আবহমান

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-২৫ ১৩:৪৪:৩১

 আপডেট: ২০১৫-১২-২৫ ১৬:৫৫:২৯

ছবি: সংগ্রহ

মিশু মিলন:

আমরা যারা দীর্ঘদিন যাবৎ নিয়মিত এই রাস্তায় যাতায়াত করি পায়ে হেঁটে, রিক্সায় কিংবা গাড়িতে; তাদের কাছে এই তিন রাস্তার মোড়টি বিস্ময়ের, বিরক্তির, স্মৃতিকাতরতার, আবার শঙ্কারও। এই তিন রাস্তার মোড়টি বহুবার তার রূপ বদল করেছে, মানে তার রূপ বদল করা হয়েছে। আর আমরা সাধারণ নারী, পুরুষ, বৃহন্নলা, রূপান্তকামী; অর্থাৎ অফিসের বড় কর্তা, কেরানি, পিওন, অধ্যাপক, ছাত্র, বেকার, ভবঘুরে, ভ্রাম্যমাণ কামশিল্পী, ডাক্তার, মুচি, ঠেলাওয়ালা, বাদামওয়ালা, বড় ব্যবসায়ী; মানে সমাজের তাবৎ শ্রেণির মানুষ যারা প্রতিদিন এই রাস্তায় চলাফেরা করি, তারা এই মোড়টির রূপ বদল দেখি আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা করি, কেউ কেউ মুখ বুজে থেকে কেবল শুনি। আমরা কেউ কেউ বিস্মিত হই এই ভেবে যে, এই রাস্তার মোড়টি যতবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে, দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল করে মহৎ কাজ করলেও কোন মানুষ সংবাদপত্রের পাতায় এর সিকি ভাগও ঠাঁই পান না!

বিরক্তির কারণ হলো পাঁচ বছর পরপরই নানান রকম নির্মাণ সামগ্রী এনে জড়ো করা হয় রাস্তায়, ফলে জ্যাম লেগে যায় আর ভোগান্তিতে পড়ি আমরা। আমাদের মধ্যে যাদের বয়স একটু বেশি তারা স্মৃতিকাতরতায় ভুগি এই ভেবে যে, আহা, একদিন এখনে শিরীষ গাছের ছায়ায় বন্ধুদের সাথে কতো আড্ডা দিয়েছি! প্রেয়সীর কাঁধে মাথা রেখে কীভাবে যে দিনের প্রহর পেরিয়ে সন্ধ্যা উতরে গেছে টেরই পাইনি! আর শঙ্কার কারণ হলো, রাস্তার মোড়টি নিয়ে কোনদিন না ধুন্ধুমার কাণ্ড বেঁধে কোপাকুপি-গোলাগুলি শুরু হয়ে যায় এবং মাঝখানে পড়ে প্রাণ যায় আমাদের মতো নিরীহ কোন প্রাণীর, হয়তো যার একার রোজগারের ওপর নির্ভর করে কোন মতে বেঁচে আছে পাঁচ-ছয়জন মানুষ।

    একসময় তিন রাস্তার মোড়ের মাঝখানটা ছিল বিরাট একটা সমবাহু ত্রিভুজের মতো, লাল ইটে বাঁধাই করা ত্রিভুজের একেকটি বাহুর মতো ঘের, মাঝখানে তিনটি প্রকাণ্ড শিরীষ বৃক্ষ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ছায়া দিতো; আর ত্রিভুজের ঘাসে ছাওয়া সবুজ জমিনে বর্ণিল বিন্দুর মতো আমরা আড্ডা দিতাম নিশ্চিন্ত মনে। ত্রিভুজটা ঘিরে ছিল তিনটি চওড়া রাস্তা। রাস্তা দিয়ে মানুষ যার যার কাজে যেতো আসতো, ক্লান্ত হলে শিরীষের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিতো কিন্তু কেউ কখনও আমাদের আড্ডা কিংবা প্রেয়সীর সঙ্গে সময় যাপনে বিঘ্ন ঘটাতো না। শুধু যে তরুণ-তরুণীরাই আড্ডা দিতো তা নয়, প্রবীণেরাও দিতেন। রাতের বেলা ভবঘুরে আর রাস্তার পাগলেরা ঘুমাতো এখানে এবং ভ্রাম্যমাণ কামশিল্পীরা তাদের প্রায় উন্মুক্ত সুকোমল পিঠ কিংবা নাভির চতুঃপার্শ্বের স্ফুরিত তুলতুলে অঞ্চলে ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিপুণ ব্যবহারপূর্বক মদনদেবের পঞ্চবাণে কামোপহতকে এখান ধরে নিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে কামসেবা করতো!    

মাঝে মাঝে দেখতাম ত্রিভুজের পূর্ব দিকের বাহু দুটির মিলনস্থলে দাড়ি-গোঁফওয়ালা জটাধারী এক বৃদ্ধ বসে বসে একই সাথে চার পাঁচটা বিড়ি ফুঁকতো আর তাকে ঘিরে থাকতো একদল মানুষ। বিড়ি অর্ধেক শেষ হলে পুরুষের রতিপাতের ঠিক আগ মুহূর্তের অস্থিরতা নিয়ে ছুঁচালো মুখে পরপর বেশ কয়েকটি টান দিয়ে বিড়িগুলো ছুঁড়ে দিতো মানুষগুলোর সামনে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সেই আধ খাওয়া বিড়ি কুড়িয়ে ফুঁকতো। এই মানুষগুলো জটাধারী লোকটির পরিচয় দিতো বিড়ি পীর বলে আর নিজেদেরকে বিড়ি পীরের মুরিদ। বিড়ি পীরের সারা গায়ে থাকতো ধূলি-কালি, স্নান করতো না, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো। বেশিরভাগ সময়ই সে থাকতো উলঙ্গ আর তার তলপেটের নিচের সঘন পাকা-আধপাকা ময়লা জটালো কেশের ভেতর থেকে নি¯প্রাণ কাছিমের মাথার মতো নেতিয়ে পড়া লিঙ্গটি থাকতো মলিন হয়ে যাওয়া তালগাছে ঝুলন্ত বাবুই পাখির বাসার মতো অণ্ডকোষের ওপর।

মুরিদরা তাকে নতুন লুঙ্গি কিনে দিলেও সে একবেলার বেশি পরনে রাখতো না লুঙ্গি এবং খুব যত্ন করে লুঙ্গিখানা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতো, মুরিদরা সেই ছাই কিছু গায়ে-মাথায় মাখতো আর কিছু পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে যেতো সম্ভবত পরিবারের অন্যান্য সদস্য কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। মুরিদরা তাকে খাবার কিনে দিলে সে নামমাত্র খাবার মুখে দিয়ে ফেলে দিতো, তবে বিড়ি ফেলতো না কখনও, কিছু বিড়ি কানে গুঁজে রাখতো। পাঁচ-ছয়টা বিড়ি ধরিয়ে একসাখে ফুঁকতে ফুঁকতে তার মুখের কাছের দাড়ি-গোঁফ তামাটে হয়ে গিয়েছিল।


তারপর এক মাঘের শীতের রাতে বিড়ি পীর মরে পড়ে রইলো ত্রিভুজের পূর্বদিকের দুই বাহুর মিলনস্থলে। বিড়ি পীরের মুরিদরা বললো, ‘পীর বাবা স্বেচ্ছায় দেহ রেখেছেন।’ আমাদের মতো ভদ্রলোকেরা কেউ বিশ্বাস করলো আবার কেউ বললো, ‘কোল্ড স্ট্রোক।’ যে যাই বলুক, বিড়ি পীরকে নিয়ে আলোচনা আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়ে গেল চায়ের দোকানে, সকাল-সন্ধ্যার ভিড় বাসে, রিক্সার আরোহী কিংবা পায়ে হাঁটা মানুষের মধ্যে। বিড়ি পীরের অসাধারণত্ব-অলৌকিকত্ব নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো সর্বত্র। বিড়ি পীর যে জায়গায় মরে পড়ে ছিল তার মুরিদেরা সে জায়গায় গোলাপজল ছিটিয়ে ফুল-মালা, আগরবাতি ইত্যাদি সহযোগে তাদের ভক্তি প্রদর্শন করতে লাগলো। মুরিদদের কেউ কেউ জায়গাটা আপাতত বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সালু কাপড়ে ঢেকে দেবার কথাও ভাবলো।

একদিন বিকেলবেলা আমরা আড্ডা দিচ্ছি, আশপাশে যুগল যৌবন মেতে আছে প্রেমময় খুনসুটিতে, বিড়ি পীরের মৃত্যুস্থান ঘিরে কয়েকজন মুরিদ বসে নিজের মনোবাঞ্ছা পূরণের অভিলাষ জানাচ্ছে বিড়ি পীরের পরলোকগত আত্মার কাছে! তখনই কয়েকজন সরকারী কর্তা-কর্মী এবং একদল পুলিশ এসে আমাদের হটিয়ে দিল। পরদিনই দেখলাম জায়গাটা টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে এবং কয়েক মাসের মধ্যেই দেখলাম ছোট ছোট ঝাউগাছ আর সুশোভিত ফুলের বাগানের মধ্যে বাঁধানো বেদির ওপর স্থাপন করা হয়েছে দারুণ এক ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটা কোন পরিপূর্ণ মানুষের নয়, তবে মনোযোগ দিয়ে দেখলে মানুষের আদলটা বোঝা গেলেও নারী কি পুরুষ তা বোঝা যায় না! ভাস্কর্যটার নাম ‘মানুষ’। আমরা বেশিরভাগ মানুষ এতোদিন জানতাম-ই না যে ভাস্কর্য এক ধরণের শিল্প এবং এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোও হয়, আর ভাস্কর্য বোঝার তো প্রশ্নই আসে না!

আমরা সকালে কাজে যাই, রাতেরবেলা ফিরে এসে একপেট ভাত খাই, সিরিয়াল দেখতে দেখতে হাত থেকে রিমোটটা ফসকে গেলে বুঝতে পারি ঘুম পেয়েছে; নিজে মশারি টাঙিয়ে নয়তো বউয়ের টাঙানো মশারির ভেতরে ঢুকে বউকে জাপটে ধরে শুই, বউয়ের শরীর ভাল থাকলে সারাদিনের অফিসের মানসিক চাপ আর শরীরের তাপ নামিয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাই। রাতে শুয়ে শুয়ে মাথায় যদিবা খানিকটা অন্যরকম ভাবনা আসে তো সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ক্ষিদের  ভয়ে তা পালায়! সেই জন্ম থেকে পেট আর পুঁজির কাছে রামধরা খেয়ে আছি আমরা। ভাস্কর্য নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়ই পাই না, কেননা মাথাটা আমার দেহের সাথে থাকলেও মগজটা ভাড়া দিতে হয়েছে পেটের কারণে, তাও যদি পেটে পরিপূর্ণ প্রশান্তি মিলতো!


তবে বাসে কিংবা চায়ের দোকানে ভাস্কর্যটি নিয়ে নানা কথা শুনতে পেতাম; দু’একজন ভাস্কর্য নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতো আর আমরা বেশিরভাগ মানুষই মুখ বুজে শুনতাম সেসব কথা। কেউ বলতো, ‘ভাস্কর্যটির বিমূর্ত উপস্থাপন শৈলী মানুষকে বড় আকৃষ্ট করে’; কেউ বলতো, ‘ভাস্কর্যটির ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তি আছে যা মানুষকে প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগায়’; কেউ বলতো, ‘ভাস্কর্যটির উচ্চতা কম, তাছাড়া লাইটের ব্যবহার ঠিক না হওয়ায় রাতেরবেলা যথার্থ ফোকাস হয় না’; এরকম নানা কথা শুনতে পেতাম। আমরা তাদের কথা কিংবা ভাস্কর্যের অন্তর্গূঢ় ব্যাখ্যা কিছু বুঝতাম আর কিছু আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যেতো।   

আবার কেউ কেউ গলা খাঁকারি দিতো, ‘ইহা কুফর কর্ম! ইসলামে মূর্তি জায়েজ নয়। সাতসকালে মূর্তি দেখে কাজে বের হওয়া গুণাহ্, এই মূর্তি সরিয়ে ফেলা উচিত।’ কেউ ওয়াক তুলতো, ‘এসব কাফের হিন্দু সংস্কৃতি, পবিত্র ইসলামের জমিনে কাফের সংস্কৃতি চলতে পারে না, ক্ষমতায় গেলে এই মূর্তি ভেঙে ফেলে আরবীতে আল্লার নাম স্থাপন করা হবে।’          
             
এইসব নিয়েই ছিল আমাদের দৈনন্দিন যাতায়াত কিংবা চায়ের দোকানে বসে এককাপ দুধ নয়তো আদা চা পান। তবে আমাদের অনেকের কাছেই ভাস্কর্যটি ভাল লাগতো। আমরা যারা শিল্পের গূঢ় তত্ত্ব কম বুঝতাম কিংবা যাপিত জীবনে দেখাদেখি ধর্মপালনের বাইরে রীতিমতো বেশ ধারণ করে ধর্মচর্চা অথবা কাজকর্মের ভারে রাশভারী ধর্মগ্রন্থ পড়তাম না, তাদের কাছে ভাস্কর্যটিকে মনে হতো দারুণ এক সৌন্দর্যের প্রতীক! আর মানুষও ভাস্কর্যটিকে ঘিরে বসতে পারছে, আড্ডা কিংবা প্রেমের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা আসছে না। বেশ তো!   
শুনেছি ভাস্কর্যটি নির্মাণের সময় বিড়ি পীরের মুরিদরা গাইগুই করেছিল ওখানে পীরের মাজার গড়ার জন্য, কিন্তু সরকারী লোকের কাছে তাদের গাইগুই ধোপে টেকেনি সম্ভবত এই কারণে যে, বিড়ি পীরের মুরিদদের সংখ্যাটা ছিল কম এবং তাদের মধ্যে শক্তিশালী নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন কেউ ছিল না। তবে বিড়ি পীরের মুরিদ যেভাবে বাড়তে শুরু করেছিল যদি আরও কিছুদিন সে বেঁচে থাকতো, তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় তার মুরিদদের ভেতর থেকে নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন কাউকে না কাউকে পাওয়া যেতো এবং বিড়ি পীর প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেতো। আর বিষয়টা স্পর্শকাতর এবং ভোটের কথা ভেবে সরকার এখানে ভাস্কর্য স্থাপনের বদলে বিড়ি পীরের মাজার গড়ে দিতো। সেই দিক থেকে বলতে হবে বিড়ি পীরের বড় দুর্ভাগ্য, বড় অসময়ে চলে গেল বিড়ি পীর। নইলে গুলিস্তানের ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানের গোলাপ শাহ্’র মাজারের মতো এখানেও বিড়ি পীরের মাজার গড়ে উঠতো এবং দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসতো হাজার-হাজার মুরিদ। নিজেদের জীবন আর বিড়ি পীরের জীবন দেখার অভিজ্ঞতায় আমাদের কারও কারও উপলব্ধি এই যে, প্রতিষ্ঠা অনেকটা লটারীর মতো, শ্রম এবং মেধা থাকা সত্ত্বেও সকলেই এই লটারি জিততে পারে না; এক্ষেত্রে সময় এবং সুযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিড়ি পীর সময়ের আগেই মরে যাওয়ায় তার প্রতিষ্ঠা লাভ হয়নি।


তারপর একসময় সেই ভাস্কর্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা একবারে মিইয়ে গেল। নগর কিংবা নগরের বাইরে দেশের অন্যত্র ঘটা নতুন নতুন ঘটনার আড়ালে চলে গেল ভাস্কর্য। আমরাও যাতায়াতের পথে কোন দিন ভাস্কর্যের দিকে তাকাই, কোনদিন বা ভাস্কর্যের কথা মনেই থাকে না। কিছুকাল পর একদিন সচেতনভাবে আমরা লক্ষ্য করলাম ধুলোবালির আগ্রাসন এবং পাখ-পাখালির পুরীষে ভাস্কর্যটি কিছুটা মলিন হয়ে পড়েছে, কিন্তু তাতে ভাস্কর্যটির বাহ্যিক সৌন্দর্য কিংবা অন্তর্নিহিত শক্তি এতটুকুও ম্লান হয়নি।

এমনিভাবে বছর পাঁচেক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ একদিন দেখলাম ভাস্কর্যটি নেই এবং জায়গাটি পুনরায় টিন দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। আমাদের মনে নানা ধরণের প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকলে সেই প্রশ্ন দীর্ঘ হবার আগেই পরদিন সকালের খবরের কাগজেই মিললো উত্তর ভাস্কর্যটি ওখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এই জন্য যে ওখানে একজন নেতার মূর্তি স্থাপন করা হবে। ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে কিছু ছাত্র-ছাত্রী, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মী মানববন্ধন করলো বটে কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভাস্কর্যের জায়গায় স্থাপন করা হলো নেতার মূর্তি।         

আর ত্রিভুজটাও সবদিক থেকে কেটে আগের চেয়ে একটু ছোট করে ফেলা হলো এবং পূর্বদিকের যে স্থানটায় বিড়ি পীর মরে পড়ে ছিল সেই স্থান খর্ব করে রাস্তার সাথে মিশিয়ে দেওয়া হলো জনগণের যাতায়াতের স্বার্থে রাস্তা আরও চওড়া করার জন্য। এতে করে সমবাহু ত্রিভুজটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের রূপ নিলো, নেতার মূর্তি সর্বদিক তো বটেই এমনকি অনেক দূর থেকেও যাতে দেখা যায় সেজন্য মূর্তি স্থাপনের আগেই শতবর্ষী শিরীষ বৃক্ষ তিনটি কেটে ফেলা হয়েছিল এবং ত্রিভুজটি লোহার গ্রিল দিয়ে ঘিরে বন্ধ গেটে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ’ লিখে। আমি অনেকদিন খেয়াল করেও সেখানে অবশ্য কোন অসাধারণ জন দেখতে পাইনি!

এই যে ভাস্কর্য অপসারণ করে নেতার মূর্তি স্থাপন করা হলো, এটা নিয়ে কিন্তু আলোচনা-সমালোচনা কম হলো না। কি চায়ের দোকানে, কি বাস-গাড়িতে, সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল। অনেকে বললো, ‘ভাস্কর্য সরিয়ে এখানে নেতার মূর্তি স্থাপন করা ঠিক হয়নি।’ আবার অনেকে বললো, ‘কাজটা প্রশংসনীয় নিঃসন্দেহে, কেননা দেশের জন্য এই লোকটির অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।’

‘মানুষ’ নামক ঐ ভাস্কর্যটির মতোই একসময় আলোচনা-সমালোচনা মিলিয়ে গেল আমাদের দৈনন্দিন দিনযাপনের ব্যস্ততায়। নেতার মূর্তিটির কথা আর মনেই পড়তো না, চলাচলের পথে যদিবা কখনও চোখে পড়তো তো ভাসা ভাসা।

পাঁচ বছর এই মোড়টি আমাদের কাছে রাস্তার আর পাঁচটা সাধারণ মোড়ের মতোই ছিল কিন্তু পাঁচ বছর অতিবাহিত হতেই আবার সংবাদ শিরোনাম হলো মোড়টি; আবার আমাদের চায়ের দোকানে কিংবা ভিড় বাসের আলোচনায় ফিরে এলো এই বিস্ময়কর, বিরক্তিকর, স্মৃতিকাতর আর শঙ্কিল মোড়টি। কেননা নেতার মূর্তিটি ওখান থেকে অপসারণ করা হয়েছে এই অভিযোগে যে, তার কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক ছিল না এবং তিনি দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে ছিলেন মারাত্মক ক্ষতিকর। নেতার মূর্তি অপসারণের পক্ষে বিপক্ষে নানা মত শুনতে পেলাম। অনেকে বললো, ‘মূর্তি অপসারণ করার জন্য বর্তমান সরকারকে সাধুবাদ জানাই। এই লোকটি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের স্বাধীনতা হরণ করেছিল।’ অনেকে নাক সিঁটকালো, ‘এ আর কিছু নয়, নষ্ট রাজনীতি।’ যথারীতি অনেককে বলতে শোনা গেল, ‘কোন ধরণের মূর্তিই ইসলামে জায়েজ নয়!’

এইসব আলোচনা নিয়ে কোথাও কোথাও একটু-আধটু হাতাহাতিও হয়ে গেল, ঠোঁটের পাশ দিয়ে কষ গড়ালো এবং গাল ফুলে গেল। তবু ভাল যে রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হলো না, শুধু বিরোধী পক্ষ সুর চড়ালো, ‘ক্ষমতায় গেলে ওখানে পুনরায় আমাদের নেতার মূর্তি স্থাপন করা হবে।’   

আমরা যারা আটপৌরে মানুষ, তারা সকালে কাজে যাই আর রাতে ফিরি। কোন ঝামেলায় জড়ানো আমাদের অভ্যাসে নেই যতক্ষণ না ঝামেলা নিজে এসে আমাদের পরিবারকে না জড়ায়। রাস্তায় হাঁটাচলা করি, ঠেলাঠেলি করে বাস-গাড়িতে যখন যাই তখন কিছু কিছু কথা কানে আসে। আসলে অনর্থক সেসব কথা, সারবত্তা কিছু নেই; লাভ তো নেই। যেখানে লাভ নেই সেখানে মাথা খাটানোর সময় আমাদের কোথায়! আমরা ভাস্কর্য নিয়ে পত্রিকায় পক্ষে-বিপক্ষের কলাম পড়ি, টেলিভিশনের ‘টক শো’তে বাকযুদ্ধ দেখি। মজাই লাগে!

আমরা কেউ কেউ ভাবলাম নিশ্চয় ‘মানুষ’ নামক সেই ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপন করা হবে, কিন্তু ‘মানুষ’ নামক ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপনের ব্যাপারে কোন রাজনৈতিক দলই কিছু বললো না। আমরা অপেক্ষায় রইলাম কী হয় তা দেখার জন্য।

একদিন অফিসে যাবার পথে আমরা প্রচণ্ড যানজটে পড়লাম এবং যথা সময়ে অফিস ধরতে পারবো কিনা সেই চিন্তায় দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগলো আমাদের শরীর থেকে। কিন্তু অনেকক্ষণ বাসে বসে থাকার পরও যখন বুঝতে পারলাম সহসাই সিগন্যাল ছাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই তখন বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। মোড়ের কাছটায় এসে যানজটের কারণ জানতে পারলাম এবং আমরা যারা বাস থেকে নেমে সময় মতো অফিস ধরার জন্য একে অন্যকে ঠেলেঠুলে হাঁটতে শুরু করেছিলাম তারা সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম মোড়ের কাছে। সারা শহর প্রদক্ষিণ শেষে পূর্বদিকের রাস্তা দিয়ে ট্রাকে করে একজন প্রয়াত নেতার প্রকাণ্ড মূর্তি নিয়ে একটি মিছিল এগিয়ে আসছে মোড়ে দিকে, পূর্বে যে জায়গায় ‘মানুষ’ নামক ভাস্কর্যটি এবং আরেক নেতার মূর্তি ছিল সেখানটায় স্থাপন করা হবে। এ কারণেই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিপরীত সুর থাকলেও বেশিরভাগ মানুষই সুর চড়ালো এই বলে যে, ‘স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য এই নেতা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তার মূর্তিই স্থাপন করা উচিত।’


কে নেই মিছিলে! তাবড় তাবড় রাজনৈতিক নেতা, কবি-সাহিত্যিক, সংগীত শিল্পী, চিত্রকর, ভাস্কর, সিনেমার নায়ক-নায়িকাসহ যেন এক তারার মিছিল! তাদের দেখতে পেয়ে আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। এতোদিন যাদেরকে সিনেমা-টিভিতে দেখেছি তাদেরকে স্ব-শরীরে এতো কাছে দেখতে পেয়ে আমরা একেবারে হাড়-হাভাতের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম রাস্তায়, বিলম্বে অফিসে ঢুকে বসের ধমকানি খাবার কথা ভুলে! গোল্লায় যাক অফিস! অফিস রোজ করতে পারবো, কিন্তু এই তারাদের কি রোজ দেখতে পারবো, এরা তো আর আকাশের তারা নন যে রাতের বেলা আকাশের দিকে তাকালেই দেখা যাবে! এরা যে আকাশের তারার চেয়েও দুর্লভ!  

মিছিল ঘিরে রেখেছে নানান বাহিনীর নিরাপত্তা কর্মীরা, আমাদের মতো আমজনতাকে মিছিলের ধারে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না; তা না দিক, দূর থেকে যে দেখতে পাচ্ছি এই আমাদের চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য! ট্রাকসহ তারার মিছিলটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের কাছে গিয়ে থামলো। কর্মীরা ট্রাক থেকে খুব সতর্কভাবে নেতার মূর্তিটি নামিয়ে বেদির দিকে নিতে লাগলো। পাতি নেতারা মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে লাগলো মূর্তির উদ্দেশ্যে, শিল্পীরা কেউ দু-এক কলি দেশাত্মবোধক কেউবা দু’চার লাইন রবীন্দ্র সংগীত গাইলো, কতিপয় আবৃত্তি শিল্পী গলার রগ ফুলিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতে শুরু করলো নেতাকে নিয়ে লিখিত কবিতা! কিন্তু মূর্তিসহ বেদির দিকে এগোতেই বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ালো সবাই! এমনকি আমরা যারা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছি তারাও। এতক্ষণ আমরা তারা দেখছিলাম, আর তারারা দেখছিল মূর্তির চাঁদমুখ! তাই বেদির দিকে কারো দৃষ্টি পড়েনি। দৃষ্টি যখন পড়লো তখন দেখলাম,  বেদির ওপর বসে একটি উলঙ্গ শীর্ণ ধুলোমাখা কালো ছোট্ট শিশু আপন মনে নিজের নুনুর মাথা খুঁটছে, গালে তার ময়লা কেটে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ!





আপনার মন্তব্য