ফিরে দেখা এক জন্মকথা- ১৪

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-০৩ ১৭:০২:৪৮

রাজা সরকার:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
৩৯
থানা লেবেল পর্যন্ত মিলিটারি ক্যাম্প রাখা যাচ্ছে না। তুলে দেয়া হচ্ছে। কারণ পরিকাঠামোর অভাব। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে ফোর্সের সংখ্যা কমাতে হচ্ছে। ফোর্স যাচ্ছে বর্ডারে। সময় বেশি হাতে নেই। ইন্ডিয়া তাদের আর্মিকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের তিন দিক ঘিরছে বেশ  কিছুদিন যাবত। আমাদের মাথামোটা উপরওলারা আছে শুধু পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে। এই অংশে আর্মিরা কী অবস্থায় কাজ করছে তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। ইন্ডিয়া বঙ্গোপসাগর অবরোধ করে ফৌজ আনার সহজ রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। সাধারণ সৈন্যরা না পেলেও অফিসাররা বিপদের গন্ধ পেয়ে গেছেন। ইন্ডিয়া আক্রমণ করছে না। করলে মুশকিল হয়ে যাবে। আক্রমণ না করেই যা করছে, ট্রেনিংপ্রাপ্ত  সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের ঠেলা সামলানোই কঠিন হয়ে পড়ছে। দেশের অভ্যন্তরে এত কঠিন মোকাবেলার কথা ভাবা হয়নি। মিলিটারিদের মহকুমা পর্যায়ে সরিয়ে নিয়ে সংহত করার চেষ্টা হচ্ছে। দেশটার গ্রাম অংশের আপাত নিরীহ মানুষদের প্রতিরোধ ভাঙা প্রায় অসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে ল এন্ড অর্ডার রেস্টোর করা যাচ্ছে না। পুলিশ ছাড়া থানাগুলোতে বসে সিভিল প্রশাসন চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে মিলিটারি। তার ফল এখন চারদিকে ছোট ছোট মুক্তাঞ্চল, মুক্তিদের নিয়ন্ত্রণে। অল রাবিশ—কথাটা অফিসারদের মদের টেবিলে ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে।  

রেডিও পাকিস্তান মারফত জানানো হচ্ছে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা অটুট। ইন্ডিয়ার সন্ত্রাসী এবং গুপ্তচরদের অনুপ্রবেশ বন্ধে সেনাবাহিনী সজাগ রয়েছে। সীমান্ত সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত বাহিনী যে কোন আক্রমণের জবাব দিতে প্রস্তুত। ফিল্ড মার্শাল ইন্ডিয়াকে এই বলে সতর্ক করে যাচ্ছেন যে প্রতিবেশী দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের ফল মারাত্মক হতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সন্তোষজনক। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারী বেসরকারি সংস্থা স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। ---হালার পুতেরা আর কত বানায়া বানায়া মিছা কথা কয়---রাখত তর রেডু পাকিস্তান—ধর জয় বাংলা---হুনি তারা কিতা কয়--। এভাবেই রেডিও শোনার এক আধটা আসর সন্ধ্যার দিকে জমে উঠছে এখন আমিত্তিপুর বা শ্রীমন্তপুরে।

মা বাবা চলে যাওয়ার পর যতটা ভয় সঞ্চারিত হয়েছিল মনে মনে , ততটা এখন আর নেই। সাবিত্রীর মায়ের সাহায্যে নিয়তি সংসার কিছুটা গুছিয়ে নিতে পেরেছে। বড় ব্যাপার, কেন জানি দিবাকর খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নিয়তি তার শরীর নিয়ে খুব সাবধানে চলা ফেরা করে। এখন ন’মাস অতিক্রান্ত। ধান কাটার কাজও প্রায় শেষ। এ নিয়ে সামনে কাজ আছে। নিজেদের ভাগের ধান শুকানো, সিদ্ধ  করা, শেষে ঢেঁকিতে কুটা। নিয়তি এর কোনটাই করতে পারবে না। এই সময় কাজের লোক পাওয়া মুশকিল। তবু দিবাকর চেষ্টায় আছে। শেষে সালাউদ্দিন চাচার শরণ নিতে হবে বোঝা যাচ্ছে।

একমাস আগের পরিস্থিতিও এখন আর নেই। কেন্দুয়া আর মোহনগঞ্জে পর পর দুটো বড় আঘাত হেনে মুক্তিবাহিনী এই অঞ্চলটাকে কিছুটা স্বাভাবিকতা দিতে পেরেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব থাকলেও স্থানীয় বাজার এখন প্রতিদিনই বসছে। এই সব খবর চাপা থাকে না। বাঘমারাতেও পৌঁছেছে। পরিবারের মহিলা শিশু বৃদ্ধদের সঙ্গে না নিয়ে এসে গ্রামের দু একজন কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও গ্রামে ফিরে এসেছে। তাদের কাছে ঐপারের খবরাখবর পাওয়া গেছে। অবশ্য রবীন্দ্রবাবুর খবর পাওয়া যায়নি। হয়তো তারা ক্যাম্পে আর নেই। নিয়তি খুব বেশি চিন্তা করছে না। খবর পেয়ে হয়তো বড়দাদা এসে তাদের নিয়ে গেছে শিলিগুড়িতে।  

অল্প অল্প শীত পড়ে গেছে। মানুষের ঘরে এখন অন্তত চালটা মজুত আছে। এইসব সময় উৎসব পার্বণের সময়। কিন্তু সে-সব কথা এখন কেউ ভাবে না। এর মধ্যে আবার নতুন উপসর্গ তৈরি হয়েছে মাঝে মাঝে আকাশে খুব দ্রুত গতির এরোপ্লেনের ওড়াওড়ি। কেউ কেউ বলে এসব ফাইটার বিমান। বোমা ফেলে মানুষ মারে। কান ফাটানো আওয়াজ শুনে মাঝে মাঝে বুক কাঁপে। কিন্তু এখনও বোমা ফেলেনি। প্লেনের শব্দ শুনলেই বাচ্চাকাচ্চারা ভীষণ দৌড়াদৌড়ি করে। বারণ করলেও শোনে না। হাতের কাছে পেলে দু ঘা পিঠে বসানো যায়।কিন্তু নিয়তি এখন অনেকটাই শ্লথ হয়ে পড়েছে। অনেকসময় আবার ভালোও লাগে যে বাচ্চাদের কলরবে অন্তত প্রাণের  স্পন্দনটাতো শোনা যায়।  

দিবাকর একদিন সন্ধেবেলায় হাতে একটা রেডিও নিয়ে বাড়িতে আসে। নিয়তি অবাক। কার কাছ থেকে আনলো বা পয়সা কোথায় পেল, কিছুই বলছে না। পাশের বাড়ির করিমকে নিয়ে একমনে কানে দিয়ে সে বারান্দায় বসে খবর শুনছে আর মাঝে মাঝে খুশি উপচে পড়ছে তাদের কথাবার্তায়। কীসের খুশি সেটা জানা গেল রাতে খেতে বসে । ইণ্ডিয়া পাকিস্তানের যুদ্ধ লেগে গেছে। এইবার ব্যাডারা  বুঝব কত ধানে কত চাল। যুদ্ধটা আমাদের এই দিকে লাগেনি। লেগেছে পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে। নিয়তি একমনে দিবাকরের  উচ্ছ্বাস পূর্ণ কথা শুনে যাচ্ছিল। হঠাৎ মাঝ খানে জিজ্ঞেস করে বসলো--রেডিয়ো কই পাইলা?  

১৯৬৫ সনেও একবার যুদ্ধ লেগেছিল। সেবারও যুদ্ধের খবর শোনার জন্য রেডিওর খুব প্রচলন হয়েছিল। পাশের বাড়ির কাকাদের এক রেডিওতে সারা গ্রামের মানুষ খবর শুনতে আসতো। কিন্তু ঐ যুদ্ধটা এই দিকে হয়ই নাই। বল বিক্রম প্রদর্শনের জন্য সামান্য গোলাগুলিও শোনা যায়নি । কোথায় কোন মুল্লুক পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে ঐসব হয়েছে। কিন্তু এবারের বিষয়টা আলাদা। খবরাখবর শুনে দিবাকর নিশ্চিত হয়েছে যে এবার এদিকেই আসল যুদ্ধটা হবে। কেননা একটা যুদ্ধত দেশের ভেতরে চলছেই। সেইটা আরো জোর কদমে শুরু হবে এবার। এসব নিয়ে দিবাকরের এত কথা,এত চিন্তা দেখে নিয়তি ভাবে লোকটার হলোটা কী। আজকাল বাড়িতেও খুব কমই থাকে। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি , নানা জনের সঙ্গে কথাবার্তা, তাতেই তার সময় ব্যয় হয়। এইসব করে অবশ্য সে নিজেকে বেশ মানিয়ে  নিয়েছে । এই কারণে নিয়তি মনে মনে আশ্বস্তও বোধ করে। রেডিওর ব্যাপারে আরো দু একবার জিজ্ঞেস করার পর সে জানালো যে পশ্চিমপাড়ার  দোলনের কাছ থেকে রেডিয়ো কিনেছে। ধানের বিনিময়ে। দোলন বাঘমারা থেকে ফিরে এসেছে। আসার সময় সে দুটো রেডিও এনেছিল। একটা সালাউদ্দিন চাচা নিলো আর একটা সে। সালাউদ্দিন চাচাই বললেন যে—লইয়া লও মন চাইলে—কামে লাগব। ধান উঠার সময় গ্রামের মানুষের একটুআধটু  বিলাসিতার সখ হয়। নিয়তি দিবাকরের কথা শুনে মনে মনে হাসে। ভাবে যে এখনও কত ছেলেমানুষ রয়ে গেছে।

৪০
দুপুরে ভাত খেতে রান্না ঘরে ঢুকে দিবাকর বললো—ঢাকাতে বোমা ফালাইছে আইজ সকালে—কইছিলাম না যুদ্ধ এইদিকেও হইব— ঠিক লাইগা গেছে—দেহ অহন কী অয়। তার বড় ছেলে শম্ভু বললো—বাবা আমরার এইহানে বুমা পড়তো না? উত্তরে দিবাকর বলল—চুপ কর--।  নিয়তি দিবাকরের কথায় এখন আর খুব একটা অবাক হয়না। কত কি সে রেডিওতে শুনে। খেতে খেতেই দিবাকর শুনলো করিমের গলা—উঠোনে দাঁড়িয়ে করিম বলছে---দুলাভাই হুনছুইন ঢাহায়ত বুমা ফালছে আইজ--। খেতে খেতেই উত্তর দিল দিবাকর –হ হ হুনছি—কাচারি ঘরে বও গিয়া আইতাছি—রেডিও খুলন লাগবো। নিয়তি তারে আস্তে আস্তে খাওয়ার পরামর্শ দিল। তাড়াহুড়াতে গলায় না আবার মাছের কাঁটা লাগে। দিবাকর খেয়ে উঠে হাত ধুতে বাইরে গিয়েই প্রচন্ড এক শব্দে প্রায় মাথা নিচু করে ফেললো। অবশ্য অচিরেই টের পেল আম গাছে উপর দিয়ে উড়ে গেল একজোড়া প্লেন ।

খেয়ে উঠে দিবাকর রেডিও নিয়ে কাচারি ঘরে গিয়ে দেখে অনেক লোক সেখানে। আজ একটু বেশিই । সব গ্রামেরই। রেডিও খুলে  জয়বাংলা ধরলো। খালি যুদ্ধের খবর। তাতে মানুষজন বেশ উত্তেজিত। উত্তেজনার বশে দু একটা খিস্তি বেরিয়ে গেলে তারা দুলাভাইয়ের কাছে মাফি চেয়ে রেখেছে আগেই। দুলাভাই নিজেও আর কোন কথায় কান দেয় না। রেডিওর প্রতিটি শব্দ পারলে সে মনে গেঁথে রাখে। কাচারির সামনে দিয়ে সরকারি রাস্তা। যাতায়াতের মানুষজন তাদের চীৎকার উল্লাস শুনে শুনে যায়। দুপুরের খাওয়ার পর এই আসর এখন কদিন ধরেই বসছে। প্রথম ছন্দপতন ঘটলো সে দিনই যে দিন ঢাকাতে বোমা পড়ার খবর এলো এদিকে। কাচারি ঘরে দরজায়  সেদিন দেখা গেল আহমেদ মৌলবী দাঁড়িয়ে। ঘরের জমজমাট আসর হঠাৎ চুপ। ভিড়ের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার সঙ্গে উর্দু মিশিয়ে যা বললেন তার মর্ম কথাটা দাঁড়ায় অনেকটা এইরকম যে-- ভাই সব তোমরা কার সাফল্যে উল্লাস করতাছ জানি না—তবে পাকিস্তান হেরে   গেলে কিন্তু মুসলমান ভাইদের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। তোমরা সব নওজোয়ান, তোমাদের হয়তো জানা নেই যে এই দেশ অনেক শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ১৯৪৭ সনে হাসিল করেছিলাম। পাকিস্তানের দুইভাই পূব পশ্চিমের দুইবাড়িতে থাকে—ঝগড়া বিবাদ হতেই পারে—চাইলে আবার মিটমাটও করে নেয়া যায়—কিন্তু ধর্মচ্যুত হয়ে, কাফেরের লগে শলা করে দেশ ভাঙলে, আল্লাতালা কিন্তু ক্ষমা করবেন না। মুসলমান ত মুসলমানই হয়—তার কোন বাঙালি বিহারি হয়না—পূরব পশ্চিম হয় না। সেই জন্য আল্লার বান্দা মুসলমানের জবানে ‘জয় বাংলা’ হয়না, হয় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। বলে কিছুক্ষণ তিনি সকলের দিকে  তাকিয়ে থেকে খোদা হাফেজ বলে যে দিকে যাচ্ছিলেন চলে গেলেন। রেডিওর আওয়াজ কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। তিনি চলে যাওয়ার পর আওয়াজ বাড়ানো হলেও খবর শুনে কেউ আর আগের মত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো না।    

আহমেদ মৌলবীর প্রভাব এই দশ গাঁ’য়ে প্রশ্নাতীত। কিন্তু এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন? এই কথা বলতেতো কেউ আগে শোনেনি । তবু  তার এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের ফল খুব গভীর হলো। কারণ পরদিন থেকে রেডিওর খবর শোনার জন্য দু তিন জনের বেশি কাচারি ঘরে আসেনি। তাতে দিবাকর উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। মনে মনে ভাবে উনার কথার উপর কেউ কথা বলার সাহস রাখে না। কেউ বললো না যে ভাইভাই মুসলমানরাত মুসলমানদেরও ছাড় দেয়নি। হিন্দুদের সঙ্গে সমান তালে মেরেছে ঢাকা সহ অন্যান্য জায়গায়, সেইটার কী বিচার হবে! গত কয়েকমাস যাবত চলা দেশের পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করার মত মানুষ এ অঞ্চলে খুব বেশি নেই। যাও বা আছে তারা এই সময় মুখ খুলতে খুব বেশি রাজি নয়।

মৌলবীর এই ছোট বক্তৃতার প্রতিক্রিয়া অনেকদূর ছড়িয়েছে। কানে গেছে সালাউদ্দিনেরও। আর মুশকিলটা হয়েছে তারও। সরিষার  খালের ওপারের মামুদপুর গ্রামের কিছু মোড়ল সালাউদ্দিনের নামে কুৎসা রটানো শুরু করেছে। সেই-ই নাকি আমিত্তিপুরটাকে নষ্ট করছে শ্রীমন্তপুরের হিন্দুদের দালালী করে করে। হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে ছাড়ুক—এইটাইতো সুযোগ তাদের স্থাবর অস্থাবর যা থাকে তা নিয়ে  নেয়ার। কিন্তু তা নাকি হবে না। সালাউদ্দিনের ভয়ে কেউ নাকি এসব ভাবেও না। আমিত্তিপুর কি শেষমেষ কাফেরর গ্রাম হয়ে গেল?  

দিবাকর এখন সকাল সন্ধ্যে ঘরের বারান্দায় বসে খবর শোনে। গ্রামসুত্রে খবর পায় আহমেদ মৌলবীর সঙ্গে সালাউদ্দিনের বিস্তর কথা কাটাকাটি হয়েছে একদিন। এসব শুনে দিবাকর গভীর বিষন্নতায় নিমজ্জিত হয়। নিজে ধর্ম নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামায়নি। বিষয়টা  সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে কিছু বলতেও পারবেনা। সে শুধু জানে হিন্দু আর মুসলমান দুইটা আলাদা ধর্মের মানুষ। দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে অনেক বিবাদ। বিবাদের আসল কোন কারণ আছে কিনা সে জানে না। জানে শুধু বিবাদ আছে। কেউ কেউ বলে এই বিবাদ নাকি চিরকাল ছিল—থাকবেও চিরকাল। চিরকাল ব্যাপারটা কত লম্বা দিবাকর কল্পনা করতে পারে না। তবে এতদিন একটা ধারণা ছিল যে তাদের মুক্তাগাছার গ্রামের মুসলমানদের থেকে এখানকার মুসলমানরা অনেক ভাল মানুষ। সেই ধারণাই তাকে এখানে এতটা জনমুখী করে তুলছিল। কিন্তু কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল--পাশের বাড়ির করিমও যুদ্ধের কোন খবর এখন খুব একটা জিজ্ঞেস করে না।

বারান্দায় বসে এসব সাত পাঁচ ভাবে দিবাকর। নিয়তি এখনও এসব কিছু জানেনা। তবে তার খটকা লাগে যে মানুষটা এখন দেখি  রেডিও নিয়ে বাড়িতেই থাকে বেশি। তলিয়ে ভাবার মত শরীরের অবস্থা নিয়তির নয়। এখন সে বেশির ভাগ সময় শুয়ে থাকে। সাবিত্রীর মা কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে কখনো কখনো দেখে যায়। এটা ওটা জিজ্ঞেস করে।

সকালে  খাওয়ার পর দিবাকর কানে রেডিও লাগিয়ে একটা জোর খবর শুনলো যে যশোহর না কোথায় যেন, পরিষ্কার শোনা গেল না, পাকিস্তানী ক্যান্টনমেন্টের পতন হয়েছে । ইন্ডিয়ান পদাতিক ফৌজ বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেছে। খবরটা শোনানোর মত কেউ নেই। করিমটাও আর আসেনা। নিজেই মিটি মিটি হাসছে সে। এইসময় উঠোনে জব্বারকে দাঁড়ানো দেখে সে ভুত দেখার মত চমকে উঠলো। সেই গন্ধটা পরখ করে দেখলো, না, নেই। এ কি সেই জব্বার? জব্বার মিটিমিটি হাসছে। বলছে –কী জামাইবাবু আছুইন কেমন? দিবাকর সে কথার উত্তর না দিয়ে শুধু বললো –কী ব্যাফার ভাই? জব্বার কিছুটা এগিয়ে এসে বললো আইজ বৈকালে আফনেরার কাচারি ঘরে মৌলভী সাবের  মিটিং আছে--  আফনেও আইবেন। বলে সে আর দাঁড়ালো না। একই কথা করিমের ঘরের সামনে গিয়েও বললো। বলে সে চলে গেল।  

জব্বারের অপহরণের খবরটা ঠিকই ছিল। করেছিল মুক্তিবাহিনীই। তবে অনেকদিন ধরে জব্বারের মৃত্যুর খবর শোনার আতঙ্কে যখন তার মা বাবা ভুগছে তখনই গোপনে খবরটা এলো যে জব্বার বেঁচে আছে। সে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গেই আছে। তার বিষয়ে তার মা বাবা যেন বেশি খোঁজ খবর না করে। অনেকে এরপর সন্দেহ করে যে মোহনগঞ্জ থানা এবং মিলিটারী ক্যাম্প আক্রমণের নক্সা তৈরি করা হয়েছিল জব্বারের দেয়া তথ্য অনুসারে। তাতে সাফল্য ছিল প্রায় নব্বই ভাগ। দুইজন মিলিটারী এবং একজন পুলিশ ছাড়া সেই সংঘর্ষে আর কেউ মারা যায়নি। একজন মুক্তিযোদ্ধা শুধু আহত হয়েছিল সামান্য। এসবই দিবাকরের শোনা এবং সংগ্রহ করা খবর। আজ তাদের বাড়ির উঠোনে জব্বারকে দেখে তার সংগ্রহ করা সেই সব খবর তালগোল পাকিয়ে গেল। মনের ভেতরে জমে থাকা ভয়ের মধ্যে সে হাবুডুবু খেতে লাগলো। মৌলবী সাহেবের মিটিং এর লগে জব্বারের সম্পর্ক কী?
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য