কমলকুমার মজুমদার এবং পথের পাঁচালী

 প্রকাশিত: ২০১৫-১০-১৬ ১৫:৪৫:১৮

 আপডেট: ২০১৫-১০-১৯ ১৪:৪৩:২৭

ফরিদ আহমেদ:

পথের পাঁচালীকে বিশ্বের সেরা ফিল্মগুলোর কাতারে ফেলে দেওয়া যায় নিঃসন্দেহে। সাইট এন্ড সাউন্ড বা ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ম্যাগাজিন একে বহু বারই সেরা ফিল্মগুলোর অন্যতম বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের উপমহাদেশের যে কোনো চলচ্চিত্রনির্মাতার জন্য ফিল্মের কাজ শিখতে গেলে, পথের পাঁচালী দেখাটা বাধ্যতামূলক একটা কাজ। এ ধরনের উঁচু মানের একটা চলচ্চিত্র চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের প্রশংসায় ভাসবে, এটাই স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই।

বিশ্বের বাঘা বাঘা সব চলচ্চিত্র সমালোচকেরা এই ছবির নানা ভালো দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন, উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন এর অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মণিমানিক্যকে।  তো এই রকম একটা ফিল্ম সম্পর্কে কেউ একজন মন্তব্য করবে যে, পুরো সিনেমাটার একটা মাত্র দৃশ্য ভালো হয়েছে, এমনটা কি ভাবা যায়? যায় না। বিদেশি কেউ হলে, হতেও পারে, এই ভেবে এমনটা হয়তো মানা যায়। কিন্তু যদি তিনি বাঙালি হন, তাহলেতো অবিশ্বাসের মাত্রাটা চরমে পৌঁছে যায়। কারণ, এই ছবিটার সাথে আমাদের বাঙালিদের তীব্র আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। এটিই এই উপমহাদেশের প্রথম বিশ্বমানের ছবি এবং মোটামুটি একটু সাহস নিয়ে বলে ফেলা যায় যে, এখন পর্যন্ত এটিই সেরা ছবি। পথের পাঁচালীকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নি আর কোনো ভারতীয় চলচ্চিত্র। কিন্তু, তারপরেও, যতো অবিশ্বাসই হোক না কেনো, বাস্তবে এরকমটা সত্যি সত্যিই কিন্তু ঘটেছিল। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ খ্যাত সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার সত্যজিৎ রায়ের এই সিনেমা দেখে এরকমই একটা নির্মম মন্তব্য করেছিলেন।

কমলকুমারের এই মন্তব্যকে উড়িয়ে দেওয়া যেতো ঈর্ষাকাতর ব্যক্তির বক্তব্য হিসাবে, কিংবা ফিল্ম সম্পর্কে জ্ঞান নেই এমন কোনো ব্যক্তির হাঁটু কাঁপানো আলটপকা মন্তব্য হিসাবে। কিন্তু কমলকুমার তা ছিলেন না। সিনেমা এবং থিয়েটার বিষয়ে অত্যন্ত বোদ্ধা একজন মানুষ ছিলেন তিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর দৈত্যকাহিনীতে বলেছেন, 'বাংলা থিয়েটার সম্পর্কে ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান ও নতুন চিন্তা, নিজে ছবি আঁকতেন ও খ্যাতনামা চিত্র সমালোচক ছিলেন, গ্রামের জীবন, বিভিন্ন অঞ্চলের লোকশিল্প ও কথা ভাষায় রূপান্তর - এমন কত দিকে ছিল তাঁর আগ্রহ। সাহিত্য তো ছিল তাঁর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত।

কমলকুমারকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা অবশ্য এরকম চাঁচাছোলা মন্তব্যে একবিন্দুও বিস্মিত হন নি। প্রশংসা করার ব্যাপারে কোনো এক বিচিত্র কারণে ভয়াবহ কার্পণ্য ছিলো ভদ্রলোকের। তাতেও সমস্যা ছিল না। বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করাতে তাঁর জুড়ি ছিলো না। সুনীল যেমন বলেছেন, 'কমলদার সবচেয়ে বেশী কৃতিত্ব ছিলো বিখ্যাত ব্যক্তিদের চরিত্র হননে। একবার তিনি একটি খরগোসের কথা বলেছিলেন ওর গোঁফ অবিকল আশু মুখুজ্যের মতন। তারপর সেই খরগোসটার কটা বাচ্চা হলো, তার মধ্যে একটার গোঁফ আবার শ্যামাপ্রসাদের মতন হুবহু। তখনকার একজন সাড়াজাগানো তরুণ গদ্যলেখক, আমাদের প্রিয়, তাঁর সম্পর্কে কমলদা বলেছিলেন, ও তো টিপসই দিয়ে মাইনে নেয়। আর একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক সম্পর্কে বলেছিলেন, হ্যাঁ ওমুক তো, ঠিক বুটজুতোর মতন মুখখানা।'

এই রকম চরিত্রের কমলকুমারের মুখ থেকে শিল্পকলা বা সিনেমার প্রশংসা বের করে আনা বা তাঁকে সন্তুষ্ট করাটা কোনো ব্যক্তির পক্ষেই আদৌ সম্ভব ছিল না। শুধু যে পথের পাঁচালী নিয়েই তিনি এমন মন্তব্য করেছেন তা নয়, আকিরো কুরোসাওয়ার বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র 'রাশোমন' সিনেমা নিয়ে একই ধরনের দয়ামায়াহীন মন্তব্য করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন যে, যেখানে পুলিশটা ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে নদীর পাশে দিয়ে যাচ্ছে, সেই জায়গাটা ভালো। কমলকুমার মজুমদারের মন্তব্য নিয়ে শুরুতে সত্যজিৎ রায়ের কিছুটা উষ্মা থাকলে, পরে তা কেটে যায়। তিনি বুঝে যান যে, এর চেয়ে বেশি প্রশংসা কমলকুমার মজুমদারের মুখ থেকে বের করা সম্ভবপর নয়। সত্যজিৎ রায় তাঁর কমলকুমারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে লিখিত ‘কমলবাবু’ প্রবন্ধে এই বিষয়টা তুলে ধরেছেন এভাবেঃ

"তখন আমি বিজ্ঞাপনের অফিসে কাজ করি, আর কাজের ফাঁকে ফিল্ম করার স্বপ্ন দেখি। কমলবাবু দেখলাম ফিল্মের ব্যাপারে শুধু আগ্রহী নন, যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বটে। আদিযুগের বহু দিশি, বিলিতি ছবি তাঁর দেখা আছে এবং স্মরণে আছে। ‘ঘরে বাইরে’ ছবি করার পরিকল্পনা হচ্ছে জেনে কমলবাবু মেতে উঠলেন। চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে, আর কমলবাবু ডিটেল জুগিয়ে চলেছেন। তাঁর মতে নিখিলেশ একটি ‘ক্রাইস্ট ফিগার’। গ্রামের পথ দিয়ে যেতে যেতে একবার মাথাটাকে কাঁটা ডালে রুখে যেতে দিল। ক্রাউন অব থর্নস। সন্দীপের কিশোর চেলা অমূল্য গুলি খেয়ে ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়লো; পুকুরের জলে তার মাথা, সেই সিঁড়ির ধাপে; অকস্মাৎ শান্তিভঙ্গের ফলে অমূল্যর মাথার ভাসমান চুলের পাশে গেঁড়িগুগলি ভেসে উঠল।

কমলবাবুর নিজেরও ফিল্ম করার ইচ্ছে ছিল। সম্ভবত কোনো কোনো বিশেষ কাহিনীর চিত্ররূপ তিনি কল্পনা করতে ভালোবাসতেন। দুটি কাহিনীকে আশ্রয় করে কিছু সময় ও চিন্তাও তিনি ব্যয় করেছিলেন। সেদুটি হল শরৎচন্দ্রের অভাগীর স্বর্গ ও রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস। দুটিরই জন্য নাকি দু হাজারের উপর ‘ফ্রেম-স্কেচ’ করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে অভাগীর স্বর্গ-র জন্য করা খান পঞ্চাশেক স্কেচ আমাকে দেখিয়েছিলেন। কমলবাবুর পরিকল্পিত চিত্ররূপে কাহিনীর সুরু জমিদার গৃহিণীর শবযাত্রা দিয়ে। দুপাশে কলাবন, মাঝখানের পথ দিয়ে শবযাত্রা চলেছে কীর্তনের সঙ্গে। ঝোড়ো বাতাসে কলাপাতা আন্দোলিত হচ্ছে, রাস্তা থেকে খই উড়ে গিয়ে মাঠে পড়ছে।

ঘরে বাইরের জন্যও নাকি হাজার খানেক (হাজারের কমে কথা বলতেন না তিনি) স্কেচ করেছিলেন, কিন্তু অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তার একটিও দেখান নি।

সেই সময় প্রায় প্রতি শনিবারই একসঙ্গে ফিল্ম দেখতে যাওয়া হত। ছবি সম্বন্ধে কমলবাবুর মতামতও ছিল গতানুগতিকের বাইরে। ‘ব্রীফ এনকাউন্টার’ দেখে প্রসংশা করেই বললেন, ‘ঠিক যেন অরপেনের ছবি’। ‘রাশো-মন’ দেখে আমরা সবাই মুগ্ধ; কমলবাবুকে জিগ্যেস করাতে বললেন, ‘যেখানে পুলিশটা ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে নদীর পাশে দিয়ে যাচ্ছে, সেই জায়গাটা ভালো’।

১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী ছবি মুক্তি পাবার পর অনেকবার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও কমলবাবুর মনে ছবিটা সম্বন্ধে কোনো উৎসাহ সঞ্চার করতে পারিনি। আমি অবিশ্যি নিরুদ্যম হইনি। শেষে একদিন যখন সত্যিই দেখলেন, তখন হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। আমারই এক পরিচিতের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় রাস্তায়, তাকে বললেন ছবিতে মাত্র একটি দৃশ্য ভালো লেগেছে – যেখানে অপু-দুর্গা চিনিবাস ময়রার পিছনে ধাওয়া করে। খবরটা শুনে কিঞ্চিৎ অভিমান হয়েছিল; রাশো-মন কেন যে এককথায় বাতিল করেছিলেন সেটা ভেবে কোনো সান্ত্বনা পাইনি।

এর বেশ কিছুদিন পরে যখন ভদ্রলোকের সঙ্গে আবার দেখা হয়, তখন ছবিটির প্রসঙ্গ আর তুলিনি, আর মনেও সেই সম্পর্কে আর কোন উষ্মার ভাব ছিল না; কারণ ততদিনে হৃদয়ঙ্গম করেছি পল্লীগ্রামের জীবন নিয়ে ছবি করে কমলবাবুকে খুশী করার মত ক্ষমতা আমার নেই।"

আপনার মন্তব্য