প্রকাশিত: ২০১৬-০১-১৬ ১৪:২৩:৪১
রিন্ভী তুষার:
কল্পনা-জল্পনা শেষে, প্রায় পনের বছরের কল্পনার অবসান ঘটিয়ে জল্পিত কাহিনীর কল্পিত রূপ গল্পিত হতে যাচ্ছে।
মনে করেন যে, সময়টা ১৮৯৬ কিংবা ৯৫। অথবা তারও প্রায় ১০০ বছর, ১৯৯৫ কিংবা ১৯৯৬। দিনটা! দিনটা কারো মনে আছে বলে মনে হয় না। আমারও মনে নেই। এই সালগুলো কেন বিখ্যাত? আইনস্টাইনের জন্ম হয়েছিলো? তার কিছুকাল পর বিদ্রোহী কবি নজরুলের? কিংবা নামকরা কোন ধর্মগুরুর অন্নপ্রাসন বা হাঁটতে শেখা শুরু? জানি না। ১৮৯৫-৯৬ হতে ১৯৯৫-৯৬ একি ঘটেছিলো? বা শুধু ১৯৯৫-৯৬ একি ঘটেছিলো? জানি না, বলতে পারবো না। তবে “কল্পনা” করতে পারবো। হুম, “কল্পনা”টা ঠিক ঠিক কল্পনা করতে পারবে।
- আচ্ছা স্যার, কোন নারীকে জোরপূর্বক অপহরণের পর তাকে হত্যার আগে ধর্ষণ কি বাধ্যতামূলক?
স্যার - দেখো, বিষয়টি “কল্পনা” করো।আর সব অপহরণ কি জোরপূর্বক হয়? কিছু স্বেচ্ছায়ও হয়।
আর ধর্ষণ, ধর্ষণ কি? ধর্ষণ তো “কল্পনা”। আমাদের যুদ্ধের মহড়ায় ব্যবহার হওয়া ডামি গোলাবারুদের মতো। শুধুই “কল্পনা” মাত্র।
আমি তখন ছোট। তবে “কল্পনা” করতে পারি। সন্ধ্যা হতেই শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। বিকালের পরই রাত। মাঝে সন্ধ্যা বলে কিছু নেই। তখন সন্ধ্যা প্রায়ই জোরপূর্বক অপহৃত হয়। তারপর সরকারী ঘোষণায় নিখোঁজ হয়ে যায়। সন্ধ্যার একটা কল্পিত ছবিসহ লিফলেট রাতের আধাঁরে ছাপা হয়। তারপর তা দিনের আলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
আমি তখন প্রায়ই দিনের আলোতে পাহাড়ে যাই। পাহাড়ে গিয়ে গাছেদের, ফুলেদের, পাখিদের, লতা-পাতাদের রাত জেগে ঘুম পাহারা দেবার কারণ জানতে চেষ্টা করি। পাহাড়, লতা-পাতা, ফুল বেঁচে থেকে আমাকে আনন্দ দেয়।
-আচ্ছা স্যার, উঁচু পাহাড়েই সবসময় অবস্থান নিতে হয় কেন?
স্যার- উচ্চতাকে কাজে লাগানো সহজ হয়।আর আমরা তো “চীর উন্নত মম শির” এটা কি তুমি জানো না?
আমি কিছুটা নির্মম ছিলাম। প্রায় ৪৭টি ফড়িং আর ৮টি প্রজাপতি হত্যা করেছিলাম। কোন বিভাগ এই জন্য কোন জবাবদিহিতা আমার কাছে চায় নি। আমিও দেই নি। কোন অধিকারে ফড়িং আর প্রজাপতি সবুজে উড়ে বেড়ায়? এই অধিকার ওদের কে দিয়েছে? ওদের কোন অধিকার নেই। অধিকারটা ওদের “কল্পনা”।
ফড়িং মেরে হাফ-সেঞ্চুরি করতে না পারার একটা যন্ত্রণা ছিলো। তবে কোন বেদনা ছিলো না।
-স্যার, মিশনটা কি আনসাক্সেসফুল?
স্যার- নো কমেন্টস, নো কমেন্টস। আর কিছু ফড়িং, প্রজাপতির মৃত্যু নিয়ে এত হৈচৈ করাটা কি খুব দরকার? তোমার কি মনে হয়?
পাহাড়ে আলোটা গড়াতে পারে না ঠিক। কেমন যেন, ছোপ ছোপ হয়ে লেগে থাকে। এক রকমের লাল রঙের তরল যোজককলা। আইমিন লিকুইড যোজক (যোজক ইংরেজিটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না) ব্যানানা’র মতো। তবে অন্ধকারটা বেশ গাঢ় সবুজ। অনেকে কালো ভেবে ভুল করলেও, আসলে সেটা ছিলো এক রকমের ফল রঙা সবুজ। একটা আহত ফড়িং নিহত হবার আগে আমাকে বলেছিলো কথাটা। এই ফলরঙা সবুজ অন্ধকারটা বেশ অদ্ভুত। পাহাড়ের গায়ে এমনভাবে মিশে থাকে, দিন কিংবা রাত কখনোই একে আলাদা করা যায় না।
স্যার- দেখো, এই সবই বাকোয়াস। ফড়িং, প্রজাপতি এইসব জংলি জানোয়ারের বংশ, ভাষা এই সবের কোন ঠিক আছে? সে কি করে বুঝলো তাগো ভাষা? আর মরার সময় ফড়িং- এর খায়া কামনাই রং-ঢং, আলো অন্ধকার নিয়া কথা বলবে! ট্র্যাস, যত্তোসব। এই সবই “কল্পনা”।
৪৭টি ফড়িং আর ৮টি প্রজাপতি হত্যার পরও আমার কখনো কোন গর্তে পা ঢুকে যায় নি। “কল্পনা” তেও কোন ক্ষতি হয় নি।
আমার একটা বন্ধু ছিলো। নাম ছিলো ফোরকান। আমরা বলতাম ফোরকান- চারকান। আমি সেদিন স্কুলে যাইনি। ও দুপুরে বাসায় এসে বললো- চল, একাডেমী যাবো। একাডেমীর মেম্বার হলে বই পাওয়া যাবে। আর কি কি যেন বললো, সব কিছু মনে নেই। একাডেমীর সেই বই পড়া ফাঁকি দিয়ে আমরা দুই বন্ধু দোলনায় চড়তাম। “দশ টাকার তখন অনেক দাম”। আমি একা হয়ে গেলাম।
আমি কিছু পাহাড় চিনতাম। একটা খালকে তার ভুল পরিচয়ে নদী বলে জানতাম। তার আসল পরিচয় আমি কখনোই জানতে পারি নি। কিছু কিছু গাছ, লতা- পাতা আর একটা উঁচু ঢিবি, যেখানে শেয়াল মানুষের হাড়-গোড় এনে খেতো; ঐ জায়গাটা চিনতাম। কিন্তু শেয়ালটার সাথে আমার কোন পরিচয় ছিলো না। পথ চলতে চলতে নাকি টাকা পাওয়া যায়, আমি তাই দেখে শুনে পথ চলতাম। “টাকা হলে বন্ধুকে পাওয়া যেতে পারে”।
স্যার- না, না, এসব মিথ্যা কথা। কি বলে এসব? জানে না! চিনে না! সবই জানে, সবই চিনে।
সময়টা সব সময়ই বেয়াড়া। কথা শুনতে চায় না। বলছিলাম ১৯৯৫-৯৬ এর কথা। হঠাৎ আবার ১৯৯৭ চলে এলো। নদীতে অনেক চর পড়ছিলো তখন। নদীদের তখন বেশ দিনক্ষণ হিসাব করে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। নদীদের কাছে তাদের জায়গার মালিকানার প্রমাণ দেখতে চাওয়া হয়। দলিল নিয়ে কোর্টে হাজির হতে নির্দেশ দেয়া হয়। নদীদের তখন থেকেই বোধহয় বেশ কাহিল অবস্থা (যা হোক এটা নিয়ে গল্পটা পরে লিখছি)। হঠাৎ করে না, নদীর চরগুলো ১৯৯৭ সালের দিকে পাহাড়ের গায়ে উঠে পড়ে। আইমিন- দূরবর্তী শাখা খুলে বসে পড়ে আর কি।
কেউ কেউ বলে না-না সালটা ঠিক নাই। কেউ বলে ঠিকই আছে। ’৮৫ সালে ব্যাটা জন্মাইলে সন দেখি ’৮৭ লিখলে চলবো? যদি ৯৭ লেখা হয় তয় ৯৭ হইতেই গুনতে হইবো, ৭৭ লিখলে ৭৭।
সাল গণনায় আমি খুব কাঁচা। নিজের বয়সটাও ঠিক হিসাব করে বলতে পারি না। ঐ যে বলেছিলাম একা হয়ে গেলাম। টাকাটা মানে ঐরকমের কাগজটা ভালোই চিনেছিলাম। পথেঘাটে তাই খুঁজে-খুঁজে চলি।
সেদিনও তেমনি চলছিলাম। একাডেমী থেকে বের হয়ে, বড় মাঠটা ফেলে, পার্কটার দিকে ফিরে মুচকি হেসে- সে ভালো আছে কিনা জেনে, হাঁটছিলাম। কিছুটা আনমনা ছিলাম। ছোট হলেও মন বলে কিছু একটা ছিলো বোধহয় তখন।
হঠাৎই গায়ে একটা কাগজের দলা এসে পড়লো। একটা সবুজ ফলরঙা পিক-আপ আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়ীটা থেকেই দলাটা এসেছে। গাড়ীটা আমি চিনি। বহুবার রিলিফের বড় বড় বিস্কুটের আশায় ওই রকম গাড়ী দেখলেই আমি, আমার বন্ধুরা দাড়িয়ে পড়তাম। তারপর গাড়ীর পেছন পেছন হাঁটতাম। গাড়ীটা আমাদের দলের ছিলো। আমরা তাই জানতাম। আমি খুব উত্তেজিত হয়েছিলাম। “কল্পনা” করেছিলাম নিশ্চয়ই টাকা। “কল্পনা”তেও কি বোকা ছিলাম আমি। কাগজের দলাটা লিফলেট ছিলো।
আবার একটা গোধূলি বিকালের পরপরই, কিন্তু সন্ধ্যাতে নয়, কিন্তু রাত্রিবেলা বাড়ি ফেরে নি। সূর্য ছাড়াই গোধূলির একটা গলিত সাদাকালো ছবি ছিলো লিফলেটে। সন্ধান-দাতার জন্য অনেক বড় অংকের একটা পুরস্কারের ঘোষণাও ছিলো লিফলেটটিতে।
আমি তাকে চিনতে পারি। “কল্পনা”তে তাকে দেখেছিলাম। সে আমাকে ফড়িং আর প্রজাপতিদের সবুজে, পাহাড়ে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা বলেছিলো। সে যে ফড়িং আর প্রজাপতিদের “কল্পনা” তা আমার চিনতে একটুও ভুল হয়নি। কারণ আমিই এই “কল্পনা”কে ফলরঙা সবুজ অন্ধকারদের চিনিয়ে দিয়েছিলাম। ফড়িং, প্রজাপতিদের অধিকার “কল্পনা” করতে বলায় আমি একটা পাহাড়ে ঐ “কল্পনা”টাকে পুঁতে ফেলতে একটা গর্ত করেছিলাম। যদিও পাহাড়ের কোন গর্ত কোনদিনও আমাকে আহত করেনি।
- স্যার, এই সব বিষয়ে আপনি কিছু বলবেন?
স্যার- তুমি আর কিছুক্ষণ পর তার কাছে থেকে গল্পটা আবার জানতে চেয়ো। তার ওই বক্তব্যই হবে আমার সঠিক মন্তব্য।
আমার সমস্ত বয়ান শুধুই “কল্পনা” নিয়ে।
শুধুই “কল্পনা” মাত্র।
আপনার মন্তব্য