আত্মজীবনী

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-২২ ১২:৩৬:১৯

ফরিদ আহমেদ:

শরৎচন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথ খুব স্নেহ করতেন। তিনি প্রায় নিয়মিতভাবেই রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতেন। নানান বিষয়ে দুজনের আলাপ আলোচনা হতো। রবীন্দ্রনাথই বেশি বলতেন, শরৎচন্দ্র মন দিয়ে শুনতেন। মাঝে মাঝে সলজ্জভাবে নিজের মতামতও দিতেন।

একদিন রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে বলেন যে, “শরৎ, তোমার জীবন সম্পর্কে লোকের বড় কৌতূহল। আমার জীবনস্মৃতির মত তুমিও তোমার জীবনের কথা লেখো। সেই লেখা পড়ে বাংলার পাঠকসমাজ তোমার জীবন সম্বন্ধে জানতে পারবে।"

উত্তরে ঘাড় গুঁজে শরৎচন্দ্র বলেন যে, “গুরুদেব, সেটা বোধহয় সম্ভব না। আমার জীবন তো আপনার মত ভালো কিছু না। আগে বুঝতে পারি নাই যে এত বড় হবো। কীভাবে কীভাবে যেনো হয়ে গিয়েছি। বুঝতে পারলে, আগে থেকে একটু সমঝে টমঝে ভালো হয়ে চলতাম। জীবনীতে ভালো ভাল কথা লেখা হতো। তা তো হয় নি। এখন ওগুলো লিখতে গেলে বড় লজ্জার বিষয় হবে। লোকে নিন্দে-মন্দ করবে। আমার বই আর কেউ কিনবে না। তাই, এই জীবনে আমার আর আত্মজীবনী লেখা ঠিক হবে না।"

শরৎচন্দ্রের উত্তর শুনে রবীন্দ্রনাথ গোঁফের ফাঁকে মুচকি হাসলেন। মনে মনে বললেন, “নাহ! ছোকরাটা বরাবরের মতো গাধাই রয়ে গেলো। আরে ব্যাটা! আমি আমার জীবনে কী কী অকাম -কুকাম করেছি, তা কি তুই জানিস? এঁড়ে বাছুর থাকার সময়েই আমার জন্য আমার বড় ভাইয়ের বউ বিষ খেয়ে মরেছিলো। সেই নিয়ে সেকি কেলেঙ্কারি! ঘরে-বাইরে সব জায়গায়। কতো কিছু করে ধামাচাপা দিতে হয়েছিলো তা। তারপরে আরো কতো কী! ভাস্তিকে লেখা চিঠিগুলো পর্যন্ত আমার এডিট করে প্রকাশ করতে হয়েছে। ওগুলো কি আমি লিখছি নাকি আমার জীবনীতে কোথাও?”

‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’এই কথা বলা রবীন্দ্রনাথও তাঁর আত্মজীবনীতে সব কথা লেখেন নি, অনেক কিছু গোপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ গোপন করলেও, তাঁর কথা অনুযায়ী সেগুলো অবশ্য গোপন থাকে নি চিরকাল। কেউ কেউ জেনে গেছে সেগুলো। এই যেমন জানতেন হুমায়ূন আজাদও। তিনি কিশোর-কিশোরীদের জন্য অত্যন্ত সরল, প্রাঞ্জল, গতিময় এবং অনুপম ভাষায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন। বইটার নামও কবিতার মতো সুললিত, অপূর্ব সৌন্দর্যময়। সেই কাব্যধর্মী বইয়ের নাম লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী। সেই বইতে তিনি রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর সব কথা তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন নি, সেটা বলেছেনে এভাবে,

“রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান। বাল্যকাল থেকেই তিনি সাহিত্যে উৎসাহী ছিলেন। তাঁদের বাড়ির সবাই ছিলেন সাহিত্যে উৎসাহী। তাঁর পিতা ছিলেন লেখক, বড়ো ভাইয়েরা ছিলেন লেখক, বড়ো বোন ছিলেন লেখিকা। তিনিও তাঁদের দেখাদেখি লেখা শুরু করেছিলেন শিশুবয়সে। তিনি ভালোবাসতেন কবিতা পড়তে, ভালোবাসতেন গাছপালার সৌন্দর্য দেখতে। গাছপালা অর্থাৎ প্রকৃতিই ছিল তাঁর বড়ো শিক্ষক। স্কুল তাঁর ভালো লাগতো না। স্কুলের দেয়ালগুলো মনে হতো পাহারাওলাদের মতো কঠোর। তাঁর জীবনকাহিনী তোমরা তাঁর নিজের লেখা দুটি বই থেকে জেনে নিতে পারো। সে-বই দুটি হচ্ছে জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলা। এ-বই দু’টিতে তিনি নিজের কথা বলেছেন মধুর ক’রে; তবে তাঁর আরো অনেক কথা ছিলো বলার, কিন্তু বলেন নি। তাঁর গোপন কথা তিনি গোপন ক’রে গেছেন, কেননা আমাদের সমাজ হচ্ছে গোপনীয়তার সমাজ। সব সত্য এখানে প্রকাশ করা যায় না।“

একা রবীন্দ্রনাথকে দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই। সরল সত্যি হচ্ছে যে, আত্মজীবনীতে কেউই তাঁদের জীবনের কালো অংশকে তুলে ধরেন না। শুধু ভালোটাকেই আলোঝলমল করে তুলে ধরেন তাঁরা। এমনভাবে লেখেন যেনো কোনোদিন কোনো খারাপ কাজ তাঁকে দিয়ে হয় নি, কোনো ক্ষুদ্রতা তাঁকে কখনো স্পর্শ করে নি, কাউকে তিনি কষ্ট দেন নি, যা কিছু কষ্টের নীল বেদনা, তা সবই তিনি একাই নীলকণ্ঠ পাখি হয়ে পান করেছেন আকণ্ঠ। শুধু যে যাঁরা আত্মজীবনী লেখেন, তাঁরাই এই কাজটা করেন, তা নয়। যাঁরা অন্যের জীবনী লেখেন, তাঁরাও একই কাজ করেন। কারণ, সাধারণত দেখা যায় যে, বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়স্বজন বা রক্তসম্পর্কীয় কেউ মৃত ব্যক্তির জীবনী লিখে থাকেন। স্বভাবতই তাঁরা চান না যে মৃত ব্যক্তির কোনো খারাপ অংশ প্রকাশ পাক। সেটার মাধ্যমে তাঁর কোনো অবমাননা হোক। মানুষ যে দোষে-গুণে মিলিয়েই হয়, সেটা আমাদের এই সমাজ সহজে মেনে নিতে পারে না। হয় ফেরেশতা বানাতে হবে কাউকে, নতুবা শয়তান। এর মাঝামাঝি কিছু নেই।

হুমায়ূন আজাদের ভাষ্য অনুযায়ী, “কোনো বাঙালি আজ পর্যন্ত আত্মজীবনী লেখে নি, কেননা আত্মজীবনী লেখার জন্য দরকার সততা।“এই সততাটা কারোরই নেই। সবাই আছে নিজেকে মহান করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। অন্যের চোখে নিজেকে কীভাবে ভালো মানুষ প্রমাণ করা যায়, সচ্চরিত্র, উদারপ্রাণ, দয়ালু হিসাবে দেখানো যায়, তার জন্যে আগ্রহটা একটু বেশিই সকলের। সে কারণেই তাঁর মতে, “বাঙালির আত্মজীবনী হচ্ছে শয়তানের লেখা ফেরেশতার আত্মজীবনী।“

এই ফেরেশতা আত্মজীবনী নিয়ে আহা-উঁহু করে আহ্লাদে মাতা যায় হয়তো, আসল সত্য জানা যায় না কিছুতেই। যায় না জানা জীবনীর পিছনের আসল মানুষটাকে। চিনতে পারা যায় না তাঁকে পরিপূর্ণভাবে। খণ্ডিত চিত্র নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় সবাইকে আজীবন। এর ব্যতিক্রম যে, দুই একটা নেই, তা অবশ্য নয়। কেউ আবার নিজেকে সাহসী এবং সৎ প্রমাণ করতে বানিয়ে বানিয়ে খারাপ অংশগুলো বেশি লেখেন। এটা অবশ্য ব্যতিক্রম হিসাবেই স্বীকৃত।

আপনার মন্তব্য