বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা: (প্রথম পর্ব: নির্ভারতা ও ভার – ১০ )

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-১৯ ১৪:৩৭:১৩

 আপডেট: ২০১৫-১২-২৪ ১৪:৫৪:১৪

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা: (প্রথম পর্ব: নির্ভারতা ও ভার – ৮ এবং ৯ ) এর পর....
১০

তেরেজার আচরণগুলো আরো বেশী আকস্মিক আর অস্থির হয়ে ওঠে। টমাসের অবিশ্বস্ততা সম্বন্ধে জানার প্রায় দুই বছর পার হয়ে গেছে ততদিনে। এর থেকে মুক্তি পাবার যেন কোনো উপায় নেই।

আসলেই কি টমাস এইসব কাম বন্ধুত্বর সম্পর্কগুলো পরিত্যাগ করতে একেবারেই অক্ষম? অবশ্যই সে অক্ষম, এই পরিত্যাগ তাকে বিধ্বস্ত করে ফেলবে। অন্য নারীদের প্রতি আকর্ষণ এবং চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করার মত ক্ষমতা তার নেই। এছাড়া নিয়ন্ত্রণ করার কোনো প্রয়োজনীয়তাও সে অনুভব করতে ব্যর্থ হয়। তার চেয়ে আর কেউই ভালো জানে না, এই সব ছোটখাটো অভিযান তেরেজার সাথে তার সম্পর্কের প্রতি কত সামান্যতম শঙ্কার কারণ। তাহলে কেন সে তাদের পরিত্যাগ করবে। ফুটবল খেলা দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার মতই, এধরনের পদক্ষেপের নেবার বাড়তি কোন কারণই অনুভব করেনি।

কিন্তু বিষয়টি কি এখনো আনন্দের ব্যাপার তার কাছে? এমনকি যখন সে অন্য কোন নারীর কাছে যায়, স্পষ্টতই তাকে তার ভালো লাগেনা না এবং আর কখনো সে সেই নারীর কাছে যাবে না বলে প্রতিজ্ঞাও করে নিজের কাছে। সারাক্ষণই টমাস তার চোখের সামনে তেরেজার ছবি দেখতে পায়, এবং ব্যাপারটাকে মোছার একমাত্র উপায় তখন দ্রুত মাতাল হওয়া। তেরেজার সাথে তার দেখা হবার পর, সে মদ ছাড়া আর কোন রমণীর সাথে সঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়েছে! কিন্তু তার নিশ্বাসে মদের গন্ধ তেরেজার কাছে তার অবিশ্বস্ততার  নিশ্চিত চিহ্ন।

টমাস একটা অদ্ভুত ফাঁদে বন্দী: এমন কি তার এইসব বন্ধুদের কাছে যাবার পথে, তার মনে হতো কেন সে যাচ্ছে, অপছন্দ হতো, অরুচি হতো; কিন্তু আবার একদিন যদি সে না যেত, তাকে আবার ফোনে নতুন করে দেখা করার জন্য দিনক্ষণ ঠিক করতে দেখা যেত।

তখনো পর্যন্ত সাবিনার সাথেই শুধুমাত্র সে খানিকটা স্বস্তি বোধ করতো। সে জানতো সাবিনা কথা গোপন রাখতে জানে, তাদের গোপনে দেখা হবার ব্যাপারটি সে প্রকাশ করবে না। সাবিনার স্টুডিও  সবসময় যেন তাকে আমন্ত্রণ জানাতো অতীত কোনো স্মৃতিচিহ্নর মত, তার প্রিয় সেই ভাবনাহীন ব্যাচেলর অতীত।

হয়তো সে নিজেও বুঝতে পারেনি আসলে তার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে: এখন সে দেরী করে বাসায় আসতে ভয় পায়, কারণ তেরেজা তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। তারপর একদিন সাবিনা তাকে ধরে ফেলে সঙ্গমের সময় বার বার ঘড়ির দিকে তাকাতে, এবং কাজটি শেষ করার জন্য তাড়াহুড়া করতে।

এরপর, তখনও নগ্ন, অলসভাবে হেটে তার স্টুডিওতে ইজেলে রাখা অর্ধ সমাপ্ত পেইন্টিং এর সামনে এসে দাড়ায় সাবিনা এবং আড় চোখে টমাসকে দেখে দ্রুত তার কাপড় পড়তে।

যখন পুরোপুরি কাপড় পরা হয়ে গেছে, শুধুমাত্র একটি পা খালি, টমাস সারা ঘরের দিকে তাকিয়ে, এরপর মাটিতে পুরোপুরি শুয়ে পড়ে টেবিলের নীচে কি যেন খুঁজতে থাকে।

সাবিনা তখন বলেছিল, ‘মনে হচ্ছে তুমি আমার সব ছবির মূল থীমে পরিণত হচ্ছে, দুটি পৃথিবীর সম্মিলন, দ্বিমুখী রূপ, স্বেচ্ছাচারী এক লিবার্টাইন[২০] টমাসের রূপরেখার মধ্যে, অবিশ্বাস্য ভাবে দেখা যাচ্ছে রোমান্টিক প্রেমিকের মুখ। অথবা, অন্যভাবে, একজন ট্রিষ্টানের [২১] মধ্য দিয়ে, যে সারাক্ষণ তার তেরেজার কথা ভাবছে, আমি দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হওয়া এক স্বেচ্ছাচারীর সুন্দর পৃথিবী’।

টমাস সোজা হয়ে দাড়ায়, অন্যমনস্কভাবে সাবিনার কথাগুলো শোনে।

সাবিনা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কি খুঁজছো তুমি’?

‘একটা মোজা’।

সেও সারা ঘর জুড়ে টমাসের সাথে মোজা খুজতে শুরু করে, আবারও  টমাস মেঝেতে শুয়ে পড়ে টেবিলের নীচে খোজে।

’তোমার মোজা তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না’, সাবিনা বলে, ’তুমি মনে হয় মোজা ছাড়াই এসেছিলে’।

টমাস তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে  চিৎকার করে বলে, ’আমি কিভাবে মোজা ছাড়া আসবো’? ’আমি নিশ্চয়ই আসার সময় শুধু এক পায়ে মোজা পরে আসিনি, তাই না’?

‘সেটা কিন্তু একেবারে অসম্ভব ব্যাপার না। ইদানীং তুমি এমনিতেই খুব অন্যমনস্ক। সবসময় তাড়া করছো, ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছো। একটুও অবাক হবোনা যদি তুমি এক পায়ে মোজা পরতে ভুলে  গিয়ে থাকো’।

খালি পা টা টমাস যখন জুতোর মধ্যে ঢোকাতে যাবে, তখন সাবিনা বলে, ’বাইরে খুব ঠাণ্ডা, আমি তোমাকে আমার একটা মোজা ধার দিচ্ছি’।

সাবিনা তাকে একটা লম্বা, বেশ ফ্যাশনদুরস্ত চওড়া নেটের মোজা দেয় পরার জন্য।

সে ভালো করে বুঝতে পারে তার সাথে মিলনের সময় ঘড়ির দিকে তাকানোর জন্য সাবিনা তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। তার মোজা সে নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। বাইরে সত্যি সত্যি খুব ঠাণ্ডা, সাবিনার প্রস্তাব গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই তার। সে বাসায় ফিরে যায় একপায়ে মোজা, অন্য পায়ে  গোড়ালিরে উপর ভাজ করে গুটানো চওড়া নেটের মেয়েলী মোজা পরে।

তার পরিস্থিতি উভয়সঙ্কটের: তার প্রেমিকাদের চোখে, সে তেরেজার জন্য তার ভালোবাসার কলঙ্ক চিহ্ন বহন করছে, আর তেরেজার চোখে, সে তার প্রেমিকাদের সাথে তার গোপন অভিসারের কলঙ্ক চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে।

(চলবে)

আপনার মন্তব্য