যত দোষ মিডিয়া ঘোষ

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-১১ ০১:০৫:১৮

মাসকাওয়াথ আহসান:

ঘটা করে পালিত হলো নারী দিবস। চারপাশে কথার খই। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-সেলফিতে একাকার নারী অধিকারের দোকানদারেরা। নারীকে সম্মান জানাতে “নারী দিবসে”  বিভিন্ন দপ্তর নারীর অধীনে পরিচালনার ঘোষণা দিতেই সবার চোখ আনন্দ অশ্রুতে থৈ থৈ করছে। এই প্রতীকী নারীর ক্ষমতায়নে আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যায় দপ্তরগুলোতে নারী নেতৃত্বের এতই অভাব যে একটি বিশেষ দিবসে ক্ষমতার অলংকার পরিয়ে একটা বিরাট আত্মতৃপ্তির চোয়াল বিস্তৃত হাসিতে বিগলিত পুরুষ সমাজ। এ যেন মামুজান একদিন শখ করে বলছে, ভাগ্নী আইজকা নারী দিবস; আইজকা সারাদিন তুমি আমার বাইসাইকেল নিয়া ঘোরাঘুরি করো; কাইলকা আবার দিয়া দিও। ভাগ্নীকে বাই সাইকেলে বসিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে একটি সেলফি তুলে মামুজান ফেসবুক স্টেটাস দিয়ে দেয়, আজকের দিনটি শুধুই কন্যা-জায়া-জননীর এবং ভাগ্নীর।

ভালোই যাচ্ছিলো নারী দিবসটি। হঠাত বাধ সাধলো সুন্দরবনের ব্যঘ্র সদৃশ এক মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য। উনি একজন মহামানব। উনার কাছে কোন কিছুই কোন বিষয়ই নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু কোন ব্যাপার নয়। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য কারো বাড়তি কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। শুধু গরু-ছাগল চিনলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যায় যে কোন লোককে। নৌ দুর্ঘটনায় অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনায় মহামানব উদাস চোখে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। সুন্দরবনে উনার ঠিক করে দেয়া রুটে তেলবাহী লঞ্চ ডুবে বনের মাঝের খালগুলো তেল-কালিতে মাখামাখি হয়ে গেলেও তিনি নির্বিকার।

আসল কাজের কাজ যখন কোনটাই ঠিকঠাক হচ্ছে না; তখন মহামানব ভাবেন, অনেক হয়েছে এসব পার্থিব কাজ। এবার কিছু স্পিরিচুয়াল ইনপুট দিতে হবে এ জগতকে। সুতরাং বিভিন্ন সংগঠনের বাঁশীতে ফুঁ দেয়া কর্মসুচি থেকে শুরু করে সেমিনার সিম্পোজিয়ামে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। নিত্য নতুন জ্ঞান দান করেন। দেশপ্রেমের মঙ্গল প্রদীপ জ্বালা থেকে কবুতর ও বেলুন ওড়ানো তার নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

আর বিভিন্ন রকম সংগঠন বিশেষ বিশেষ দিবসে একটা সেমিনার করে। সেমিনার করতে গেলে একজন মন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করলে মিডিয়া কাভারেজের সুবিধা হয়। নারী দিবসের যে কোন অনুষ্ঠানে যুগের পর যুগ নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন একজন মহিয়সী নারীকে প্রধান অতিথি করলে মিডিয়ার ক্যামেরা আসে না। ক্যামেরা না আসলে আয়োজকদের লাভ কী! সাতটার বুলেটিনে ১২ সেকেন্ডের একটা বাইট দেয়া না গেলে শ্যালিকাদের সামনে মুখ দেখানোর জো থাকে না আয়োজক দুলাভাইয়ের।

দাতা সংস্থাগুলোও মিডিয়া কাভারেজের ভিডিও ফুটেজ ছাড়া খুশী হয়না। আর মন্ত্রী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হলে মন্ত্রীর উসিলায় একদিকে মিডিয়া কাভারেজ হয়; উপরন্তু মন্ত্রীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে দিলে মহল্লার লোক সমঝে চলে। এই লোকের মন্ত্রীর সঙ্গে ওঠাবসা আছে; সে কী যা-তা ব্যাপার।

নারী দিবসের আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিতে এসে মহামানব মন্ত্রীর মাঝে এক শিক্ষক ভর করে। উনার ইচ্ছা করে জেন্ডার স্টাডিজের একটা ক্লাস নিয়ে নিই। নারীরা মুগ্ধ হয়ে বক্তব্য শোনেন। আহা এই মানুষটির এতো মায়া- এতো জ্ঞান আর মুখপোড়া মিডিয়া সারাক্ষণ এই মহামানবের পিছে লেগে থাকে। এক মহিয়সী নারী বলেন, আজ এই সেমিনারে না এলে জানা হতো না এতো খাঁটি মানুষ এখনো এই পৃথিবীতে আছেন।

মহামানব বলেন, একটা শহরে কোটি কোটি মানুষ থাকলে মানুষে মানুষে ধাক্কা লাগতেই পারে। গাড়ীতে গাড়ীতে ধাক্কা লাগার মতই ব্যাপার। কাজেই নারীর সঙ্গে উতসবে আয়োজনে পুরুষের সামান্য ধাক্কা লাগাটাকে এতো বড় করে দেখার দরকার কী। এরচেয়ে মারাত্মক ঘটনা বিদেশে ঘটে।

বিদেশে অবশ্য একটা লঞ্চডুবি হলে নৌমন্ত্রী পদত্যাগ করে। কিন্তু কোন কোন শান্তির সবুজ ব-দ্বীপ থাকে যেখানে প্রতিদিন একটা করে লঞ্চ ডুবলেও নৌমন্ত্রী পদত্যাগ করে না। মহামানব বিদেশে নারীর সঙ্গে ঘটা মারাত্মক ঘটনার ঘনঘটা সম্পর্কে জানেন; কিন্তু দুর্ঘটনার দায়িত্ব নিয়ে মন্ত্রীর পদত্যাগ করার ঘনঘটা সম্পর্কে বোধহয় কিছুই শোনেননি।

মহামানব অত্যন্ত মানে যথাসম্ভব মায়াবী কন্ঠে উপস্থিত বিদগ্ধ নারী সমাজকে বোঝান, ছোটখাট ব্যাপারকে বড় করে দেখতে নেই। উপস্থিত নারীদের কারো একবারো মনে হয়না মন্ত্রীকে বিনয়ের সঙ্গে বলা দরকার, নারী-শিশু-অন্যসম্প্রদায়ের মানুষ এরকম স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোতে একটু বুঝে শুনে মন্তব্য করতে হয়। এদের প্রতি যে কোন সহিংসতার ঘটনাকে হালকা বা খাটো করে দেখলে অপরাধীরা প্রশ্রয় পায় মানসিকভাবে।

মিডিয়ায় মন্ত্রীর এই জেন্ডার সংবেদনশীলতার অভাবমন্ডিত বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন হয়। “ কোন বিষয়ই নয়”। দৈনিক বদলে দাও পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়। মন্ত্রীর সমর্থকদের মস্তিষ্ক গরম হয়ে যায়।

--এমন কথা উনি বলেন নাই; এই কারণে আমি এই ফালতু দৈনিক বদলে দাও পড়িনা। ওরা টুইস্ট করে সংবাদ ছেপেছে।

মিডিয়া এবং সাংবাদিকদের তুলোধুনা করে দেয়াই আজকের সমাজের প্রচলিত বিনোদন। আগে প্রায় প্রতিটি লোকই ছিলো জ্যোতিষী কিংবা হোমিওপ্যাথির শখের ডাক্তার। যুগের পরিবর্তনে এখন সবাই মিডিয়ার সমালোচক। তারা মনে করে মিডিয়ার সমালোচনা গাছের পেয়ারা পাড়ার মতোই অত্যন্ত সহজ। আর সাংবাদিকের সমালোচনা হচ্ছে কিশোরীর হাতের মোয়া।

হঠাত দেখা যায় দিনবদল ডটকমও মহামানবকে নিয়ে খবর ছেপেছে, “কোন বিষয়ই নয়”। দৈনিক বদলে দাও সরকার সমর্থকদের “শয়তানকে পাথর ছোড়ার” নিয়মিতব্রত। কিন্তু দিনবদল ডটকম সরকার সমর্থকদের খুবই আদরের মিডিয়া মাজার। তবে কেন এমন হলো!

একই টুইস্ট দুটি দা-কুমড়া সম্পর্কের মিডিয়া নাচবে না এতো কমনসেন্স। কিন্তু ক্ষমতার আবেশ ও সেলফি মস্তিষ্কে ওপিয়ামের মত কাজ করে। একজন প্রতিবেদক একটা প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর সাব এডিটর প্রথমে এটি সম্পাদনা করেন। এরপর সিনিয়র সাব এডিটর সেটি পুনঃসম্পাদনা করে খবরটি সম্পর্কে নিশ্চিত হলে বার্তা সম্পাদকের কাছে জমা পড়ে সে প্রতিবেদন। বার্তা সম্পাদক খবরটির সত্যতা ও এর পক্ষে প্রমাণাদি আছে কীনা তা আরো নিশ্চিত হয়ে তবে খবরটি প্রকাশ করেন। দৈনিক বদলে দাও এবং দিনবদলডটকম সম্পর্কে যতই মিশ্র অভিমত থাকুক না কেনো; খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে এই ধাপগুলো তারা মেনে চলবেই। যুগের পর যুগ মিডিয়া এভাবেই কাজ করে। যারা করে না; তারা দ্রুত ক্রেডিবিলিটি হারায়। কিন্তু “ফিলগুডে’আসক্ত লোকজনকে এসব বোঝাবে এটা কার সাধ্য।

আর মন্ত্রী মহোদয়কে প্রধান অতিথি করা মানেই মিডিয়া ( বিপদ) ডেকে আনা। মন্ত্রীর বক্তব্যের অডিও-ভিজুয়াল প্রমাণাদি থেকে যায় নানা মিডিয়ায়। ফলে কেউ যদি ঘুম থেকে উঠে খবর দেখে হুংকার দিয়ে ওঠে, আমি প্রত্যক্ষদর্শী বলছি মন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে; সেটা দিনশেষে শোনায়, আমি প্রত্যক্ষদর্শী বলছি সূর্য আজ পশ্চিমদিকে উঠেছিলো। কিন্তু মিডিয়া লিখেছে, সূর্য পূর্ব দিকে উঠেছে; আই হেট জার্নালিস্টস।

ওদিকে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক গোটাকতক নারী জাগরণের ফ্যাশনেবল ক্যাট ওয়াকার প্রত্যেক নারী দিবসেই টিভিতে এসে হিহি-হাহা করে; গোটা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলেছে এমন একটি দেহভঙ্গী তাদের। এরাও ক্ষমতার আবেশের ওপিয়াম সমাজ। তারা সেজেগুজে টিভি শো করে। তারপর সেলফি তুলে ফেসবুকে দিয়ে লাইক-লাভ-অশ্রুজল-“আন্নে আমার আইকন”-“ক্যামনে পারেন”—“আপুনি এত্তো এত্তো ভালোবাসা” জাতীয় পেলব প্রশংসার ইউফোরিয়ায় এরা এতোই ব্যস্ত দিন কাটায় যে মন্ত্রীর জেন্ডার সেনসিটিভিটি বর্জিত বক্তব্যের খবর তাদের কানে পৌঁছায় না। পৌঁছালেও তাদের অনুশীলিত নির্লিপ্ততার ধ্যানে মগ্ন থাকতে হয়। ক্ষমতা-কাঠামোর গায়ে ফুলের টোকা লাগলে যদি নিজেদের ফুল খেলবার দিনগুলো না থাকে এই আশংকায় তারা ব্যস্ত থাকে তাদের সেলফির কিটি পার্টিতে। এই মন জুগিয়ে চলা “সফল যারা কেমন তারা” নারীদের কাছেও বর্ষবরণের নারী নিগ্রহের ঘটনাটি তেমন “কোন বিষয় নয়”।

ব্রেণলেস বিউটিরা রাজত্ব করে কনে দেখা আলোয়, মিডিয়ায়, কর্পোরেট রেড কার্পেটে, শোবিজে, নানাদপ্তরে, মন্ত্রীসংকুল সেমিনারে, এমন কী ফেসবুকে। এরাও নববর্ষে নারীকে ধাক্কা দেয়া উপপুরুষের মত নানাছলে শান্ত-সৌম্য-মেধাবী-নিরাপোষ নারীদের ধাক্কা দিয়ে পিছে ফেলে দিয়ে এগিয়ে যায় সাফল্যের “লাস্যদৌড়ে”। যাকগে এসব কোন বিষয় নয়। আসল দোষ মিডিয়ার। যত দোষ মিডিয়া ঘোষ। তারাই যে হ্যাঁচকা টানে খুলে দেয় এক একটা মেক-আপ চর্চিত মুখোশ!

গল্পের সবগুলো চরিত্রই কাল্পনিক ও স্যাটায়ারপূর্ণ। জীবিত, মৃত কারও সঙ্গে মিলে গেলে এটা নেহায়েত কাকতাল।

আপনার মন্তব্য