জাস্টিন ট্রুডো’র আত্মজীবনী ‘কমন গ্রাউন্ড’-১

কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জীবনের কথা বলেছেন তাঁর গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’-এ। সেখান থেকে বিশেষ বিশেষ অংশ অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক।

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-০২ ১৭:০৩:৪৬

মনিস রফিক:

২৪ সাসেক্স-এ আমার ছেলেবেলা
আমার জীবনের গল্প শুরু করতে হলে আমাকে প্রথমেই ফিরে যেতে হবে এক'শ বছর পূর্বের ব্যানফ শহরে। স্কটল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব উপকূলের এবারডিনশায়ারে হালকা জনবসতি অঞ্চলে ছিল শহরটি । তখন ১৯১১ সাল। জেমস জর্জ সিনক্লেয়ার নামে এক স্কুল শিক্ষক বাস করতেন সেই শহরে। মাছ ধরা ছিল তার একমাত্র নেশা। সেই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা এক ছোট্ট নদীতে একদিন সে কয়েকজন বন্ধু নিয়ে কেবল ছিপ ফেলেছে। সেই সময় এক সামন্ত-রক্ষী এসে তাকে জানালো, সেখানে তারা মাছ ধরতে পারবে না, কারণ ঐ এলাকার জমিদার ওটার মালিক। রক্ষী সেদিন এটাও জানিয়ে গিয়েছিল, তারা যদি আর কখনো সেখানে ছিপ ফেলে তবে তাদের জেলে যেতে হবে। ইউরোপের অন্য জায়গার মত স্কটল্যান্ডেও তখন সামন্ততান্ত্রিক সময়।

অপমানিত নিরীহ স্কুল শিক্ষক জেমস তার মাছধরার জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে কিছুটা রাগে ফেটে পড়েছিলেন। রক্ষীকে উদ্দেশ্য করে তিনি প্রতিবাদী হয়ে বলে উঠলেন, এমন  সব জায়গা কখনো ব্যক্তি মালিকানাধীন হতে পারে না, এটা হবে জনগণের। তিনি এটা জানতেন, তার কথা আর প্রতিবাদের কানাকড়ি মূল্য নেই অত্যাচারী সামন্ততান্ত্রিক শাসকদের কাছে। কিছুটা খেদের সাথেই তখন তিনি বন্ধুদের বললেন, যেখানে তিনি স্বাধীনভাবে নদীতে মাছ ধরতে পারবে না, সেখানে তিনি তার জীবনের বাকী সময় কাটাতেও চান না। জেমসের এক বন্ধু তখন বলে উঠেছিলেন, তিনি বইয়ে এক অদ্ভুত জায়গার নাম পড়েছেন যেখানে ছোট ছোট ঘন বনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট ছোট নদী আর যেখানে রয়েছে টলটলে পানির ছোট ছোট অসংখ্য লেক। অবাধে মাছ ধরা যায় সেখানে। সেই নদী বা লেকগুলোর মালিক জনগণ। স্কটল্যান্ডের মত সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের কোনো রাজত্ব নেই সেখানে। বন্ধুটি সবাইকে জানিয়েছিলেন, ব্যানফ শহর থেকে প্রায় চার হাজার মাইল দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পারে ঐ জায়গাটার নাম ব্রিটিশ কলম্বিয়া।

কয়েক মাস পর জেমস জর্জ সিনক্লেয়ার তার স্ত্রী বেটসী এবং তাদের তিন বছরের ছেলে জিমিকে নিয়ে নতুন বসতির সন্ধানে পাড়ি জমান কানাডার দিকে, তারপর তারা বসতি গড়ে সেই বন্ধুর বর্ণনার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায়। ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় এসে জেমস শুধু তার মাছ ধরার নেশায় পূরণ করতে পারেন নি, বরং নতুন জায়গা তার সামনে এনে দেয় এক অফুরন্ত সুযোগের হাতছানি। তিনি দেখলেন, এখানে সামন্ত প্রভুদের দাপট নেই আর নেই কোনো সাধারণ মানুষের বঞ্চনার কোনো পরিবেশ। পূর্ব পুরুষের ভিটে মাটির মায়া নিমিষেই ভুলে গিয়ে নতুন জায়গাকে নিজের আপন স্থান ভেবে তিনি শুরু করলেন জীবনের নতুন পথ চলা।

যে তিন বছরের জিমি বাবা মায়ের সাথে এই নতুন প্রাণের জায়গাই এসেছিল, পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সে হয়ে উঠে এক পরিপূর্ণ সফল মানুষ। এই সময়ের মধ্যে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন, একজন রোডস স্কলার হন আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রয়েল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্সের একজন হয়ে যুদ্ধ করেন। এলাকার পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরবর্তীতে তিনি কেবিনেট মন্ত্রী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শেষ জীবনে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে তার জীবন কাটান। তিনি এবং তার স্ত্রী ক্যাথলিন তাদের পাঁচ মেয়ের চার নম্বরের নাম রাখেন মার্গারেট। বর্তমানে মার্গারেট এখন মন্ট্রিলে বাস করেন। এই মার্গারেটই আমার মা।

১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উত্তর ভ্যাংকুভার থেকে নির্বাচিত এমপি জিমি সিনক্লেয়ার যখন তার কাজের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা পাচ্ছিলেন, সে সময় একদল ফরাসি-কানাডিয়ান ছাত্র নৌকায় মন্ট্রিল থেকে জেমস বে পর্যন্ত ১৬শ কিলোমিটারের এক দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করে। ১৭শ শতাব্দীতে হাডসন  বে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা... ক্যরিয়াস দ্য বয়েস... যে পথে তার অভিযান চালিয়েছিলেন, মূলত সেই পথ ধরেই এই নৌকা-দলটি তাদের অভিযান চালায়। তাদের এই ভ্রমণ সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা পায়। একটা সংবাদপত্রে ছয় জন অভিযানকারীর নাম বিশেষ গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়েছিল, এই ছয় জনের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন আমার বাবা, পিয়েরে ই ট্রুডো।

আমার বাবার অভিযানটি সত্যি খুবই কঠিন ছিল। তাদের খাদ্য ফুরিয়ে গিয়েছিল। আবহাওয়া তাদের অনুকূলে ছিল না, কিন্তু সব বৈরিতার পরও বাবা উপভোগ করেছিলেন তাঁর অভিযান। এই উপভোগের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল,  এই অভিযানের মাধ্যমে তিনি তাঁর জন্মস্থান কুইবেক'কে এক অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পেয়েছিলেন। কুইবেকের গহীনের সৌন্দর্য আর মানুষ আর সংস্কৃতির অনাবিল ভালোবাসা তাঁকে এক অন্যরকম আনন্দ দিয়েছিল।  

আমাদের পরিবারে পানির প্রভাবটা ছিল অন্যরকম। সত্যি কথা বলতে কী আমার জীবনের প্রথম যে ঘটনাটা আমি স্মরণ করতে পারি তার সাথে পানির একটা সংযোগ রয়েছে। তখন আমি দু'বছরে পা দিইনি। ঘটনাটা ঘটেছিল হ্যারিংটন লেকে। সেটা হচ্ছে গতানিউ পার্কে । প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের পেছনেই সেই লেকটি। জায়গাটা ছিল বাবার খুব ভালোবাসার। উনি সময় সুযোগ পেলেই সেখানে সবাইকে নিয়ে সময় কাটাতে চাইতেন। আমি ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা বলছি। লেকের পানি তখনো পরিপূর্ণভাবে বরফে জমাট বাঁধেনি। আমাকে স্নো শ্যুট পরানো হয়েছে। বাবা আমাকে নিয়ে স্লাইডিং করে সেই জমাট বাঁধা পানির কাছে এসে পড়ছেন। বাবা আমাকে নিয়ে বেশ কয়েকবার এমন উঠা নামা করলেন।

জীবনের প্রথম এমন রোমাঞ্চিত এক ঘটনায় আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠছিলাম। একটু দূরে একটা টিলায় দাঁড়িয়ে মা আমাদের আনন্দ উপভোগ করছিলেন। মার পেট তখন ফুলে ছিল। কারণ আর কিছুদিন পরই আমার ছোটভাই সাচা'র পৃথিবীতে আসার সময় হয়ে গিয়েছিল। বাবার সাথে কয়েকবার স্লাইডিং করার পর আমি যখন প্রচুর আনন্দ পাচ্ছিলাম, তখন বাবার মনে হয়েছিল আমি নিজে নিজেই ওপর থেকে নিচে নেমে পড়তে পারবো। বাবা এমন ভেবেই আমাকে স্লাইডিং এর ওপর থেকে আমাকে নীচে গড়িয়ে দিলেন। আমি আনন্দে চিৎকার করেই নীচে নামছিলাম, হঠাত আমার কানে আসলো মায়ের চিৎকার। 'আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চা' বলে মা চিৎকার করছিলেন।

আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি আছড়ে পড়েছিলাম বালুর ওপর এবং আমার শরীরের কিছু অংশ গিয়ে পড়েছিল বরফ-পানির ওপর। আমার শরীর জুড়ে তখন বাচ্চা বিড়াল সাঁজের স্নো শ্যুট। আমার তখন একটায় চিন্তা আমার সাধের স্নো শ্যুটটা পানিতে ভিজে যাবে নাতো। বাবা এসে আমাকে উদ্ধার করতে করতে আমার তখন কিছুটা পানিতে ভেজা হয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে মুহূর্তটার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে, কারণ আমি মনে করি, ওভাবেই আমি ঘরের বাইরে প্রথম ব্যাপ্টাইজড হয়েছিলাম।

আমার জীবনের এই প্রথম স্মরণীয় ঘটনার পূর্বে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। সেটা ছিল  আমার জন্ম মুহূর্তে। স্যার এ ম্যাকডোনাল্ড ছিলেন কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি২৪ সাসেস্কের সরকারি বাসভবনে থাকা অবস্থায় সন্তানের বাবা হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে আমার যখন জন্ম হয় তখন আমার বাবাও কানাডার প্রধানমন্ত্রী। আমার জন্ম হয়েছিল অটোয়ার সিভিক হাসপাতালে। সেসময় প্রসবকক্ষে স্ত্রীর পাশে স্বামীর থাকার নিয়ম ছিল না। আমার জন্মের সময় আমার বাবা আমার মায়ের পাশে থাকবেন না এ বিষয়টি আমার মা কোনক্রমেই মানতে চান নি। তিনি এই নিয়মের প্রতিবাদ করতে সিদ্ধান্ত নিলেন, তার সন্তান জন্ম দেবার সময় যদি তার স্বামীকে তার পাশে থাকতে না দেয়া হয় তবে তিনি হাসপাতালে সন্তান জন্ম দিবেন না, তিনি তার ঘরে সন্তান জন্ম দিবেন।

নিজ ঘর বলতে ২৪ সাসেস্ক এর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। মায়ের এই প্রতিবাদ যখন হাসপাতালের বোর্ড অব ডিরেক্টরদের কানে পৌঁছল, তখন তারা তাড়াহুড়া করে দীর্ঘদিনের প্রচলিত নিয়ম ভেঙে আমার জন্ম মুহূর্তে বাবাকে মায়ের পাশে থাকতে দিয়েছিল। অটোয়ার সিভিক হাসপাতালের এই ঘটনার পর পরই অটোয়ার অন্যান্য হাসপাতাল এবং ধীরে ধীরে কানাডার সব হাসপাতাল থেকে পূর্বের নিয়মটি বাতিল হতে থাকে।

আমি জন্মেছিলাম বড়দিনে অর্থাৎ যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিনে। আমার ভাবতেই ভালো লাগে আমার জন্মদিনে পৃথিবীর খ্রিষ্টান ধর্মের মানুষেরা আনন্দ-উৎসবে মেতে ছিল। আর আমি ছিলাম কানাডার হাসপাতালে জন্ম নেয়া সেই ভাগ্যবান শিশু মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়ে যার প্রথম শব্দ মধুর আনন্দ ধ্বনি হয়ে বেজেছিল একসাথে বাবা ও মায়ের কানে। আমার এটাও ভাবতে আনন্দ লাগে, আমার জন্মের সাথে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা কানাডার এক ঘুণে ধরা পচা নিয়মের অবসানের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য