শাহ আব্দুল করিমের গানে শোষণহীন সমাজচিন্তা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১০ ১৮:২১:৫৫

দীপংকর দাশ গুপ্ত:

সুন্দরবনের রামপালে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। সুন্দরবন ধ্বংসী, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই আন্দোলন শুরু হয়েছে “ তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুত-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’’-র উদ্যোগে। অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা-রামপাল লংমার্চ। সারাদেশ থেকে প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি সাধারণ ছাত্র সমাজ অংশ নিয়েছে লংমার্চে। আন্দোলনকে গতিশীল করতে নানান প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, নাটক, কবিতা। সকলেরই এক দাবী, নব্য সম্প্রসারনবাদী ভারতের সাথে অসম চুক্তির মাধ্যমে আমাদের দেশের সম্পদ, আমাদের গর্ব, প্রকৃতির অপরূপ নিদর্শন বিশ্বের সর্ববৃহৎ নোনা পানির বন সুন্দরবন ধ্বংস করা যাবে না। বিদ্যুতকেন্দ্রের বিকল্প আছে কিন্তু সুন্দরবন এর কোন বিকল্প নেই। এটি বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে জাতীয় সম্পদ রক্ষার দাবীতে চলমান একটি আন্দোলন। একই ধরনের নানান দাবীতে উপনিবেশিক আমল থেকে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতন কালীন সময় এবং তৎপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। এ আন্দোলনগুলোতে নানান পেশাজীবী, রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃবৃন্দের যেমন অবদান ছিল, তেমনি অবদান ছিল সংস্কৃতিকর্মীদের, বিশেষভাবে আন্দোলনের
উদ্দেশ্য গণমানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সচেতন ও সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে।

তেমনি একটি আন্দোলন হয় ১৯৫৪ সালে। সিলেটের হরিপুরে আবিষ্কৃত হয় তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র। সেই তেল গ্যাস অধিগ্রহণ করার স্বার্থে দেশীয় দালাল গোষ্ঠীর সাথে আঁতাত করে সাম্রাজ্যবাদ গোষ্ঠীর অপতৎপরতা শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবেই দেশের প্রগতিশীল নাগরিক এর প্রতিবাদ করেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামে গঞ্জে মানুষজনকে সচেতন ও আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রচারনা শুরু হয়। সেই সময় সিলেটের সুনামগঞ্জের একজন বাউল “তেল চোরা” দের নিয়ে একটি গান লিখেন, নানান জায়গায় গেয়ে বেড়ান;

“ হরিপুরে হরিলুট কেন, দেশবাসী কি খবর জানো;
তেলচোরা তেল নিল শোন, এদেশকে করতে চায় শ্মশান।”

বাউলের গানে ফুটে ওঠে জাতীয় সম্পদ রক্ষার তাড়না। দেশের জন্য খনিজ সম্পদ কতটুকু মূল্যবান, তিনি তাঁর গানে তা ফুটিয়ে তুলেন। করেন দেশবাসীকে সংগঠিত করার চেষ্টা।

“এইভাবে তেল দেওয়া যায় না, দেশবাসী তা মানতে চায় না
করেন সবাই বিবেচনা, এই তেল মায়ের দুধের সমান
সম্পদ দেশবাসীর হয়, ব্যক্তিগত মালিক কেউ নয়
রয়েছে তেল চোরারই ভয়, দেশবাসী হও সাবধান...”

বর্তমান সময়ে বসে এই গানের কথাগুলো যদি বিবেচনা করি তাহলে মনেই হয় না এই গানের রচয়নকাল ১৯৫৪। বর্তমানে আমরা যারা দেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার দাবীতে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি, ১৯৫৪ সালে রচিত ওই গানের প্রতিটি শব্দের ভাবার্থ তো আমাদেরই মনের কথা। বাউলের সেই গানে সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের চরিত্র ও ষড়যন্ত্র অত্যন্ত সহজ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে, একই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা, মমত্ববোধ। সহজ-সাবলীল ভাষার সাথে গ্রাম বাংলার মাটির সুর মিশ্রিত গাওয়া ওই গান গণমানুষের হৃদয়ের অন্তঃপুরে নিশ্চিত ভাবেই নাড়া দিয়েছিল।

বাউলের নাম শাহ আব্দুল করিম, জন্ম দিরাই উপজেলার উজানধল(ধলআশ্রম) গ্রামে। গ্রাম বলতে এখন আমরা যেমন বুঝি তেমনটি না। এখনতো গ্রাম মানে অনেকটা নগরেরই ছায়া। পাকা দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ঘরে ঘরে টেলিভিশন, স্কুল-কলেজ সবকিছুই বিদ্যমান। কিন্তু তখন মাটির রাস্তা ছিল, গ্রীষ্মের দিনে ওই রাস্তায় ধূলা উড়তো, মাটিতে সোঁদা গন্ধ ছিল, সূর্য উঠার আগেই পান্তা ভাত খেয়ে কৃষক মাঠে যেতেন হাল চড়াতে, ছেলে মেয়েরা একসাথে নদীতে সাঁতার কাটতো, সদ্য বিবাহিতা পল্লীবধূ পুকুরের জলে গোসল সেরে বিকালে উঠানে পিঠা বানাতেন, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাওয়ার বাহন বলতে শুধু নৌকা।

এরকমই এক গ্রামে বাংলা ১৩২২ সালের ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার জন্মগ্রহণ করেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, মরমী সাধকদের সংস্পর্শে আশা, বাউল হয়ে ওঠা সকল কিছুর সূচনা এ গ্রামেই। বিশাল পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় পরিবারের নানান সংকট-সমস্যা, জমিদার, জোতদার, মহাজনদের অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ সকল কিছুই প্রত্যক্ষ করেছেন নিজ চোখে। আমরা বাউল আব্দুল করিম এর পরিবারের যে প্রতিচ্ছবি পাই নানান গানে, তা মূলত সমগ্র দেশের প্রতিটি গ্রামের অসংখ্য পরিবারেরই প্রতিচ্ছবি।

জীবনের প্রতিটি সময়েই তাকে লড়াই করতে হয়েছে, কখনো এ লড়াই দারিদ্র্যতার সাথে, কখনো জমিদার-মহাজনদের সাথে, কখনোবা গ্রামের প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীদের সাথে। এসকল লড়াইয়ে কখনো তিনি জয়ী হয়েছেন, কখনোবা হয়েছেন পরাজিত। তবে তার রচিত গানে তিনি এ সকল সংকট-সমস্যা, অত্যাচাআর-নির্যাতন, শোষণ-লুন্ঠণ এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা থেকে আমরা তৎকালীন গ্রাম বাংলার গণমানুষের জীবনাচরণ দেখতে পাই, জানতে পারি তিনি কেমন সমাজ প্রত্যাশা করেছিলেন, দেখতে পাই সমাজের বহুরূপী নিদর্শন।

আমরা অনেকেই ভাবি না, চিন্তা করি না। কিন্তু আব্দুল করিম ভাবতেন, চিন্তা করতেন, স্বপ্ন দেখতেন একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থার। যে সমাজে একজন কৃষক তার ফসলের ন্যায্য হিস্যা পাবে, একজন শ্রমিক তার ন্যায্য মজুরী পাবে, যে সমাজ এইমাত্র জন্ম নেওয়া একটি শিশুর মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিবে, একজন বৃদ্ধ চাষীকে যে সমাজে পরিবার সমেত মাসে ৭দিন অনাহারে কাটাতে হবে না। তার ভাবনাগুলি, চিন্তাগুলি, স্বপ্নগুলি তিনি ফুটিয়ে তুলতেন তার শব্দ গাঁথুনিতে;

“বাউল আব্দুল করিম বলে সূক্ষ্ম রাস্তা ধরো,
শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে বাঁচার উপায় করো”

তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, তিনি ছিলেন গণমানুষের গায়েন, সুনামগঞ্জবাসীর “পীর সাব”। মানুষের দুঃখ দুর্দশার নানা চিত্র তার গানে ফুটে উঠতো, গানের সুরের সাথে ভেসে আসতো অন্তর্নিহিত কষ্ট, শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের দীর্ঘঃশ্বাস ফেরী হয়ে বেরাত তার গানে;

“এই কি তোমার বিবেচনা, কেউ যে খায় মাখনছানা
কেউর মুখে অন্ন জুটে না, ভাঙ্গাঘরে ছানি নাই”

বাউল আব্দুল করিম রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন। ১৯৫৪ সালে মওলানা ভাসানীর আহবানে তিনি কাগমারী সম্মেলনে যোগ দিয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। পরবর্তীতে দেশের নানা জায়গায় যুক্তফ্রন্ট এর প্রচারনায় তিনি ছিলেন নিত্যসঙ্গী। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার গন্তব্য ছিল মানুষ। মানুষের মধ্যেই তিনি অরূপের সন্ধান করতেন, লালন এর মত মনের মানুষের সন্ধান তারও ছিল, এই মানুষ হল সেই যার মাধ্যমে শোষিত নিপীড়িত মানুষ মুক্তির আলোর সন্ধান পাবে। সকল মানুষের মধ্যে নিহিত থাকা এ মনের মানুষকে তিনি জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তার মনে সুপ্ত সম্ভাবনার উদয় হয়, এইবার বুঝি শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাবে দেশ। তার এ মনচিন্তা তার গানের মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই;

“স্বাধীন বাংলায় রে বীর বাঙালি ভাই
শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা চাই।”

’৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতি নিয়েও তার স্পষ্ট ভাবনা ছিল, তিনি চেয়েছিলেন মুক্তির এ দলীল গানে গানে ছড়িয়ে দিতে;

“গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র, এই ছিল তার মহামন্ত্র
ধর্ম নয় শোষণের যন্ত্র, নিরপেক্ষ সমুদয়”

কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর দেশব্যাপী হত্যা, নির্যাতন, লুন্ঠণ, শোষণ-বৈষম্যের চিত্র দেখে তিনি যারপনাই হতাশ হন। তার গানেও তার হতাশার পরিচয় পাওয়া যায়;

“ভেবেছিলাম একদিন দেশ হবে স্বাধীন, এখন শুভদিন আসতে পারে
শোষকের মন্ত্রনা বিষম যন্ত্রনা, প্রাণে সহেনা দুঃখ বলব কারে।।”

বা

“রক্ত দিয়ে স্বাধীন হলাম মুক্তি পাব বলে
শোষিতের নাই স্বাধীনতা, আছে শোষকের কবলে”

আব্দুল করিম গণমানুষদেরই একজন। গান গেয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে তিনি চষে বেড়িয়েছেন, মানুষকে গান শুনিয়ে হয়ে উঠেছেন তাদেরই একজন, মানুষ তাকে আপন করে নিয়েছে। মানুষের দুঃখ বেদনাকে তিনি রাধাকৃষ্ণের বিরহ সঙ্গীতে দিয়েছেন অনন্য রূপ। দুঃখ বেদনার কারণ রূপে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে হয়েছেন স্পষ্টভাষী, দোতারার সুর হয়েছে তীক্ষ্ণ, পৌঁছে গেছে মরম থেকে মরমে।

সর্বহারাদের একজন হয়েই চেষ্টা করেছেন তাদের জাগিয়ে তোলার, স্থানে স্থানে শাসিয়েছেন শোষকদের;

“শোষক তুমি হও হুশিয়ার চল এবার সাবধানে
তুমি যে রক্ত শোষক বিশ্বাসঘাতক, তোমারে অনেকে চিনে”

আব্দুল করিম গান ভালোবাসতেন, মানুষের জন্যই গান বাঁধতেন। দৃশ্যমান পুরষ্কার বা সম্মাননা এসব তার কাছে ছিল গৌন। এই ভালোবাসার গানের জন্যও তাকে লড়াই করতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সমাজের রক্ষণশীল-প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। তিনি তার সুস্পষ্ট, তীক্ষ্ণ উচ্চারণে পরাস্ত করেছেন তাদের, প্রগতিশীলতার কাছে পরাজিত হয়েছে রক্ষণশীলতা। তিনি যে সময়কালে দাঁড়িয়ে সমাজের ধর্মান্ধগোষ্ঠীর বাঁধার মুখে উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারন করেছেন, “সত্য বলি, গান আমি ছাড়িব না”; বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমরা অনেকেই তা চিন্তা করতে পারি না। তার এ বলিষ্ঠ কণ্ঠ যুগে যুগে, কালে কালে প্রগতিশীল সমাজকর্মীদের প্রেরণা যোগাবে, মানুষে ন্যায্য অধিকার থেকে যে গোষ্ঠী মানুষকে বঞ্চিত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্দমী করবে।

আব্দুল করিম পুরোদমেই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। আধুনিক যুগে অসাম্প্রদায়িকতাকে ধরা হয় প্রগতিশীলতার অন্যতম স্তম্ভ রূপে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও মূর্তি ভাঙা, মন্দির-মসজিদে হামলা, জনগোষ্ঠীর উপর হামলা নিত্যকার ঘটনা। কিন্তু তৎকালীন সময়েও তিনি মসজিদ-মন্দির কেন্দ্রিক মালাজোড়া, কবিগান বা রাধাকৃষ্ণ সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। এ সকল অনুষ্ঠানে ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলমান সকল মানুষের যাতায়াত ছিল যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরই পরিচায়ক। তার নানান গানে তিনি হিন্দু মুসলমান দুটি সম্প্রদায়কে বাংলা মায়ের দুই সন্তান রূপে অভিহিত করেছেন;

“বাংলা মোদের মা জননী, আমরা ভাই ভগিনী
ভেদনাই হিন্দু মুসলমান, বাঙালি, বাঙলা জবান”

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লড়াই সংগ্রাম সংগঠিত করার জন্য সকল ধর্মের মানুষকে তিনি আহবান জানিয়েছেন, সম্প্রীতির সহাবস্থান গড়ে তুলেছেন;

“কৃষক মজুর ভাই, হিন্দু-মুসলিম প্রভেদ নাই
বাঁচার মতো বাঁচতে চাই সবাই বলরে”

ধর্মের ভিত্তিতে তাই যখন দেশ ভাগ হয়, তখন তাই তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। চারদিকে সাম্প্রদায়িক হামলা, সংঘাত এ জর্জরিত বাংলার নিরীহ মানুষকে দেখে তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়;

“পথ ভু্লিয়া ধর্ম নিয়া মারামারি লেগে যাই
দুইয়েরই হইল ক্ষতি কার দুঃখ কারে জানাই”

তার অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা, দর্শন এর উদাহরণ অসংখ্য যা লিখে শেষ করা যাবে না। দেশভাগের পর দ্বিজাতি তত্ত্বকে ব্যংঙ্গ করে অনেক গানেই তিনি উল্লেখ করেছেন ‘মুসলীম লীগের ভাঙা লেন্টন’ নিভানোর কথা। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকালে দেশবিরোধী রাজাকারের নির্যাতনের কথাও তিনি বলে গেছেন নানা সময়;

“হানাদার বাহিনী আর দালাল রাজাকার
ধনরত্ন লুট করে নেয়, মা বোনদের ইজ্জত মারে”

আব্দুল করিম তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরও নানা চিত্র তার নানা গানে ফুটিয়ে তুলেছেন, আঘাত করতে চেয়েছেন মর্মমূলে। এ ব্যাপারে তিনি বেশ কৌশলী ছিলেন। গ্রামীন গৃহ বধূদের যে নিজের বাড়িতে যাওয়ার সময় শ্বশুর বাড়ি থেকে বাঁধা দিতো, তা তিনি ফুটিয়ে তুলতেন তার গানে, পরবর্তীতে প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছে গান শেষ করতেন, মূলমন্ত্র বিঁধে যেত মানুষের মনে। বাউল তার নানা গানে স্ত্রী সরলা এর নানান গুনের কথা নিসংকুচে বলে গেছেন। বর্তমান সমাজেও নারীদের নানান ভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। এই জায়গায় আব্দুল করিম তার স্ত্রীর নাম দিয়ে গানের মাধ্যমে মূলত গ্রাম বাংলায় নারী সমাজের অবদানের কথাই ফুটিয়ে তুলেছেন।

জ্যামাইকান পপ সঙ্গীত শিল্পী ‘বব মার্লে’ একটি কথা বিশ্বাস করতেন যে মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা, বর্ণপ্রথা মানুষের মন থেকে একেবারে নির্মূল করা সম্ভব। আর এজন্য মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে, গানের মাধ্যমে ভালোবাসার বীজ মানব হৃদয়ে প্রোথিত করতে হবে। আব্দুল করিম ঠিক এই কাজটিই করেছেন। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে গানই হয়েছে তার একমাত্র কিন্তু দৃঢ় হাতিয়ার, মানব মানবীর দুঃখ কথা গানের মাধ্যমেই তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করিয়েছেন যা রূপ নিয়েছে ভালোবাসায়। গানের মাধ্যমেই বাঙালির মনে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ রোপন করতে চেয়েছেন।

তাই আসুন, তার গান থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করি, চর্চার মাধ্যমে শুদ্ধ হই, গড়ে তুলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাঙলা।

তথ্যসূত্রঃ ১. মিহিরকান্তি চৌধুরী। ২০১১। শাহ্‌ আব্দুল করিমঃ জীবন ও কর্ম। ঢাকাঃ ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশন।
২. শুভেন্দু ইমাম। ২০১০। শাহ্‌ আব্দুল করিমঃ পাঠ ও পাঠকৃতি (সম্পা.)। সিলেটঃ বইপত্র।
৩. ব্রিকলেন। শিকড় ও সত্ত্বায় ভাটির পুরুষ। লেখকঃ ফারুক মেহেদী

আপনার মন্তব্য