ফল অফ চাঁনতারা

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-১৫ ২১:৩৬:১২

 আপডেট: ২০১৫-১২-১৫ ২১:৫৮:৪৬

মাসকাওয়াথ আহসান:

রেড টেলিফোন হাতে থর থর করে কাঁপছে রাও ফরমান আলী। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ফোনের ওপ্রান্তে। ফরমান হাউ মাউ করে কাঁদে।

--স্যার ঢাকায় মাইনকার চিপা বলে এক চিপা আছে; সেইখানে আটকাইয়া গেছে আর্মি; বাঁচান স্যার।

--বাঁচা মরার মালিক আল্লাহ। এখন বিরক্ত করো না ফরমান। জেনারেল রাণী এসেছেন।

ফোনটা রেখে দেয় ইয়াহিয়া। জেনারেল রাণীর দিকে তাকিয়ে বলে, মুঝে ছোড়কে কাঁহি না যাও, ও জানেমান মুঝে থোড়াছা জহর পিলাও।

জেনারেল রাণী গ্লাসে রুহ আফজা ঢালতে ঢালতে বলে, জহর পিনে কি জরুরত কীয়া হ্যায়, ইতনা খুন তো পি চুকা তুম।

ঢাকায় ইয়াকুব মালিক বার বার ফোন করছে সি আই এ-র এডামসকে। ফোন ধরে না।

তৃষ্ণার্ত হুসাইন আনসারী। পানি খাওয়ার উপায় নেই। পানির কল ছাড়লেই রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। হুসাইন চিতকার ডাকে, আবদুল্লাহ ঐ আবদুল্লাহ; ঠিক করে বলো ঠিক কত মানুষ মেরেছো?

আবদুল্লাহ টেবিল থেকে ক্যালকুলেটার নিয়ে কীসব হিসাব নিকাশ করে। তারপর ধমক খেয়ে বলে, ৩০ হাজার।

--তুমি একাই ৩০ হাজার!

--আমি ছাড়া আর কোন বীর ছিলনা স্যার। বাকীরা কাবাডি খেলেছে।

--চুপ করো।বুঝতে পারছি ১৯৫ জন মিলে কতজন মেরেছো।

আবদুল্লাহ আমতা আমতা করে। ইয়াকুব মালিক আবদুল্লাহর দিকে তাকিয়ে বলে, তদন্ত হলে তুমি সাক্ষী দিবা। ৩০ হাজারটাই বলবা কাকাতুয়ার মতো ঠিক আছে।

--ঠিক আছে স্যার। ডিনার রেডি। খেয়ে নিন।

--কীসের খাওয়া দাওয়া। এডামতো ফোন ধরে না।

খাবার টেবিলে বসে খাবারের দিকে তাকিয়ে সবাই কাঁপতে থাকে। প্লেটের মধ্যে মৃত চোখ। গোস্তে কামড় দিলে মনে হয় কচ কচ করে মানুষের নাক-কান চেবাচ্ছে। মানুষের পায়ের নেহারি, ব্রেণ মাসালা, যকৃতের ঝাল ফ্রাই। তীব্র বিবমিষায় সবাই টেবিল থেকে উঠে পড়ে।

হঠাত এডামসের ফোন আসে। ইয়াকুব ফোন ধরে বলে, আপনার সপ্তম নৌবহর তো এলোনা; অন্ততঃ সাত বোতল হুইস্কি তো পাঠাবেন নাকি!

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বাসায় কিছুক্ষণ পরপর ঢিল পড়ছে। পথচারীরা একটা করে ঢিল মেরে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। জেনারেল রাণী বলে, আমি যাই, আপনি বসে বসে ঢিল খান।

অসহায় আকুতিতে ইয়াহিয়া কেঁদে ওঠে, আজ যানে কি জিদ না কারো।

পাগলের মত প্রবেশ করে টিক্কা খান। তার চক্ষু লাল। সিং বেরিয়েছে। সারমেয় দাঁত দুটি লম্বা হয়ে গেছে। সে বিড় বিড় করে বলে, হাউ মাউ খাও; মানুষের গন্ধ পাও।

কয়েকজন প্রহরী এসে চ্যাং দোলা করে নিয়ে যায় টিক্কা খানকে।

ইয়াহিয়া খান বলে, যে কয়টা ইস্ট পাকিস্তানে খুনাখুনী করে এসেছে, সব কটার মানুষ খাওয়ার নেশা হয়েছে।

জেনারেল রাণী সংশোধন করে দেয়, বাংলাদেশ বলুন সদর সাব।

ইয়াহিয়া হঠাত তার পেছনে স্ট্যান্ডে ঝোলানো পতাকা থেকে চাঁন-তারা খসে পড়তে দেখে।

ঢাকায় এতোদিন যারা বসে বসে পপকর্ণ খেয়েছে; ভেবেছে বাঙ্গালী এ যুদ্ধে জিততে পারবে না; তারা নড়েচড়ে ওঠে। দ্রুত বাংলাদেশের পতাকা বানানোর অর্ডার দেয়। লিভিং রুম থেকে জিন্নাহর ছবি সরিয়ে মুজিবের ছবি ঝুলিয়ে দেয়। সেভ করা ছেড়ে দেয়; যাতে দেখতে মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিযোদ্ধা লাগে। বিভিন্ন পরিবারের সন্তান সম্ভবা মায়েদের বলে দেয়, বঙ্গবন্ধুর নাতির নাম যেহেতু জয় রাখছে, তোমরাও তোমাদের বাচ্চাদের নাম রাখবে জয়। পুরা নাম মুজিবুর রহমান জয় হলে ভালো হয়। সিক্সটিন্থ ডিসেম্বর সামনে রেখে মোটামুটি একটি সিক্সটিন্থ ডিভিশন তৈরী হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়াতে। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা তখনও যুদ্ধে; কেউ কেউ আহত সহযোদ্ধাদের চিকিতসা নিয়ে ব্যস্ত।

মিয়ানওয়ালী কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে একজন প্রহরী জানিয়ে যায়, ভুট্টো সাব আসছে, আপনার জন্য কিউবার তামাক নিয়ে এসেছে; আর একটা কবর খুঁড়তে বলছে। মনে হয় ঐদিকে যুদ্ধের ফল ভালো না।

--আসতে দাও তাকে।

বঙ্গবন্ধু হাঁটাহাটি করছিলেন।

ভুট্টো প্রগলভ হয়ে বলে, শেখ সাব আপনি একটু বসলে কথা বলতে সুবিধা হয়।

--দাঁড়িয়ে থাকলে কী অসুবিধা তোমার!

ভুট্টো প্রহরীকে দিয়ে একটা টুল আনিয়ে নেয়। তারপর টুলের উপর দাঁড়িয়ে বলে,

--ঐখানে আপনি আর এইখানে আমি; খালি একটু আটকে পড়া সৈন্যগুলি ছাড়ায়ে দেন ভাই।

--দেখো তোমার মত গদির রাজনীতি আমি করিনা। যুদ্ধের আইন অনুসারে যা হবার হবে। আর শোনো আমাকে ভয় দেখানোর যে খবরটা খুঁড়েছো; ওটা তোমার জন্য মানানসই। আমার জন্য খুঁড়লে আরো লম্বা কবর খুঁড়তে বলো।

ভুট্টো থতমত খেয়ে বেড সাইড টেবিলের ওপর তামাক রেখে সটকে পড়ে।

কলকাতায় যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে তাজউদ্দীন বৃষ্টিতে ভেজেন। মাথার মধ্যে মুজিব ভাইয়ের সমূহ বিপদের কথা ভেবে এতো বড় বিজয়ের আনন্দে শামিল হতে পারছেন না। আনন্দ করে বেড়াচ্ছে মুশতাক। গত দুদিন সে রবীন্দ্র সংগীত শোনা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সুরধারা শরীরে সিঞ্চিত করে মুশতাক মনে মনে বলছে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।

প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঢুকে তাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে মুশতাক জিজ্ঞেস করে, এতো খুশীর দিনে কাঁদছেন!

--ঘুরে ফিরে মুজিব ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে।

--উনি এসে পড়বেন চিন্তা করবেন। উনি ফেরার পর উনার নিরাপত্তার দিকে পরম ভালোবাসায় লক্ষ্য রাখবো। আপনি ভাববেন না। আপনাকে আমরা বিশ্রামে পাঠিয়ে দেবো।

তাজউদ্দীন বলেন, বিশ্রামের সময় কোথায়; এখন তো একটা পুড়িয়ে দেয়া দেশের ছাইগাদা থেকে উঠে দাঁড়াতে হবে।

হঠাত ঢাকা থেকে ফোন আসে। তাজউদ্দীন ধরে বলেন, আপনার ফোন।

মুশতাক হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে ফোন ধরে। ওপার থেকে একজন বলে, বড় ভাই সিক্সটিন্থ ডিভিশন গ্যাং তৈরী হয়ে গেছে। আমরা দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে দিয়েছি।

উল্লসিত জুলজুলে চোখে মুশতাক চোরা চোখে একবার তাজউদ্দীনের দিকে তাকিয়ে; তারপর নজর লুকিয়ে বলে; ব্রাভো; গো এহেড।

ঢাকায় ওয়াটার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়ায়; ইয়াকুব মালিক পড়েছে ভীষণ বিপদে। হুসাইন আনসারীকে সে জানায় ফিসফিস করে, বাথরুম চেপেছে।

হুসাইন খেঁকিয়ে ওঠে, অসুবিধা কী, বাগানের ঝোপের আড়ালে সেরে আসুন।

--সে কী করে হয়।

--কেন হবে না আমরা এলিট হয়েছি তো পূর্বপাকিস্তানের রক্ত শুষে। মনে করে দেখেন আপনার-আমার আব্বা রেললাইনের ধারে পাঞ্জাবের গমক্ষেতে পটি করতো। এতো সহজেই অতীত ভুলে গেলে কী করে হবে!

ইয়াকুব ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে শৈশব স্মৃতি রোমন্থন করে। হঠাত অন্ধকারে মনে হয় একটি হাত তার পা জড়িয়ে ধরেছে। উঠে দাঁড়ালে বোধ হয় একটি বেয়নেটে খোঁচানো মৃতদেহ সেখানে। দ্রুত পায়ে হোটেলের ভেতরে চলে আসে সে।

রাস্তায় সাধারণ মানুষের আনন্দের ঢল। সাধারণ মানুষকে এসে সিক্সটিন্থ ডিভিশন গ্যাং ধমক দেয়। জোরে জোরে শ্লোগান দিবা। চিঁ চিঁ করো ক্যানো! ল্যাঞ্জা ইজ ডিফিকাল্ট টু হাইড। তুমাদের পতাকা কোথায়! কোথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা!

পেছন থেকে বলে, রাজাকারের পোলা রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা হইলে জোশ একটু বেশীই হয়।

ধমকদানকারী গ্যাং দ্রুত সটকে পড়ে। অন্যান্য এলাকায় ঘুরতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চেক করতে।

রাও ফরমান আলী আকাশের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে দেড় লিটার হুইস্কি লিভারস্থ করে। তার অকস্মাত মনে হয় আকাশ থেকে চান হারিয়ে গেছে; তারাগুলো ঝরে পড়ছে। নীচে তাকিয়ে দেখে সবুজ উদ্যান; তার মাঝখানে চাপ চাপ লাল রক্ত। ভোর হয়ে গেছে। পাকিস্তানের খুনীরা তাকিয়ে দেখে ঘন সবুজ দিগন্তে লাল সূর্য উঠেছে।

কয়েকজন খেটে খাওয়া মানুষ হাড্ডিসার যুদ্ধ ক্লান্ত; উদাত্ত গলায় আনন্দ অশ্রুতে একসঙ্গে গাইছে-

আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি।

আপনার মন্তব্য