নগরে বসন্ত

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১৩ ০০:৫৮:৪৪

 আপডেট: ২০১৯-০২-১৩ ০১:০৬:৪৯

সজল ছত্রী:

‌'তোমার হাতে কিসের দাগ? রাগ মুছেছো কার?
তোমার চোখে কেমন জল? কিসের অন্ধকার?
তোমার ঠোঁটে কোন সে কথা? গোপন বেদনার?
বসন্তের এই নতুন দিনে, ও পুরনো মানুষ তোমার
                                -কিসের হাহাকার'

বরণ করে নিতে খোলা মন চাই। এমন না যে এলো আর সবাই সাদরে ডালি সাজিয়ে সম্ভাষণ জানালো। কারো মুখ বাঁকা হবে, কারো তেতো হবে। কারো সন্তুষ্টি হবে না, নিজেকে ব্যাপক বঞ্চিত ভাববে সে। বরণ করে নিতে তাই অবশ্যই খোলা মন চাই। শীত আসে পাতাঝরা শুষ্কতা নিয়ে, তাকে বরণ করে নিতে হয়। ক্ষেত ভরে যখন আনাজ দেয় তখন শুষ্কতাকে ভুলে যাই। বসন্ত তেমনও নয়, দখিনা হাওয়া আর নানান সুগন্ধ সাথে নিয়েই আসে। তবে একবসন্ত সবার ভাঁড়ার পূর্ণ করে দিতে পারে না। তাকে তাই ফিরে ফিরে আসতে হয়। আবার যদি আসে,এ বসন্তে না হোক অন্য বসন্তেও যদি আসে তবে তাকে আর ত্যক্ত করা কেন। শরীর কাঁপানো শীতে, বরষায়, হেমন্তের ভরপুর দিনে সে কোথায় ছিলো তার হিসেব কি খুব জরুরি!

আমার জন্ম ভালো। ইট-কাঠ দেখে বড় হইনি। সবুজে বেড়ে উঠতে পেরেছি অনেকটা বয়স, বরষা ও না বুঝা বসন্ত। মাদী ইলিশ যেমন ভরপেট নিয়ে অপার সমুদ্র ছেড়ে নদীতে চলে আসে, সব গর্ভবতী নারীদেরও সবুজে চলে যাওয়া প্রয়োজন, মাঝে মাঝে এমন মনে হয়।

সঠিক বসন্তে বাতাসে সুগন্ধ আসে। কামোন্মত্ত হয়ে পড়ে বৃক্ষপলার শরীরও। ছোট গাছে ফুল ফুটে। বুজুর্গ শাখায়ও দোলে নবতর পাতা, মুকুল। বসন্ত এমনই। ঠাঁঠানো রোদকেও মনে হয় গরম আদর। তবে নাগরিক বসন্তে কিছু তফাৎ আছে। নগরের বসন্ত চুপচাপ আসে। ফুল ফুটিয়ে চলে যায়। চলে যাওয়াটা এখানে সত্যি, দূরত্বটা বাস্তবিক। কিন্তু বরণ করে নেওয়াটা সবসময়ই জমকালো। নাগরিকরা বসন্তকে বরণ করে নিতে সব আয়োজন করে রাখে। নারী-পুরুষের কাছে আসে, মানুষ মানুষের কাছে আসে আর প্রকৃতির দানকে উদযাপন করে। অন্য কোনো উৎসবে প্রকৃতির জন্য এতোটা কৃতজ্ঞতা থাকে না আমাদের। মানুষ নিজেও প্রকৃতির অংশ তাই সাযুজ্য খোঁজে নেওয়ার ফুসরতও এতোটা মেলে না। বাঙালির সবচে বড় উৎসব পহেলা বৈশাখেও মানুষ নিজেদের জন্য আনন্দ করে। কিন্তু বসন্তবরণের আয়োজন প্রকৃতিকে উৎসর্গ করা। প্রকৃতির আনন্দে নিজেকে উদ্ভাসিত করে সবাই। এখন আমিও নাগরিক। বাসন্তি মুখরতার সরব।

নবান্ন উৎসব, পিঠা উৎসব, পান্তা-ইলিশের পহেলা বৈশাখ সব উৎসবেই তো একটা উপলক্ষ থাকে জমিয়ে তোলার। কিন্তু নাগরিক বসন্তবরণকে কি দিয়ে জমিয়ে তোলা হবে? সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শোভাযাত্রা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা নাকি গুণীজন সংবর্ধনা দিয়ে? এসব তো যেকোনো দিনই করা যায়। বসন্তের বিশেষত্ব কি? নারী-পুরুষের সম্মেলন? বাঙালির অবদমিত আবেগের একটা গতি হতে পারে বসন্তের সূতো ধরে। আমরা মোবাইল, ইন্টারনেট সবই ব্যবহার করছি পাকা 'আধুনিক' মানুষের মতো, শুধু মনের কথা বলার সময়ই আমরা গোড়া সংস্কৃতিপরায়ণ। অবস্থা বিশেষে কাঠ-ধার্মিকও। তদুপরি জীবন থেমে নেই। ধর্ষণ, ব্যভিচার, লিভটুগেদার, প্রতারণা সবই আমাদের আছে। আছে কারো কাছে কু হয়ে, কারো কাছে সু হয়ে। জমা হচ্ছে বিচ্ছেদের 'সৎ সাহস'ও। শুধু মিলনের সঠিক সমীকরণ মিললো না এখনও। কেন ভালোবাসি না, তা বলতে বেশ শিখে গেছি। কেন ভালোবাসি তা বলার সময় এখনও আমরা আবেগ আর নিয়তির রেলে চাকা চালিয়ে দেই। বসন্ত কি আমাদের ভালোবাসার কারণগুলো বলে দেবে? বলে দেবে- কেন নারী ও পুরুষের মিলন সর্বদাই ধ্রুপদী?

নাকি আর দশটা শহুরে উৎসবের মতো সংস্কৃতির বনসাই প্রদর্শনী, ঐতিহ্যের গুণগানের সাথে ভোগপনার নিরস মিশ্রণ আর কথা কপচানোর আরেকটি উপলক্ষ হবে বসন্তবরণ? জায়গা মতো তীর লাগানোতে আমরা ব্যস্ত, ধনুকবাজির বৈধতা ও শুভ্রতা আমাদের প্রয়োজন নেই! সময়ের বিবর্তনে ক্রমশই অদ্ভুত হয়ে উঠা এক জাতি আমরা বসন্তের খেলাতেই তো বেশ মেতেছি। হৃদয়ে কি ছোঁয়া লাগলো তার কিছু?

গাছে ফুল ফুটবে, ভ্রমর উড়বে, কীটপতঙ্গ পরাগায়ন করবে আর সব ফল খেয়ে যাবো আমরা, যারা ভালোবাসাকে বোমার চেয়েও ভয় পাই, খেলার মাঠে চিয়ার্স লিডারদের উচ্ছ্বাস নেই প্রাণভরে। এই দিনটা ফুরাক, বসন্ত তার আনন্দটা পুড়াক।

২.
দিকে দিকে ফুল ফুটছে। বনে-বাগানে, নার্সারিতেও। বেহেস্তে ও কবরস্থানে। রঙের হোলি খেলে- আজ বসন্ত বলে- মনের কথাটুকু খুলে বলি। আজ কারণ জেনে নিই- যার যেমন দৃষ্টি হোক- ফুল ফুটল কেন, ভালোবাসা জাগল কেন মনে? আজ রীতির ঘরে প্রীতির জোগান হোক। অবদমন টুটে গিয়ে মনের আলো ছড়িয়ে পড়ুক জনে।

আপনার মন্তব্য