রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-২৮ ২৩:৪৮:১০

রাজেশ পাল:

“বন্ধন মানে তবে কি শুধুই কারাগার শৃংখল?
পাখির জীবন তবে কি সত্য হবেনা মানবপুরে?
হবেনা কখনো স্বাধীন যেমন আদিম জীবন ছিলো?”

পাখির জীবনে আদিম জীবনের স্বাধীনতা খুঁজে ফিরেছিলেন তিনি। যেখানে অন্যায়, যেখানে অবিচার, সেখানেই ঝলসে উঠেছে তার লেখনী। ছিন্ন করতে চেয়েছে সকল অচলায়তনের বেড়াজাল। আশির দশকে তার কাব্যিক প্রতিবাদ ঝড় তুলেছিল বাংলার চিরায়ত সাহিত্য ভুবনের আকাশে। তার “যে মাঠ থেকে এসেছিল স্বাধীনতার ডাক, সে মাঠে আজ বসে নেশার হাট” কিংবা “আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই” ছিলো বাংলার প্রতিবাদী তারুণ্যের মূর্ত প্রতীক। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীকে। একই সঙ্গে তার কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা।

মাত্র ৩৫ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত সময়ে রচনা করেছেন অসংখ্য জ্বালাময়ী কবিতা। যার উচ্ছ্বাস ছিলো আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভার মতো। যা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় চারদিক। যেখানে দেখেছেন অসংগতি সেখানেই ফেটে পড়েছেন প্রতিবাদে। রক্তের দামে কেনা স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত পদযাত্রায় তীব্র ক্ষোভে বলে ওঠেন,

“জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর,
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আরষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা – একি হবে নষ্ট জন্ম ?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।

বাতাশে লাশের গন্ধ
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ -
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়
এ চোখে ঘুম আসেনা।”

ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ডাকসুর নির্বাচনে হেরেছিলেন বন্ধুর কাছে। তিনি ছিলেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার। আর এই আন্দোলনের খাতিরেই গড়ে তোলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ১৯৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত দেশে এমন কোনো আন্দোলন নেই যাতে রুদ্রর সশরীর অংশগ্রহণ ছিল না।

কবিতা, গল্প, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধ, গান যেখানেই শিল্প সাহিত্য সেখানেই রুদ্র। কবিতা আর বিদ্রোহ ছিল রক্তে। ’৭৯ সালে বের হয় প্রথম বই ‘উপদ্রুত উপকূলে’ প্রথম বইতেই ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ লিখে সব মনোযোগ, পাঠক কেড়ে নেন। বলেন- ‘আমি কবি নই শব্দশ্রমিক/শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই ভুল বোধে ভুল চেতনায়।’

দ্বিতীয় বই ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’। তারপর একে একে ‘মানুষের মানচিত্র’ (৮৪), ‘ছোবল’ (৮৬), ‘গল্প’ (৮৭), ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’ (৮৮), ‘মৌলিক মুখোশ’ (৯০)। ৭টি কবিতার বই। আর মৃত্যুর পর বের হয় নাট্যকাব্য ‘বিষ বিরিক্ষের বীজ’। জীবন নিয়ে রুদ্র যত হেলাফেলাই করুক, কবিতা নিয়ে কখনো করেননি। কবিতায় তিনি সুস্থ ছিলেন, নিষ্ঠ ছিলেন, স্বপ্নময় ছিলেন।

তখন, বাংলাদেশে চলছে গ্রহণের কাল। এরশাদের 'কাব্য প্রতিভা'র স্ফুরণ ঘটতে থাকলো পত্রিকার প্রথম পাতায়। এরশাদ ও তার ভাড়াটে কবি সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দিন, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মাহবুব তালুকদার, ইমরান নূর, মোফাজ্জল করিমরা  তাদের বাহাদুরি দেখাতে ঢাকায় যখন অনুষ্ঠান করেন এশীয় কবিতা উৎসব করে, বিপরীতে রুদ্র দাঁড়িয়ে যান ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’ নিয়ে। সাথে ছিলেন জাফর ওয়াজেদ, মোহন রায়হান, ইসহাক খান, নিশাত খান, তুষার দাশ এবং শিমূল মোহাম্মদ ।ভেঙে যায় এরশাদের কবি খেতাবের স্বপ্ন। ধর্মীয় হানাহানি কবিকে করে তোলে ব্যথিত। সেই উতসরিত বেদনা থেকে ধর্মকে ঘোষণা দেন আফিমের চেয়েও ভয়ানক হেমলক বিষ হিসেবে।

দ্রোহের পাশাপাশি প্রেম রুদ্রকে করেছিল নিজ স্বকীয়তায় অনন্য। ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন তসলিমা নাসরিনকে। তখনো তসলিমা নাসরিন সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি পাননি। সে বিয়ে টেকেনি। অবশ্য ’৯০-এর শেষদিকে তসলিমার সঙ্গে আবার প্রেম শুরু হয়েছিল। তসলীমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন রুদ্র। তাকে নিয়ে লিখেছিলেন অবিস্মরণীয় ভালোবাসার গান,

“পুষে রাখে যেমন কুসুম, খোলসের আবরণে মুক্তোর ঘুম।
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া, ভিতরের নীল বন্দরে।

ভাল আছি ভাল থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।
দিয়ো তোমার মালাখানি, বাউলের এই মনটারে।
আমার ভিতরে বাহিরে...

কিন্তু সেটা ছিল তসলিমার দ্বিতীয় বিবাহ থেকে তৃতীয় বিবাহে উত্তরণের মধ্য সময়ে। ফলে সে প্রেমও টিকল না। শরৎচন্দ্র তাঁর শ্রীয়ান্ত উপন্যাসে বলেছিলেন, “বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা, বরং দূরেও ঠেলিয়া দেয়। আর সেই দূরে ঠেলে দেয়ার ক্ষোভ থেকেই তিনি তসলিমার প্রতি লিখেন,

“লক্ষী সোনা, এখন তুমি বিড়াল এবং কুকুর পোষো
শুকরগুলো তোমার সাথে খাপ খেয়ে যায়,
কাদা ঘাটায় দক্ষতা বেশ সমান সমান।
ঘাটাঘাটির ঘনঘটায় তোমাকে খুব তৃপ্ত দেখি,
তুমি বরং ওই পুকুরেই নাইতে নামো
উংক পাবে, জলও পাবে।
চুল ভেজারও তেমন কোন আশঙ্কা নেই,
ইচ্ছেমত যেমন খুশি নাইতে পারো।
ঘোলা পানির আড়াল পেলে
কে আর পাবে তোমার দেখা।
মাছ শিকারেও নামতে পারো
তুমি বরং ঘোলা পানির মাছ শিকারে
দেখাও তোমার গভীর মেধা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্যামা তরুণী শিমুলের সঙ্গে প্রেম হলো। কিন্তু অভিভাবক রাজি না। সে সম্পর্কও চুকেবুকে গেল। সেই থেকে রুদ্র আরো বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে লাগলেন। ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যেতে লাগলেন। ক্ষয়ে যেতে লাগলেন। অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতা ফলস্বরূপ আলসারে পেয়ে বসেছিল তাকে। পায়ের আঙুলে রোগ বাসা বেঁধেছিল। ডাক্তার বলেছিল পা বাঁচাতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে। তিনি পা ছেড়ে সিগারেট নিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলস্বরূপ স্থান হলো হলি ফ্যামিলির ২৩১ নম্বর কেবিনে। ’৯১ সালের ২০ জুন ভালো হয়ে পশ্চিম রাজাবাজারের বাড়িতে ফিরেও গেলেন। কিন্তু ২১ জুন ভোরে দাঁত ব্রাশ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, বাংলা ভাষায় অসামান্য কবি রুদ্র ।

স্বাধীনতাউত্তর বাংলা কবিতায় একই সাথে প্রেম আর দ্রোহের যুগপৎ সম্মিলনী এভাবে ফুটে ওঠেনি আর কারো কবিতায়। আপন জীবনের সংস্কারের প্রাচীর ডিঙিয়ে, সনাতনী সমাজ ব্যবস্থার সীমানা পেরিয়ে, মুক্ত বাতাসের বলিষ্ঠ প্রশ্বাসে শতাব্দীর বৈশিষ্ঠ্য মণ্ডিত আধুনিকতাকে তিনি করেছিলেন আহবান।

নব্বইয়ের দশকে স্বীয় কন্ঠে কবিতা পাঠে জাগিয়ে তুলেছিলেন নবতারুণ্যকে। কিশোর কবি সুকান্তের অকাল প্রয়াণের পরে রুদ্রের অসময়ে বিদায় ছিলো বাংলার সাহিত্য আকাশে একটি উল্লেখযোগ্য নক্ষত্রপতন। যেন মধ্যগগনে অস্তমিত হলো প্রখর তেজের রবি। হলো একটি স্বর্ণালী অধ্যায়ের অবসান।

এ ক্ষুদ্র পরিসরে এই কালজয়ী কবির জীবন বা সাহিত্যকর্ম নিয়ে ছিটেফোটাও আলোকপাত করা সম্ভব হলোনা। শুধু একজন ভক্তের হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসার অর্ঘ্যটুকুই সশ্রদ্ধচিত্তে নিবেদন করে গেলাম।

আপনার মন্তব্য