দাগ

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-১৫ ২০:৫৭:৪২

বাবুল হোসেইন :

তার একমাত্র ছেলে সাজ্জাদ। সদ্য কৈশোর থেকে ব্যঙাচির মত লাফিয়ে লাফিয়ে যৌবনের দোরগোড়ায়। মা অন্তপ্রাণ। সারাক্ষণ মা মা করে মাথায় তোলে বাড়ীর সদর অন্দর সব মহল। এই গ্রামের নাম কামারখাল। অরণ্যের দিনরাত্রির কথা শুনলে যে গ্রামের ছবি ফুটে ওঠে এই গ্রাম তাকেও ছাড়িয়ে গেছে তার সবুজ রূপবিভায়।

গহীন বৃক্ষরাজির আলাদা আলাদা সৌন্দর্য আছে আর সেই মোহিনীরূপ সবগুলো বাড়িকেই আলাদা আলাদা জঙ্গলের রূপ দিয়েছে। মনে হবে ভুল করে কোনো অরণ্যের গভীরে এসে পড়েছি।  আর তার হরিৎনিনাদ এক মোহনসুরবিলাসি গরিমা দিয়েছে এইগ্রামে। প্রকৃতির এমন উদারহৃদয় দান অন্যকোনো গ্রামে আছে কিনা এইটা একটা ভাবার বিষয় হতে পারে। কত রকমের ফসলি গাছপালা, কাঠের গাছগাছরাদি। যেনো এক সবুজ স্বর্গ- অবারিত মাঠ গগন ললাট। আর তাদের অঙ্গে হরেক রঙ লেপটে আছে। আছে লতায় পাতায় নানারঙের নানাগল্পও।

মিঠে সবুজ, কচি সবুজ, সবুজাভ, শ্যাওলা সবুজ - আহা কত কত রকমের সবুজ। মন উদ্দীপ্ত করে দেয় এইসব উদ্দীপক পত্রমিতালিরা, উদ্ভিন্নযৌবনা করে দেয় সারাদিন অবসন্ন দেহমনে। এই গ্রামে রাত্রি নামে এক ভয়ানক দানবিক সৌন্দর্য নিয়ে। ঘন হওয়া কৃষ্ণসবুজ অন্ধকার। চরাচরে সেকি এক নৈরব নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে- যদিও সবুজের সহোদরেরা এখানেও কম নেই। অজপাড়াগা বলতে যা বোঝায় তার চিরায়ত নাম কামারখাল।

যুবকের মনে একফোঁটা শান্তি নেই। দেশে এক চরম নৈরাজ্য চলছে। যুদ্ধের দামামা চারদিকের জীবনে ভয় ভীতি হতাশা এবং অনটনের অশেষ। যে যেভাবে পারছে সামলাচ্ছে। কেউ যুদ্ধে যাচ্ছে,  কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে স্থানান্তরিত হচ্ছে। নিরিবিলি এবং থানাসদর থেকে বেশ দূরে বলে যুদ্ধের ভয়ানক দস্যুতা এখানে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। কিন্তু সন্তোষ স্যারের বাবা মঙ্গল দাশের লম্বা  বারান্দায় রেডিওতে গ্রামসুদ্ধ উপচে পড়লে, এই দৃশ্যে যুদ্ধের আতঙ্ক কলেরার মত ছড়িয়ে যেতে সময় লাগে না। এই দূরগ্রামেও শিউড়ে ওঠে আত্মারাম। বন্দুক, বেয়নেট, রাইফেল দৃশ্যত যে কোন ছোটখাটো ঘটনার ভিতরেই হঠাত নাজিল হয়ে যায়। যুদ্ধের ভয়াবহতা তখন সারাগ্রামে এক আতঙ্ক।

ত্রিশমাইল দূরে উপজেলা সদর। সেখানে মিলিটারি ক্যাম্প। মাইল ত্রিশেক দূরত্ব হয়তো কমই কিন্তু আসল বিপত্তি হলো যোগাযোগের নাজেহাল অবস্থা। তাই ভয়েও কিছুটা শান্ত থাকছে মানুষ এই যোগাযোগ অব্যবস্থাপনার সুবাদে। বৈরিতা কখনো কখনো আশীর্বাদ হিশেবেই আসে মানুষের জীবনে। প্রকৃতি বৈরিতা নাপছন্দ করে আর মানুষ সবসময়ই বৈরিতা থেকে উত্তরণের পন্থা আবিষ্কারে মনোনিবেশিত হলেও সময় অর্থ সাহস বাঁধা হয়ে ওঠে। মানুষের রক্তে জয় করার নেশা চিরন্তন। এই চিরন্তনতা মানুষকে আলাদা মর্যাদাসম্পন্ন করেছে অন্য সবার থেকে। বৈরি প্রকৃতিকে আমূল পাল্টে ফেলতে মানুষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কিন্তু সবসময় মানুষের কপালে বিজয়চিহ্ন আঁকা থাকে না। এইটাও প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিশোধ।

সাজ্জাদ যুদ্ধে যাবে। পারিবারিকভাবে সাজ্জাদরা বীরের জাতিই। গ্রামের নানা গোষ্ঠীগত দ্বন্ধে বছরের পর বছর তারা ঢাল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করেছে। এরকমই এক যুদ্ধে সাজ্জাদের বাবা বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে নিহত হয়েছেন এইতো কবছর হলো মাত্র। রক্তের উদ্দামতা আর তেজোদৃপ্ত বিচরণ সাজ্জাদের মধ্যে প্রবল। সে ভাবে- এই যুদ্ধের মাঝে বসে থাকা এক চরম কাপুরুষতা। আমি কাপুরুষ নই।

সেলিমভাইদের দলের কয়েকজন পাশের গ্রাম শ্রীধরপাশার মিন্টু মেম্বারের ভাইয়ের সাথে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেন্টুভাই, বিএ অনার্সের ছাত্র, এবং ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়। তারা বন্ধুরা মিলে ট্রেনিং করতে যাবে ভারতে। এখন, আপাত নিরাপদ এইগ্রামে এসেছে শক্তিশালি দলগঠনের কাজে। সাজ্জাদ সেন্টুভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে। তার রক্তে দ্রোহের আগুন টগবগ করছে। তার বাবার অকাল প্রয়াণের বেশীদিন হয়নি। শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সাজ্জাদ কিছু করছে না। পাঠশালার গণ্ডি গ্রামের প্রাথমিক থেকে পাশ করার পর তার মামারা তাকে একটা বিদ্যালিয়ের মাস্টারি করতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে সে নিজের থেকেই ছেড়ে দিয়েছে তার স্বভাববিরোধি কাজ বলে। অর্থসম্পদের রমরমা না থাকলেও ভূমি আর বৃক্ষ মিলে তারা কম সম্পদের মালিক নয়। হাজার মন ধান খেত থেকে আসে বর্গা দিলেও। আর নিজেরা কামলা খাটিয়ে করলেতো আরো বেশী।

সাজ্জাদ আড়ে-আড়ে থাকে। প্লান ঠিক করে রেখেছে সে। সেন্টু ভাইদের দলেই সে যাবে। কিন্তু তারই আপন মামা শান্তিবাহিনীর লোক এবং তিনি দীর্ঘদিন ধরে এলাকার মেম্বার হিশেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নাম সিরাজ উদ দৌলা। লোকে নবাব বলে ডাকে তার নবাবী চালচলনের জন্য। এটা যতোটা না নামের ঠিক ততটাই আত্মগরিমার এক জীবন্ত দলিল তার কাছে। ভাবে মনে হয় নবাবের বংশধর এখানে এখনো প্রতাপ নিয়ে আছেন। এবং তিনি তার পুত্রকন্যাদের নাম এই নবাবী বংশেরই আদলে রেখেছেন। গ্রামের এবং আশেপাশের কয়েকগ্রামের হাল হাকিকত তিনি দীর্ঘদিন ধরেই নজরদারিতে রাখছেন এবং জায়গামত পাঠিয়ে দিচ্ছেন- কেউ তেমন জানে না। সাজ্জাদের উড়নচণ্ডী মন, এসব ভাবার কথা তার মাথায়ই ঢুকেনি। সে প্লান কষে একা একা, কাউকে না জানিয়েই।

সন্তোষ স্যারের পরিবার দেশত্যাগ করেছেন এরই মধ্যে। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা এপাড়ার দুইঘর মাত্র হিন্দুমানুষ, সময় হাতে রেখে, চারদিকের পরিস্থিতি নজরে রেখেই বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছেন। বেতারে যে সব খবর আসে তাতে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারাটা কষ্টকরই। ভোররাত্রে অন্ধকার থাকতেই সবাই বেড়িয়ে পড়ে যা যা পারা যায় জিনিশপত্তর নিয়ে। অনেকদূর পরে তাদের মনে পড়ে অরুণকে আনা হয়নি ঘুম থেকে তোলে। অরুণ বারান্দার ঘরে একা ছিলো রাত্রে। সকালে তাড়াহুড়ো করতে যেয়ে কারো মনে ছিলো না। এতো তাড়া ছিলো তাছাড়া বর্ডার পাসের নানা ঝামেলা মাথার ভিতর কিলবিল করছিলো তাদের। অরুণের কথা ভেবে কেঁদে ওঠলেও কিছু করার নেই। বিপদ মাথায় নিয়ে এতদূর যাওয়ার কথা তারা আপাতত ভাবতে পারছে না। কিন্তু না ভেবেও, উপায় হচ্ছে না। কাউকে পেলে না হয় জানানো যেতো একটা নিরাপত্তাজনিত ব্যাপারে। কিন্তু এই দুর্দিনে, কাউকে পাওয়া তো যাবেই না উলটো অরুণের জন্য সবার জীবনকে আর বিপদসঙ্কুল করে তোলা আরকি। এইসব তারা যেতে যেতে ভাবে আর কোথায়ও বসে একটু বিরতি দিয়ে চোখের জল মোছে। অরুণের মা কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যান। কিন্তু, নিজের ছেলের কথা ভেবে তিনি আকুল হবেন বিকুল হবেন সে মুহূর্তটা ঠিক তাদের জীবনে নেই এখন। সন্তানের কথা কেউ না ভেবে পারে না। কিন্তু, সবাই নিশ্চুপ থেকেও এইটাই বোঝায় যে, এক অরুণের জন্য বাকী প্রায় বিশজনের জীবনকে বিপন্ন করার মানে অরুণেরও বিপন্নতা। বেচে থাকলে, অরুণের সাথে দেখা হবে আবার। আমরা তো আর একেবারে চলে যাচ্ছি না।

সকালের ঘুম ভেঙে অরুণ পায়খানায় যায়। আয়েশ করে ঘরে ঢুকে মা মা ডাকতেই ছ্যাঁত করে ওঠে সমস্ত বুকের ভিতর। বাড়ীর প্রতিটা জিনিশ এলোমেলো। মনে হচ্ছে রাত্রে এক কঠিন যুদ্ধ হয়ে গেছে তাদের ঘরে। সে দৌড়িয়ে কাকিমাদের ঘরে যায়। কেউ নাই। দাদু দিদা কেউ নাই। নেই শিপনরাও। দুইঘরভর্তি মানুষ রাতের অন্ধকারে হাওয়া হয়ে গেলো অথচ অরুণ তার জানে না কিছুই। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে অরুণ। মা মা বলে গগনবিদারী চিৎকার করে সে। আর সারা বাড়ী পায়চারি করে। আর কাঁদতেই থাকে।

সাজ্জাদ রাত্রে চলে গেছে কাউকে না বলে। সাজ্জাদের মা সকালে ঘুম থেকে ওঠেই সাজ্জাদ সাজ্জাদ বলে চিৎকার করে দেখেন সাজ্জাদের ঘরের জানালা খোলা আর সে খোলা জানালায় একটা রশ্মি দিয়ে বাইরে থেকে লাগানো। তার মানে সাজ্জাদের সকল প্লান শেষ, সে এখন যুদ্ধের পথে। সে সেন্টুভাইয়ের কাছে যায়। তারপর আরো কয়েকজনের সাথে করে সে চলে যায় ট্রেনিং নিতে। তার বারবার মায়ের কথা মনে পড়ছিলো, মনে পড়ছিলো ছোট ছোট বোনদের মায়ামাখানো মুখগুলো। মা একা একা সামলাবেন কিভাবে এই চিন্তায় সে অস্থির ছিলো। কিন্তু এর থেকেও বেশী অস্থিরতা তাকে কাঁপাচ্ছে আমূল যেটা সে সহ্য করতে পারছে না তা হলো দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। আগে তো দেশমাতার নিরাপত্তা দিতে হবে। নইলে এই মানুষ এই মা বোন পরিবার কোথায় ভেসে যাবে খড়কুটোর মত। সাজ্জাদ ভাবে— বেঁচে থাকলেই তো পরিবার তবে। আর যদি বেঁচেই না থাকি তো কী হবে এই পরিবার দিয়ে। আর এরকম সময়ে, এইভাবে বেঁচে থাকা যায় না। এইটাকে বেঁচে থাকা বলে না। সাজ্জাদের দেশপ্রেম, মাতৃপ্রেম প্রখর। আগে দেশের পরিবারের জন্য নিরাপত্তা দিতে হবে। আর সে সেই ব্যবস্থাই করছে। সে দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধে যাচ্ছে। ভোরের নরোম কুয়াশা মাড়িয়ে সাজ্জাদ দলের সাথে হাঁটে হাওরের মাঝবরাবর পথে। ভিতরে দুরন্ত এক টগাবগানি তাকে অস্থির করে রাখে- সে ঠিক জানে না কেনো এই অস্থিরতা। বাড়ী থেকে মা বোনদেরকে ফেলে চলে যাওয়া নাকি যুদ্ধের দামামা তার সমস্ত হৃদয়কে এক অন্যসুরে কাঁপিয়ে যাচ্ছে। দুইটারই এক মিশ্র তিরতিরানি তাকে কাঁপায়।

অরুণ কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়ে বারান্দায়। সাজ্জাদের মা ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরতে থাকেন। দাশ বাড়ীতে এসে তার বুকের ভিতর কাঁপন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। নীরবতার এক আশ্চর্য কূপে নেমে যান তিনি। এতো বছরের পরম্পরায় তারা একসাথে মিলেমিশে আছেন কোনোদিন তাদের মধ্যে আলাদা থাকার বাসনা আসে নি। ঝগড়া হয়েছে, আবার মিটেও গেছে। কিন্তু, এই যুদ্ধ আমাদের অন্তর্মূলে বিভেদরেখা এঁকে দিচ্ছে। তিনি হুহু করে কেঁদে ওঠেন। ছেলের শোক আর প্রতিবেশীর শোক একসাথে একাকার হয়ে যায়। আর তার মনে একটাই চিন্তা ভেসে ওঠে ওদের সাথে সাজ্জাদ চলে গেছে। ভারতে যুদ্ধির ট্রেনিঙে অনেক ছেলেরাই যাচ্ছে। তারা, মাঠে নামার আগে কিছুদিন সেখানে হাতে কলমে অস্ত্রচালানোসহ আরো দরকারী ট্রেনিং নিয়ে আসে। তিনি কান্না চেপে ঘরের দাওয়ায় উঁকি দেন। অরুণ অঝোরে ঘুমুচ্ছে যেনো কয়েকদিন খায়নি আর চোখজোড়া ফোলা ফোলা পটকামাছের পেটের মত। তিনি কিছু শোনার আগেই আন্দাজে বোঝে যান অরুণকে ভুলে ফেলে গেছে ওরা। কিন্তু, এতদিনে, একটাবারও এরা তাদেরকে বলে নি কেনো। আমাকে অন্তত বলতে পারতো সন্তোষের মা। এতদিন ধরে সুখে দুখে ভাগাভাগি করে বলতে গেলে একপাড়াতে থাকি অথচ যাওয়ার সময় নিষ্ঠুরের মত না বলে যাওয়া তাকে কষ্ট দেয়। এইটাও বোঝেন তিনি কী কষ্ট নিয়ে দেশছাড়া হতে হয় সেটা কেবল যারা যাচ্ছে তারা বোঝবে। মাধবীদেবির সাথে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্কই শুধু ছিলো না, দীর্ঘ এক জীবন তারা পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠেছিলেন। এমন নিখাদ সম্পর্ক ছিলো তাদের। বাড়ী ছেড়ে কেউ চলে গেলেই, গ্রামেরই অন্য পাড়ার লোকেরা বাড়িঘর লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। নবাব মেম্বারের প্ররোচনায় এসব হচ্ছে তিনি বুঝতে পারেন। ভাইয়ের দিকে একদলা থু থু ছিটিয়ে নিজেরে হালকা করেন তিনি। তিনি চিৎকার দিয়ে ওঠেন লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে- কী হচ্ছে এসব? বলে তিনি অরুণকে নিয়ে হনহন করে বাড়ীর দিকে হাটা ধরেন।  

সাজ্জাদ যে চলে গেছে তিনি কাউকে জানাতে চান না। চুপচাপ থাকেন তিনি। তার ছেলের অন্তর্পীড়ন তিনি ঠিকই জানেন। খুনের বদলা নেওয়া রক্তে তার দ্রোহের আগুন। এইবার তো পিতৃহত্যার প্রতিশোধ আর কেউ আটকাতে পারবে না। দুহাতে বুকে ধরে এতদিন বোঝ দিয়ে রেখেছিলেন। এখন আর পারলেন না তিনি। আর না পেরেই বরঙ ভালো হয়েছে। তার ছেলে বীরের মত কাজ করেছে। কয়জন পারে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে। অথচ এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করছে আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়া না হওয়ার প্রশ্ন। তিনি মনে মনে ছেলের জন্য গর্ব অনুভব করেন। এইকদিনে গ্রামের হালচাল মতিগতি বেশ বোঝে গিয়েছেন তিনি। পোড় খাওয়া তার বুক- সিধুরে মেঘ দেখলেই আৎকে ওঠেন। ছেলেকে তিনি আটকাতে পারবেন না আরো আগেই বোঝে ফেলেছিলেন। মায়ের মন বলে কথা। তাছাড়া যার রক্তে প্রতিশোধের নেশা আছে সেই এই ভয়াবহতা কোনোভাবেই মেনে নেবে না, মেনে নেওয়াটা প্রচণ্ড কাপুরুষতা। আর মা হিশেবে তিনি বরঙ এইটাই চাইতেন ছেলের কাছে। লক্ষ লক্ষ মায়ের ছেলেরা যুদ্ধে গেছে। তিনি অরুণকে গোসল করিয়ে সাজ্জাদের পুরনো কাপড় পরিয়ে শীলা ও খেলার সঙ্গে কথা বলেন। দুইবোন সঙ্গীভাই পেয়ে যেনো ভুলে গেছে নিজের ভাইয়ের নিখোঁজ সংবাদ। নতুন ভাই হিশেবে অরুণের সাথে যেভাবে আনন্দ করার কথা তা হচ্ছে না। সবাই কেমন থমথমে হয়ে আছে। অরুণতো একেবারে ভয়ে জড়োসড়ো। এমন না যে সে এ বাড়ীতে আগে আসে নি। এবারের আসা যে অন্য আসা, একেবারে চলে আসা কিংবা তার পরিবারহীনতা তাকে আপাতত এই পরিবারে আশ্রয় দিয়েছে এইটা তার ছোটমনে খেলা করে না। সে জানে, দূর ভবিষ্যতের আশা করা বোকামি শুধু, এই ভয়াবহ বর্তমান সামনে দাঁড়িয়ে গিলে খাবে কিনা তার উত্তর জানা জরুরি। সে তাই ভাবতে চেষ্টা করে। সাজ্জাদ ভাই কোথায় খালা বলে সে খুঁজতে বেড়িয়ে যায় সাজ্জাদকে। আর মায়ের চোখভর্তি পৌষের কুয়াশা – ঘনায়মান অন্ধকারে হারিয়ে যান মা একা একা।

এসব খবর চাপা থাকে না। সাজ্জাদের খবরও থাকে নি। আর থাকবেই বা কিভাবে, যেখানে তার নিজের মামাই শান্তিবাহীনির পাণ্ডা। এককান হয়ে বহুকান তারপর সারাগায়ে পৌঁছে গেলে সাজ্জাদের মাকে তলব করেন মেম্বার নবাব। তোমার ছেলের এতো বড় সাহস? এ? আমরা আছি না, আমাদেরকে না বলে সে এতোবড় কাজ করতে পারলো কিভাবে? আমরা কী মারা গেছি? এখন সারাগায়ের উপর বিপদ নেমে আসবে আর সেটা তোমার ছেলের জন্য। এরকম কুলাঙ্গার ছেলে আমার ভাগনা হতে পারে না। শোনে, সাজ্জাদের মায়ের রক্ত মাথায় ওঠে যায়। তিনি, বলেন, আপনার মত দেশের শত্রু আমারো ভাই হতে পারে না। দেখি আপনি কী করতে পারেন? এক মুহূর্ত দেরি না করে ভাইয়ের বৈঠকঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন দিলশান বেগম। তিনি মুষড়ে পড়েন না। কেনো পড়বেন যেখানে তার ছেলে কোনো অন্যায় করছে না। দেশকে বাঁচানো কী অন্যায়। তার বাবা তাকে এই শিক্ষা দেন নি। তার ছেলেকেও তিনি দেন নি। কী এক দুর্বিনীত অদম্য স্পৃহা তার বুকে মিলেমিশে মাতৃত্বের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। তিনি প্রস্তুতি নিতে থাকেন ভবিষ্যতে আরো যা যা ঘটবে তার জন্য। তার চারটা মেয়ে ও অরুণ। অরুনকে তিনি পুত্রের অধিকার দিয়েই এ বাড়ীতেই নিয়ে এসেছেন। এবং তার দুই মেয়ে শীলা ও খেলাকে বলেছেন ভাই বলে ডাকতে। সাজ্জাদ ফিরে আসলেও অরুণ তার পুত্রস্নেহ ও ভূসম্পত্তি পাবে এই আর্জি তিনি করে রেখেছেন।

অরুণ কাঁদে। সেই কান্না দিলশান বেগম অন্তর থেকে অনুভব করেন। তার বুকে সাজ্জাদের জন্য যে চাপাকান্না গুমরে মরছে সেই একি কান্না অরুণের মনেও। তাদের কান্না আর আলাদা নেই। একাকার সে কান্না দুজনকে আরো বেশী ঘনবদ্ধ করে তোলে। পরস্পরের দুঃখাবলি পরস্পরের সাথে মিলেমিশে একের নির্ভরতা অন্যের উপর চাপিয়ে তারা মা-পুত্র হয়ে ওঠেন আরো তাড়াতাড়ি। আলিঙ্গনের বদলে তারা বিনিময় করেন চোখের অশ্রু- যা কোনোদিন শেষ হবে না তাদের। একজন নিজের ভুবন হারিয়ে এতিম আর অন্যজন উৎসর্গের আনন্দে ম্রিয়মাণ। তারা জড়িয়ে ধরেন না একে অন্যকে। তার থেকে বেশী কথা বলেন যেনো কথারা সব ফুরিয়ে যাচ্ছে এখুনি। শীলা খেলা পাশে বসে থাকে। আনন্দ নাকি বেদনার এইসব মুহূর্ত তারা দুইবোন বোঝে উঠেতে পারে না।

এক আন্ধার করা বিকেলবেলা আসে সেই ভয় জাগানিয়া যুদ্ধের গল্পের দানবেরা, এতদিন রেডিওতে যাদের ভীতিময় ভয়ঙ্করতার গল্প শোনেছে তারা কেবল, দেখেনি। ছফুট লম্বার সেই লোকগুলো দেখলে সত্যি সত্যি দানব মনে হয়। ঘন-গোঁফ সেই দানবের গায়ে আরেকটু দানবিক আকার দিয়েছে। কাঁধে বন্দুক, বুলেটের ব্যাগভর্তি ঝোলা সারা শরীরের সঙ্গে, কালো গামবুট, কটকট আওয়াজের সাথে হায়েনার স্পষ্ট পদচ্ছাপ। দিলশান বেগম স্থির থাকেন— একেবারে নিস্পৃহ, নির্মোহ যেনো কিছুই ঘটে নি জগতে, জীবনে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে ওঠে তিনি অসীম নির্লিপ্ততা নিয়ে দাঁড়ান সেই দানবের। সাজাদ কোথায় বলে খালেক মোল্লা চেঁচিয়ে ওঠে।

ওর ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে গেছে।

ভালো করে বল, মিথ্যে বললে মা ছেলেকে এমন মজা দেখামু জীবনে আর কোনোদিন মুক্তির নাম মুখে নিবি না।

দিলশান বেগম চুপ থাকেন আরো।

সেই গোঁফওয়ালা দানব তার কাঁধ থেকে বন্দুক নামিয়ে হুংকার ছাড়ে।

দিলশান বেগম আরো ঠাণ্ডা আরো জড় হয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকেন। এইটা একটা প্রতিশোধ তার কাছে। একজন মুক্তির মায়ের বুক মাথা সটান থাকবে সবসময়, এই দৃঢ়তা তাকে আরো উজ্জীবিত করে দেয় যেনো। তিনি ভাবেন, এই গর্ব সকলের হয় না। সকলের ভাগ্য এতোটা প্রসন্ন হয় না এক জীবনে যে, দানবের সামনে দাঁড়াতেও ভয় লাগে না, বরং গর্ব বুকটা ভরে ওঠে।

খালেক মোল্লা আবার চেঁচায়। সবকটারে ধরে একসাথে এমন পেদামো যে জীবনে বেঁচে থাকলে শুধু আমাদের ছায়াই দেখবি সামনে।

দিলশান বেগম কথা বলেন না। ভিতরে ভিতরে অসীম সাহসী হয়ে ওঠেন। আর নীরবতা পালন করেন আরো কঠিনভাবে।

এই নীরবতা দানবের বুকে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কাঁধ থেকে বন্দুক নামিয়ে দুনলা দিয়ে এমন জোড়ে দিলশান বেগমের বুক বরাবর আঘাত করে, তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পড়ে যান। কিন্তু এই পড়ে যাওয়া মানে নতি স্বীকার বা মাথা পেতে নেওয়া নয় এইটা বোঝাতে তিনি একদলা থু থু ছিটিয়ে দেন শূন্যের দিকে। রক্তের লাল ধারা নামে ঘরের পিছনের রাস্তার মধ্যে। ভিজে যায় পুকুরঘাটে যাওয়ার পথটুকু।  

আরো একটা আঘাত করে মোল্লা- আজকের মধ্যে ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে আয় নইলে একটারেও শেষ রক্ষা করতে পারবি না। স্বামীছড়া এতো তেজ তোরে কে দেয় মাগি?

দিলশান বেগম কিছুটা জ্ঞান ফিরে পান কিন্তু প্রচণ্ড প্রাণময়তায় মনে মনে গালি দেন শুয়োরটাকে। তোর বৌ বাচ্চাদেরকে বিলিয়ে দিয়েছিস বলে সবাইকে এমন মনে হয়?

বাড়ীর পিছনের ঝোপ থেকে অরুণ শীলা খেলাকে নিয়ে আসে দৌড়ে। অবিরল রক্তের ধারা মায়ের বুক থেকে মাতৃভূমির বুকের জমিন লাল করে যাচ্ছে। অরুণ ভাবে, এই লাল আমাদের সকলের রক্তের রঙ হয়ে ওঠবে একদিন। সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে সে যে কেনো যেতে পারে নি এই আফসোস তাকেও ছাড়ে না এখন।

শীলা ও খেলাকে বুকে নিয়ে অরুণের দিকে তাকান দিলশান বেগম। অরুণের ভিতর থেকে মা মা শব্দ বুলেটের বেগে বেড়িয়ে পড়ে যেনো। সেও তৃতীয় বন্ধনের ভিতর ঢুকে যায় দিলশান বেগমের। তিনি রীনা ও রেহানাকে ফুফুর বাড়ী থেকে আনতে বলেন তাইজুদ্দিকে। সবাই মিলে একসাথেই থাকতে হবে।

আপনার মন্তব্য