মেঘদূত

রবীন্দ্র জন্মবাষিকী উপলক্ষে নিবন্ধ

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-০৭ ১৬:২০:৪১

সুকান্ত গুপ্ত:

কবিবর, কবে কোন বিস্মৃত বরষে
কোন পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্ত্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আধার স্তরে স্তরে
সঘন সংগীত মাঝে পুঞ্জীভূত করে।।
(মেঘদূত/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ৮জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭, ১৮৯০ খ্রি: শান্তি নিকেতন)

আষাঢ়ের প্রথম দিনের বর্ষণের সাথে মেঘদূত কবিতা এক হয়ে মিশে আছে। বর্ষার প্রথম দিনের বর্ষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমর বর্ষাকাব্য ‘মেঘদূত’ এর জনক কালিদাসের কথা মনে করেছেন। মহাকবি কালিদাসের অনবদ্য কাব্য ‘মেঘদূত’ রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ ভাবে মুগ্ধ করে এবং তাঁর মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-

‘‘আষাঢ়ের মেঘ প্রতি বৎসর যখনি আসে, তখনই নতুনত্বে রসাক্রান্ত ও পুরাতন পুঞ্জীভূত হইয়া আসে।... মেঘদূতের মেঘ প্রতি বৎসর চিরনূতন চির পুরাতন হইয়া দেখা দেয়... মেঘদূত ছাড়া নববর্ষার কাব্য কোনো সাহিত্যে কোথাও নাই। ইহাতে বর্ষার সমস্ত   অন্তর্বেদনা নিত্যকালের ভাষায় লিখিত হইয়া গেছে। প্রকৃতির সাংবৎসরিক মেঘোৎসবের অনির্বচনীয় কবিত্ব গাঁথা মানবের ভাষায় বাঁধা পড়িয়াছে।(বিচিত্র প্রবন্ধ- নববর্ষা)"

মেঘদূতের চিত্র কল্পনা, তার ভাষা ও অন্তর্নিহিত তত্ত্ব কবি মনকে এমন করে অধিকার করেছে যে, তিনি যেন কালিদাসের ভাবে ভাবানুরাগী। তিনি কবিতাটি লিখেছেন নৈপুণ্যের সাথে। মেঘদূতের কাহিনীর সাথে সাথে সেই কবিতার চিত্র বর্ণনা ও এমন কি ভাষা পর্যন্ত নিজের কবিতার অন্তর্গত করে এগিয়ে চলেছেন। যা পরের ঐশ্বর্য সম্ভার সঞ্চয় করতে করতে নিজেকে আবিষ্ট করার সুনিপুণতা। কবিতাটিতে কবিগুরু কালিদাসের কালের একটি পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা তৈরি করেছেন।

নববর্ষার আগমনে কবির মনে পড়ছে মেঘদূতের বিরহ ব্যথিত যক্ষের কাহিনী আর তার মেঘদূতের পথের ছবি ও শোভা।  সে কবিতা এমনই বর্ষার দিনে কত বিরহী পাঠ করে দুঃখের মধ্যে ও আনন্দ অনুভব করেছে। কবি সেই সবার কথা মনে করেছেন বঙ্গদেশে বসে। যেখানে আরেক কবি জয়দেব তাঁর সুললিত কাব্য গীতগোবিন্দ আরম্ভ করেছিলেন নববর্ষার মেঘ- মেদুর ছবি এঁকে। কবি আকাশে বহমান মেঘ দেখতে দেখতে তার সাথে কল্পনার কালিদাসের বর্ণিত সকল দেশের শোভা সন্দর্শন করছেন। আবার কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যান। কবি তখন চিন্তা করেন-

ভাবিতেছি অর্ধরাত্রি অনিদ্র নয়ান
কে দিয়েছে হেন শাপ, কেন ব্যবধান?
কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ?
কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ?
সশরীরে কোন নর গেছে সেইখানে,
মানস-সরসী তীরে বিরহ শয়ানে
রবিহীন মনিদীপ্ত প্রদোষের দেশে
জগতের নদী গিরি সকলের শেষে।

কবি গুরু বর্ষাকে রূপ দিয়েছেন নানা ভাবে। তাঁর কবিতায় বর্ষা কখনো বিরহিনীর বিরহ আবার কখন প্রিয় মানুষটিকে একান্তে কাছে পাবার আনন্দ, না বলা কথা বলার আনন্দ। বর্ষা এলায়েছে তার মেঘময় বেণী।’’ ইহা দেখে কবির মনে পরছে সে সময়ের বর্ষার কথা, বিচিত্র সব ছবি তার চোখের সামনে ফুটে উঠছে। চিরন্তনী নারীর প্রতিনিধি রাধা  বর্ষার আগমনে  প্রিয়া সমাগমের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন তিনি বিরহ ব্যথা সহ্য না করতে পেরে দিবাতেই অভিসারে চলেছেন। যে সব প্রবাসী প্রিয় মিলনোৎসুক হয়ে গৃহের পথে যাত্রা করে বাহির হয়েছেন সেই সব পথিকের বিরহ বধূরা শূন্য পথের দিকে কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করছে কবির চোখে সেই ছবিও ভেসে উঠছে (একাল ও সেকাল ২১ বৈশাখ ১২৯৫, ১৮৮৮ খ্রী:)

রাধাকৃষ্ণ প্রেম কাহিনী বহু পুরাতন হয়েও নিত্য নবীন, কালিদাসের মেঘদূতের যক্ষদম্পতীর বিরহ ব্যথা বহু প্রাচীন কিন্তু এখনো চির নবীন। এই দুই প্রেমিক যুগল আত্মভোলা প্রণয় নিবেদন ও বিরহ ব্যথার প্রতীক স্বরূপ। তাই এইসব কাহিনী কখনো পুরানো হয় না। নবীন প্রেমিক প্রেমিকারাও তাদের অন্তর বেদনা নিজের অন্তরে আজও অনুভব করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ বর্তমানের সঙ্কীর্ণ ভূমিতে দাঁড়িয়ে দুই হাতে অতীত ও ভবিষ্যতকে ধারণ করে মিলন ঘটিয়েছেন বহু কবিতায়। তাঁর মানসলোকে বর্তমান ভূত ও ভবিষ্যৎ একটি মালার মত গ্রথিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরহের একরূপ প্রকাশ করেছেন বর্ষার মধ্যে। যখন নববর্ষার আগমনে আর্দ্র তীর পূর্ব বায়ু বহিতেছে বেগে তখন মনে জাগিতেছে সদা আজি সে কোথায়? কতদিন সে তো আমার কাছে ছিল তবু তো তাকে আমার অন্তরতম গূঢ় কথাটি বলার অবসর পাই নাই-

কতকাল ছিল কাছে, বলিনি তো কিছু
দিবস চলিয়া গেছে দিবসের পিছু।
মনে হয় আজ যদি পাইতাম কাছে
বলিতাম হৃদয়ের যত কথা আছে।
(আকাঙ্ক্ষা- ২০ বৈশাখ ১২৯৫, ১৮৮৮ খ্রী:)

হৃদয়ের সেই কথাটি জীবনের শেষ চরমতম কথা- ‘জীবনমরণময় সুগম্ভীর কথা তাকে যদি আত্মার আঁধারে বিজনে বসিয়ে সেই কথা শুনতে পারতাম, তা হলে দুজনেই শুনতে পারতাম-

‘‘দুটি প্রাণতন্ত্রী হতে পূর্ণ একতানে
উঠে গান অসীমের সিংহাসন পানে”।

আপনার মন্তব্য