পাহারা

 প্রকাশিত: ২০১৭-০১-০৯ ১৪:২৪:৫৪

শাশ্বতী বিপ্লব:

শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে অবসাদগুলো ধুয়ে নিচ্ছিল শায়লা। বহুদিনপর দিনের বেলা একটু ভেজার সুযোগ পেয়েছে সে। মাথা ব্যথাটা ছেড়ে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে। কিছুটা ভালো লাগছে এবার।

হঠাৎ দরজার দিকে চোখ গেলো। বাথরুমের দরজায় মৃদু ধাক্কার আওয়াজ, নবটা কেউ ঘুরিয়ে খোলার চেষ্টা করছে। শায়লা জানে দরজার ওপাশে রোহান দাঁড়িয়ে। ইশ্, কতক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে আছে কে জানে।

শাওয়ারটা বন্ধ করলো শায়লা। এতক্ষণ পানির একটানা শব্দে সে খেয়াল করেনি। পানির শব্দ বন্ধ হতেই এবার শুনতে পেল ভীত সন্ত্রস্ত রোহানের কণ্ঠস্বর, "মা মা, কথা বলছো না কেন? মা, মা।"

শায়লা তড়িঘড়ি করে গা মুছে নিতে নিতে বলতে থাকে, "এইতো বাবা, আমার হয়ে গেছে। এক্ষুনি আসছি।"

কোনরকমে কাপড়টা পরে, চুলটা টাওয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসে শায়লা। বাথরুমের দরজার সামনেই সাত বছরের রোহান দাঁড়ানো, তির তির করে কাঁপছে। চোখমুখ ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য।

রোহানকে বুকের সাথে জাপটে ধরে শায়লা, "কিচ্ছু হয়নি বাবা, মা'র কিচ্ছু হয়নি। এইতো মা, দেখো। কেনো ভয় পেয়েছো বাবা, কেন শুধু শুধু ভয় পাও?"

রোহান: তুমি কথা বলছিলে না কেন মা? কতবার ডাকলাম, উত্তর দিলে না কেন?

শায়লা: শাওয়ারের শব্দে শুনতে পাইনি বাবা। কিন্তু তুমি এখানে কেন? তোমার কার্টুন দেখা শেষ?

রোহান: উহু।

শায়লা: তবে উঠে এলে কেন বাবা? মাতো গোসলের কথা বলে গেছি তোমাকে। তবে আবার কেন তুমি বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলে রোহান। মাকে একটু সময় না দিলে মা'র গায়ে তো ময়লারা কামড়ে দেবে, তাইনা?

রোহান: আমিতো কার্টুনই দেখছিলাম। মনে হলো, তুমি চুপিচুপি বাথরুম থেকে বের হয়ে বাসার দরজা খুলে চলে গেছো। তাই দেখতে এসেছিলাম।

শায়লা: তোমাকে না বলে আমি কেন চলে যাবো? কোথায় চলে যাবো? এমন ভুল কথা ভাবতে নেই বাবা।

রোহান: বাসার দরজাটা শব্দ হলো যে। তবে কে শব্দ করলো মা? ফেরেশতা এসেছিলো?

শায়লা: কেউ শব্দ করেনি রোহান। তুমি ভুল শুনেছো। হয়তো পাশের বাসার দরজার শব্দ পেয়েছো।

রোহান: কিন্তু তুমি উত্তর দিচ্ছিলে না কেন? আমি ভাবলাম তুমি মরে গেছো। তুমি মরে যেওনা মা।

শায়লা: ছিঃ বাবা, এসব ভাবতে নেই। আমি কক্ষনো মরব না। তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবো না। কোনদিন না।

শায়লা প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে, "আচ্ছা রোহান, ফুপ্পি যে তোমাকে ড্রইং বুকটা দিয়েছে, সেটা খুব সুন্দর তাইনা?"

রোহান: হুম।

শায়লা: তোমার পছন্দ হয়েছে?

রোহান মাথা নাড়ে। তার পছন্দ হয়েছে।

শায়লা: আমি আর তুমি মিলে কালার করলে কেমন হয়? মজা না? যাও, এক দৌড়ে ড্রইং বুকটা আর কালার বক্সটা নিয়ে এসোতো বাবা। আজকে আমরা সবগুলো ছবি কালার করে ফেলবো, কেমন?

রোহানের মুখের মেঘ কেটে যায়। "আচ্ছা" বলে ড্রইং বুক আর কালার বক্স আনতে চলে যায়। ওর মুখে এখন আর কোন ভয়ের চিহ্ন নেই। কিন্তু তাতে নিশ্চিন্ত হতে পারে না শায়লা। সে জানে রোহান কাল আবার একই কাণ্ড করবে। কিছুতেই শায়লাকে চোখের আড়াল হতে দেবে না। মাকে হারানোর এক প্রচণ্ড ভয় মনে নিয়ে বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে।নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়লা।

শিশু মনোবিজ্ঞানী রিফাতের কাছে কয়েকবার রোহানকে নিয়ে গেছে শায়লা আর রাজীব। মাকে হারানোর অদ্ভুত এক আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে ছোট্ট রোহানের মনে। রোহান যেন কিছুতেই একা না থাকে সেটা বারবার বলে দিয়েছেন ড. রিফাত। শায়লা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে মেনে চলার। কিন্তু কিছুটা ব্যক্তিগত সময়তো তার লাগেই। যদিও সেগুলোও যতটা পারে রাজীব বাসায় থাকাকালীন সময়ে সারার চেষ্টা করে। গোসলও সে আজকাল সন্ধ্যার পরই করে। কিন্তু আজ এতো মাথা ব্যথা করছিলো শায়লার, মনে হলো গোসল করলে ভালো লাগবে। তাছাড়া, রোহানও বসে বসে কার্টুন দেখতে রাজী হয়ে গেলো।

মাত্র একটা বছরে কত কিছু বদলে গেলো। একটি মানুষের অস্বাভাবিক চলে যাওয়া, সেটা নিয়ে সন্দেহ আর অবিশ্বাস, সবকিছু মিলিয়ে শায়লার জীবনটা যেন হঠাৎ চলতে চলতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। মনিকা ওর আত্মীয় নয় ঠিকই, কিন্তু হরিহর আত্মা বলতে যা বুঝায় তাই। সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকে ওরা খুব ভালো বন্ধু। মনিকার ছেলে অঞ্জন ও রোহান একই বয়সী। ওদের দুজনেরও খুব ভাব। তাতে শায়লা আর মনিকার খুব সুবিধাও হয়। দু'জনকে একসাথে খেলতে দিয়ে নিজেরা জমিয়ে আড্ডা দিতে পারে। বাচ্চারা মোটেও বিরক্ত করে না। সেই মনিকা এমন হুট করে চলে যাবে কে ভেবেছিলো? আর তার ছোট্ট রোহানের মনে এমন গভীর ক্ষত তৈরি করবে, সেটাই বা কে ভেবেছিলো? মনিকার মৃত্যুতে রোহানের এই প্রতিক্রিয়া হবে শায়লা সেটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি।

মনিকা রোহানকে খুব আদর করতো। বলতো আমার দুইটা ছেলে। রোহানও মনিকা আন্টি বলতে অজ্ঞান। শুধু রোহান কেন, মনিকাকে যারাই চিনতো সবাই ওর ভক্ত ছিলো। খুব প্রাণবন্ত আর হাসিখুশি জমাটি টাইপের মেয়ে ছিলো মনিকা। সবসময় ফিটফাট, স্মার্ট। সেই মনিকা এই বয়সে এমন হঠাৎ করে মরে যাবে সেটা কেউই সহজে মানতে পারেনি। গত বছর এমন সময়ই মনিকার লাশ বাথরুমের দরজা ভেঙে উদ্ধার করে তার পরিবারের লোকজন।

মনিকার ম্যাসিভ এ্যাটাক হয়েছিলো। বাথরুমের ভিতরে থাকায় কেউ কিচ্ছু টের পায়নি। ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে শেষে দরজা ভাঙতে হয়েছিলো। বাথটাবে বসে ছিলো মনিকা, নিস্তেজ। হাসপাতালে নেয়ার অনেক আগেই মনিকা চলে গিয়েছিলো।

প্রথমে সবাই মনিকার হাজবেন্ড মৃদুলকে সন্দেহ করলেও পরে সেটা ধোপে টেকেনি। মনিকার হাই প্রেসারের সমস্যা দেখা দিয়েছিলো, ওষুধও খেতো। ডাক্তার ওকে টেনশন করতে নিষেধ করে দিয়েছিলো। কী নিয়ে এতো টেনশন করতো মনিকা? শায়লা অনেকবার ভেবেও কোন কুল পায়নি।

মৃদুল ভাই আর অঞ্জনকে নিয়ে মনিকার সুখের সংসার। মৃদুল ভাই একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান। অল্প বয়সেই বেশ বড় পজিশনে চলে গিয়েছিলো সে। ভালো বর, ভালো ইনকাম, মাঝে মাঝেই এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ানো। চাকরী করতে না পারা নিয়ে মনিকার একটু আক্ষেপ থাকলেও অসুখী ছিলো না সে। অন্তত শায়লা তাই জানতো। গৃহিণীর জীবনে বেশ ভালোই মানিয়ে নিয়েছিলো। শুধু মাঝে মাঝে মনিকা অমন ছন্নছাড়া হাসিটা যে কেন হাসতো!

মারা যাওয়ার আগের কয়েকটা মাস মনিকার কিছুটা পরিবর্তন শায়লার চোখেও পড়েছিলো। কেমন যেন মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যেতো। আবার মাঝে মাঝে এতো বেশি হাসতো যে কেমন খটকা লাগতো শায়লার। কয়েকবার সেকথা মনিকাকে বলেওছে। জানতে চেয়েছে কোন সমস্যা চলছে কিনা। কিন্তু মনিকা তার স্বভাবসুলভ হাসিতে সব উড়িয়ে দিয়েছে। তারপর হঠাৎই এমন অপ্রত্যাশিত চলে যাওয়া।

শায়রার মনে খটকাটা বেড়ে গিয়েছিলো মনিকার মৃত্যুর পর মৃদুল ভাইয়ের মুখটা দেখে। কিছুটা যেন অপরাধীর মতো মনে হয়েছিলো শায়লার। ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে কথা বলছিলো না। মনে হচ্ছিলো কিছু একটা লুকাতে চাইছে। এটা কি নিছকই তার অতি কল্পনা? সে মনিকার বন্ধু বলে? নাকি সত্যি কোন সমস্যা চলছিলো ওদের মাঝে? জানেনা শায়লা। জানার এখন আর কোন সুযোগও নেই। খালাম্মা অবশ্য বলছিলেন মনিকা আগের দিন রাতে হঠাৎ ফোন করেছিলো। বলেছিলো, কয়দিন এসে মায়ের কাছে এসে থাকবে। এমনিতে কাছাকাছি বাসা বলে মনিকা মায়ের বাসায় রাতে থাকতে চাইতো না। বলতো, নিজের বিছানা ছাড়া আমার ঘুম হয় না মা। তাই যত রাতই হোক ও বাসায় ফিরে যেতো। তাই বাসায় থাকার কথাটা কেমন লাগলেও কিছু বলেননি খালাম্মা। ভেবেছিলেন বাসায় এলে ধীরে সুস্থে জিজ্ঞেস করবেন।

মৃত্যুর খবর পেয়ে মনিকাদের বাসায় ছুটে গিয়েছিল শায়লা, রোহানও সাথে ছিলো। শায়লা অনবরত কাঁদছিলো। চোখমুখ ফ্যাকাসে, কাঁপছিলোও অল্প অল্প। বিড়বিড় করে অনবরত সুরা পড়ছিলো। মনিকার কোলে রোহান মায়ের এই অভিব্যক্তিতে ঘাবড়ে গিয়েছিলো, সেও ভয়ে কাঁপছিলো। কিন্তু শায়লার সেটা খেয়াল করার মতো মনের অবস্থা ছিলো না। কেন যে সেদিন রোহানকে মায়ের বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়নি শায়লা, কেন যে পুরোটা সময় ওকে সাথে রেখেছিলো। একটু অসাবধানতা, বেখেয়ালে ছেলেটার ক্ষতি করে ফেলেছে শায়লা। এখন হাজার চেষ্টা করেও সেই স্মৃতি রোহানের মন থেকে মুছতে পারছে না।

শায়লা-রাজীবের একক ছোট্ট পরিবার। বাসায় এমন কেউ নেই যার কাছে রোহানকে রেখে যাওয়া যায়। তাই জন্মানোর পর থেকেই শায়লা যেখানেই যায় রোহান তার সাথে থাকে। আর মনিকার বাসা হলেতো কথাই নেই, রোহান যাবেই। শায়লারও অভ্যাস হয়ে গেছে। রোহান সাথে না থাকলেই বরং খালি খালি লাগে শায়লার।

সেদিন মনিকার বাসায় যাওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যু নিয়ে সকল আলোচনা- সমালোচনার সবটা সময় রোহান কমবেশি সামনেই ছিলো। শায়লা খেয়ালই করেনি রোহান সবটাই মন দিয়ে শুনছে। এমনকি নিজেদের বাসায় শায়লা আর রাজীব যখন নিজেদের সন্দেহ নিয়ে আলোচনা করছিলো সেগুলোও রোহান শুনেছে। ঠিক হয়নি, একদম ঠিক করেনি তারা।

রাতে ঘুম পাড়ানোর সময় রোহান শায়লার কাছে জানতেও চেয়েছিলো, "মা, মৃদুল আঙ্কেল খুব পচা, তাইনা।"

শায়লা: নাতো, কেন?

রোহান: তবে মনিকা আন্টিকে মেরেছে কেন?

শায়লা: মৃদুল আঙ্কেলতো মারেনি বাবা। মনিকা আন্টির হার্ট এ্যাটাক হয়েছিলো।

রোহান: কিন্তু মৃদুল আঙ্কেলতো ওকে বকেছিলো। সেই জন্যই না ও ইচ্ছে করে হার্ট এ্যাটাক করে মরে গেলো।

শায়লা: তোমাকে এসব কে বলেছে রোহান? ইচ্ছে করে হার্ট এ্যাটাক করা যায় না।

রোহান: বারে, তুমি যে বাবাকে খাবার টেবিলে বসে বললে। তাছাড়া অঞ্জনও আমাকে বলেছে। মনিকা আন্টি খুব কেঁদেছিলো জানো মা।

অঞ্জন এসব বলেছে! শায়লার মনের সন্দেহটা আবার উঁকি দিতে থাকে। কিন্তু রোহানকে কথা বাড়াতে দেয় না।

শায়লা: তোমার এসব ভাবতে হবে না রোহান। তুমি ঘুমোও। অঞ্জন ভুল বুঝেছে, ছোট তো। আমি ওর সাথে কথা বলবো কেমন?

রোহান সেদিনের মতো চুপ করে গেলেও তার ভাবনা থেমে থাকেনি। রোজ অঞ্জনের কাছে যেতে চাইতো। শায়লাও নিয়ে যেতো। বিশেষ করে অঞ্জনের কথা ভেবে। রোহান গেলে ও একজন খেলার সাথী পায়। আর খালাম্মা, মানে মনিকার মাও শায়লাকে দেখলে খুশী হয়। ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে।

রোহানের কথা শায়লা খুব একটা সিরিয়াসলি নেয়নি সেদিন। কিন্তু প্রতিদিন রোহানের কথার ধরন আর অভিব্যক্তি পাল্টে যাচ্ছিলো। কেমন করে যে সেটা শায়লার চোখ এড়িয়ে গেলো ভাবলে নিজের উপর খুব রাগ হয় শায়লার।

মনিকার চল্লিশা থেকে ফিরে শায়লার ঘুম আসছিলো না মোটেও। নিজের ভেতরের গুমোট ভাবটা দূর করতে কিছুক্ষণ রাজীবের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো।

শায়লা: মৃদুল ভাইকে খেয়াল করেছো আজকে? কেমন যেনো লাগলো তাইনা?

রাজীব: নাতো, খেয়াল করিনি। আমার সাথে তো স্বাভাবিকভাবেই কথা বললো।

শায়লা: সেটাই তো। বড্ড বেশি স্বাভাবিক। কয়েকজনের সাথে হাসি ঠাট্টাও করতে দেখলাম।

রাজীব: শুধু শুধু বাজে কথা বলো না তো। হাসি ঠাট্টা করবে কেন? দুর থেকে দেখে কি বুঝতে কি বুঝেছো তার ঠিক নেই।

শায়লা: না না। তুমি খেয়াল করনি। আমি মনিকার হাই প্রেসারের সমস্যাটা নিয়ে একটু কথা বলার চেষ্টা করলাম, কেমন যেনো এড়িয়ে গেলো।

রাজীব: হুম।

শায়লা: অঞ্জনও এখন থেকে খালাম্মার কাছেই থাকবে।

রাজীব: সেটাই তো স্বাভাবিক। মৃদুল ভাই ব্যস্ত মানুষ, অঞ্জনকে দেখাশোনা করার উনার সময় কই। আর তাছাড়া, উনি পুরুষ মানুষ, একা কীভাবে বাচ্চা মানুষ করবে?

শায়লা: মানে? পুরুষ মানুষ বাচ্চা মানুষ করতে পারবে না কেন? একা মা যদি পারে তবে একা বাবা কেন পারবে না? এটা কেমন কথা বললা!

রাজীব: শোন শায়লা, এই ব্যাপারে তোমার সাথে তর্ক করার কোন ইচ্ছা বা এনার্জি আমার নেই। আমার সকালে জরুরী একটা মিটিং আছে। আমাকে ঘুমাতে দাও।

গুমোট ভাব সারাতে গিয়ে পরিবেশটা আরো গুমোট হয়ে গেলো। ধুর ছাই! শায়লা কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লো। ডাইনিং এ গিয়ে পানি খেলো। তারপর রোহানের ঘরে উঁকি দিলো। রোহানের ঘরটা বাবা মায়ের সাথেই। ভেতর দিয়ে আসা যাওয়া করা যায়। রোহানকে আলাদা ঘরে দেয়ার পর দেয়াল ভেঙে একটা এক্সট্রা দরজা লাগিয়ে নিয়েছে ওরা। ছেলেটা মাঝে মাঝে এসির মধ্যেও ঘামে। শায়লা প্রতিরাতে একবার উঠে দেখে আসে সব ঠিক আছে কিনা।

ডিম লাইটের আলোতে শায়লার মনে হলো রোহান জেগে আছে। বড় লাইটটা জ্বালাতেই রোহান উঠে বসলো। চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। শায়লা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি ঘুমোওনি?"

রোহান: উহু।

শায়লা: কেন বাবা? কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?

শায়লা রোহানের কপাল গলায় হাত দিয়ে পরীক্ষা করে। নাহ্, টেম্পারেচার স্বাভাবিক।

রোহান: আমার ভয় করছে মা।

শায়লা: ভয় করছে? তুমি না এখন বিগ বয় হয়ে গেছো বাবা? বিগ বয়রা কক্ষনো ভয় পায়না। আর মা বাবাতো পাশের ঘরেই আছি। ভয় কীসের বাবা?

রোহান: অঞ্জনের জন্য ভয় করছে। ও একা একা কীভাবে থাকবে মা? অসুখ করলে কে আদর করবে? মাকে ছাড়া কি কেউ থাকতে পারে?

শায়লা এরকম কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। একটু থমকালো, কয়েক মুহূর্ত মাত্র। আবার সামলে নিলো। কিন্তু রোহানের কথার কোন সরাসরি উত্তর দিলো না।

শায়লা: তুমি না ঘুমিয়ে এসব ভাবছো? ভেরি ব্যাড। নাও ঘুমিয়ে পড়ো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। লক্ষ্মী পাখীর মতো ঘুমিয়ে পড়ো দেখি।

রোহান শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর আবার বললো, " বাবাও তো তোমাকে মাঝে মাঝে বকে। তুমিও কি হার্ট এ্যাটাক করে মরে যাবে মা?

শায়লা: এসব কি বলছো রোহান? এবার কিন্তু মা রাগ করছি। মনিকা আন্টির হাই ব্লাড প্রেসারের সমস্যা ছিলো বাবা। আমার তো সেই সমস্যা নেই।আমার কেন হার্ট এ্যাটাক হবে?

বললো বটে, কিন্তু মনটা খচখচ করতে লাগলো শায়লার। ভাবলো, অঞ্জনের সাথে রোহানের মেশাটা কি বন্ধ করে দেবে? রাজীবের সাথে আলোচনা করতে হবে এটা নিয়ে। অঞ্জন রোহানের মাথায় আজেবাজে চিন্তা ঢোকাচ্ছে। মৃদুল ভাইকেও বলবে নাকি অঞ্জনের কথা? থাক দরকার নেই, ভুল বুঝতে পারে। রোহানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে এসব সাতপাঁচ ভাবে শায়লা। কিন্তু নিজেরাই যে ক্রমাগত রোহানের চিন্তার খোরাক যোগাচ্ছিলো সেটা মনোবিজ্ঞানী ড. রিফাতের কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি ওরা।

ড. রিফাত বলেছেন, "আমরা বড়রা অনেক সময় ছোটদের সামনেই নিজেদের বিষয়গুলো আলোচনা করি। মনে করি ওরা শুনছে না বা শুনলেও বুঝতে পারবে না। সেটা কিন্তু আমাদের বড়দের একটা মস্ত ভুল। ছোটরা সবটা শোনে এবং নিজের মতো ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নেয়। আজকালকার বাচ্চারা এটা আরো বেশি করে। এখনকার বাচ্চারা একক পরিবারে চার দেয়ালের মাঝে বড় হয়। বাবা-মা তাদের জগতের অনেকটাই জুড়ে থাকে। বাবা-মাকে ওরা অনেক বেশি ফলো করে। আমরা অতোটা করতাম না। আমাদের শৈশবে অপশন অনেক বেশি ছিলো, ভাবনার জগতটাও অনেক বিস্তৃত ছিলো। কিন্তু এখনকার শিশুদের জন্য অপশন খুবই কম। ইলেকট্রনিক গেজেটের বাইরে তাই বাবা মাই শিশুদের জগত। আমাদের তাই কোন সিরিয়াস বা জটিল বিষয় ওদের সামনে আলাপ করা উচিত নয়। আপনারা এটা একটু খেয়াল রাখবেন। রোহানের সামনে সেসবই আলোচনা করবেন যেটা ওর জন্য উপযোগী। আর এমন কোথাও নিয়েও যাবেন না যেটা ওর জন্য উপযোগী নয়। দেখুন, যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। আপনারা সাবধান না হলে এটা ধীরে ধীরে সিজোফ্রেনিয়ায় পরিণত হতে পারে।"

ড. রিফাতের কথা শুনে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলো শায়লা। সংসারে থাকতে গেলে টুকটাক ঝগড়া, কথা কাটাকাটি তো হয়ই। সব সংসারেই হয়। শায়লা-রাজীবও ব্যতিক্রম নয়। সেসব কথা কাটাকাটির সময় রোহানকে ঠিক খেয়াল করতো না তাদের দু'জনের কেউই। কিন্তু রোহান সবটা খেয়াল করতো। বাবা মায়ের ঝগড়ার সময় ও ভয় পেতো, বিশেষ করে মনিকার মৃত্যুর পর। আর মনে মনে ছক কাটতো মা'কে কীভাবে পাহারা দিয়ে রাখা যায়। এগুলো সে ডঃ রিফাতকে বলেছে। রোহান আরো বলেছে, মাকে পাহারা দিয়ে না রাখলে ফেরেশতা এসে মাকে নিয়ে যাবে। তাকে অঞ্জন বলেছে, ও যদি ওর মাকে পাহারা দিয়ে রাখতো, তাহলে ওর মা কোনদিন ওকে ছেড়ে যেতে পারতো না।

রোহানের জন্য এই উপলব্ধিটা নতুন। অঞ্জনের কাছ থেকে পাওয়া। অঞ্জনই বা কীভাবে এমন সিদ্ধান্তে এলো সেটাও জানেনা শায়লা। অঞ্জন রোহানকে বলেছে, ফেরেশতারা যখন মায়েদের জীবন নিতে আসে তখন বাচ্চারা কাছে থাকলে ফেরেশতারা ভয় পায়, নিতে পারে না। মাকে ছাড়া বাচ্চারাতো অনেক কাঁদবে, তাই ওরা পালিয়ে যায়। ফেরেশতারা বাচ্চাদের কান্না একদম সহ্য করতে পারে না। কিন্তু অঞ্জনতো সেটা আগে বুঝতেই পারেনি। তাই মায়ের জন্য আগে থেকেই কাঁদেনি। কাছেও ছিলো না। ফেরেশতা এসে এই সুযোগে ওর মাকে নিয়ে চলে গেছে। কি বোকামি করে ফেলেছে সে।

রোহান অঞ্জনের কথা বিশ্বাস করেছে। তাই সে ঠিক করেছে কিছুতেই সে একই বোকামি করবে না, কক্ষনো না। সে সবসময় মাকে পাহারা দেবে। এমনকি বাবার কাছ থেকেও সে মাকে আগলে রাখবে। আর সব সময় মায়ের জন্য কাঁদবে। ফেরেশতা যেনো কক্ষনো ওর মাকে কিছুতেই নিয়ে যেতে না পারে।

আপনার মন্তব্য

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন