আজ ড. হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৪-২৮ ১৪:১২:১৯

মারূফ অমিত:

বাংলা সাহিত্যের প্রথা ভাঙ্গার রূপকার বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন আজ। ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি মুন্সীগঞ্জের রাঢ়িখাল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্যে প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে হুমায়ুন আজাদ ভিন্ন মাত্রা যোগ করেন।

তাঁর সমস্ত বই, প্রবন্ধ, কবিতা সৃষ্টি হয়েছে প্রথাকে অস্বীকার করে। তার প্রবচনগুচ্ছ এদেশের যুক্তিবাদী পাঠক সমাজকে করে তুলেছে সচেতন।

তাঁর লেখাতে বাঙালী মুসলমান সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামী নিয়ে যুক্তি নির্ভর বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে ভিন্ন মতবাদ তুলে ধরা হয়েছে। এতে একদিকে তিনি যেমন নন্দিত হয়েছেন, আবার নিন্দিতও হয়েছেন। এর স্বপক্ষে তার জবাব ছিল, তিনি এই গোত্রেরই মানুষ, তাই এ জাতির কাছে তার প্রত্যশা অনেক; কিন্তু যখন দেখেন বাঙালি অনিবার্যভাবে পতনকেই বেছে নিচ্ছে তখন তিনি তার সমালোচনা করেন। 

তিনি কুসংস্কারহীন এক আধুনিক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু মৌলবাদীরা তার স্বপ্নকে সত্যি হতে দেয়নি। তাঁকে হত্যা প্রচেষ্টা এবং পরবর্তিতে মৃত্যুর মাধ্যমে তাঁর মতবাদকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

হুমায়ুন আজাদের জন্ম মুন্সিগঞ্জের রাঢ়িখাল গ্রামে। জন্ম তারিখ ১৩৫৪ সালের ১৪ বৈশাখ, ইংরেজি ১৯৪৭ -এর ২৮এপ্রিল। তার আসল নাম হুমায়ুন কবীর, পরে হুমায়ুন আজাদ নামে লেখালেখি শুরু করেন। তাঁরা তিন ভাই দুই বোন। ছোটবেলা থেকে বই পড়া ছিল তাঁর নেশা। লেখালেখির শুরুও ছোটবেলা থেকেই।

হুমায়ুন আজাদ প্রথম উপন্যাস লেখা শুরু করেন ক্লাস নাইনে পড়ার সময়। শৈশবের পড়ার ঘরের সামনে ছিল একটি কদম গাছ। বর্ষায় ফুল ফুটে গাছটি রূপসী হয়ে উঠতো। এটিকে নিয়েই তিনি প্রথম উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন। ছোটবেলায় শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ ও দত্তা উপন্যাস পড়ে আপ্লুত হয়েছিলেন তিনি।

নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় কবিতা লেখার শুরু। কিন্তু প্রথম ছাপা হয়েছিল গদ্য-কচিকাচার আসরে। কচুরিফুল ছিল তাঁর চোখে সবচেযে সুন্দর ফুল! বর্ষায় পুঁটি মাছের রূপালি ঝিলিক তাঁর চোখে ছিল অপরুপ সৌন্দর্য।

মেট্রিক পরীক্ষায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ২১তম হয়েছিলেন। তারপর ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এ সময় তিনি শওকত ওসমানের সান্নিধ্য পান। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। অনার্সে হুমায়ুন আজাদ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে এমএ`তেও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি প্রচুর গদ্য ও পদ্য লিখেছেন। ভুগেছেন নিঃসঙ্গতায়, কামনায়, ডুবেছেন জ্ঞানে ও শিল্পকলায়! ১৯৬৯ সালেরই আগষ্ট মাসে যোগ দেন চট্টগ্রাম সরকারি মহাবিদ্যালয়ে। ১৯৭০-এ ফেব্রুয়ারিতে যোগদান করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক এবং ডিসেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে। ১৯৭৩-এ কমনওয়েলথ বৃত্তি পেয়ে চলে যান এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি করার জন্য। এ বছরেই প্রকাশ পায় তার কবিতার বই ‘অলৌকিক ইস্টিমার’।

১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন সহপাঠী লতিফা কোহিনূরকে। ১৯৭৬ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। ১৯৭৭ থেকে পুরোপুরি প্রবেশ করেন লেখালেখির জগতে।

হুমায়ুন আজাদের মধ্যে ছিল বহুমাত্রিক সত্তা। একদিকে তিনি ভাষা বিজ্ঞানী, আবার একই সঙ্গে কবিতা, উপন্যাস লিখে হয়েছেন সাহিত্যিক। হুমায়ুন আজাদ মূলত একজন কবি ছিলেন। যদিও তিনি সাহিত্যে বিভিন্ন শাখায় সফলভাবে বিচরণ করেছেন। কিন্তু তাঁর কবিসত্ত্বাটি কখনো তাঁকে ত্যাগ করেনি। লেখাগুলো বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায় তিনি অতিমাত্রায় শব্দ সচেতন, যা একজন কবির অনিবার্য গুণ। তাই তিনি শব্দকেই বেছে নিয়েছিল অব্যর্থ অস্ত্র হিসাবে এবং এখানেও তাঁকে ফল বলেছেন বিদগ্ধজনেরা।

বিজ্ঞানের যুগে মধ্যযুগীয় বিশ্বাসকে ঘৃণা করতে তিনি। ৫৮ বছর বয়সে ক্লান্তিহীনভাবে তিনি সৃষ্টি করেছেন ৬০টির বেশি গ্রন্থ।

হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ প্রকাশের পর থেকেই তিনি ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠির রোষানলে পড়েন। এ উপন্যাসটি প্রকাশের পর সংবাদপত্র কিংবা মিছিলে মিটিং তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। 

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় একুশে বইমেলা থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার পথেতাঁর উপর শারিরীক আক্রমণ করেন ধর্মীয়-উগ্রবাদীরা। গুরুতর অবস্থায় তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকার তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে পাঠায়।

হামলার ৪/৫ বছর পর জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের একটি ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষনেতা শায়খ আব্দুর রহমান হুমায়ুন আজাদ এবং একই সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম ইউনুসকে হত্যার নির্দেশ দেবার কথা স্বীকার করেছিলেন।

হুমায়ুন আজাদ উন্নত চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসার পরও মৌলবাদীরা তাঁর পিছু ছাড়েনি। তাকে টেলিফোন, উড়ো চিঠির মাধ্যমে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে। এই মানসিক অশান্তির নিয়ে হুমায়ুন আজাদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীকে খোলা চিঠি লেখেন। কিন্তু কেউ-ই তার চিঠিকে গুরুত্ব দেন নি।

আক্রান্ত হওয়ার বছর দুয়েক আগে জার্মান সরকারের কাছে সে দেশের কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর গবেষণা করার জন্য একটি আবেদন জানিয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। এই অস্বস্তিকর সময়ে জার্মান সরকার তার রিসার্চের জন্য অনুমোদন দেয়। ২০০৪-এর ৭ আগস্ট গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান।

১১ আগস্ট রাতে জার্মান কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের দেওয়া একটি পার্টি থেকে ভালোভাবেই নিজের ফ্ল্যাটে ফিরেন। এ রাতেই কোনো একসময় হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। ১২ আগস্ট ভোরে ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর এই মৃত্যু নিয়েও নানা রহস্য রয়েছে।

হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর জার্মান সরকারের তত্ত্বাবধানে মিউনিখে তার এপার্টমেন্টে পাওয়া সব জিনিসপত্র ঢাকায় তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। ওই জিনিসপত্রের ভেতরেই পাওয়া যায় তার হাতের লেখা তিনটি চিঠি। এগুলো তিনি লিখেছিলেন বড় মেয়ে মৌলিকে, ছোট মেয়ে স্মিতাকে এবং একমাত্র ছেলে অনন্য আজাদকে। অনুমান করা হয়, ওই লেখার অক্ষরগুলোই ছিল তার জীবনের শেষ লেখা।

হুমায়ুন আজাদের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘অলৌকিক ইষ্টিমার’, ‘লাল নীল দীপাবলি (বাঙলা সাহিত্যের জীবনী)’ ‘জ্বলো চিতাবাস’, ‘শামসুর রাহমান-নিঃসঙ্গ শেরপা’, ‘Pronominalization in Bengali’ ‘বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র’, ‘বাক্যতত্ত্ব’, ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসেন’, ‘কতোনদী সরোবর (বাঙলা ভাষার জীবনী)’, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, ‘আমাদের শহরে একদল দেবদূত’, ‘আমার অবিশ্বাস’, ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র’, ‘নারী’, ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’, ‘আধার ও আধেয়’, ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’, ‘মানুষ হিসাবে আমার অপরাধ সমূহ’, ‘কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ’, পাক সার জমিন সাদবাদ প্রভৃতি।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের স্বীকৃতি-স্বরূপ তিনি ১৯৮৬ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ‘অগ্রণী শিশু-সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার (২০০৪) এবং ২০১২ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদক (মরণোত্তর) পেয়েছেন তিনি।

আপনার মন্তব্য