দ্য সান অলসো রাইজেস

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-২৬ ১২:৩৩:০১

মাসকাওয়াথ আহসান:

কতগুলো ছেলে তার দরজায় কড়া নাড়ে। অনেক নেড়েও কোনো জবাব মেলে না। কি ব্যাপার, লোকটা কি মরে গেলো নাকি! নাকি ঘরে কেউ নেই। কড়া নাড়তে নাড়তে হাত ব্যথা হয়ে যায়।

আর্মেনিয়ান চার্চের পাশে ইট খসে পড়া একটা দোতলার ওপরে চিলেকোঠায় এক টুকরো ঘর। প্লাস্টার খসে পড়েছে। কালিঝুলি শ্যাওলায় দেয়াল জুড়ে নানা ধরণের তৈলচিত্র। বুঝিবা এই ঘরে যে মানুষটি থাকে, বসবাস করে, তার জীবনগাথা এমন অযত্নে-অবহেলায় আঁকা হয়ে গেছে।

ছাত্র কমান্ডের কয়েকজন যুবক, শীর্ণ শরীর অথচ জ্বলজ্বলে চোখ, টিএসসি'র স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সামনে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্বর্ধনা দেবে। সেইসব মুক্তিযোদ্ধাকে, যারা বিস্মৃতির চিলেকোঠায় একাকী বাস করেন। অবগুণ্ঠন-স্বেচ্ছানির্বাসন-সংগুপ্ত বেদনার ভার নিয়ে যাদের ভিতরে-বাইরে প্রতিনিয়ত দহন চলে।

হঠাৎ কতোগুলো কবুতর উড়ে যায় বাকবাকুম করে ডানা ঝাপটে। সড়সড় করে লেজ নেড়ে একটা টিকটিকি চলে যায়। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ছেলেগুলোর পা ব্যথা হয়ে গেছে। তিনি কি ঘুমাচ্ছেন, এতো বেদনা নিয়ে কি মানুষ ঘুমাতে পারে! চার্চের ঘণ্টা বাজছে। ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজেই চলেছে। হঠাৎ তিনি দরজা খুলে দাঁড়ালেন। আনন্দে ছেলেগুলোর চোখের পানি ছলছল করছে। মনে হচ্ছে তারা এক দীর্ঘাঙ্গী ধর্মযাজকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথার চুল সাদা। শুকনো টানপড়া ত্বকের মধ্য থেকে ফুঁড়ে ওঠা শক্ত চোয়াল। চোখ দুটো ধূসর। তিনি কোনো কথা বললেন না। ইশারায় ওদের ভিতরে আসতে বললেন। ছেলেগুলো সংকুচিত। ধুলোমলিন একটা ঘরে কোথায় বসবে তারা। বিছানায়, ভাঙা চেয়ারে ভাগাভাগি করে বসে।

তিনি একটা কাপড়ের হেলান চেয়ারে বসলেন। ছাদের দিকে তাকালেন। টালির ছাদ, চুনসুরকি খসে পড়ছে। লোহার পাতে মরচে। দেয়ালে বঙ্গবন্ধু, রবিঠাকুর, নজরুলের বিবর্ণ ছবি। আরেকটা ছবি চেনা গেলো না। ছেলেরা উৎসুক চোখে তাকিয়ে। তিনি এই প্রথম গমগমে গলায় বললেন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। তাঁর কোনো লেখা পড়েছ? একটা ছেলে মাথা নাড়ায়, দ্য সান অলসো রাইজেস। তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ছেলেটা বলতেই থাকে। সেখানে আপনার মতো একজন যোদ্ধার কথা আছে, জ্যাক বার্নস। আনন্দে তার চোখে পানি এসে যায়।

তিনি পা দিয়ে সরিয়ে ফেলেন কাল রাতে ফুরিয়ে যাওয়া কনিয়াকের বোতল, গ্লাস। তিনি তো একজন বাঙালী পিতাই। সন্তানদের সামনে যে করেই হোক লুকোবেন কষ্টের ইতিউতি। বাম হাত দিয়ে যখন ডান হাতের পাঞ্জাবির হাতা গুটালেন, বেরিয়ে পড়লো একটা প্লাস্টিকের হাত। ছেলেরা অবাক বিস্ময়ে তাকালো সেদিকে। 'আড়ানি ব্রিজ ওড়াতে গিয়ে একটা হাতও উড়ে গেলো।' এখনো ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে, রাজশাহী মেইল-এ পাক আর্মি আসবে। টানটান উত্তেজনা। ওদের রুখতে হবে। যেভাবেই হোক তাদের বাধা দিতে হবে। অন্তত জটিল করে ফেলতে হবে তাদের গতিপথ। কনকনে শীতের রাতে ব্রিজের নিচে বোমা বেঁধে দিয়ে ডুব সাঁতারে উঠে আসার আগেই বোমাটা ফেটে গেলো। অল্পের জন্য জানটা বেঁচে গেলো, কিন্তু হাতটা! বাম হাতটা দিয়ে তিনি ডানহাতের ওপরে জড়স্পর্শ বুলালেন।

একটা ছেলে সাহস করে বলে, আরো কিছু বলুন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে আমাদের ভালো লাগে।

তিনি হেসে ফেললেন। আনন্দে তার শিরদাঁড়া ঋজু হলো। এমনভাবে ঘাড় ফোলালেন যেন স্মৃতির ঘোড়ার কাঁধে একজন ক্ষত্রিয়। একজন মুক্তিযোদ্ধারই তো এমন শিভলরি থাকার কথা। ঈশ্বরদীতে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। যুদ্ধ করেছিলাম পাকশীতে, রূপপুরে, দাশুড়িয়ায়, আওতাপাড়ায়। জানো, শুধু লাঠিসোটা নিয়ে গ্রামের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। সাড়া মারোয়াড়ী হাইস্কুল মাঠে আমরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর এলো ঢাকা-পাবনা রোড দিয়ে পাক আর্মি আসছে। ফেরি পার হয়ে কয়েকটা জলপাই রঙ ট্রাক নগরবাড়ি পৌঁছে গেছে। অলরেডি জায়গায় জায়গায় গাছের গুঁড়ি ফেলে গ্রামের মানুষরা ব্যারিকেড দিয়েছে। একটা ভাঙা পিকআপে চড়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমরা দাশুড়িয়ার দিকে এগোলাম। ভোরবেলা হাইওয়ের নিচে মাটির ঢালে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। হঠাৎ লরির আওয়াজ পাওয়া গেলো। গ্রামবাসী হৈ হৈ রৈ রৈ করে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। লরিগুলো ব্যারিকেডে থেমে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাক আর্মি ঘাবড়ে যায়। আমরাও এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তাদের ঘিরে ফেলি। ওরা সারেন্ডার করে। রূপকথার মতো সেই সম্মুখযুদ্ধ। ষোলআনা কৃতিত্বই কিন্তু গ্রামবাসীর। আমরা শুধু সাহস যুগিয়েছিলাম। সুগারক্যান ফার্মের মধ্যে পাক সেনাদের বন্দি করে রেখেছিলাম আমরা। আহা স্বপ্নের মতো লাগে।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। পায়চারী করলেন। মনেহয় যতোবার তিনি স্মৃতির কাছে যান, তার মধ্যে একজন তরুণ যোদ্ধা জেগে ওঠে। ঘাড় ফুলিয়ে বলেন, আমরা ঈশ্বরদী মোটরস্ট্যান্ডে সেদিন বিকেলে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালাম। তিনি ওপরের দিকে তাকালেন। যেন এই মুহূর্তে তিনি দেখতে পাচ্ছেন সেই মানচিত্র আঁকা লাল-সবুজ পতাকায় হাওয়ার কাঁপন।

একজন সাহস করে সম্বর্ধনার আমন্ত্রণটা দিয়েই ফেলে। সেখানেই ভুলটা হয়। তার চোখের রঙ বদলায়। ক্ষিপ্ত বাঘের মতো ঘাড় ঘষতে থাকেন। তার গলায় কষ্টের কফ জমে থাকা একটা ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস শব্দ হয়। তারপরও যথেষ্ট বিনয়ের সাথে বলেন, কোনো কিছু পাওয়ার আশায় তো মুক্তিযুদ্ধ করিনি। গো টু দোজ অ্যাম্বিসাস পিপল হু ওয়ান্ট রিটার্ন। যারা মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়িয়েছে দেশপ্রেমের ঠোঙায়। ব্যবসা করে আঙুল ফুলে তিমি মাছ হয়েছে। তিনি শুধরে নেন, না না হাঙর হয়েছে, মনস্টার হয়েছে, রাক্ষস! তিনি একটু উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। রাজাকারদের সাথে একই টেবিলে হুইস্কিতে সিপ করেছে। কম্প্রোমাইজ করেছে। নেতা হয়েছে। গো টু দেম। গো টু দোজ ম্যাজিশিয়ানস। স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সামনে তারা তোমাদের যাদু দেখাবে।

একজন তরুণ ভীষণ সাহস দেখিয়ে বলে- না আপনাকে যেতে হবে। আমরা একজন শুদ্ধ পিতার মুখ দেখাবো সবাইকে। একজন বিশুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাকে দেখাবো। নি:স্বার্থ দেশপ্রেমিককে দেখাবো।

তিনি ক্ষিপ্ত হন। ডোন্ট বি মেলোড্রামাটিক। তোমরাও দেখছি দালাল বুদ্ধিজীবীদের মতো সুন্দর সুন্দর কথা বলতে শিখেছো। আমি কোথাও যাবো না। আই অ্যাম উইদড্রন ফ্রম সোসাইটি।

ওরা নাছোড়বান্দা। আপনাকে যেতে হবে।

ঠিক আছে আমার জীবনের ২৮টি বছর ফিরিয়ে দাও। আমার জাতির পিতাকে ফিরিয়ে দাও। দেশ স্বাধীনের পরেও এদেশে যেসব মুক্তিযোদ্ধার রক্ত ঝরেছে, তাদের ফিরিয়ে দাও। স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার গুলিতে যেসব দেশপ্রেমিক; গণতন্ত্র প্রেমিক মরেছে তাদের ফিরিয়ে দাও। তিনি হাউমাউ করে শিশুর মতো কেঁদে ফেলেন।

তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে একজন তরুণ। তার হাতটাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। পিতা আমাদের আরেকটা সুযোগ দাও। দেখে নিও তোমাদের যা বলার ছিল তাই বলবে বাংলাদেশ।

আপনার মন্তব্য