কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতায় প্রেম ভালবাসা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৬-১৫ ০১:৩১:৩৮

মনোজিৎকুমার দাস:

কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৫, ১৮৯৯–আগস্ট ২৯, ১৯৭৬) (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ ভাদ্র ১২, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) কে শুধুমাত্র বিদ্রোহ কবি হিসাবে আখ্যায়িত করলে গান ও কবিতায় তাঁর অলোকসামান্য প্রতিভার কথা না বলা থেকে যায়। তিনি সাম্যবাদী, অসাম্প্রদায়িক কবি, একইসঙ্গে বিদ্রোহী ও প্রেমিক কবি, গীতিকার, সঙ্গীতজ্ঞ । তিনি  তাঁর বিদ্রোহ কবিতায় বলেছেন ‘‘মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য.... এই পঙক্তি থেকে উপলব্ধি করা যায় তিনি একাধারে  রণ-তূর্য বাদক আর অন্যদিকে প্রেম, প্রেয়সী।

প্রেমিক নজরুলের আসল পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর রচিত গানগুলিতে৷ প্রেম-বিরহ, ব্যর্থতা, আশা, নিরাশার অনুভূতি প্রকাশে নজরুলের কোনো জুড়ি ছিল না৷ তাঁর প্রেমসংগীতগুলোর বাণী ও সুর এককথায় অনবদ্য৷ নজরুল নানা আঙ্গিকের তিন হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। পৃথিবীর কোনো ভাষায় একক হাতে এত বেশি সংখ্যক গান রচনার উদাহরণ নেই, আরো বড় কথা তাঁর নিজের লেখা গানগুলোর  বড় একটি অংশই তাঁরই সুরারোপিত। এই গানগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রেম ভালবাসার গান, ভক্তিমূলক গান, প্রকৃতি বন্দনা ও দেশাত্মবোধক গান; রয়েছে রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যঙ্গাত্মক গান, সমবেত সংগীত, রণ সংগীত ইত্যাদি৷ প্রকৃতপক্ষে নজরুলগীতির শ্রেণি বিন্যাস করলে আমরা  তাকে ১০টি ভাগে ভাগ করতে পারি।। এগুলো হলো: ভক্তিমূলক গান, প্রণয়গীতি, প্রকৃতি বন্দনা, দেশাত্মবোধক গান, রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যঙ্গাত্মক গান, সমবেত সঙ্গীত, রণ সঙ্গীত এবং, বিদেশী সুরাশ্রিত গান।

এখানে বলে রাখা ভাল নজরুলের আবির্ভাব ও কর্মকাল রবীন্দ্রযুগের অন্তর্ভূত। তবু নজরুল রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের সম্পূর্ণ বাইরে থেকে গীত রচনা করেছেন ও সুরারোপ করেছেন। তিনি বাংলা গানে বিচিত্র সুরের উৎস। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও একই সঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও সুগায়ক।

বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা নজরুলের গান ও কবিতায় প্রেম ভালবাসা তুলে ধরার আগে আমরা দেখে নিতে পারি তাঁর ভক্তিমূলক গান,  প্রকৃতি বন্দনা, দেশাত্মবোধক গান, রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যঙ্গাত্মক গান, সমবেত সঙ্গীত, রণ সঙ্গীত এবং, বিদেশী সুরাশ্রিত গানের ওপর আলোকপাত করতে পারি।

নজরুল ইসলাম একাধারে রচনা করেছেন গজল গান, কাব্য সংগীত ,ঋতু-সংগীত, খেয়াল, গণসংগীত–শ্রমিক-কৃষকের গান, ধীবরের গান, ছাদপেটার গান, তরুণ বা ছাত্রদলের গান, মার্চ-সংগীত বা কুচকাওয়াজের গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান, নারী জাগরণের গান, মুসলিম জাতির জাগরণের গান, শ্যামাসংগীত, কীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী, অন্যান্য ভক্তিগীতি, ইসলামী সংগীত, শিশু সংগীত, নৃত্য-সংগীত, লোকগীতি – ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, সাম্পানের গান, ঝুমুর, সাঁওতালী, লাউনী, কাজরী, বাউল, মুর্শিদী এবং আরও নানা বর্ণের গান। বিভিন্ন বিদেশী সুরের আদলে রচিত গানের সংখ্যাও কম নয়। এ ছাড়া লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীকে অবলম্বন করে 'হারামণি' পর্যায়ের গান তিনি রচনা করেছেন।তিনি তাঁর সৃজনশীল প্রতিভায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক  নতুন  রাগ সঙ্গীত রচনা করেছেন। তাঁর রচিত নতুন রাগ রাগিণীর ওপর ভিত্তি করে লেখা 'নবরাগ' পর্যায়ের গানগুলি নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভার অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয়বাহী।

আমরা প্রথমে তাঁর লেখা প্রেম ভালবাসার আঙ্গিকের গানের প্রথম পঙক্তি এখানে তুলে ধরে দেখার চেষ্টা করবো নজরুল কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই আঙ্গিকের জনপ্রিয় গানগুলো লিখেছিলেন।তাঁর লেখা প্রেমের গানের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর প্রথম পঙক্তি প্রথমে উপস্থাপন করছি।

'মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, , দেব খোঁপায় তারার ফুল'- , আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন-, প্রিয় যাই যাই বলো না-, প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই,আজ নিশীথে অভিসার তোমার পথে, আমি সুন্দর নহি জানি,প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই,নিশি না পোহাতে যেয়ো না যেয়ো না,তব যাবার বেলা বলে যাও মনের কথা,আমি ময়নামতির শাড়ি দেবো, তোমার হাতের সোনা রাখি আমার হাতে, যাবার বেলায় ফেলে যেয়ো একটি খোঁপার ফুল, মিলন-রাতের মালা হব তোমার অলকে, ভালোবাসার ছলে আমায়,কে নিবি ফুল কে নিবি ফুল,পেয়ে আমি হারিয়েছি গো,সখি বাঁধো লো বাঁধো লো ঝুলনিয়া, , ,এলে কি বধুঁ ফুল-ভবনে, বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে,যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই,মোরা আর জনমে হংস-মিথুন,গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়, গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে, পরো পরো চৈতালী-সাঁঝে কুসমী শাড়ি, পিয়া পাপিয়া পিয়া বোলে, বুকে তোমায় যৌবন-সিন্ধু টলমল টলমল এগুলো ছাড়াও তাঁর লেখা অসংথ্য প্রেমের গানের কথা বলা যায়। নজরুলের জীবনে দ্রোহ ছিল, ছিল প্রেম। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিতে দ্রোহের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে। নজরুলের কবিতায় প্রেমের অনুষঙ্গ বিশেষ ভাবে ধরা দিয়েছে। তাঁর প্রেমের কবিতা নারী অনুষঙ্গ উঠে এসেছে। তিনি নারীকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন তার কবিতা ও গানে। তাঁর নারী কবিতা থেকে কিছুটা তুলে ধরলে তিনি কোন দৃষ্টিতে নারীকে দেখেছেন। সাম্যের গান গাই-আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!/ বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/ বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,/ অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।/ নরককুণ্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?/ তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।/ অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,/ ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।  

তাঁর লেখা প্রেমের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করতে পারি। কবি-রাণী: তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।/ আমার এ রূপ-সে যে তোমায় ভালোবাসার ছবি।/ আপন জেনে হাত বাড়ালো-/ আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো,/  বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা/ পুবের অরুণ রবি,-/তুমি ভালোবাস ব’লে ভালোবাসে সবি?--------

তিনি তাঁর গোপন প্রিয়া কবিতায় : পাইনি ব’লে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রাণী,/ মধ্যে সাগর, এ-পার ও-পার করছি কানাকানি!/ আমি এ-পার, তুমি ও-পার,/ মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার/ ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাতছানি,/আমি মরু, পাইনে তোমার ছায়ার ছোঁওয়াখানি।নজরুল ইসলাম তাঁর অ-নামিকা কবিতায় তাঁর অনাগত প্রিয়াকে এভাবে বন্দনা করেছেন। তোমারে বন্দনা করি /স্বপ্ন-সহচরী /লো আমার অনাগত প্রিয়া, /আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া! /তোমারে বন্দনা করি…./ হে আমার মানস-রঙ্গিণী, /অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী! /তোমারে বন্দনা করি…. /নাম-নাহি-জানা ওগো আজো-নাহি-আসা! /আমার বন্দনা লহ, লহ ভালবাসা….

কাজী নজরুল ইসলামের দোলনচাঁপা  কাব্যগ্রন্থের পূজারিণী  কবিতায় ভালবাসার অনুরণন ঘটিয়েরেছন বিশেষ অনুষঙ্গে। এত দিনে অবেলায়-/প্রিয়তম !/ধূলি-অন্ধ ঘূর্ণি সম/দিবাযামী/যবে আমি/নেচে ফিরি”ধিরাক্ত মরণ-খেলায়-/এ দিনে অ-বেলায়/জানিলাম, আমি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি।/পূজারিণী!/ঐ কণ্ঠ, ও-কপোত- কাঁদানো রাগিণী,/ঐ আঁখি, ঐ মুখ,/ঐ ভুর”, ললাট, চিবুক,/ঐ তব অপরূপ রূপ,/ঐ তব দোলো-দোলো গতি-নৃত্য দুষ্ট দুল রাজহংসী যিনি’-/ চিনি সব চিনি।

বাল্যজীবন থেকে বাকরুদ্ধ পর্যন্ত কবি কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তিজীবন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ।ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যে নানা শাখায় ও গানে যে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন নজিরবিহীন। তিনি একবার বলেছিলেন যে তাঁর সৃষ্ট গানই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। তিনি নানা আঙ্গিকের গান বিশেষ করে প্রেম পর্যায়ের গানগুলো তাঁর নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও বিরহ বেদনার ফসল। একজন সত্যিকারের প্রেমিক বলতে যা বোঝায়, তা নজরুলের ব্যক্তিজীবন থেকে উৎসারিত এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

নজরুলের জীবনে কয়েকজন নারী বিশেষ ভাবে প্রভাব ফেলেছিল। তাদের সঙ্গে প্রেম ভালবাসা সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেই সব প্রেম ভালবাসা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেনি। আর তা থেকেই প্রেম ভালবাসার কবিতা ও গানে আনন্দ, আকাঙ্ক্ষা, বিরহ বেদনার অনুরণনর ঘটিয়েছেন নজরুল। তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ প্রেম বিরহের এই গানগুলো: 'মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল', প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই, মিলন-রাতের মালা হব তোমার অলকে, বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে,যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই,মোরা আর জনমে হংস-মিথুন,গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায় এর মত অসংখ্য প্রেমের গান।

নজরুলের প্রথম প্রেম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস, ফারসি ভাষায় যার অর্থ গুল্ম)। তিনি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের মেয়ে ছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকালে নার্গিসের মামা ক্যাপ্টেন আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে নজরুলের। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। নজরুল তখন মুসলিম সাহিত্য সমিতির (কলকাতা) অফিসে আফজালুল হকের সঙ্গে থাকতেন। ওই সময় আলী আকবর খানের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। আকবর খান নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে কলকাতা থেকে ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেইলে নজরুল কুমিল্লা এসে পৌঁছান।

 ময়মনসিংহের ত্রিশালে দরিরামপুরের লেখাপড়া পাঠ চুকিয়ে আসানসোলে ফিরে যাওয়ার পর  পর এটিই ছিল নজরুলের প্রথম পূর্ববঙ্গ যাত্রা। যাওয়ার পথে তিনি ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাটি লেখেন। ট্রেনে কুমিল্লা পৌঁছে নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় ওঠেন। চার-পাঁচ দিন সেখানে কাটিয়ে কবি রওনা দেন দৌলতপুরের খাঁ বাড়ির উদ্দেশে। তবে সেই চার-পাঁচ দিনেই সেনবাড়ির সবাই বিশেষ করে বিরজা দেবীর সঙ্গে নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। নজরুল তাকে ‘মা’ সম্বোধন করেন।

কাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের কিছুটা সময় কেটেছে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরে। মোট পাঁচবারে সেখানে প্রায় ১১ মাসেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন কবি। তরুণ কবি নজরুল ১৯২১ সালের এপ্রিলে কুমিল্লার দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসেন। বাড়ির জ্যেষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে খুব অল্প সময়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে নজরুলের। কবিতা শুনিয়ে, গান গেয়ে তাদের তো বটেই, দূর-দূরান্ত থেকেও লোকজন ছুটে আসত কবির নৈকট্য লাভের আশায়। আলী আকবর খানের বোন আসমাতুন্নেসার বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকায় আসমাতুন্নেসা তার ভাইয়ের বাড়িতে তেমন সমাদর পেতেন না। আসমাতুন্নেসার স্বামী মুনশি আবদুল খালেক একটি মেয়ে রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। আর সেই মেয়েটিই কবি নজরুলের প্রথম প্রেম সৈয়দা খাতুন। নজরুল যাকে ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন নার্গিস। নার্গিসের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছিল কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দিঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশির সুরে মুগ্ধ হন নার্গিস। খাঁ বাড়ির মুরব্বিরা নার্গিসের বর হিসেবে নজরুলকে তেমন পছন্দ করতেন না। নজরুলকে তারা ছিন্নমূল বাউণ্ডুলে হিসেবেই দেখেছিলেন। কিন্তু গ্র্যাজুয়েট আলী আকবর খানের চাপে তারা প্রতিবাদ করতেন না। এক পর্যায়ে খোদ নজরুলই বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন।  কিন্তু ঘটল বিচিত্র এক ঘটনা। কবির বিয়ে হলো ঠিকই, বাসর আর হলো না। কোনো এক অজানা অভিমানে বাসররাতেই নজরুল বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। দৌলতপুর থেকে চলে আসেন কুমিল্লায়। কিন্তু সেই অভিমানের কারণ কবি কোনো দিন কাউকে মুখ ফুটে বলেননি। ইতিহাসও তা স্পষ্টভাবে খুঁজে বের করতে পারেনি। তবে আরেকটি সূত্রমতে, নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়েই হয়নি। আলী আকবর খান নজরুল-নার্গিসের বিয়ের আয়োজন করলেন জাঁকজমকের সঙ্গে। তার অতি আগ্রহ ও নার্গিসের কিছু আচরণ নজরুলকে এই বিয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা করে তোলে। ঘটনার আরও অবনতি হয় যখন কাবিননামায় আলী আকবর খান একটি শর্ত রাখতে চাইলেন— ‘বিয়ের পরে নজরুল নার্গিসকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন না, দৌলতপুরেই তার সঙ্গে বাস করবে।’ এ অপমানজনক শর্ত মেনে না নিয়ে নজরুল ইসলাম বিয়ের মজলিশ থেকে উঠে গিয়েছিল। তার মানে, সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগমের সঙ্গে নজরুল ইসলামের ‘আকদ’ বা বিয়ে একেবারেই হয়নি। (কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা— মোজাফফর আহমদ পৃষ্ঠা-৬৭)।

দৌলতপুর থেকে বিয়ের শেষ রাতেই নজরুল কুমিল্লার সেনগুপ্ত বাড়িতে এসে উঠেন। নজরুল দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পরিশ্রম ও মানসিক কষ্টে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেনগুপ্ত পরিবারের সবাই কবিকে সেবাযতœ করে সারিয়ে তুলতে নেমে পড়েন। কিশোরী প্রমীলাই মূলত নজরুলের শুশ্রূষার দায়িত্ব পান। দুজনের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক সেসময়ই দানা বাধে। তাঁর এই প্রেমের কথা তাঁর বিজয়িনী কবিতায় তিনি এভাবে প্রকাশ করেন : হে মোর রানী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে। আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।

১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর প্রকাশিত দোলনচাঁপা কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত দোদুল দুল নামক প্রথম কবিতায় প্রমীলার সৌন্দর্যে বিমোহিত কবি তার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন ।অবশেষে নজরুল-প্রমীলার বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে। ধর্ম, বিবাহ-আইনের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে, ধর্মীয় বাধা ডিঙিয়ে তাঁদের বিয়েটা হয়েছিল স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় বহাল রেখেই। তখন প্রমীলার বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের ২৩।

প্রেম নজরুলের জীবনে এসেছিল বারবার, প্রিয়ার বিরহে হয়েছেন বেদনাভারাতুর। "বুকে তোমায় নাই বা পেলাম,রইবে আমার চোখের জলে।ওগো বধূ তোমার আসন গভীর ব্যথার হিয়ার তলে।"এভাবে নজরুলের অসংখ্য কবিতা ও গানে প্রেম ও বিরহ প্রকাশ পেয়েছে। হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কবি একা ঝরাফুল কুড়িয়ে গেছেন।

প্রতি প্রেম মূলত তিনবার এসেছিল। প্রথম নার্গিস আসার খানম, দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলা দেবী এবং তৃতীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসা। এর মাঝে ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগ কিংবদন্তীতুল্য। এ ছাড়াও রানী সোমসহ আরও দু-একজনের নাম এলেও সেগুলো উল্লেখ করার মতো নয়।

নজরুল  বিদ্রোহী কবি হিসাবে পরিচিত হলেও তার জীবনে দ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে যে প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে তারই অনুরণন ঘটেছে তাঁর  প্রেমের  পর্যায়ের গান ও কবিতায়। নজরুলের  প্রেম পর্যায়ে এই সব গান ও কবিতা চিরকালীন অনুষঙ্গে ভাস্বর। প্রেমিক কবি নজরুলের এই পর্যায়ের গান ও কবিতা আজকের প্রেমিক প্রেমিকাদের হৃদয়তন্ত্রীকে প্রেম ভালবাসা এবং বিরহ বেদনায় অনুরণন ঘটায়।  

পরিশেষে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতায় প্রেম ভালবাসা উজ্জ্বল মহিমায় দীপ্যমান।আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই।

আপনার মন্তব্য