হ্যালুসিনেশনের এক জীবন্ত উপন্যাস ‘জীবনানন্দ দাশের লক্ষ্মীপেঁচা’

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-১২ ০১:৪১:২০

রেজা ঘটক:

ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে এক গবেষণায় দেখা গেছে, সারাবিশ্বে গড়ে প্রায় শতকরা ১০ ভাগ মানুষ হ্যালুসিনেশানে আক্রান্ত ছিল। ঠিক একশো বছর পর বিংশ শতকের শেষের দিকে আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, সারাবিশ্বে অন্তত প্রায় শতকরা ৩৯ ভাগ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের হ্যালুসিনেশানে ভোগেন।

হ্যালুসিনেশান কী? চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটি মানুষের এক ধরনের জটিল অথচ অলীক বীক্ষণ বা কাল্পনিক অস্তিত্বে বিশ্বাসের উপলব্ধি। বাস্তব নয় বা পুরোটা অবাস্তব বা অলীক বা কাল্পনিক কোনো বিষয়ের প্রতি কারো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কল্পনার সমাহারের কীর্তিকলাপ হলো হ্যালুসিনেশান। যাকে সংক্ষেপে বলা হয় সাইসিয়াট্রিক ডিসঅর্ডার। কথাসাহিত্যিক জেসমিন মুননী এবার মানুষের আচরণের এই জটিল বিষয় বা হ্যালুসিনেশানকে বিষয়-আশয়কে আখ্যান করে লিখলেন তার প্রথম উপন্যাস 'জীবনানন্দ দাশের লক্ষ্মীপেঁচা'।

উপন্যাসের গল্পটি এরকম- বাহান্নের ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিক্ষোভের দিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আয়েশা সিদ্দিকার জন্ম। যার বাবা জামিল সিদ্দিকি ভাষা আন্দোলনের অন্যান্য ভাষা সৈনিকদের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে সক্রিয় ছিলেন। ঢাকায় জামিল সিদ্দিকিদের ছিল পৈতৃক সূত্রে হোটেল ব্যবসা। জামিল সিদ্দিকির বাবা দেশ বিভাগেরও অনেক পূর্বে মির্জাপুর থেকে ঢাকায় এসে এলিফ্যান্ট রোডে বসবাস শুরু করেন এবং হোটেল ব্যবসা চালু করেন। রাজনীতির পাশাপাশি হোটেল ব্যবসার কারণে সিদ্দিকি সাহেবের পরিবারকে ঢাকার সবাই তখন থেকেই এক নামে চিনতেন।  রাজনীতি করার কারণে জামিল সিদ্দিকি ছিলেন কিছুটা সংসারবিমুখ। কিন্তু কন্যা আয়েশা'র জন্মের পর তিনি সংসার আর ব্যবসায় ভারী মনোযোগী হলেন। একসময় ধীরে ধীরে হোটেল ব্যবসায় ধ্বস নামলো। কিন্তু ততোদিনে বিদুষী নারী হিসেবে কন্যা আয়েশা'র সুনাম তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আইএ পরীক্ষার পর বাবা জামিল সিদ্দিকি বন্ধু'র ছেলের সঙ্গে কন্যা আয়েশার বিয়ে দিলেন। একাত্তরে আয়েশার স্বামী সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে যখন লন্ডনে। এদিকে তখন যুদ্ধ শুরু হলে রাজাকারদের হাতে নিহত হন জামিল সিদ্দিকি। অসহায় মা রাবেয়া খাতুন প্রেগন্যান্ট কন্যা আয়েশাকে নিয়ে তখন আশ্রয় নিলেন বাবার বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। দেশ স্বাধীন হবার দু'মাস আগে আয়েশা ভূমিষ্ঠ করলো তার প্রথম সন্তান। মা রাবেয়া খাতুনের মত আয়েশারও প্রথম কন্যাসন্তান। আয়েশা'র কন্যার নাম রাখা হলো আদৃতা। আলোচ্য উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এই আদৃতা।

দেশ স্বাধীনের পর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ কলোনিতে বড় হতে থাকে আদৃতা। আদৃতা'র ছোট একটি ভাই আছে। যার নাম আবির। মা আয়েশা'র মত আদৃতাও খুব রূপসী, লাবণ্যময়ী, মায়াবি। বয়ঃসন্ধিকালেই যার রূপলাবণ্যে কলোনিতে নানান কিসিমের বেনামী উড়োচিঠি আসা শুরু হয়। যে কারণে মা আয়েশা আদৃতাকে অনেকটাই চোখে চোখে রাখা শুরু করলেন। কলোনির মাঠে যেখানে ছিল আদৃতার বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলাসহ অবাধ বিচরণ, সেই আদৃতাকেই বয়ঃসন্ধিকালে এই উড়োচিঠির কারণে মা আয়েশা সামাজিক চক্ষুর বিষদাঁতকে আড়াল করতে তাকে ঘরে আটকাতে বাধ্য হলেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র তখন আদৃতা সবসময় মায়ের কঠোর অবরোধের মধ্যে ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করল। কলোনির ছোট্ট রুমে ক্লাস সেভেন থেকেই আদৃতার এই অনাকাঙ্ক্ষিত বন্দিজীবন অনেকটা যেন জেলখানার কয়েদির মত। কোথাও তার আর একা যাবার স্বাধীনতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হলে তাই আদৃতা বেছে নেয় মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার অভিনব কৌশল। শৈশবে কলোনিতে একসঙ্গে বড় হওয়া আরিফের সঙ্গে তার এক পর্যায়ে বন্ধুত্ব হয়। আরিফ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের একজন তুখোড় কর্মী আরিফ। আরিফের মধ্যেই আদৃতা যেন নিজের নানার প্রতিচ্ছবি দেখে দেখে আরিফকে ভালোবাসতে শুরু করে। সবার অলক্ষ্যে তাদের ডেটিং চলতে থাকে বন্ধু'র বাসায়।

এদিকে আদৃতার বাবা মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন। ছেলে সদ্য বিসিএস পাস করে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বাগেরহাটে পোস্টিং। ছেলেপক্ষের সঙ্গে পাকাপাকি হয় যে, আদৃতার ফার্স্ট ইয়ার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার পরেই বিয়ে হবে। সেদিন ছিল আদৃতার জন্মদিন। সেদিন-ই সন্ধ্যায় সাংগ্রিলা রেস্টুরেন্টে ছেলেপক্ষ মেয়েকে আংটি পড়িয়ে যাবার কথা। পরীক্ষার পর বিয়ের আসল আনুষ্ঠানিকতা হবে। এমনই সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু আগের রাতে আদৃতার একটুও ঘুম হয়নি। কী করবে সিদ্ধান্তহীনতায় নির্ঘুম রাত কেটেছে আদৃতার। স্বাভাবিকভাবেই সকালে মা-বাবা আদৃতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বাবা আদর করে মেয়েকে বলেছে- বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ তুমি গাড়ি নিয়ে যাও। একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। পার্লারে যাবার দরকার নেই, মায়ের হাতে সেজো। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একসময় আদৃতা খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হয়। প্রাইভেট পড়া শেষ করে বান্ধবী শিপ্রাকে সঙ্গে নেয় আদৃতা। মাঝখানে চট্টগ্রাম কলেজের সামনে ফোন ফ্যাক্সের দোকান থেকে শিপ্রার মাধ্যমে যোগাযোগ করে আরিফের সঙ্গে। অন্যান্য দিনের মত ষোলশহর স্টেশনে কৌশলে ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়ে দুই বান্ধবী সোজা চলে যায় নাজমুলদের বাসায়। যেখানে আসলে আদৃতা আর আরিফ সুযোগসুবিধামত নিয়মিত ডেটিং করত।

সেদিন বিকালে আরিফ আর নাজমুল সব আয়োজন পাকা করলে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতেই আইনগতভাবেই আদৃতা ও আরিফের বিয়ে হয়। তারপর ওরা বন্ধুদের নিয়ে সোজা রওনা হয় আরিফের নানাবাড়ি কুমিল্লায়। সেখানে আদৃতার বাবার পাঠানো পুলিশের জেরার মুখে পরতে হয় এই নব দম্পতিকে। কিন্তু সবকিছু আইন মত হওয়ায় আদৃতার দৃঢ়তার কাছে হেরে যায় আদৃতার মাতৃপিতৃকূল। এরপর আদৃতা-আরিফের নতুন সংসার জীবন শুরু হয় ঢাকার ইন্দিরা রোডে। কিন্তু কোথায় যেন প্রকৃতির কী রহস্যময় হেয়ালী তা একদম কিছুই টের পায়নি আদৃতা। এরপর বিদ্রোহী আদৃতা যখন প্রেগন্যান্ট তখন তার অনার্স ফাইনাল সামনে। এরমধ্যে হঠাৎ উভয় পরিবার একটি নাটকীয় সমঝোতায় পৌঁছায়। সমঝোতার বিষয়টি কেবল পরিস্থিতি বিবেচনায় অজানা ছিল আদৃতার। কারণ আরিফ তখন ক্যান্সারের শেষ পর্ব পাড়ি দিচ্ছে। একা আদৃতা আরিফের এসবের কিছুই জানে না। শেষ পর্যন্ত আরিফ ক্যান্সারের কাছে হার মানে। আদৃতা আবার ফিরে যায় মা-বাবার কাছে। এক সময় স্বাভাবিক নিয়মে জন্ম হয় আদৃতার প্রথম সন্তান মুমু'র। কয়েক বছর না যেতেই আবার আদৃতার বিয়ে হয় শাহরিয়ারের সাথে। শাহরিয়ারেরও আদৃতার মত আগে একটি বিয়ে ছিল। সেই ঘরে একটি তিন বছর বয়সি ছেলে আছে কাইফ। ছেলেটি অটিস্টিক। দ্বিতীয় বিয়ের পরে সেখানেও আদৃতার আরেকটি মেয়ে হয়। মেয়ের নাম ফারিসা। মুমু, কাইফ, ফারিসা এই তিন সন্তান নিয়ে আদৃতা-শাহরিয়ারের সংসার এগিয়ে চলে। কিন্তু জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতে ধীরে ধীরে আদৃতা হয়ে যায় এক জটিল হ্যালুসিনেশনের রোগী।

মা আয়েশা সিদ্দিকার পছন্দের ডাক্তারের কাছেই নিয়মিত যেতে হয় আদৃতাকে। আদৃতার জীবনের এই নানান বাক-পরিবর্তন, ঘটনা-প্রতিঘটনা, ঘটনার পরম্পরাকে ঘিরে এগিয়ে চলে এই উপন্যাস 'জীবনানন্দ দাশের লক্ষ্মীপেঁচা'। যেখানে আদৃতা একজন হ্যালুসিনেশনের রোগী। প্রতি শনিবার তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। প্রথম প্রথম মা আয়েশা সিদ্দিকা সঙ্গে যেতেন। এখন ড্রাইভার নিয়ে নিজেই যান। মাঝে মাঝে নিজেই গাড়ি চালান, ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে। নিজের জীবনের কঠিন সময়ের নানান ঘটনাবহুল ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত আদৃতার মস্তিষ্কে তাই নানান কিসিমের ঘটনার অবিরাম উথাল-পাথাল আস্ফালন খেলা করে। ছোটবেলায় চাচির বাসায় যাবার সময় পথে বাঁশঝাড়ের আড়ালে একবার আদৃতা প্রথম হায়েনার লোলুপ দৃষ্টি'র মুখোমুখি হয়েছিল। সেই রাতে ছোট্ট আদৃতার ভীষণ জ্বর হয়েছিল। হুজুরের পানি পড়া খেয়েও সেই জ্বর সারেনি বটে। সেই থেকে আদৃতা পুরুষদের চোখ দেখলেই বুঝতে পারত কোন চোখের কী ভাষা, কী ইশারা, কী রহস্য। আর বড় হবার পর জীবনের যে বহতাকে আদৃতা মাড়িয়েছে, তারই এক জটিল সমীকরণ যেন আদৃতার মাথায় সারাক্ষণ গিজগিজ করে। যে কারণে এখন সে পুরাদস্তুর হ্যালুসিনেশনের রোগী।

কখন যে তার আরিফের কথা মনে পড়ে, কখন যে তার শাহরিয়ারের কথা মাথায় আসে, কখন যে আবার ডাক্তারের মনের ভাষা পড়ার বিভ্রমে কাটে আদৃতার, সে নিজেই তা জানে না। আবার স্বামী শাহরিয়ারের গার্মেন্টস ব্যবসার কানাডিয়ান বায়ার হিসাবে ফ্যামিলি ফ্রেন্ড জনি কার্লসও তার চিন্তাজগত কখনো কখনো এলোমেলো করে দেয়। আপাত দৃষ্টিতে বাইরে থেকে আদৃতার মনোজাগোতিক এসব বিষয়-আশয় দেখার কোনো সুযোগ নেই। কথাশিল্পী জেসমিন মুননী আদৃতার সেই মনোজাগোতিক ঘটনাবলীর নিরবচ্ছিন্ন টাটকা ঘটনাসমূহকে (দূর অতীত-অতীত-ঘটমান-বর্তমান ও চলমানতাকে) খুব কৌশলে স্বল্পকথায়, দক্ষভাষাশৈলীতে অত্যন্ত জীবন্ত অথচ টানটান উত্তেজনায় নির্ভেজালভাবে চিত্রায়ন করেছেন আলোচ্য উপন্যাস 'জীবনানন্দ দাশের লক্ষ্মীপেঁচা'য়।

এর আগে পাঠক জেসমিন মুননী'র ছোটগল্পের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। যেখানে আমরা 'মানুষ ও মানুষের গল্প', 'কুয়াশা ও দীর্ঘশ্বাসের দিন' 'লেখক ও নায়িকার দ্বিতীয় পর্ব' গল্পগ্রন্থের সঙ্গে পরিচিত। ছোটগল্পে জেসমিন মুননী যে কৌশলটি ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে হাত পাকিয়েছেন, নিজস্ব একটি ভাষারীতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, নিজস্ব একটি ঢং যার বাক্য গঠন ও শব্দ ব্যবহারে ইতিমধ্যে পাঠকের নজর কেড়েছে। এবার যেন আরো দক্ষতার সঙ্গে প্রথম উপন্যাসেই জেসমিন মুননী সেই নিজস্বতাকে আরো এক উচ্চমাত্রায় নতুন বলয়ে, নতুন ঢংয়ে গল্প বলার প্রচেষ্টা দেখালেন। যা বাংলা সাহিত্যের আধুনিক উপন্যাসে নিঃসন্দেহে একটি নতুন মাইলফলক স্পর্শ করবে বলেই আমি আশাবাদী।

জেসমিন মুননী'র গল্প বলার ধরনটি চমৎকার। কোনো ধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টি না করে সোজাসুজি গল্পের একেবারে হাঁড়ির ভেতর ঢুকতে পারেন সহজেই। সেখান থেকে কাড়ি কাড়ি গল্পের অনুষঙ্গ শুনিয়ে শুনিয়ে পাঠকের একেবারে নাড়িতে পৌঁছে দেবার এক আশ্চর্য শক্তি আছে মুননী'র এই জাদুকরী কৌশলে। আমরা গার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জাদুবাস্তবতার সঙ্গে যেমন পরিচিত। আবার ভার্জিনিয়া উলফের অন্দর মহলের চিরায়ত জটিল আখ্যানের সঙ্গেও আমরা পরিচিত। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেখানে গল্পের ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত গল্প ফাঁদেন, অত্যন্ত সতর্ক পাঠক না হলে ইলিয়াসকে পাঠ করা যতোটা কঠিন, তেমনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ'র 'কাঁদো নদী কাঁদো'র গল্প যেমন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জটিল উপন্যাসের একটি। সেখানে জেসমিন মুননী'র গল্প বলার কৌশলে এক ধরনের সারল্য আছে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে, গল্প নির্বাচনের কৌশলে, জীবনের ঘটমান জটিল সংশ্রবে জেসমিন মুননী কিন্তু একটি জটিল গল্পই সহজভাবে উপস্থাপন করেন।

শব্দপ্রয়োগ, শব্দের জাদুকরী ইশারা, ব্যঞ্জনা, দ্যোতনা, মূর্ছনায় হয়তো মুননী'র লেখায় অবিরাম লক্ষণ ততোটা এখনো সুস্পষ্ট নয়, কিন্তু গল্প নির্বাচন, গল্পের জটিল বাঁক-পরিক্রমা, ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-উচাটন অনেকটা মুনশিয়ানার সঙ্গেই ইতোমধ্যে আয়ত্ত করেছেন কথাশিল্পী জেসমিন মুননী। একজন হ্যালুসিনেশনের রোগী আদৃতার কাছে যেমন সন্দেহ আর বাস্তবতার মধ্যে অনেক ফারাক, অনেক জাদুবাস্তবতা, অনেক অলীক স্বপ্নময়তা কাজ করে, তার উপলব্ধিতে যেমন কখনো দূর অতীত বা নিকট ভবিষ্যৎ, আবার কখনো অতীত আর বর্তমানের এক দোদুল্যমানতা একাকার হয়ে যায়, তেমনি কথাশিল্পী জেসমিন মুননী এক দূরুহ কৌশলে পাঠককে আটকে রাখেন তার গল্পের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। অন্ধকার রাস্তায় পথিকের যেমন রশিকে সাপ ভেবে আঁতকে ওঠার আশংকা থাকে, তেমনি জেসমিন মুননী'র গল্পের জটিল সমীকরণকে সহজে আয়ত্ত করার জন্য পাঠককে এক নতুন পরীক্ষা দিতে হয় পঠনে পাঠনে।

এমনিতে রাতের লক্ষ্মীপেঁচা এক ভারী রহস্যময় প্রাণী। পেঁচার চোখ যেন আরো জটিল রহস্যে ভরপুর। অন্ধকার অমাবস্যার রাতে বাঁশঝাড়ের হুতোম পেঁচার ডাকে গ্রামীণ ছোট্ট কিশোর-কিশোরীর বুকের ভেতর যেমন ঢিবঢিবানি ওঠে। তেমনি এক ঢিবঢিবানির অফুরান অথচ স্বচ্ছ নিটোল ধারা যেন বয়ে যায় মুননী'র 'জীবনানন্দ দাশের লক্ষ্মীপেঁচা'র বাঁকে বাঁকে, পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। সেখানে পাঠককে আরো কঠিন এক ঢিবঢিবানির ভেতর থেকে যেতে হয়, কারণ কখন যে ঘটনার দূর অতীত-পর্ব চলছে, কখন যে ঘটনার বর্তমান পর্ব চলছে, আর কখন যে অলীক স্বপ্নের ঘোরলাগা রহস্যঘেরা জাদুবাস্তবতা চলছে, তা আবিষ্কার করতে পাঠকের সেই ঘোরলাগা রহস্যময় চাঁদের মায়াবি উস্কানির আড়ালে হাবুডুবু খেতে হয়। এখানেই কথাশিল্পী জেসমিন মুননী নিপুণ দক্ষতায় সহজ-সরল ভাষার ব্যবহার সত্ত্বেও যেন উতরে যান।

তবে আলোচ্য 'জীবনানন্দ দাশের লক্ষ্মীপেঁচা' উপন্যাসের বিষয়-আশয়-প্রেক্ষিত-পরিক্রমা ও নেপথ্যের কারিগরি প্রক্রিয়াকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালে বলা যায়, একটি উপন্যাসের চরিত্ররা, পাত্রপাত্রীরা, স্থান-কাল-অবস্থান, ঘটনাবলী, ঘটনার পরম্পরা ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়-আশয়গুলো কেবল ঘটনাকেই উপস্থাপন করে না, পাশাপাশি একটি সুদীর্ঘ সময়ের নানান কিসিমের হাজারো অবিচ্ছিন্ন বিষয়-আশয়কে ঘিরে একটি সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যেতে যেতে একটি বিশাল ক্যানভাসকে চিত্রায়ন করে। যা 'জীবনানন্দ দাশের লক্ষ্মীপেঁচা' উপন্যাসে কার্যত চিত্রায়ন করতে কিছুটা হলেও ব্যর্থ হয়েছে। যদিও এখানে কয়েক বছরের ঘটনা-পরম্পরা লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু সেখানে বাংলার চিরায়ত ষড়ঋতুর রূপটি পুরোপুরি পাওয়া যায় না। আলোচ্য উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আদৃতা যদিও নগরের বাসিন্দা, কিন্তু নগরের জটিল কার্যকলাপের অসংখ্য ঘটনাবলী, যে শাটল ট্রেনে চেপে আদৃতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত, সেখানকার নানান কিসিমের ঘটনা আদৃতার মনোজগতে কোনো অনুরণন বা স্পৃহা জাগায় না দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। একজন হ্যালুসিনেশনের রোগী'র বরং এসব জটিল জটিল ঘটনার এক নিরবচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত হবার স্বাভাবিক পরিক্রমা উপন্যাসের বাঁকে বাঁকে উপস্থাপিত হলে 'জীবনানন্দ দাশের লক্ষ্মীপেঁচা' উপন্যাসটি আরো সুদৃঢ়ভাবে পাঠকের মনোজগতে কামড় দিতে পারত বলেই আমি বিশ্বাস করি।

যেহেতু উপন্যাস হিসাবে 'জীবনানন্দ দাশের লক্ষ্মীপেঁচা' জেসমিন মুননী'র প্রথম প্রচেষ্টা। হয়তো ভবিষ্যতে পাঠকের সেই অসীম ক্ষুধার বিষয়টি পূরণে মুননী আরো নজর দেবেন বলে আমি এখনো আশাবাদী। আলোচ্য উপন্যাসে কিছু কিছু বানান বিভ্রাট সচেতন পাঠককে অযথা কষ্ট দিতে পারে। যা হয়তো প্রকাশক পরবর্তী সংস্করণে ঠিক করবেন বলে আমি প্রত্যাশা রাখি। বিশেষ করে প্রিন্টার্স লাইনে উপন্যাসের নামের বানানটি ভুল করায় এটি একটি অমার্জনীয় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে বলে আমি মনে করি। ভবিষ্যতে প্রকাশক এই বিষয়ে আরো সচেতন হবেন বলেই আমি দাবি জানাই।

জেসমিন মুননী'র 'জীবনানন্দ দাশের লক্ষ্মীপেঁচা' উপন্যাসটিতে মোট আশি পৃষ্ঠা। বোর্ড বাঁধাই অফসেট কাগজে ছাপা। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী সঞ্জীব পুরোহিত। বইটি প্রকাশ করেছে মেঘ। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে দেশে ১৭৫ টাকা ও বিদেশে ৫ মার্কিন ডলার। বইটির প্রথম প্রকাশকাল ফাল্গুন ১৪২২, ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে।

আপনার মন্তব্য