তেরো এপ্রিল

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-০৭ ১৪:১৯:০৫

রায়হান রহমান রাহিম:

ত্রপা ঘুমুচ্ছিলো এতক্ষণ৷ হঠাৎ জেগে উঠেছে৷

তখনও সন্ধ্যা মিলায় নি; দূরের খাস্তি নদীর মাথায় আকাশ বিষণ্ণ গম্ভীর,যেন তার ভীষণ মন খারাপ হয়ে আছে৷

ত্রপার মনে পড়লো আজ তেরো এপ্রিল৷ আজ এক বিশেষ দিন৷

হাসান হাঁটছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় গেট থেকে শিবগঞ্জের দূরত্বটা রিকশা নেওয়ার মত হলেও সে প্রায় দিনই হেঁটেই চলে যায়৷ টিউশনিতে যাবে৷ সামনের মাসে ছাত্রীর পরীক্ষা,আজও হয়তো আধঘণ্টা বেশি পড়াতে হবে৷

ছাত্রীটি ক্লাস সেভেনে উঠেছে এ বছর৷ যথেষ্ট মেধাবী হলেও, হাসানের তাকে পড়াতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে৷ সে ইংলিশ মিডিয়ামের অন্যান্য বাচ্চাদের মত চটপটে নয়৷

প্রায় দিনই দেখা যায়- হাসান বেশ আগ্রহ নিয়ে হয়তো তাকে কোন একটা বিষয় বোঝাতে চায়, অথচ তার মন সেখানে নেই! বদমেজাজি ছেলে হিসেবে বন্ধুমহলে হাসানের সুনাম আছে৷ এ জাতীয় সময়গুলোতে তার পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন কাজ হয়ে যায়৷ তবুও সে যত্ন করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে৷

আজকাল টিউশনি পাওয়াটা যেন অমাবস্যার চাঁদের মত,তার উপর মনের মত বেতন- দুর্দিনে কে হাতছাড়া করতে চায়?

হাসানের মোবাইল বাজছে৷ পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সে খেয়াল করল-যে নাম্বার থেকে ফোনটা এসেছে,নাম্বারটা কেমন যেন চেনা চেনা৷ পরিচিত কেউই হয়তো৷

হাসান চিনতে না পেরে, রিসিভ না করেই মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে ৷ তৃতীয়বারে প্রায় বাধ্য হয়েই রিসিভ করলো৷ ও পাশ থেকে একটি নারীকন্ঠ শোনা যাচ্ছে৷ কণ্ঠটি ত্রপার,সেটি হাসানের বহুদিনের পরিচিত৷ কোন এক আশ্চর্য কারণে হাসানের বুক কেমন ঢিপঢিপ করছে, ঠিক প্রথমদিন ত্রপার ফোন রিসিভ করার মত৷ হাসান এর কারণ বুঝতে পারছেনা৷

- হাসান,কেমন আছো?
- আমি ভালো আছি ত্রপা৷
- তুমি?
- ভালই৷
- এত চিৎকার-চেঁচামেচি কিসের?
- রাস্তায় হাঁটছি, এ কারণে এত শব্দ হচ্ছে৷
- তোমার হাঁটাহাঁটির স্বভাবটা রয়েই গেছে তাহলে!
- টিউশনিতে যাচ্ছি৷
- বাপরে! আজকাল টিউশনিটাও করা হয়?
- খুবই নিয়মিত৷ সামনের মাসে ছাত্রীর পরীক্ষা৷
- ছাত্রী?
- বাচ্চা! ক্লাস সেভেন, সেকেন্ড গার্ল, স্কলার্সহোম! হাসছ কেনো?
- না, এমনি! তুমি পাগল, পাগলই রয়ে গেল৷ যাইহোক!
- যাইহোক?
- আজ তেরো এপ্রিল৷

হাসান একটু থেমে গিয়ে, বললো-তোমার মনে আছে, সাতটায় সজল স্যারের কেমিস্ট্রি কোচিং মিস দিয়ে এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে কতদিন বসে থাকতাম?
- তুমি একদিনও চুল আঁচড়িয়ে আসতে না৷ ঘুম থেকে উঠেই দৌঁড়৷ ইশ! কি যে বিচ্ছিরি লাগতো! তোমার মনে আছে কতদিন আমি তোমার চুল আঁচড়িয়ে দিয়েছি? চুল আঁচড়ালে কিন্তু তোমাকে বোকা বোকা লাগে! হাসবেনা, সত্যিই বোকার মত লাগতো৷
- মুহিব ভালো আছে ত্রপা?
- তেরো তারিখে তুমি যেদিন ঘোষণা দিয়ে প্রেম ভেঙে দিলে,সেদিন রাতে তোমার দেয়া সিগারেটটি খেয়েছিলাম৷
- তোমরা এসব বাজে বিশ্রী জিনিস কিভাবে যে খাও তোমরাই জানো, ছিঃ!
- সিগারেট খেয়েছো? তুমি? আশ্চর্য তো!
- হাসান কবিতা শুনবো৷
- রাস্তায় আছি বললাম না?
- আমি কিছু জানিনা,কবিতা শোনাও!

হাসান কবিতা খুঁজে পাচ্ছেনা৷ হঠাৎ সে বিড়বিড় করে আবৃত্তি করতে শুরু করলো - আমাকে ছেড়ে যাবার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো। তোমার খবরের জন্যে যে আমি খুব ব্যাকুল এমনটি নয়.......
- হাসান থামো৷ মুহিব ভালো আছে৷ মুহিবের মোহের মুগ্ধতাদের ইতি হয়েছে বহুদিন আগেই৷ তবে আমি ভালো নেই৷ পড়,তুমি হাসান এবার কবিতা খুঁজে পেয়েছে৷
বিড়বিড় বাদ দিয়ে সে ভরাট গলায় কবিতা পড়তে শুরু করেছে –

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক’রে উঠবে দরজাজানালা আর তোমার হৃৎপিণ্ড।
পর মুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠাণ্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুত শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।

আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চুড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।

না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্রধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।

তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তনপ্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খসে প’ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পর মুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।

শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশশতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।

পৃথিবী এখন দু'টি মানুষে স্থির৷

হাসান হাসছে,ল্যাম্পপোস্টের অভাবে কেউ তার সে হাসি দেখতে পাচ্ছেনা৷
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এসেছে৷
ত্রপার রুমের বাতিটা নেভানো৷

ত্রপা কাঁদছে,সেটিও কেউ দেখতে পাচ্ছেনা ৷

আপনার মন্তব্য