, তার একমাথা ঝাঁকড়া চুলের মতোই রাস্তার দু’ধারের গাছপালা, তাও অন্ধকার! ধুলোবালি মাখা পাঁচড়াময় নগ্ন শরীরের মাধাই পাগলার মতোই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে খানা-খন্দে ভরা পিচের রাস্তা। খেয়ালের বশে মাধাই পাগলার নিতম্ব বেয়ে অন্ডকোষে এসে, অতঃপর অন্ডকোষের কালো সরু খাড়িপুঞ্জে আতি-পাতি করে পথ খুঁজে ফেরা লাল পিঁপড়ার মতো দিগি¦দিক হয়ে অন্ধকারে হেঁটে নিরাপদে ঘরে ফিরতে চাইছেন তারাপদ। আজন্মের চেনা পথ, তবু তার মনে হচ্ছে পথ ভুল হয়নি তো! হাতে দুই ব্যাটারির টর্চলাইট থাকলেও এখনই জ্বালতে চাইছেন না, বড় রাস্তা ছেড়ে ইটবিছানো গলিতে ঢুকে তারপর জ্বালবেন।  

    গত মাসে ঢাকায় অপারেশান সার্চলাইট শুরুর পরদিন থেকেই ঢাকা থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরা মানুষের মুখে পাক আর্মির পৈশাচিক হত্যাকান্ডের কথা শুনে একটা ভয় ভয় ভাব বিরাজ করছিল গোটা শহরজুড়ে, আর গত পরশু পাক আর্মি ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করার পর থেকে যেন একটা জলপাই রঙের স্যাঁতা পড়া বৃহৎ কালো পাথর চেপে বসেছে শহরের বুকের ওপর। মেয়েরা তো নয়ই, জরুরী কাজ ছাড়া কোন পুরুষও ঘরের বাইরে যাচ্ছে না।  

তারাপদ গিয়েছিলেন কানাইপুর বেয়াইবাড়ি। বড় মেয়ে নীলার বিয়ে দিয়েছেন কানাইপুরের নামকরা পাট ব্যবসায়ী সদানন্দ সাহার ছেলের সঙ্গে। তারা কি করবেন, কি ভাবছেন, দেশে থাকবেন, নাকি ভারতে চলে যাবেন সেই বিষয়ে জানতেই বেয়াইয়ের পরামর্শ নিতে গিয়েছিলেন। বেয়াই অবশ্য জানিয়েছেন তারা এখনই কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। এতো বড় ব্যবসা, গুদাম ভরা হাজার মণ পাট, এসব ফেলে গেলে তো লোকে হরিলুটের মাল মনে করে সব গায়েব করে দেবে। তাই শেষ পর্যন্ত দেখতে চান বেয়াই।

    আবার হবু বেয়াইও একই কথা বললেন। হবু বেয়াই, মানে ছোট মেয়ে শীলার হবু শ্বশুর। আসছে ১২ আষাঢ় বিয়ে। সবকিছু ঠিকঠাক, ছেলের আশির্বাদও হয়ে গেছে। তারাপদ’র ইচ্ছে ছিল না মেয়েকে এখনই বিয়ে দেবার। শিলা বি, এ পড়ছে। ভেবেছিলেন এম, এ পাস করুক তারপর বিয়ে দেবেন। কিন্তু পাত্র-পাত্রী নিজেরাই নিজেদের পছন্দ করেছে। পাত্র এম, এ পাশ করে প্রভাষক হিসেবে ঢুকেছে একটা কলেজে। পাত্রের বাবা অর্থাৎ হবু বেয়াই এখনই ছেলের বিয়ে দিতে চান। হবু বেয়াই ফরিদপুর কোর্টের উকিল, একটু চশমখোর। চোখের পর্দা ছেঁড়া, নইলে ছেলে-মেয়ে একে অপরকে পছন্দ করেছে, এখানে তো দেনা-পাওনার কথা তোলাই উচিত নয়। তিনি কি ছোট মেয়ের শরীর-সংসার সাজিয়ে গুছিয়ে দিতেন না! ট্যাঁকের মুখ বেঁধে কোমরে গুঁজে রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন! আর তো মেয়ে নেই, এই শেষ। এরপর একমাত্র ছেলের বিয়ে দেওয়া ঢের দেরি। অথচ হবু বেয়াই বিয়ের পাকা কথাবার্তার সময় দাঁড়ি-পাল্লা উঁচিয়ে ধরলেন। মেয়ের সুখের দিকে তাকিয়ে তিনি কথা বাড়াননি, এক পাল্লায় মেয়ে-আরেক পাল্লায় পণ দিতে রাজি হয়েছেন। কে জানে এই চশমখোরের ঘরে গিয়ে মেয়েটা কেমন থাকবে! ছেলেটা অবশ্য ভাল।

    তাই বিয়ে যখন ঠিক হয়েই গেছে, তখন এই দুঃসময়ে কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে হবু বেয়াইয়ের সাথেও পরামর্শ করে নেওয়া প্রয়োজন মনে করেছেন তারাপদ। কিন্তু কানাইপুরের বেয়াইয়ের মতো, হবু বেয়াইয়ের কথা শুনেও তিনি আশ্বস্ত হয়েছেন। আপাতত দেশ ছাড়ছেন না। তাদের পাড়ার কয়েকটি পরিবার অবশ্য আর্মি আসার খবর শুনে গতকালই ভারতে চলে গেছে।  

এখন হবু বেয়াইয়ের বাড়ি থেকেই ফিরছেন তিনি। লোহার পুল পেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে আসতেই তার বুকে যেন বাজ পড়েছিল আর্মির গাড়ি দেখে। ভাগ্যিস আগে থেকেই চোখে পড়েছিল, চট করে একটা বাড়ির আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। নইলে এতক্ষণ কি হতো কে জানে! বুক এখনও ধরফর করছে, শরীর কাঁপছে রঘুর ঢাকের পর্দার মতো!    
    সুনসান পরিবেশে গলিতে ঢোকার মুখে বাঁ দিকে হোলের বিচি চুলকানোর খসখস শব্দ শুনলেন আর অন্ধকারে একটি অবয়বের আকার দেখতে পেলেন তারাপদ, কিন্তু চমকালেন না। ওটা মাধাই পাগলা, দোকানের সামনের সিঁড়িটাই ওর রাতে থাকবার অলিখিত জয়গা। এ পাড়ার সবাই জানে। তবে মাঝে মাঝে কয়েকদিনের জন্য ও কোথায় যে উধাও হয়ে যায়, কে জানে!     
গলিতে ঢুকে লাইট জ্বাললেন তারপদ। ঠিক ছড়িয়ে  নয়, যতটা সম্ভব গুটিয়ে; খাড়াভাবে, পায়ের থেকে সামান দূরে, ভাঙাচোরা ইটের রাস্তায়। পাড়া সুনসান, কেবল ঝিঁঝির রাগ-রাগিনী; কোন বাড়িতে আলো জ্বলছে না। পরশু রাত থেকেই এ পাড়ার আলো অতিমাত্রায় সংযমী হয়েছে, সংযমী হয়েছে মানুষের কন্ঠস্বর, এমনকি কুকুরেও। সন্ধ্যার পর মাধাই পাগলার মতোই ঝিমিয়ে থাকে পাড়াটা।

রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকে নেমে ঘরের সামনের সরু জায়গাটুকু পেরোতে পেরোতে গলা খাঁকারি দিলেন দুইবার, তারপর দরজার সামনে এসে দেখলেন দরজা খোলা! তার গলা খাঁকারি শুনলেই শীলা অথবা শীলার মা দরজা খুলে দেয়। আর্মি আসার পর থেকে দরজা খোলার সময় আলো জ্বালতে নিষেধ করেছেন তিনি।
ছোট করে তিনি লাইট জ্বাললেন চৌকাঠের ওপর। চৌকাঠের ওপাশে কেউ নেই। ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে টর্চ জ্বেলে ডাকলেন, ‘শীলা...।’
কেমন একটা গন্ধ ভেসে এলো নাকে। নাক টেনে আবার ডাকলেন, ‘তোরা সব কই?’
কোন সাড়া নেই। কয়েক পা এগোতেই টর্চের আলো ঝিলিক দিয়ে উঠলো মেঝের রক্তের ওপর, লাল টকটকে তাজা রক্ত!

দুই

তারাপদ ছুটছেন পীড়বাড়ির উদ্দেশ্যে। পীর শমসের মোল্লা, মুরিদরা বলে সাম্যবাদী তাপস পীর শমসের বাঙ্গালী; লোকে বলে, পীর শমসের বাঙ্গালী। তারাপদ যাচ্ছেন শমসের মোল্লার ছেলে মুসার কাছে, একটা হাত বাঁকা হওয়ায় সে পরিচিত নুলা মুসা নামে। গোয়ালচামট বাসস্ট্যান্ডের কাছে আলিমের চায়ের দোকানের সামনেই নুলা মুসার দেখা পেলেন তিনি। মজিদ বিহারী, কালু বিহারী, চান্দা আর আইয়ুবকে সঙ্গে নিয়ে উঠতি যুবক নুলা মুসা বয়সের চেয়ে দ্বিগুণ ভারিক্কি আর দাম্ভিক ভঙ্গিতে হাঁটছে আঙুলের ফাঁকের সিগারেটে ঠোঁট ছুঁইয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে। তারাপদ গিয়ে কেঁদে-কেটে নুলা মুসার পা জড়িয়ে ধরলেন, ‘মুসা, আমার ছেলে-মেয়ে আর বউকে কই রাখছো বাবা। ওরা কি বেঁচে আছে? তোমার পায়ে পড়ি বাবা, তুমি ওদের ফিরায়ে দাও।’     

    কান্নার দমকে তারাপদ’র কথা আটকে যাচ্ছে গলায়। নুলা মুসা সহযোগীদের দিকে একবার তাকালো। তারপর ঘাড়টা সামান্য নিচু করে তারাপদ’র মুখের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে বললো, ‘আমরা তো তাদের নিই নাই, তাদের নিয়ে গেছে আর্মিরা। আর্মিদের সেবাযতœ করার জন্য। সময় হলেই তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’
    ‘তোমরা তো সাথে ছিলে বাবা। আমার ঘরের মধ্যে রক্ত কেন, ওরা সবাই বেঁচে আছে তো?’
    ‘পা ছাড়েন।’
    পা ছাড়লেন না তারাপদ। কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন। চান্দা লাথি মারলে তারাপদ ব্যাঙের মতো উল্টে পড়লো রাস্তায়। কাঁধ থেকে রাইফেলটা নামিয়ে চান্দা বললো, ‘দেই মালাউনডারে খালাস করে!’
    ‘থাক, এমনিতেই মরবে, জ্বলতে জ্বলতে মরুক।’

    বলে আর দাঁড়ালো না নুলা মুসা। হেঁটে এগিয়ে গেল সামনে, সহযোগীরা তাকে অনুসরণ করলো। কেবল কালু বিহারী আরেকটা লাথি মারলো তারাপদকে, মাটি থেকে উঠার সময়।   
    মাটিতে লেপটে বসে নুলা মুসাদের চলে যাওয়া দেখলেন তারাপদ। এলাকার ছেলে নুলা মুসা। এইতো গত নির্বাচনের সময়ও আওয়ামীলীগের হয়ে ভোট চেয়ে বেড়ালো সবার কাছে। একটু উদ্ধত কিন্তু তারাপদ’র সাথে বেয়াদবি করেনি কোনদিন, রাস্তায় দেখা হলে কথাও বলেছে। অথচ এত তাড়াতাড়ি বদলে গেল নুলা মুসা! দেশের সাথে, দেশের মানুষের সাথে বেঈমানী করে হয়ে গেল পাকিস্থানী আর্মিদের দোসর। এতটাই নিচে নেমে গেল নুলা মুসা যে প্রতিবেশী মা-বোনদেরকে পাকিস্থানী আর্মির হাতে তুলে দিতেও ওর বিবেকে এতটুকু বাঁধলো না!
    কাল রাতে শুধু তারাপদ’র স্ত্রী-কন্যাই নয়, আরও কয়েকজন যুবতী মেয়েকেও তুলে নিয়ে গেছে পাকিস্থানী আর্মিরা। নুলা মুসা এবং তার দলবল বাড়ি চিনিয়ে নিয়ে এসেছিল পাকিস্থানী আর্মিদের।

    কাল সারারাত ঘুমোননি তারাপদ। প্রতিবেশীদের বাড়িতে ছুটোছুটি করেছেন, বেশিরভাগ বাড়িই খালি। গলিতে আর্মিদের ঢুকতে দেখে পালিয়েছে তারা। তারাপদ পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন। পাড়ায় ফিরেছেন গভীর রাতে। পাড়ার লোকজনও ভয়ে ভয়ে ঘরে ফিরেছে অনেক রাতে, আর্মির গাড়ি এসেছিল এর বেশি কিছু বলতে পারেনি তারা। তারাপদ রাতভর কেঁদেছেন আর আছাড়ি-পিছাড়ি করেছেন। তার কান্না শুনেও এগিয়ে আসেনি কেউ। না কোন হিন্দু, না কোন মুসলমান। সকলেই ভীত-সন্ত্রস্ত। অথচ দু’দিন আগেও কোন বাড়িতে কারো কান্নার আওয়াজ পেলে বা কেউ বিপদগ্রস্ত হলে প্রতিবেশীদের ভিড় জমে যেত, সান্ত্বনা এবং সুপরামর্শ দেবার মানুষের অবাব হতো না!  

    কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ ফুলে গেছে তারাপদ’র। জবা ফুলের মতো লাল চোখ মেলে দেখলেন নুলা মুসারা রিক্সায় উঠে চলে গেল দৃষ্টির বাইরে! হাল ছাড়লেন না তারাপদ, আশায় বুক বাঁধলেন স্ত্রী-কন্যা আর পুত্রের বেঁচে থাকার খবর শুনে। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলেন নুলা মুসার বাবার কাছে গিয়ে তার হাতে পায়ে ধরবেন, ওর বাবা পীর মানুষ, তার যন্ত্রণা তিনি ঠিকই বুঝবেন! বাবার আদেশে যদি নুলা মুসা তার স্ত্রী-সন্তানদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করে!  

    তারাপদ গিয়ে দেখলেন শমসের মোল্লা মুরিদদের দোয়া করছেন, মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে ফুঁ দিচ্ছেন। ভিড় কমলে তিনি শমসের মোল্লার পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। শমসের মোল্লা কখনও চোখ বুজে, কখনও চোখ খুলে শুনলেন। তারপর বললেন, ‘যুদ্ধকালে বিধর্মী কাফের এবং বিরোধী পক্ষের মেয়েছেলে গনিমতের মাল। বীর যোদ্ধারা যদি তাদের ভোগ করে তাতে গুণাহ্ নেই, জায়েজ। পাকিস্থানী আর্মি আল্লাপাকের প্রিয় বান্দা। পাকিস্থানকে রক্ষার জন্য আল্লাহ তাদেরকে পাঠিয়েছেন। এখন তারা যদি বিধর্মী মেয়েছেলেদের ভোগ করে আমি তাতে বাঁধা দিতে পারি না, কেননা গনিমতের মাল এ যোদ্ধাদের হক আছে। বাঁধা দিলে আল্লাহ আমার ওপর নাখোশ হবেন!’

কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে বিড়বিড় করতে করতে তসবির দুটো দানা অতিক্রম করে আবার বললেন, ‘তবে...উপায় একটা আছে...।
বেলুনের মতো চুপসে গিয়ে পুনরায় যেন বাতাস ফিরে পেলেন তারপদ, আশান্বিত হয়ে তাকালেন শমসের মোল্লার মুখের দিকে।
‘তুমি যদি পবিত্র মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করো, নিজেকে আল্লাহপাকের বান্দা হিসেবে স্বীকার করো, তবে আমি তোমার স্ত্রী-সন্তানদের মুক্তির ব্যাপারে দেন দরবার করে দেখতে পারি। তবে, তোমার স্ত্রী-সন্তান মুক্ত হবার পর তাদেরকেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। ভেবে আমাকে জানাও। এখন এসো, অন্যদেরকে দোয়া নিতে দাও।’
আবার তসবিহ গুনতে শুরু করলেন শসসের মোল্লা। তারাপদ ভেবে দেখার সময়টুকুও অপব্যয় করতে চাইলেন না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণে রাজি হয়ে গেলেন। ধর্মের চেয়ে তার কাছে এখন স্ত্রী-সন্তানের জীবন বড়। জীবন না বাঁচলে কী হবে তার এই ধর্ম দিয়ে!
     শমসের মোল্লা দুইহাত ঊর্ধ্বে তুলে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! হে মাবুদ, সব আপনার মোজেজা, সব আপনার ইশারা!’
তারাপদ’র মাথায় ডানহাত রেখে বিড়বিড় করতে লাগলেন।  

    পরদিনই পীর শমসের মোল্লা তারাপদকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করলেন। তারাপদ’র নতুন নাম হলো মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেন। তার পরনে এখন ধবধবে সাদা নতুন পাঞ্জাবী-পাজামা। মাথায় সোনালী জরির কাজ করা সাদা টুপি। ধর্মান্তর উপলক্ষে পীরের মুরিদদের পরামর্শ মতো সাধ্যমতো বেশ পুরু এক তোড়া টাকা রাখলেন শমসের পীরের পায়ের কাছে, হাতে-পায়ে চুম্বনও করলেন। শমসের পীর তার কাঁধে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কাফের ধর্ম ছেড়ে তুমি খোদার ছায়াতলে এসেছো, খোদা নিশ্চয় তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করবেন।’
    বলে টাকা তোড়াটা পায়ের কাছ থেকে তুলে পাশে রাখা লাল সালু কাপড়ের থলের মধ্যে রাখলেন।   
     
    আরও দুটো দিন কেটে গেল। তারাপদ, না না, ইব্রাহিম; মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেন অনেক রাতে বাড়ি ফেরেন, আর খুব সকালে চলে যান পীরবাড়ি। পীরের পায়ে পড়েন স্ত্রী সন্তানকে ফেরানোর কথা বলে। পীর তাকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেন। ইব্রাহিম ধৈর্য ধরেন, তার চালের আড়ত থেকে বস্তার পর বস্তা চাল আসে পীড়বাড়িতে। তবু স্ত্রী-সন্তান ফেরে না।   
     একদিন বিকেলে নুলা মুসার সাথে পীর শমসের মোল্লার কাছে দোয়া নিতে এলো পাক মেজর আকরাম কোরায়শী, সঙ্গে কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য। আকরাম কোরায়শী পীরের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো, পীর আকরামের মাথায় হাত রেখে বেশ কিছুক্ষণ দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে বললেন, ‘চিন্তা মাত কারো বেটা, ইস শহর মে কোই ঝুট-ঝামেলা নেহি, ম্যায় কেহতাহু খোদা কে মর্জি সে ইন্ডিয়া ভি পাকিস্থান বন যায়েগা।’

একইভাবে সব সৈন্যের মাথায় হাত রেখে দোয়া পড়ে ফুঁ দিলেন। তারপর মেজর আকরাম যখন পীড়বাড়ির উঠোনের চেয়ারে বসে জলখাবার খেতে খেতে নুলা মুসার সাথে আলাপ করতে লাগলো, তখন এক ফাঁকে মেজরের পা জড়িয়ে ধরলেন ইব্রাহিম। বাংলায়-উর্দুতে মিলিয়ে মিশিয়ে তার স্ত্রী-সন্তানকে মুক্তি দেবার আবেদন জানালেন। নুলা মুসা তাকে ধমকালো পা ছেড়ে দূরে সরে যাবার জন্য, তবু ছড়লেন না। মজিদ বিহারী আর চান্দা ইব্রাহিমের দুই ড্যানা ধরে সরিয়ে দিতে গেলে মেজর আকরাম বললো, ‘রোখো, রোখো...। তুমহারা নাম কেয়া হ্যায়?’
‘তারাপদ সাহা....না, না, মেরা নাম ইব্রাহিম...মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেন।’
‘একবার বলতি হে তারাপদ ফির বলতি হে ইব্রাহিম হোসেন! ঝুট বোলে তো খতম কারদুঙ্গি!’
‘আমি....ম্যায় হিন্দু থা স্যার, পীর সাবকো দুয়া সে আব মুসলমান হুয়া।’
‘তুম হিন্দু থা, আব মুসলমান হুয়া!’
‘জ্বি স্যার, ম্যায় মুসলমান হুয়া, সাচ্চা মুসলমান!’
এরপর নুলা মুসা উর্দুতে পুরো বৃত্তান্ত বুঝিয়ে বলতেই বিকেল কাঁপিয়ে উচ্চশব্দে হেসে উঠলো মেজর আকরাম। কেউ বিস্ময়ে, কেউ ভয়ে, সারা বাড়ির মানুষ মেজর আকরামের চোয়াড়ে মুখের দিকে তাকালো!    
                     
তিন

স্বাধীনতার ইচ্ছে রোদ্দুরে অতুল উল্লাসে করেছে সবাই রৌদ্রস্নান, স্বাধীনতার ইচ্ছে বৃষ্টিতে আনন্দস্নান করতে করতে কখনও হেসেছে কখনও কেঁদেছে সবাই। কেউ প্রিয়জনকে হারিয়ে ফিরে পেয়ে, কেউবা প্রিয়জন হারানোর ব্যথা ভুলে পরিবারের অন্যদের নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে শুরু করেছে নতুন লড়াই। একে একে পাড়া-পড়শিরা ফিরে এসেছে। তাদের ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলেছে, হাতের চুড়ির শব্দ ছন্দ ফিরে পেয়েছে, পড়ে থাকা শূন্য-নিস্তব্ধ ঘরগুলো মুখর হয়েছে পদচারণায়-কথায়, কাজের ব্যস্ততায়। ফিরে এসেছে শিশুদের কলকাকলি-হট্টগোল। আবার একটু একটু করে জমে উঠেছে ভাঙা হাট, ফিরে পেয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। কেবল নিস্তব্ধ-নিস্তরঙ্গ তারাপদ’র সংসারসমুদ্র; না, না, ইব্রাহিম, মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেনের সংসারসমুদ্র। তারাপদ মরে গেছেন গতবছর এপ্রিলে, ইব্রাহিমের বুকে সমাধি হয়েছে তারাপদ’র। এখন ইব্রাহিম বেঁচে আছেন তারাপদ’র স্ত্রী-সন্তানদের অপেক্ষায়। তারাপদ যেমনি স্ত্রী-সন্তানদের ভালবাসতেন, ইব্রাহিমও ঠিক একই রকমভাবে ভালবাসেন তারাপদ’র স্ত্রী-সন্তানদের। এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়েছেন বড় মেয়ে নীলা আর তার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে মেরে ফেলেছে পাক আর্মিরা, পুড়িয়ে দিয়েছে ওদের বাড়ি-ঘর, গুদাম। নিশ্চি‎হ্ন হয়ে গেছে সাহা পরিবার, ভিটেয় প্রদীপ জ্বালাবারও কেউ নেই! 
 
    ইব্রাহিম এখন বড় নিঃসঙ্গ। তিনি বেঁচে আছেন কেবল তারাপদ’র স্ত্রী-সন্তানদের আশায়, যদি তারা কোনদিন ফিরে আসে! তিনি বেঁচে আছেন, তাই তার ক্ষুধা পায়, ঘুম পায়, পায়খানা-প্রসাবের চাপ আসে। সবই করতে হয় তাকে। দুটো খাবার জন্য কাজ করতে হয়, ঘরের চুলায় আগুন জ্বালতে হয়েছে। ঘরের সবকিছু লুট হয়ে গিয়েছিল, চালের আড়ত খালি হয়ে গিয়েছিল। তাকে আবার চালের আড়তে চাল তুলতে হয়েছে। চাল তুলতে গিয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছেন দোকানের সাইনবোর্ডের লেখার দিকে-‘যশোদা স্টোর’। যশোদা তারাপদ’র স্ত্রীর নাম। যশোদার ‘দা’ আর স্টোর আর ‘স্টো’ এর রঙ উঠে গিয়েছিল, টিন বেঁকে গিয়েছিল। ইব্রাহিম মিস্ত্রী ডেকে এনে টিন বদলে আবার নতুন করে লিখেয়েছেন- যশোদা স্টোর। 
 
বেঁচে থাকার জন্য সবই করতে হচ্ছে তাকে, উদ্দেশ্য একটাই-যদি তারাপদ’র স্ত্রী-সন্তানেরা ফিরে আসে! ওদেরও তো ক্ষুধা পাবে, খেতে হবে। ওদের ভবিষ্যতের জন্য তাকেই টাকা-পয়সা জমাতে হবে। শীলাকে বিয়ে দিতে হবে, ছেলেটাকে লেখাপড়া করাতে হবে, ঘরে নতুন বউ আনতে হবে। এসব করতে টাকার দরকার হবে। স্ত্রী-সন্তান থাকায় তারাপদ’র সংসারে খরচ ছিল, কিন্তু ইব্রাহিম একা। খরচ নেই বললেই চলে। যা আয় রোজগার হয় ওদের জন্য জমিয়ে রাখেন।

    লুটপাট করে নেবার পরও তারাপদ’র স্ত্রী সন্তানদের কয়েকটা পুরনো জামা-কাপড়, ছেলের ফুটবল, স্ত্রী-কন্যার চুলের ব্যান্ড-ক্লিপ, স্ত্রীর একজোড়া শাঁখা, সিঁদুরের কৌটা ইত্যাদি তাদের ব্যবহৃত এবং সংসারের কিছু টুকিটাকি জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল ঘরে। সেগুলো গুছিয়ে যতেœ রেখে দিয়েছেন ইব্রাহিম। তারা ফিরে এলে এসব জিনিস আবার দরকারী হয়ে উঠবে। কেবল মাঝে মাঝে রাত্রে যখন তাদের কথা মনে পড়ে, তখন তিনি তারাপদ’র স্ত্রী-সন্তানদের ব্যবহৃত জিনিসগুলি বের করে নাড়াচাড়া করেন। জামা-কাপড়গুলো নাকের কাছে নিয়ে তাদের শরীরের গন্ধ অনুভব করেন। তারপর রাত্রির নিস্তব্ধতা কাঁচের প্লেটের মতো খান খান করে ভেঙে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।

    স্বাধীনতার পর পর পাক আর্মির বন্দীশালা থেকে অনেকেই ফিরে এসেছে, অনেকের স্ত্রী-কন্যা পরিবারের মানুষের কাছে অপমানিত হয়ে কেউ আত্মহত্যা করেছে, কেউবা হয়েছে দেশান্তরি। কিন্তু ইব্রাহিম অপেক্ষা করে আছে মাসের পর মাস, কিন্তু আজও ফিরে আসেনি তারাপদ’র স্ত্রী-সন্তানরা। তবু ইব্রাহিম অপেক্ষায় থাকেন...!  

দুইজন ব্যতিত পাড়ার লোকজন তার কাছে বিশেষ আসে না। হিন্দুরাও না, মুসলমানরাও না। সেও চুপচাপ নিজের মতো থাকে; সকালে আড়তে যায়, রাতে ফিরে এসে দুটো ভাত ফুঁটিয়ে খায়। দরকার ছাড়া কারো সাথে বিশেষ কথাও বলে না। দুইজনের একজন আজগর আলী, প্রায়ই রাতেরবেলা আসেন, সান্ত্বনা দেন। ইব্রাহিম চুপ করে থাকেন, আজগর আলী তাকে জীবনের নতুন পথ দেখান, ‘ইব্রাহিম, তুমি মনে কষ্ট পাইলেও একটা কথা কই, তারা আর নাই। থাকলে এতদিনে ফিরে আসতো। একলা একলা আর কতদিন চলবা। জীবন তো আর থেমে থাকে না। খাইতে হয়, চলতে হয়। তোমার আবার নতুন করে সংসার করা উচিত।... তুমি যদি চাও আমার হাতে একটা পাত্রী আছে কথা বলে দেখবার পারি। পাত্রীর বয়সও বেশি না, ত্রিশ-বত্রিশের মতো। আগে একবার বিয়ে হইছিল। স্বামী মারা গেছে। কোন সন্তানাদিও নাই। মেয়ে দেখতে ভাল, ফর্সা আছে, আবার নামাজীও। আমি কথা কই কি কও?’

    কোন কথা বলেন না ইব্রাহিম। তার পাথরের মতো নীরবতা দেখে একসময় উঠে পড়েন আজগর আলী, ‘তোমার পাগল হইতে আর বেশি দেরি নাই।’
    অন্যজন বিমলেন্দু। বিমলেন্দুও আজগর আলীর মতো পথ বাতলে দেন, ‘তারাপদ, বাস্তবতা মেনে নাও। মনে করো এই দেশমাতৃকার জন্য তুমি তোমার স্ত্রী-সন্তানদের বিসর্জন দিয়েছ। শুধু তুমি না, তোমার মতো আরও অনেকেই দিয়েছে। আবার নতুন করে জীবন শুরু করো। তবে এইখানে না, এইখানে সবাই জানে তুমি মুসলমান। জায়গা-জমি, দোকানপাট বিক্রি করে তুমি অন্য কোন জেলায় নয়তো ভারতে চলে যাও। সেখানে তো আর কেউ জানেনা তুমি মুসলমান হয়েছ! তোমার বয়স এমন কিছু বেশি না, সব গোপন করে অতীতকে মাটিচাপা দিয়ে, আমাদের স্বজাতির একটা মেয়েকে বিয়ে করে আবার নতুন জীবন শুরু করো। ঘরে আবার স্ত্রী-সন্তান এলে জীবন গতি ফিরে পাবে, আবার নতুন করে সুন্দরভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করবে। জীবনে দুঃখ-ব্যথা থাকবেই, জীবন এমনই তারাপদ!’  

    একই রকমভাবে চুপ করে থাকেন ইব্রাহিম। তবু মাঝে মাঝে আসেন বিমলেন্দু, এসে বসে থেকে একাই কথা বলে চলে যান আজগর আলী।
    পীর শমসের মোল্লা তারাপদকে কথা দিয়েছিলেন সে মুসলমান হলে তার স্ত্রী-সন্তানকে ফেরানোর ব্যবস্থা করবে। সে কারণেই তারাপদ নিজেকে সমাধিস্থ করেছিলেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেনের মাঝে। কিন্তু কথা রাখেননি শমসের মোল্লা। মেজর আকরাম যেদিন দোয়া নিতে এসেছিল, তার পরদিনই শমসের মোল্লা জানিয়েছিলেন, তার স্ত্রী-সন্তানরা আর্মি ক্যাম্প থেকে পালিয়েছে। শমসের মোল্লার কথা বিশ্বাস করেননি ইব্রাহিম; তবু আশায় বুক বেঁধে আজও বেঁচে আছেন, নির্যাতনের পর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ক্যাম্প থেকে অনেক মেয়েই ছাড়া পেয়ে ফিরে এসেছিল, হয়তো কেউ কেউ পালিয়েও থাকতে পারে। ইব্রাহিম আশার জাল বুনেই চলেছেন, তার মাথার চুলের মতোই একটি একটি করে মাস ঝরে যাচ্ছে জীবন থেকে!

চার

কুমার নদী ফরিদপুর শহরকে দু’ভাগ করে মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সুবোধ বালকের মতো দক্ষিণ দিকে; দু’ধারের লোকালয়, মানুষ-বৃক্ষ-জমিনের তৃষ্ণা মিটিয়ে মিশেছে গিয়ে পাঁচ মোহনীতে। দ্বিখন্ডিত ফরিদপুর শহরকে জোড়া দিয়েছে বৃটিশ আমলে নির্মিত একটি লোহার পুল-কুমার নদের ওপর। পুলটি ভেঙে গিয়েছিল, পুনরায় মেরামত করা হয়েছে।
শারদীয় দূর্গাপূজার আজ বিজয়া দশমী। বিকেল থেকে বিসর্জনের জন্য প্রতিমা এনে জড়ো করা হচ্ছে কুমার নদীর দু’পাড়ে। দু’পাড়ে অসংখ্য মানুষ। ঢাক-ঢোল, ঝাঁঝর, ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রে মুখর দু’পাড়। মিষ্টি, মন্ডা-মিঠাই, মাটির খেলনা ইত্যাদি সাজিয়ে মেলা বসে গেছে। লোহারপুলেও অসংখ্য মানুষের ভিড়।    

যুদ্ধের পর অধিকাংশ মানুষের জীবন কাটছে অভাব-অনটনে, পূর্বের মতো জীবন গুছিয়ে উঠতে পারেনি এখনও। সঙ্গত কারণেই এবছর দূর্গাপূজার সংখ্যা কম। কিন্তু মানুষের স্ফুর্তির কমতি নেই। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে দৈনন্দিন জীবনযাপন আর টিকে থাকার লড়াই করতে করতে স্বজন হারানোর ক্ষত, ব্যথা-বেদনার পুরু আবরণটি একটু একটু করে পাতলা হয়ে এসেছে। অনাগত ভবিষ্যতে দৃষ্টি রেখে সবাই মেতে উঠেছে উৎসবে, তারই ভেতর স্বজন হারানোর ব্যথা ক্ষণিকের জন্য হলেও উঁকি দিয়েছে হয়তোবা।
আরও অনেকের মতো উৎসবে এসেছেন ইব্রাহিম। কিন্তু উৎসব তাকে ছুঁতে পারছে না। ভিড়ের মধ্যে খানিকক্ষণ হাঁটার পর নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন লোহার পুলের রেলিংয়ে ভর রেখে। হাতে একটা গরম জিলাপির পোটলা।

কুমারের বুকে ভাসছে অসংখ্য নৌকা। অনেকে বিসর্জন দেখতে এসেছে, অনেকে বিসর্জনের জন্য প্রতিমা এনেছে নৌকায়। ইব্রাহিম ঝুঁকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখছেন কুমারের বুকের ঢেউ, নৌকা আর বর্ণিল মানুষ। এতো মানুষ, তবু এদের মধ্যে তারা কেউ নেই, যাদের জন্য তিনি মাসের পর মাস অপেক্ষা করছেন! এক সময় চোখ তুলে দেখলেন সূর্য ডুবে গেছে। প্রতিমা বিসর্জন দিতে শুরু করেছে।

ইব্রাহিম উৎসবে আসেন অথচ উৎসব তাকে ছোঁয় না; তার ক্ষুধা পায় তাই খান, কিন্তু খাওয়া উপভোগ করেন না; ঘুম পায় তাই ঘুমান, কিন্তু ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখেন; শরীর আছে বলেই কাম জাগে, তাই আত্মরতির পর স্বস্তির বদলে অস্থির হয়ে কাঁদেন!  

অন্ধকার নেমে এসেছে। কুমার নদী এখন সেজেছে অসংখ্য আলোর গহনায়! হ্যাজাক আর টর্চের এলোমেলো আলোর প্রতিফলন কুমারের বুকে। একের পর এক প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। পাতলা হয়ে এসেছে মানুষের ভিড়। কেউ প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে ফিরে যাচ্ছে, কেউবা এখনও বিসর্জন দিচ্ছে; সকলের বাদ্যযন্ত্রেই বিদায়ী বাজনা, বাঁশিতে বিদায়ের সুর। ঘরে ফিরছে মানুষ, কেবল ইব্রাহিমের ঘরে ফেরার তাড়া নেই। ফিরতে ইচ্ছে করছে না। হাতের জিলাপির পোটলাটা যেমনি কিনেছিলেন, তেমনি ফেলে দিলেন কুমারের জলে! ছেলেটা জিলাপি খেতে বড্ড ভালবাসতো! মেলায় পা দিয়েই জিলাপি খাবার বায়না ধরতো। ছেলে ব্যতিত তিনি কি করে খাবেন জিলাপি, ছেলের আবদার যে শেলের মতো বিঁধছে বুকে-‘বাবা জিলাপি খাব!’
দীর্ঘক্ষণ লোহারপুলে দাঁড়িয়ে থাকার পর পা বাড়ালেন। কিছুই ভাল লাগছে না, ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। তার বাড়ির পথ সোজা, মন বলছে সোজা পথে যেতে কিন্তু শরীরে যেন এক সর্বগ্রাসী ঢেউ আছড়ে পড়ছে, যা মনের কূল ভাঙছে। ভেঙেই পড়লো মনের কূল! ব্রিজ থেকে নেমে বাঁ-দিকে মোড় নিলেন।

রূপজীবী পাড়ায় ঢুকে ইব্রাহিম কিছুক্ষণ হাঁটতে লাগলেন এলোমেলো। উৎসবের আমেজে আজ এপাড়ার দেবী দর্শনে দর্শনার্থীর অথবা পূজা দিতে পূজারী ভক্তকূলের বড্ড ভিড়! জলন্ত ধুনচির অর্ঘ্য নিয়ে পূজারীরা আরতির জন্য প্রস্তুত! হাঁটতে হাঁটতে একটা ঘরের সামনে থমকে দাঁড়ালেন ইব্রাহিম। দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে ঘরের মধ্যে কি যেন করছে একটি মেয়ে, হয়তো সাজছে। ডান দিক থেকে বিজলি বাতির আলো পড়েছে তার শরীরে। পিঠে ছড়িয়ে আছে লম্বা চুল, উন্মুক্ত পিঠের নিন্মাঞ্চল; কোমরের ওপরে ডানপাশের মৃদু ভাঁজে আলো পড়ে চিকচিক করছে! দীর্ঘদিন নারী সঙ্গহীন ইব্রাহিমের চামড়ার নিচে রক্ত টগবগ করে ফুটছে, নাকের চিমনি দিয়ে বের হচ্ছে উত্তপ্ত বাতাস। দূর্বিক্ষ পীড়িত ক্ষুধাতুর মানুষ যেমন দীর্ঘদিন পর সুষম খাবার দেখলে খাবারের ওপর হামলে পড়ার জন্য চঞ্চল ওঠে, দীর্ঘদিন কাম বঞ্চিত অথচ কামাতুর ইব্রাহিমও তেমনি চঞ্চল হয়ে উঠলেন মেয়েটির পৃষ্ঠদেশ-নিতম্বে চোখ রেখে। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো মেয়েটি। স্তম্ভিত ইব্রাহিম! কাজলটানা চোখ, চিকন আঁকা ভ্রু, ফর্সা মুখমন্ডল, কপালে লাল টিপ। বাইরে এখনও বাজছে বিসর্জনের বাদ্য, বিদায়ের সুর। ইব্রাহিমের ফুটন্ত রক্ত মুহূর্তে বরফ শীতল হয়ে গেল! সামনে সুসজ্জিত অপরূপা দেবী! এখনও হয়নি বিসর্জন, এতো দেবীর আগমন!              
                            

আপনার মন্তব্য