ফিরে দেখা এক জন্মকথা- ১৬ (শেষ পর্ব)

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-১২ ১২:৩৩:১৬

রাজা সরকার:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
৪৩
গ্রাম শুনশান। সকালে পাওয়া দারুণ খবরটা আর কাউকে দেয়া হলোনা দিবাকরের । বড় ছেলে শম্ভুকে দিয়ে নিয়তি দিবাকরকে ডেকে   আনিয়ে  বললো—সাবিত্রীর মায়রে তাড়াতাড়ি ডাইক্যা আনগা—যাও। বিছানায় শুয়ে নিয়তি ছটফট করতে লাগলো। দিবাকর চলে গেল  সাবিত্রীর মাকে ডাকতে। সাবিত্রীর মা খবর পেয়ে দিবাকরকে বলে দিল—বাবা বাড়িত গিয়া মা-এরে আঁতুড় ঘরে শুয়াইয়া দেওগা আর এক গামলা জল চুলার উপর বসাইয়া নিচে আগুন জ্বালাইয়া রাহ গিয়া—আমি এই আইতাছি। বাড়ি ফিরে দিবাকর দেখে করিমের বউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।নিয়তি আঁতুড় ঘরেই শুয়ে আছে আর গোঙাচ্ছে।

চারদিকের শুনশান সকাল নিয়তির আর্ত-স্বরে যেন নিজেও আজ কাঁদছে।  দিবাকর কী করবে বুঝতে না পেরে আবার সাবিত্রীর মায়ের বাড়ির দিকে  যাবে বলে ঘুরতেই দেখে সাবিত্রীর মা আসছে। তার কোন উত্তেজনা নেই। ঘর থেকে একগাদা পুরনো কাপড়চোপড় নিয়ে সে আঁতুড়ে প্রবেশ করতে করতে দিবাকরকে বললো –বাবা জল বসাও নাই—বসাও গিয়া—যাও এইহানে খারোইয়া থাইক্য না। বারান্দায় করিমের বউকে দেখে তাকেও সাবিত্রীর মা বললো—যাওতো বউ দেহত জল গরমডা---।  

করিমের বউকে রান্নাঘরের সামনে পেয়ে দিবাকর হাতে স্বর্গ পেল।---ও ভাবী দেহুইন জল কিবায় গরম অইবো।--এই বলে দিবাকর রান্নাঘর ছেড়ে দিয়ে বাইরে এসে পায়চারী করতে লাগলো। রেডিওর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু যেতে পারছে না। বাড়ির বাইরে রাস্তায় যেতে মন চাইছে, কিন্তু যেতে পারছে না। অবিন্যস্ত পায়ে সে উঠোনের এদিক ওদিক করতে লাগলো। এইসময় কোথা থেকে করিম এসে দাঁড়ালো তাদের উঠোনে । দিবাকর তার দিকে তাকিয়ে বলে—কারে খুঁজ? করিম বলে—হুনলাম হ্যায় আফনেরার দিকে আইছে। দিবাকর বললো—যাও রান্দাঘরে দেহ গিয়া। করিম তাদের রান্না ঘরে ঢুকে গেল। দিবাকরের ছেলেরা ঘুম থেকে ওঠার পর করিমের বউ তাদের নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পর করিম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দিবাকরকে বললো—আফনে খারোইয়া আছুইন ক্যান—চাউল বাইর কইরা ধুইয়া দ্যান গা –ভাত বসাইয়া দিবনে হ্যায়—পুলাফানগুলা খাইবো কি এট্টু পরে--? দিবাকর চাল খুঁজতে ঘরে ঢুকলো। কিন্তু চাল খোঁজার বদলে সে চমকে উঠলো। একটা রিণ রিণে  শিশুকন্ঠের কান্না যেন তার কানে ঢুকতে লাগলো। শোনা গেল কান্নাটা বারান্দার আঁতুড় ঘর থেকেই আসছে আর ক্রমে উচ্চগ্রামের দিকে উঠতে চাইছে। শোনা গেল শুধু না—কান্নাটা ক্রমে শুনশান ঘরবাড়ির উপর উঠে গিয়ে তাদের আম- জাম-সুপারি ও সবচে উঁচু নারকেল গাছটির মাথা ছুঁয়ে দশদিকেই ছড়িয়ে পড়তে চাইছে। দিবাকর থমকে গেল।

ধীরে ধীরে সে উঠোনে   নেমে এসে  দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই কান্নার বৃষ্টিতে স্নান করতে  লাগলো। একসময় পায়ে পায়ে  এসে আঁতুড় ঘরের সামনে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই সময় উলু দিতে হয়। কে দেবে—নেই কেউ  উলু দেয়ার। আঁতুড় ঘরের পর্দা সরিয়ে সাবিত্রীর মা মুখ বাড়িয়ে  দিবাকরকে দেখে হাসি মুখে বললো—সোন্দর একখান মাইয়া অইছেগো বাপ, ঘরে লক্ষ্মী আইছে—অ করিমের বউ, মা’রে গরম জলডা লইয়া আয় দেহি এইবর। রান্নাঘরের আড়াল থেকে করিমের বউ সবই শুনতেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই সে গামলা ভর্তি গরম জল নিয়ে গিয়ে আঁতুড়ের সামনে রাখলো। দিবাকর কতক্ষণ সবকিছু ভুলে ছিল খেয়াল নেই। খেয়াল হইলো করিমের বউয়ের ডাকে—দুলাভাই, আফনে অহন কুদাল লইয়া একটা গর্ত খুঁড়েনগা ঘরের ফিছনে । দিবাকর চমক ভাঙ্গতেই মাথা নিচু করে কোদাল খুঁজতে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর দিবাকর মাইয়ার মুখ দেখে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালো। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার অনুভূতি তার। একটা বিড়ি খাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে সে পুকুর পারের দিকে হাঁটতে লাগলো। বেশি সময় একা একা তার বিড়ি খাওয়া হলো না। চোখে পড়লো করিম ছুটতে ছুটতে তার  দিকে আসছে দেখে সে ভয়ে উঠে দাঁডিয়ে পড়লো। কিন্তু করিমের মুখে চওড়া হাসি।---দুলাভাই হুনছুইন যুদ্ধ নাহি থাইম্যা গেছে---পাকিস্তান হাইরা গ্যাছে। পুকুর পাড় আর তাদের বাড়ির মধ্যে দিয়ে গেছে সরকারী রাস্তা। ধীরে ধীরে সে রাস্তা দিয়ে দেখা গেল  দলে দলে লোক যাচ্ছে। আমিত্তিপুরের লোকজনইতো মনে হয়—যায় কোথায় !  

শোনা গেল তারা সবাই মোহনগঞ্জের দিকে হাঁটা দিয়েছে—ওইখানে নাহি বাংলাদেশের নিশান উড়াইছে। দুলাভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে করিমও সেই দিকে ছুট লাগাইলো। যেতে যেতে বলে গেল--আমরার পোলাফাইনগুলা বাড়িত আছে—দেহুইনযে---। মানুষজন  চলে যাওয়ার পর শ্রীমন্তপুর যেন আরো নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো। আরো একটা বিড়ি খেয়ে দিবাকর বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। বুঝতে পারলোনা কী কারণ, শুধু টের পেল তার চোখ আজ কেমন ভেজা ভেজা।

সমাপ্ত

আপনার মন্তব্য