কথাশ্রমিক

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-০১ ১৪:১১:০৪

 আপডেট: ২০১৬-০১-০১ ১৪:৩৩:২৫

মিশু মিলন:

কল-৭
‘শুভসন্ধ্যা, আমি দীপ বলছি, স্যার বলুন, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’  
‘হ্যালো...... হ্যালো......’
‘হ্যাঁ স্যার বলুন, আমি শুনতে পাচ্ছি। কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘ঐ তোগো কী বালের নেটওয়ার্ক রে, কতা কাইট্টা কাইট্টা আহে?’
‘আপনার অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত স্যার। বলুন, কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘তোরা কী বালের ইন্টারনেট ছাড়ছোস রে? লাইন আহে তো আহে না।’
‘আপনার অসুবিধার জন্য আমরা সত্যিই আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবে স্যার, খুব তাড়াতাড়ি এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমাদের নেটওয়ার্ক ডেভলপমেন্টের কাজ চলছে।’
‘তাইলে আগে ডেভলপ কইরা তারপর লাইন দেওন চুদাইতি। আগে দিছস ক্যান?’
‘স্যার, আপনাকে অফিসিয়াল ভাষায় কথা বলার জন্য অনুরোধ করছি।’
‘এ...আবার অফিসিয়াল মারায়! ঐ আমাগো ট্যাহা কী বলদার পুটকি দিয়া পড়েরে?’
‘স্যার, আসলে সেটা তো সম্ভব নয়!’
‘এক্কেরে কতা কইবি না ব্যাডা, ফাজিলের দল কুনহানকার। এট্টা ডাউনলোড দিয়া ঘুম দেওন যায় জানোস!  
‘কী ডাউনলোড দিচ্ছিলেন স্যার?’
‘তোর নানীর ল্যাংডা ছবি! বুঝছোস। হালার পুতেরা বইয়া বইয়া বালের আঁটি বান্দে! রাখ চুদানির পুত!’

কল-১৮
‘হ্যালো, হ্যালো...’
‘শুভসন্ধ্যা, আমি দীপ বলছি, ম্যাম বলুন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’  
‘বাইয়া, আমারে এট্টা ওলকাম গান সেট কইরা দ্যান।’
‘জ্বী আপনার ওয়েলকাম টিউনে কী গান সেট করে দেব বলুন ম্যাম?’
‘ঐ যে মুমতাজের গানডা.....’
‘গানের প্রথম লাইনটা বলুন?’
‘তোরে লইয়া উদাসী হইয়া হানিমুন যামু রে ভাতিজার মামু.....’
‘ম্যাম, একটু লাইনে থাকুন। আমি এখনই ওয়েলকাম টিউনে গানটি সেট করে দিচ্ছি।.....ম্যাম, আমি গানটি সেট করে দিয়েছি। আর কোনভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘আর এট্টা গান দ্যান বাইয়া।’
‘কোন গানটা দেব বলুন ম্যাম?’
‘বুম্বাইয়া মরিচ বন্ধু খাওয়াইচে আমারে, এখন সেই মরিচের ঝালে আগুন জ্বলে অন্তরে।’
‘..........দিয়েছি ম্যাম। আর কোন গান দরকার?’
‘না বাইয়া। আইজকা দুইডাই থাক। হ্যার পচন্দ অইলে আবার পরে নিমুনে, রাহি।’           
‘ধন্যবাদ ম্যাম কল করার জন্য......’

কল-৩৫
‘শুভসন্ধ্যা, আমি দীপ বলছি, স্যার বলুন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’  
‘ভাই, শুনতি পাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি, স্যার বলুন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
‘বাই, আমি সহালবেলা ত্রিশটা টাহা ভরিছি বুজিচেন। একন এই ভরসন্ধেবেলা দেকি কি পাঁচ টাকা বাষট্টি পয়সা আছে। আমি একজনের সাথে মাত্তর এক মিনিট কতা কইচি। আমার টাহা গেল কনে?’
‘স্যার এমনি এমনি তো টাকা কাটার কথা না। আপনি লাইনে থাকুন আমি দেখছি।......স্যার আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি দুপুর দেড়টায় ওয়েলকাম টিউন হিসেবে দুটো গান সেট করেছেন।’  
‘হায় আল্লা, কী কচ্চেন আপনি! দুপুর দেড়টায় তো আমি ঘুমে টাল, কাল নাইট ডিউটি ছিল আমার! গান সেট করতি যাব কোন দুঃখে!’
‘স্যার আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি দুটো ওয়েলকাম টিউন সেট করেছেন।’
‘আমি আল্লার কসম করে কচ্চি বাইডি, আমি গান সেট করিনি। আপনি ভাল করে দ্যাকেন।’
‘স্যার, আমি দেখেছি।’
‘ও বাইডি, আমি গরিব মানুষ। বহু কষ্টের টাহা। গরিবের প্যাটে অ্যাম্বা লাত্থি মারেন না। আমার টাহাডা দিয়ে দ্যান বাই।’
‘আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত স্যার। এক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই। ’
‘আমার বাইডি না ভাল, আমার টাহাডা ফেরত দ্যান।
‘আমি খুবই দুঃখিত স্যার, আপনার আর কোন সাহায্যের প্রয়োজন?’
‘হ, গুয়া মারার জন্যি বসে রয়ছেন, আবার সাহায্য!’
‘ধন্যবাদ স্যা.....’

কল ৫৭
‘শুভসন্ধ্যা, আমি দীপ বলছি, স্যার বলুন, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’  
‘হামাক একটা গান ফিট করি দ্যান বাহে। যাতে হামাক কল কইরলে লোকে শুইনতে পায়।’
‘স্যার বলুন, কী গান সেট করতে চান আপনি?’
‘ঐ নাইরকেল নাইরকেল গানটা ফিট করি দ্যান।’
‘নারকেল নারকেল...স্যার গানের পুরো লাইন অথবা শিল্পীর নামটা বলুন?’
‘কেনে আপনি এই গানটা শুনেন নাই?’
‘দুঃখিত স্যার, আমি গানটি শুনিনি.....’
‘হায় আল্লাহ...কী কইছেন বাহে, আপনের জেবনটাই তো বিথা। নাইরকেল নাইরকেল গানটা শুনেন নাই! আমনে কুন দ্যাশত বাস করিছেন বাহে! খাড়ান মুই আপনাক গাইয়া শুনাচ্ছি-
        ও তুই নাইরকেল নাইরকেল, পাকা নাইরকেল নাইরকেল
        ভিতরে জলে ভরা, ভিতরে জলে ভরা
        আর উপরে?
        উপরে ছোবরা শুধু ভিতর তাতে ভরা...’  
‘ঠিক আছে স্যার আর গাইতে হবে না, আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি লাইনে থাকুন আমি দেখছি গানটা আছে কিনা।’
‘টপাক করি দ্যাহেন।’
‘হ্যাঁ, স্যার গানটি আছে।........স্যার গানটি সেট করে দিয়েছি। আর কোন সাহায্য লাগলে বলুন...’
‘বেদানা গানটাও ফিট করি দ্যান।’
‘কোন বেদানাটা দেব?’
‘আপনে দেহি কুন গাহানই শুনেন নাই। চাকরি করেন ক্যাঙ্কা করি?’
‘না, স্যার আমি বোঝাতে চাচ্ছি বেদানা শিরোনামে তো বেশ কয়েকটটা গান আছে। আপনি কোন গানটা চাচ্ছেন? কাইন্ডলি পুরো গানের লাইনটা বলুন....’
‘ওহ, তাই কন! খাড়ান গাইয়া শুনাচ্ছি-
কী দারুণ দেখতে রে তুই নাইরে তুলনা
কচিতে ডালিম রে তুই পাকলে বেদানা।’
‘বুঝতে পেরেছি স্যার। গানটি আছে, আমি এখনই সেট করে দিচ্ছি।’
‘হেভি টপাক করি দ্যান, হাতে টাইম নাই।’
‘গানটি সেট করে দিয়েছি স্যার। আপনার কি আম, কাঁঠাল, তরমুজ আর কিছু লাগবে?’
‘মানে? কি কইছেন?’
‘বলছি স্যার, আপনার কি এ ধরণের আর কোন গান লাগবে?’
‘এখন আর নাগিবে না বাহে। পরে লিব, খুদা হাফেজ।’
‘ধন্যবাদ স্যার....’

টিম লিডার এসে দীপকে ডেকে নিয়ে যায় ফ্লোর ম্যানেজারের রুমে। ফ্লোর ম্যানেজার ফোনে কথা বলছেন। ইশারায় টিমলিডার এবং দীপকে বসতে বললেন। কথা শেষ করে চোখ রাখলেন দীপের চোখে।
‘দীপ, আপনার শরীর খারাপ?’
‘না, স্যার।’
‘এই কলটা শুনুন।
ফ্লোর ম্যানেজার তার ল্যাপটপে দীপের একটা কল চালিয়ে দিল।

‘শুভসন্ধ্যা, আমি দীপ বলছি, ম্যাম বলুন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘বাইয়া, উইয়েল কামে আমারে এট্টা গাহান সেট করে দ্যান।’
‘কী গান ম্যাম?’
‘বেহাই আমার কাঁচা আম জারে ভইরে রাইখবো’
‘দুঃখিত ম্যাম, গানটি নেই। ধন্যবাদ কল করার জন্য।’
কলটি শুনে মাথা নিচু করলো দীপ। ম্যানেজার দীপের নতমুখে তাকিয়ে বললো, ‘এটা কী করলেন আপনি? একজন গান অন্তপ্রাণ মানুষকে তার প্রিয় গান থেকে বঞ্চিত করলেন! গানটি তো আমাদের আছে। আর এভাবে হুট করে রেখে দিলেন কেন? তার আরো কোন দরকার থাকতে পারতো, তাই না? ’
‘স্যরি স্যার। আসলে এটা ছিল আমার শেষ কল। টাইম পার হয়ে যাওয়ায় ভাবলাম গাড়ীতে আমার জন্যে সবাই অপেক্ষা করছে, এজন্য কলটা কেটে দিই।’
‘দীপ, আমি আপনাকে ক্লীয়ারলি বলতে চাই, আপনার পারফরম্যান্স উন্নতি করতে হবে। এরই মধ্যে আপনি এ মাসে দুটো ইউ খেয়েছেন। গত মাসে আপনার বিরুদ্ধে কাস্টমার কমপ্লেইন ছিল। আপনার কারণে টিমের পরফরম্যান্স খারাপ হচ্ছে। আপনার কারণে টিমের অন্যরা সার্ফা করছে।’
‘স্যরি স্যার, আশা করি এমনটা আর হবে না।’
‘এরকম চলতে থাকলে কিন্তু আমি আপনার চাকরি বাঁচাতে পারবো না দীপ। আসুন।’
ফেরার সময় ঘাড়ে হাত রেখে টিম লিডার বললো, ‘বি কনফিডেন্ট ম্যান...!’
 
কল-৭৪
‘হ্যাঁলু, হ্যাঁলু ....’
‘শুভসন্ধ্যা, আমি দীপ বলছি, ম্যাম বলুন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘ও দীপ বাইয়া! কেমুন আছেন বাইজান?’
‘জ্বী ভাল। আপনি ভাল আছেন ম্যাম?’
‘হ, আল্লায় রাখছে বালা।’
‘বলুন ম্যাম, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘আমারে ম্যাম-ট্যাম কইতে অইবে না, বইন কইলেই অইবেয়ানে।’
‘আচ্ছা, বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘বাইয়া, রাসেল বাই বালা আছেনি?’
‘রাসেল....ম্যাম আপনি কোন রাসেলের কথা বলছেন?’
‘ওই দ্যাহ, আবারো ম্যাম কয়! আমার শরম লাগে! বইন কইলেই অইবেয়ানে। রাসেল বাইরে চিনতে পারতে আছেন না! আপনাগো অফিসেই কাম করে। ওই যে হেইদিন কথা কইলাম। তারপর লাবনী আপা হ্যায় কেমন আছে?’
‘আসলে এখানে তো অনেক মানুষ কাজ করে। সবার উিউটিও এক সময়ে নয়। তাই সবার সঙ্গে সব সময় কম্যুনিকেশন হয় না।’
‘কী নিকেশন হয় না?’
‘যোগাযোগ, যোগাযোগ হয় না।’
‘ও তাই কন। রাসেল বাই মনে অয় মাইন্ড করছে। আগে অনেক ফোন টোন দিতাম। রাসেল বাই, লাবনী আপা, রিপন ভাইগো লগে মেলা কথা অইতো। অহন কামের চাপে খোঁজ লইতে পারি না। বোঝজেন তো বাই, গরীব মানুষ, কাম কইরা খাইতে অয়। হ্যার লাইগাই মনে অয় রাসেল ভাই মাইন্ড করছে। অহন বোনাস-টোনাস দেয় না।’
‘বোনাস পেলে অটোমেটিক্যালি আপনার ব্যালেন্সে যোগ হবে। এর জন্য অফিসে ফোন করতে হবে না।’
‘বাইডি যে কী কয়! আগে যহন ঘন ঘন অফিসে ফোন করতাম। বইন-বাইডি গো খবর লইতাম, তহন বোনাসও পাইতাম। অহন খোঁজ লইতে পারি না বইলা বাইয়েরা মাইন্ড কইরা বোনাস দেয় না। মাইন্ড কইরেন না বাইগো গরীব মানুষ....’
‘হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। আপনি বোনাস পেলে আপনার মোবাইলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আপনার আর কোন সাহায্যের দরকার?
‘সে অইবে আনে। বাইয়ে গো লগে আমার কী খালি কামের সম্পর্ক নাকি! কদ্দিন পর অফিসে ফোন দিছি। ভাইডির লগে এট্টু সুখ-দুঃখের প্যাঁচাল পারি।’
‘ম্যাম, এখানে তথ্য সংক্রান্ত সার্ভিসের বাইরে অন্য কোন কথা বলার সুযোগ নেই। আপনি...’
‘বাইডি...লক্ষ্মী বাইডি আমার, বইনের লগে কতা কইলে কিছু অইবে না। তা আপনের আব্বা-আম্মা বালা আছেনি?’
‘হ্যাঁ ভাল আছে। ম্যাম, এখানে পারিবারিক আলাপের কোন সুযোগ নেই। দয়া করে ফোন সংক্রান্ত কোন তথ্যের দরকার থাকলে বলুন।’
‘দুরো বাইয়া! আপনি য্যান কেমুন। রাসেল বাইয়া কত বালা আছিল! রাহেন।’    

কল-১১৩
‘সুপ্রভাত, আমি দীপ বলছি, স্যার বলুন, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’  
‘দীপ। বাহ্, কী সুন্দর বাংলা নাম আপনার! আপনি ঔপনিবেশিক দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছেন কেন?’
‘স্যরি স্যার?’
‘আপনি ইংরেজিতে সম্বোধন করেন কেন?’   
‘স্যরি।’
‘আবারো আপনি কথার মধ্যে ঔপনিবেশিক দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছেন!’
‘দুঃখিত।’
‘আপনি স্যার শব্দের অর্থ জানেন?’
‘জ্বী জানি।’
‘বলুন তো কী?’
‘মহাশয়’
‘আপনি তো মহাশয় বলে সম্বোধন করতে পারেন, তাই না?’
‘জ্বী, এখন থেকে আমি মহাশয় বলেই সম্বোধন করবো। এবার বলুন মহাশয়, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’  
‘আচ্ছা, আপনার বয়স কতো?’
‘সাতাশ’
‘ওহ, তাহলে তো আপনি আমার ছেলের চেয়েও ছোট। আমার পঁয়ষট্টি। আমি তুমি করেই বলি?’  
‘জ্বী মহাশয়, আপনি আমাকে তুমি করেও বলতে পারেন।’
‘দীপ, তোমার বাবা-মা বেঁচে আছেন?’
‘বাবা নেই, মা আছেন।’
‘তুমি তোমার মাকে ভালবাসো?’
‘অবশ্যই ভালবাসি মহাশয়। বাবা-মাকে কে না ভালবাসে!’
‘ভুল কথা। সবাই বাবা-মাকে ভালবাসে না।’
‘স্যার, দুঃখিত মহাশয়, দয়া করে ফোন সংক্রান্ত কোন তথ্যের প্রয়োজন হলে বলুন।’
‘আছে, ফোন সংক্রান্ত তথ্যের প্রয়োজন আছে। সেগুলো পরে বলবো।’
‘মহাশয়, আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনি আমাদের একজন সম্মানিত প্লাটিনাম কাস্টমার। প্রায় রোজ রাতেই আপনি ফোন করে দীর্ঘ সময় কথা বলেন।’
‘কী করবো বলো? আমার হাতে কোন কাজ নেই, দু’চোখে ঘুম নেই, কথা বলার কোন মানুষও নেই! আচ্ছা দীপ তুমি বিয়ে করেছ?’
‘না মহাশয়।’
‘বিয়ে করলে বিবাহিত জীবনের প্রতি কোন প্রত্যাশা রেখো না।’
‘কেন মহাশয়?’
‘তাহলে দুঃখ পাবে। এই আমাকে দেখ, দু’চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে বিয়ে করেছিলাম। সন্তান-সন্ততি হলো। তখন আরেক রকম স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। সন্তানদেরকে নিয়ে আমি প্রত্যাশার প্রাসাদ রচনা করলাম। আমার সেই প্রাসাদ এতো উঁচু হলো যে, আমি সেখানে উঠতেই পারলাম না। আজ আমি বিপতœীক, একা, নিঃসঙ্গ। সময় কাটানোর জন্য আমাকে ফোন করতে হয় কলসেন্টারে।’
‘আপনার সন্তানেরা?’
‘একেজন একেক দেশে। কে আর আমার খবর রাখে!’
‘আমি আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি। কিন্তু...’
‘কিন্তু কী? ফোন রাখতে চাও? তোমাকে আমি আজ আর ছাড়ছিনে। সারারাত কথা বলবো। তুুমি একদিন আমার বাসায় বেড়াতে আসবে। তোমার প্রেমিকা থাকলে তাকেও নিয়ে আসবে। বন্ধু-বান্ধবকেও নিয়ে আসতে পারো। আমার বাসায় তোমাদের নিমন্ত্রণ। জমিয়ে আড্ডা মারবো...
‘হ্যালো...হ্যালো...হ্যালো মহাশয়, হ্যালো...’

কল-১৫৫
‘সুপ্রভাত আমি দীপ বলছি, বলুন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’  
‘দীপ। তুমি দীপ! তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?’
‘জ্বী, বলুন ম্যাম, কীভাবে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘তুমি পারবে? পারবে আমাকে করতে, বলো দীপ?’
‘ম্যাম, আপনাদের সাহায্য করার জন্য আমরা সদা প্রস্তুত? বলুন...’   
‘তুমি তোমার দীপের শিখা জ্বেলে আমার হৃদয়ের অন্ধকার দূর করতে পারবে? বলো পারবে?’
‘ম্যাম, সার্ভিস সংক্রান্ত কোন সাহায্যের প্রয়োজন থাকলে বলুন।’
‘সার্ভিস! দেবে তুমি, তুমি দেবে আমাকে সার্ভিস দীপ! আজ দেড় বছর হলো আমার স্বামী আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করে না। তারপর থেকে সকল সার্ভিস বন্ধ। তুমি পারবে আমাকে সার্ভিস দিতে, বলো?’
‘ম্যাম, আপনাকে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলার জন্য অনুরোধ করছি।’    
‘প্রাসঙ্গিক! এই মুহূর্তে এটাই আমার কাছে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়, দীপ! জানো দীপ, রাত হলে অন্ধকার আমার শরীরে আগুন জ্বালে! মনে হয় হাতের মুঠোয় নিয়ে অন্ধকার পিষে যদি সারা শরীরে মাখতে পারতাম! জানো, অন্ধকার মনটাকে পুড়িয়ে করে কয়লা, মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার। উহ্...   
“বিমূর্ত এই রাত্রি আমার মৌনতার সুতোয় বোনা একটি রঙিন চাদর
সেই চাদরের ভাঁজে ভাঁজে নিঃশ্বাসের ছোঁয়া আছে ভালবাসার আদর
কামনার গোলাপ রাঙা সুন্দরী এই রাত্রিতে
নীরব মনের বরষা আনে শ্রাবণ-ভাদর
সেই বরষায় ঝর ঝরে নিঃশ্বাসের ছোঁয়া
আর ভালবাসার আদর।
বিমূর্ত এই রাত্রি...”
‘ধন্যবাদ ম্যাম, আপনার কন্ঠটা খুব মিষ্টি!’
‘সত্যি বলছো! থ্যাঙ্ক ইউ ডার্লিং। জানো, ও-উ তাই বলতো। সুইডেন থেকে যখন দেশে আসতো, সারারাত আমার নগ্ন উরুতে মাথা রেখে আমার গান শুনতো ও। শেষবার যাবার সময়ও আমাকে প্রাণভরে ভালবেসে গেল। তারপর কিছুদিন পরই আমাকে চিঠি লিখে জানালো, ও আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না।
চুপি চুপি চলে না গিয়ে
সে কেন বিদায় নিলো না হেসে...
দীপ এই গানটা আমার ওয়েলকাম টিউন করে দিতে পারো?’
‘দিচ্ছি ম্যাম।......ম্যাম দিয়েছি।’
‘আচ্ছা দীপ, তুমি বিয়ে করেছ?’
‘দুঃখিত ম্যাম, ব্যক্তিগত তথ্য গ্রাহককে প্রদান করা না।’
‘দীপ, তোমরা পুরুষরা এমন কেন? কেন নারীদেরকে ময়লা টিস্যুর মতো ছুঁড়ে ফেলে দাও?’
‘ম্যাম, আমি আপনার ইমোশনটা বুঝতে পারছি, প্রবলেমটা বুঝতে পারছি। এটা আপনার ব্যক্তিগত সংকট, আমাদের কাছে তো এর সলিউশন নেই।’
‘আছে, তোমার কাছে সলিউশন আছে। তুমি তোমার সলিউশন আমাকে দেবে, আমি আঁজলা পেতে নেব। আসবে তুমি কাল আমার বাসায় সলিউশন দিতে?’
‘ম্যাম প্লিজ ...’
‘বোলোনা, বোলোনা, প্লিজ বোলো না। আজ সারারাত আমি তোমার সঙ্গে কাটাবো...  
“আমি যামিনী, তুমি শশী হে
     ভাতিছো গগন মাঝে
     মম সরসীতে তব উজল
      প্রভা বিম্বিত যেন লাজে....”
 দীপ, এই গানটা আমার রিংটোন করে দাও।’
‘........দিয়েছি ম্যাম। আর.....’  
‘ওহ্ থ্যাঙ্ক ইউ সোনা। উম্মা... তুমি এভাবেই আমাকে দেবে। তোমার সবটুকু আমাকে নিংড়ে দেবে দীপ, পারবে না?’
‘ম্যাম, ফোন সংক্রান্ত আর কোন সাহায্যের প্রয়োজন আছে কী?’
‘আছে দীপ। আমার আরো অনেক... সাহায্যের প্রয়োজন আছে। ওহ্ হো! গ্লাসটা পড়ে ভেঙে গেল। নেশাটা বেশ ধরেছে বুঝলে। মনটা বড় উতলা হয়েছে আজ। নিজেকে সামলাতে পারছি না।  
“দিল-এ-নাদাঁ তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়
আখির ইস্ দর্দ কী দবা কেয়া হ্যায়।
হম্কো উন্সে বফা কী হ্যায় উম্মীদ
যো নর্হী জানতে বফা কেয়া হ্যায়।”

বলো তো, এটা কী গাইলাম?’
‘হিন্দী গান।’
‘উহ! তোমরা না....এটা হিন্দী নয়, উর্দু গজল। মির্জা গালিবের লেখা। এর বাংলা অর্থ হলোÑ
“ওরে অবুঝ মন তোর কী হয়েছে?
এ ব্যথার নিরসন কোথায় রয়েছে?
আমি উৎকন্ঠ আর সে বেজার
হে ঈশ্বর এ কী ব্যাপার।”

‘ধন্যবাদ ম্যাম। খুব ভাল কথা, আর আপনি গেয়েছেনও খুব ভাল। ম্যাম, দয়া করে সার্ভিস সংক্রান্ত আর কোন সাহায্য লাগলে বলুন।’
‘জানো, আমার অনেক বড় স্বপ্ন ছিল-আমি বড় শিল্পী হব। ওর জন্যই আমি গান ছেড়ে দিয়েছি।’
‘আপনি চাইলে তো আবার এখন গাইতে পারেন।’
‘আর পারবো না বুঝলে, সেই মনটা মরে গেছে। আমিও মরে গেছি। নষ্ট হয়ে গেছি। বেঁচে আছে আমার প্রেতাত্মা!’
‘ম্যাম......’
‘বারবার ম্যা ম্যা কোরো না তো! তোমার বস যদি তোমাকে কিছু বলে তাহলে আমি ও শালার নামে কমপ্লেইন করবো। ও আমাকে চেনে, আমি কী করতে পারি ও জানে! যাকগে, আমায় একটু আদর করে ডাকো না ডার্লিং। কেউ আমায় আদর করেনা, ভালবাসে না। জানো, আমার বান্ধবীরা কী দারুণ সংসার করছে! ছেলে-মেয়ে নিয়ে কতো সুখে আছে। আর আমি? এতো বয়স হয়ে গেল এখনও মা ডাক শুনতে পেলাম না! আমার খুব মা হতে ইচ্ছে করে। দ্বীপ তুমি আমার সন্তানের বাবা হবে? আমার সব আছে। অর্থ-সম্পদ সব। শুধু আমার সন্তানের বাবা হবার মতো কেউ নেই! ভেবো না আমি নেশার ঘোরে আবোল-তাবোল বকছি। আমি মা হতে চাই দীপ...মা হতে চাই.....’
‘প্লিজ ম্যাম, ডোন্ট ক্রাই.....’    
‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী
আর পৃথিবীর পরে ঐ নীল আকাশ
তুমি দেখেছ কি!
আকাশ, আকাশ, শুধু নীল ঘন নীল নীল আকাশ
সেই নীল মুছে দিয়ে আসে রাত, পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে
তুমি দেখেছ কি!
তুমি রাতের সে নীরবতা.....’

দুই
সকালে লগ আউট করে অফিসের নিচে নামতেই শীত যেন দাঁতে-নখে কামড়ে ধরলো দীপকে, মানুষের মোহের মতো চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ ঘন কুয়াশা। রাস্তায় এখনও যান চলাচল তেমন শুরু হয়নি। দীপ সোজা এসে অফিসের গাড়িতে উঠে বসলো। দু’জন সহকর্মী ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। তাদের মুখনিস্রিত ধোঁয়া কুয়াশায় গা এলিয়ে দিচ্ছে। অন্য দু’জন এখনও আসেনি। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তারা এলে সবাই উঠে পড়লো গাড়িতে। শীতে গা ঝাড়া দেওয়া ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো গর্জে ওঠে গাড়িটা।

কুয়াশা ফুঁড়ে শা শা করে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে দীপ। নয় ঘন্টা রোবোটিক সার্ভিস দেবার পর আর কথা বলতে ভাল লাগে না তার। অন্য সহকর্মীরা অবশ্য কথার তুবড়ি ছুটিয়ে চলেছে। রাতে কোন্ কাস্টমার কী বলেছে, কোন্ কাস্টমার কার সাথে কেমন আচরণ করেছে, কোন্ কাস্টমার কোন জেলার মানুষ, এসব নিয়ে আলোচনা, হাসি-তামাশায় মশগুল সবাই। সে এসব আলোচনায় খুব কমই যোগ দেয়। অফিসের বাইরের জীবন থেকে সে অফিসকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়।    

    তবে সরিয়ে রাখতে চাইলেও যে, সব সময় সরে থাকে তেমনটা নয়। মাঝে মাঝে অবচেতন মনের জানালায় উঁকি দেয় ফোনের ওপাশের না দেখা কাল্পনিক কোন মুখ। মানুষ প্রয়োজনে ফোন করে, অপ্রয়োজনেও অসংখ্যবার ফোন করে। কারণে, অকারণে গালি-গালাজ করে। চৌদ্দগুষ্ঠির পিন্ডি চটকায়। এরা কি মজা পায় তা কে জানে!  
তৃতীয় বিশ্বের কোন মানুষের দ্বারে প্রকৃত শিক্ষার আলো পৌঁছার আগেই যদি প্রযুক্তি পৌঁছে যায়, তবে সেই প্রযুক্তির কতোটা এবং কীরূপ অপব্যবহার হয় এবং সমাজে এর বিরূপ প্রভাব-ই বা কতোটা পড়ে, প্রতিদিন তার সাক্ষী হয়ে থাকছে সে।

    মানুষের এই অজ্ঞতা এবং সরলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুঁজিপতিরা ইচ্ছে মতো ব্যবসা করে নিচ্ছে। নানান রকম টোপ দিচ্ছে, অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষ কিছু না বুঝেই টোপ গিলছে। নিন্মবিত্ত, স্বল্প শিক্ষিত মানুষের সস্তা রুচিও পুঁজিপতিদের মুনাফা। বাংলাদেশ এবং পশ্চিবঙ্গের মফস্বলে রেকর্ডকৃত অশ্লীল কথার কিছু চটুল গান ‘টার্গেট পীপ্ল’ এর শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে। মানুষের ঘাম ঝরানো টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে। কারণে-অকারণে ব্যালেন্স কাটা হচ্ছে। কাস্টমার অভিযোগ করলে ভুলভাল বুঝ দিয়ে দোষ চাপানো হচ্ছে তার ঘাড়েই। কাস্টমার তো গালি দেবেই!

কাস্টমারকে ভুল বোঝানো এবং গালি খাবার জন্য তো তার মতো অসংখ্য পুঁজিবাদের দাস আছেই। তাদেরকে বোঝানো হয়েছে কাস্টমার এই গালি ব্যক্তি মানুষকে দিচ্ছে না, দিচ্ছে কোম্পানীকে। অতএব কাস্টমারের অশ্রাব্য গালি খেলেও কিছু বলা যাবে না। সৌখিন গালিবাজও প্রচুর।

‘কাস্টমার ইজ অলওয়েজ রাইট’ বোঝানো হয়েছে তাদের। ভুলেও মাথা গরম করা যাবে না। মাথা গরম করে কাস্টমারকে কিছু বললেই ফ্লোর ম্যানেজার ডাকিয়ে বলবে, ‘আপনি নিজে
রিজাইন দেবেন, নাকি আমরা...’

অতএব চুপ। শুধুমাত্র দাসত্ব করো। চাকরি ছেড়ে চলে যাবে? যাও। এইচ, আর ম্যানেজারের ফাইলে শত শত সিভি জমা পড়ে আছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দাসের অভাব নেই। তৃতীয় বিশ্বের নারী বাড়ির গাভীর সাথে পাল্লা দিয়ে সন্তান জন্ম  দেয়! অভাব অবিরাম ঘরের দরজায় কাঠঠোকরার মতো ঠোকরায়!

দীপও চাকরিটা ছাড়তে পারে না। বাড়িতে অবিবাহিত দুটো বোন। একটা কলেজে, আরেকটা স্কুলে পড়ে। বিধবা মা। টিউশনির টাকায় কোনমতে লেখাপড়া শেষ করে তাকে ঢুকতে হয়েছে ফোন কোম্পানীর এই কেয়ার লাইন এ। চাকরির বাজারে হাহাকার। ছাড়লে কে তাকে দেবে চাকরি? কে যোগাবে তিনশো কিলোমিটার দূরের এক গ্রামের বাড়িতে বাস করা তিনটে প্রাণের মুখের অন্ন। কে দেবে ফুলের মতো দুটো মেয়ের লেখাপড়ার খরচ!

সহকর্মীরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে। কোন এক নারী কাস্টমার একজনকে প্রেমের অফার দিয়েছে, এই নিয়ে হাসাহাসি। কেয়ারলাইন এ প্রতিদিন কত যে গল্প তৈরি হয়! কতো যে গল্প শুনতে হয় তাদের! দিনের গল্পের চেয়ে রাতের গল্পগুলো একটু অন্যরকম। অনেক গল্পই মর্মস্পর্শী, বেদনাদায়ক। অসংখ্য নিঃসঙ্গ কাস্টমার রাতে ফোন করে। আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। নিরর্গল ভাষায় বিগত জীবনের কথা বলে, ফোন রাখতে চায় না। সময় কাটাতে চায়। কথা বলতে না চাইলে সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যার হুমকিও দেয় কেউ কেউ। উচ্চবিত্ত থেকে নিন্মবিত্ত, সবাই আছে এই তালিকায়। এই যে সকালের আলো ফুটতেই মানুষ কাজে যাচ্ছে, দিনভর নানা জায়গায় কাজ করছে, সকলের সঙ্গে হাসি-তামাশা করছে; এটা মানুষের বাইরের রূপ। এর বাইরেও মানুষের ভেতরে আরো একটি রূপ আছে। বাইরের পরিবেশে মেশার সময় অনেকেই সুখে থাকার ভান করে, ভান করতে হয়। কিন্তু সেই মানুষগুলোই যখন একা হয়, নিজের মুখোমুখি হয়, তখন তার ভেতরের অসুখটি বেড়ে যায়। হাজারো মানুষের মনে হাজারো অসুখ, অসুখে কাতর মানুষ উপশমের জন্য ছটফট করে কিন্তু দাওয়াই খুঁজে পায় না। কতো যে অসুখী মানুষ ফোন করে তাদের একান্ত গোপন কথা জানাতে চায় তার কোন হিসেব নেই। দীপের ইচ্ছে করে তাদের কথা শুনতে, কথা শুনে তাদেরকে খানিকটা সুখী করতে। কিন্তু সে তো দাস, কাস্টমারের যাপিত জীবনের ব্যথার কথা শোনার জন্য তাকে রাখা হয়নি। সঙ্গত কারণেই কাস্টমারকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ফোন রাখতে হয়। কেয়ার লাইনে চাকরি না করলে দীপ হয়তো জানতেই পারতো না সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের ভেতরের এতরকম গোপন অসুখের কথা!   

সহকর্মীদের হাসাহাসিতে রাতের প্রবীণ লোকটির কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো ঐ নীতা নান্মী নারীর কথাও। কী সুন্দর সুরেলা গলা! নীতার কথা মনে হতেই মোবাইলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানটা ছেড়ে কানে এয়ারফোন লাগালো দীপ।

গাড়ি ফ্লাইওভারে উঠে কালশীর দিকে ছুটে চলেছে। জানালার কাঁচে শিশির হাসছে, কান্নার মতো ঝরে পড়ছে। আকাশটা নীল নয়, ভীষণ ধূূসর।
কালশীর মোড় থেকে গাড়ি বায়ে বাঁক নেয়। শীতে জবুথবু দু-চারজন মানুষ কুয়াশাকে কুর্নিশ করে হেঁটে যাচ্ছে। দোকানের সামনে কুকুরের মতো কুন্ডলী পাকিয়ে আপাদমস্তক কাপড়ে মুড়ে শুয়ে আছে পথমানব। হেমন্তবাবু গাইছেন-       
এই বেদনার ইতিহাস শুনেছ কি,
দেখেছ কি মানুষের অশ্র“, শিশিরে শিশিরে ঝরে
তুমি দেখেছ কি!
অসীম আকাশ, তারই নিচে চেয়ে দেখ ঘুমায় মানুষ
জাগে শুধু কত ব্যথা হাহাকার
ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট আশা
কে রাখে খবর তার
তুমি দেখেছ কি!

গানে বুঁদ হয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে দীপ। ধূসর আকাশ-কুয়াশা ফুঁড়ে আসে পৃথা। পৃথা এখন কী করছে? হয়তো ঘুমিয়ে আছে নরম বিছানায় কারো রোমশ বুকে মুখ গুঁজে! পৃথা বলেছিল, ‘একজন কলসেন্টার এক্সিকিউটিভকে আমার বাবা তার মেয়ের জামাই হিসেবে কখনওই মেনে নেবে না। তুমি দ্রুত অন্য চাকরি খোঁজো।’  
খুঁজেছিল দীপ। পায়নি। না চাকরি, না পৃথাকে।
মিরপুর ঝুটপল্লীর জমানো কুয়াশায় পৃথা হারিয়ে যায়। বিষাদে-ক্লান্তিতে দীপের মাথাটা নুয়ে পড়ে বায়ে। হেমন্ত বাবু গেয়ে চলেছেন-
আর শুনেছ কী মানুষের কান্না
বাতাসে বাতাসে বাজে
তুমি দেখেছ কি....’

আপনার মন্তব্য