দ্য গ্রেটকোট-২

নিকোলাই ভাসিলিয়েভিচ গোগোল রবার্ট শ্যান্ডলারের ইংরেজি অনুবাদ থেকে কাজী মাহবুব হাসান

 প্রকাশিত: ২০১৭-০১-১৯ ২১:৪৭:৩৯

 আপডেট: ২০১৭-০১-১৯ ২১:৫০:২৫

কাজী মাহবুব হাসান:

দ্বিতীয় পর্ব
পিটার্সবুর্গে যারা বছরে চারশ রুবল বা তার আশে পাশে বেতন পান, তাদের সবারই একটি শক্তিশালী শত্রু আছে। সেই শত্রুটি আর কেউ নয়, আমাদের উত্তরের শীত, উত্তরীয় হিম। যদিও কেউ কেউ আছেন, তারা হয়তো বলবেন, এই শীত স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। সকাল আটটা আর নয়টার মধ্যে, ঠিক যখন রাস্তা জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে কাজ অভিমুখী মানুষের ভিড়ে, শীত এত তীব্র আর শক্তিশালী কামড় বসায় প্রতিটি নাকে, পুরোপুরি বৈষম্যহীনতার সাথে, অসহায় কেরানিরা আসলেই জানেন না তাদের নাক নিয়ে তারা কি করতে পারেন। এমন একটা সময় যখন এমনকি যারা উচ্চপদে আসীন, তাদেরও ভ্রূ, কপাল যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়, আর চোখে জমে ওঠে অশ্রু, অসহায় টিটুলার কাউন্সিলররা প্রায়শই কোনো প্রতিরোধ করতে পারেন না। শীতের এই আক্রমণ থেকে তাদের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে, যতটা দ্রুত সম্ভব ততটা দ্রুত দৌড়ানো, তাদের অকার্যকর ছোট গ্রেটকোট পড়ে, প্রায় পাঁচ ছয়টি বড় রাস্তার সমান পথ দৌড়ে তারপর দারোয়ানদের ঘরে ঢুকে প্রথমেই জোরে লাফালাফি ও মাটিতে পা ঠোকান, যতক্ষণ না দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের সব প্রতিভা আর দক্ষতা, আসার পথে যা এতক্ষণ ঠাণ্ডায় জমে শক্ত হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো আবার গলতে শুরু করে।

বেশ কিছুদিন ধরেই আকাকি আকাকিয়েভিচ বিশেষ করে তার পেছন আর কাঁধে বেশ তীব্রভাবে শীতের দংশন অনুভব করছিলেন, এমনকিও যদিও তিনি চেষ্টা করেছিলেন যে দূরত্ব তাকে অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে সেটি তার পক্ষে যতটা সম্ভব ততটা দ্রুত অতিক্রম করার জন্য। অবশেষে তার মনে হয়েছিল, তার গ্রেটকোটটি এর জন্য দায়ী হতে পারে কিনা। ঘরে পৌঁছে খুব ভালোভাবে তিনি সেটি পরীক্ষা করে দেখেন, তিনি আবিষ্কার করেন যে, দুই তিনটি জায়গায় – যেমন পেছনে আর ঘাড়ের কাছে, এটি আর মোটা কাপড়ের কোট নেই, বরং রূপান্তরিত হয়েছে পাতা চিজক্লথে (১২): এটি এত বেশী ক্ষতিগ্রস্ত যে খুবই জীর্ণ, এবং এর ভিতরের কাপড়ের আস্তরণটিও টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে গেছে। বিষয়টি অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে, আকাকি আকাকিয়েভিচের গ্রেটকোটটি তার অন্য সহকর্মীদের কাছে ছিল উপহাসের একটি বস্তু। এটি আসলে তার মহান খেতাব গ্রেটকোট থেকে বঞ্চিত হয়েছে ও পরিচিতি পেয়েছিল আকাকি আকাকিয়েভিচের ‘ড্রেসিং গাউন’ হিসাবে। আর এর গঠনটাও ছিল আসলেই খুব অদ্ভুত। কলারটি বছরপ্রতি ক্রমশ ছোট হয়েছে, কারণ এর কিছু টুকরো কোটের অন্য অংশে তালি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর সেই তালিগুলো কোনো দর্জির শিল্পের পরিচায়ক না এবং সার্বিক প্রভাবটি ছিল বাস্তবিকভাবে একটি থলের মত, সুন্দর হিসাবে যা চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। পুরো বিষয়টি জরিপ করার পর, আকাকি আকাকিয়েভিচ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তার গ্রেটকোটটিকে অবশ্য পেত্রোভিচের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

পেত্রোভিচ - একজন দর্জি, পেছনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে তৃতীয় তলায় কোথাও তিনি থাকতেন, একটি কর্মক্ষম চোখ আর সারা মুখে গুটিবসন্তের দাগ থাকা সত্ত্বেও, পেত্রোভিচ বেশ ভালোই উপার্জন করতো কেরানিসহ ও সব ধরনের মানুষদের প্যান্ট আর ফ্রককোট মেরামত করে –অবশ্য যখন তিনি মাতাল অবস্থায় থাকতেন না কিংবা মাথায় অন্য আর কোনো পরিকল্পনাও কাজ করতো না। অবশ্যই, আমার উচিৎ নয় এই দর্জি সম্বন্ধে বেশী কিছু বলার, কিন্তু যেহেতু এখন নিয়ম, কোনো একটি কাহিনীর প্রতিটি চরিত্রকে পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। বেশ, তেমন কিছু বলারও নেই: আসুন পেত্রোভিচ কেমন সেটিও আমরা দেখি, প্রথম দিকে তিনি পরিচিত ছিল শুধুমাত্র গ্রিগোরি নামে, কোনো এক ভূস্বামীর সে সার্ফ বা ভূমিদাস ছিলেন, তিনি পেত্রোভিচ (১৩) নামটি বেছে নিয়েছিল যখন স্বাধীনতা পেয়েছিলেন, আর প্রতিটি ছুটিতে অত্যন্ত বেশী পরিমাণে মদ পান করতেও শুরু করেছিলেন, প্রথম দিকে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনগুলোয়, এরপর কোনো বাছবিচার ছাড়াই চার্চের সব ছুটির দিনে, যতক্ষণ ক্যালেন্ডারে (১৪) একটা ছোট ক্রুশ চিহ্ন থাকবে। এই প্রসঙ্গে, তিনি তার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত ছিলেন, আর যখন তিনি তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করতেন, পেত্রোভিচ তাকে ভ্রষ্টাচারী আর জার্মান মহিলা হিসাবে উল্লেখ করতেন। আর যেহেতু আমরা তার স্ত্রীর কথা উল্লেখ করেছি এখন, তার সম্বন্ধেও দু একটা কথা বলা দরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে খুব বেশী কিছু তার সম্বন্ধে কারোরই জানা নেই, শুধুমাত্র পেত্রোভিচের একজন স্ত্রী ছিলেন, এবং যিনি মাথায় চাদর দেবার বদলে বনেট (১৫) পরতেন। কিন্তু, তার সৌন্দর্য, স্পষ্টতই এমন কিছু ছিল না, যে সেটি নিয়ে কেউ গর্ব করতে পারে। অন্তত কিছু পাহারাদার সৈন্য, যাদের সাথে তার দেখা হয়েছিল ও যারা তার বনেটের নীচে উকি দিয়ে তার চেহারাটা দেখার চেষ্টা করেছে, তারা তাদের গোঁফ কাপিয়ে বরং অদ্ভুত কিছু শব্দ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেছিল।

পেত্রোভিচের ঘরে যাবার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় – যে সিঁড়িগুলোর প্রতি সুবিচার করলে বলতে হবে, সেগুলো সবই পানি আর তরল আবর্জনায় সিক্ত, এবং স্পিরিটের গন্ধে এতই সম্পৃক্ত, যা আপনার চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেবে, এবং যেমনটি সুপরিচিত, পিটার্সবুর্গের সব দালানের পেছনের সিঁড়িতে যাদের উপস্থিতি চিরস্থায়ী। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আকাকি আকাকিয়েভিচ ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছিলেন, পেত্রোভিচ কাজটি করার জন্য কি পরিমাণ পারিশ্রমিক দাবী করতে পারে, এবং তিনি মনস্থির করেছিলেন, যাই হোক না কেন তিনি তাকে দুই রুবলের বেশী কিছুতেই দেবেন না।

দরজা খোলাই ছিল, কারণ পেত্রোভিচের স্ত্রী, কোনো এক ধরনের মাছ রাধার সময় রান্নাঘর এতটাই ধোয়ায় পূর্ণ করেছিলেন, এমনকি তেলাপোকাদের দেখাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। আকাকি আকাকিয়েভিচ রান্নাঘর দিয়ে প্রবেশ করেন এমনকি গৃহকর্ত্রীর অলক্ষ্যেই, অবশেষে একটি ঘরে তিনি প্রবেশ করেন, যেখানে তিনি রঙহীন একটি চওড়া কাঠের টেবিলের উপর তুরস্কের পাশার মত পা ভাজ করে পেত্রোভিচকে বসে থাকতে দেখেন। পেত্রোভিচের পাগুলো, কাজে ব্যস্ত দর্জিদের যে নিয়ম, খালি ছিল। প্রথম যে জিনিসটা সেকারণে চোখে পড়বে, সেটি হচ্ছে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলগুলো, আকাকি আকাকিয়েভিচ ইতিমধ্যে যাদের সাথে খুব পরিচিত, খানিকটা বিকৃত নোখ, যা কচ্ছপের খোলশের মত মোটা আর শক্ত।
পেত্রোভিচের ঘাড় থেকে ঝুলছে একটি রেশমি কাপড় আর কিছু তুলা, তার হাঁটুর উপরে বিছানো পুরোনো এক টুকরো কাপড়। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই সে তার সুইয়ে সুতো পরানোর চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু কিছুতে সফল হতে পারছিলেন না এবং খুব বেশী রেগে ছিলেন অন্ধকারের উপরেও, এমনকি সুতোর সাথেও, রেগে বিড়বিড় করছিলেন, ‘বেশ বেয়াড়া দেখছি, ভেতরে যেতে চাচ্ছিস না, কুত্তি কোথাকার, যথেষ্ট হয়েছে আর না’। সাথে সাথেই আকাকি আকাকিয়েভিচ অনুশোচনাবোধ করলেন এমন একটি মুহূর্তে সেখানে এসে পড়ার জন্যে, যখন কিনা ঠিক সেই মুহূর্তে পেত্রোভিচের মেজাজ বেশ গরম হতে শুরু করেছে। পেত্রোভিচকে তিনি এমন একটা সময় কাজ দিতে চাচ্ছিলেন যখন সে মদের প্রভাবে থাকে অথবা, যেমন তার স্ত্রী বলে থাকে, ‘এক চোখা শয়তানটা, বোতল টেনেছে’। সেই পরিস্থিতিতে পেত্রোভিচ সাধারণত, কোনো কিছু মেনে নেবার জন্য বেশ নমনীয় থাকেন এবং যৌক্তিক আচরণও করেন, এবং সারাক্ষণ কুর্নিশ করতে থাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পরে, অবশ্য সত্যি যে তার স্ত্রী এসে হাজির হবেন, চিৎকার করে অভিযোগ আর বিলাপ করে বলবেন যে তার স্বামী তখন নেশাগ্রস্থ ছিল, আর সেকারণে খুব কম পারিশ্রমিক সে দাবী করেছিল, কিন্তু আপনার যা করতে হবে তা হলো আরো দশ কোপেক ঢালতে হবে, আপনার সেলাইয়ের সব কাজ তাহলে সঠিক সময়ে তৈরি হয়ে যাবে।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পেত্রোভিচ সজ্ঞানে আছে- সেকারণে কঠোর আর অনমনীয় হবারই কথা, আর শয়তানই জানে কি পরিমাণ পারিশ্রমিকই না সে চেয়ে বসে তার কাজ করার জন্য। আকাকি আকাকিয়েভিচ বিষয়টি বুঝতে পেরে, যেমন বলা হয়, সেখান থেকে চম্পট দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। পেত্রোভিচ তার একটি ও একমাত্র চোখ সরু করে আকাকি আকাকিয়েভিচের দিকে মনোযোগ সহকারে তাকান ; আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আকাকি আকাকিয়েভিচ উচ্চারণ করেন, ‘শুভদিন পেত্রোভিচ!’

‘আপনাকেও শুভদিন, স্যার!’ পেত্রোভিচ বলেন, তার দৃষ্টি অবশ্যই আকাকি আকাকিয়েভিচের হাতের দিকে আটকে আছে, তিনি অনুমান করতে চেষ্টা করছিলেন, কি পরিমাণ পারিশ্রমিক পাবার কাজ তিনি এনেছেন।

‘বেশ পেত্রোভিচ, এখানে, ইয়ে.. আমার কাছে একটা..’।

বলা প্রয়োজন যে আকাকি আকাকিয়েভিচ মূলত প্রসঙ্গ আর ক্রিয়া-বিশেষণ ব্যবহার করে নিজেকে প্রকাশ করে থাকতেন, আর, পরিশেষে তার উচ্চারিত এই সব ছোট খাট অপ্রধান পদগুলো স্পষ্টতই কোনো অর্থ বহন করতে পারতো না। আর, যদিও বিষয়টি আসলেই খুবই বেশী অদ্ভুত, তার এমনকি অভ্যাস আছে কোনো কোনো বাক্য আদৌ শেষ না করারও। সুতরাং প্রায়শই যা ঘটতো, তিনি তার বাক্য শুরু করতেন এমন সব শব্দ দিয়ে, ‘এটা, আসলেই, ইয়ে, সব মিলিয়ে ..’, আর সেটাই এর শেষ। তিনি নিজেই বিস্মরিত হতেন এমন চিন্তা করে যে, সব কিছুই হয়তো ইতিমধ্যে বলা হয়ে গেছে।

‘কি বলছেন’? পেত্রোভিচ তাকে জিজ্ঞাসা করে, এবং একই সাথে তার এক চোখ পরীক্ষা করে দেখতে থাকে আকাকি আকাকিয়েভিচের ইউনিফর্মটি, কলার থেকে শুরু করে, হাতাগুলো, পেছনে, বোতামের ছিদ্রগুলো, সবকিছুই তার কাছে পরিচিত, কারণ এটা তার নিজেরই কাজ। দর্জিদের মধ্যে এমনই রীতির প্রচলন ছিল: এটাই তারা প্রথমে করে থাকেন যখন কারো সাথে তাদের দেখা হয়।

‘ইয়ে মানে, পেত্রোভিচ আমি এসেছি .. এই গ্রেটকোট, কাপড়টা… তুমি দেখেছো, অন্য সব জায়গায় এটা বেশ শক্ত, শুধু কিছুটা ময়লা হয়েছে বলে পুরোনো মনে হয়, কিন্তু এটা নতুন, যদিও শুধুমাত্র একটি জায়গা আছে যেখানে, ইয়ে, খুব সামান্য, পেছনে আর এখানে কাঁধের উপর খানিকটা পুরোনো হয়ে পাতলা হয়ে গেছে, আর এই কাঁধের উপর এখানে, সব মিলিয়েই এটুকু, তুমি দেখেছো, খুব বেশী কাজ না’।

পেত্রোভিচ আকাকি আকাকিয়েভিচের ‘ড্রেসিং গাউনটা’ হাতে নেয়, আর সেটি টেবিলের উপর ছড়িয়ে বিছায়, অনেকক্ষণ ধরেই সেটি সে পরীক্ষা করে দেখে, পেত্রোভিচ মাথা নাড়ায়, তারপর জানালার তাকের উপর রাখা তার গোলাকৃতির, এক জেনারেলের প্রতিকৃতসহ তার নস্যির কৌটার দিকে হাত বাড়ান – ঠিক কোন জেনারেল সেটি অজানা, কারণ আঙ্গুল ঠিক সেই জায়গায় একটি ছিদ্র করেছে, যেখানে জেনারেলের মুখ ছিল এবং বর্তমানে ছোট আয়তাকার একটি কাগজ সেখানে সাটা আছে। এক চিমটি নস্যি নিয়ে, পেত্রোভিচ ড্রেসিং গাউনটিকে এবার তার দুই হাত দিয়ে তুলে ধরেন এবং আলোর বিপরীতে ভালো করে সেটি পরীক্ষা করে দেখেন, আরো একবার মাথা নাড়ান তিনি। তারপর ভিতরের কাপড়ের আস্তরণটি ধরে উপরে তুলে দেখে আবারো তিনি মাথা নাড়ান, আবারো কাগজ দিয়ে ঢাকা জেনারেলের ছবিসহ নস্যির কৌটার মুখ খোলেন, নস্যি নেন নাকের ছিদ্রে, কৌটাটি বন্ধ করে সরিয়ে রেখে অবশেষে বলেন, ‘না, কাপড়ের অবস্থা
খুবই করুন। এটা ঠিক করা আর সম্ভব না’।

এই কথা শুনে আকাকি আকাকিয়েভিচ বেশ দমে যান ।

‘কেন পেত্রোভিচ’?, শিশুর মত অনুনয়ের স্বরে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘কেন, শুধুমাত্র কাঁধের কাছটায় একটু পাতলা হয়ে গেছে - তোমার কাছে তো কত টুকরো আছে.. ’।

‘হ্যাঁ, আমি কাপড়ের টুকরো ঠিকই খুঁজে পাবো, কাপড়ের টুকরো আছে ঠিকই’, পেত্রোভিচ বলেন, ‘কিন্তু কিভাবে আমি সেগুলো এর সাথে সেলাই করে জোড়া লাগাবো? পুরো জিনিসটাই তো পচে গেছে। এখানে একবার সুঁইয়ের ফোড় দিলে পুরো জিনিসটাই ছিঁড়ে যাবে’।

‘ইয়ে, ঠিক আছে, সোজা একটা তালি লাগিয়ে দাও তাহলে’।

‘কিন্তু তালি লাগানোর মত জায়গাতো আর নেই, কোনো জায়গায় ঠিক মতো কাপড় বসানো যাবে না, কাপড় খুবই পাতলা হয়ে গেছে, এত ফেঁসে গেছে যে এটাকে আর কাপড় বলা ঠিক হবে না। বাতাসের একটা ফু লাগলেই এটা উড়ে যাবে’।
‘তাহলে কোনোভাবে শক্ত করে নাও, মানে, আমি বলতে চাচ্ছি, ইয়ে, তুমিতো জানো’!

‘না’, বেশ দৃঢ়ভাবেই বলেন পেত্রোভিচ, ‘আমি কিছুই করতে পারবো না, এটার অবস্থা ভালো না, বরং ভালো হবে আপনার জন্য, পরের শীতের ঠাণ্ডার জন্য এটাকে পায়ের কাপড় বানিয়ে ফেললে। কারণ এইসব মোজায় তো আর বেশী পা গরম হবে না। এই বুদ্ধিটা জার্মানরা আবিষ্কার করেছে, যেন তারা বেশী করে টাকা আয় করতে পারে তাদের জন্য। ( পেত্রোভিচ জার্মানদের বিরুদ্ধে কিছু বলার জন্য কখনোই সুযোগ হাত ছাড়া করতেন না), আর গ্রেটকোট যদি বলেন, স্পষ্টতই আপনার দরকার একটা নতুন কোটের’।

‘নতুন’ শব্দটা শুনে আকাকি আকাকিয়েভিচের চোখগুলো ঝাপসা হয়ে ওঠে, আর যেন ঘরের সবকিছু তার সামনে ভাসতে শুরু করে। শুধুমাত্র তিনি যা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন – পেত্রোভিচের নস্যির কৌটার উপরে ঢাকনায় – কাগজ দিয়ে ঢাকা জেনারেলের মুখ।

‘কি বলছো তুমি – ‘নতুন’’? তিনি জিজ্ঞাসা করেন, যেন এখনও কোনো স্বপ্নে আছেন। ‘আমার কাছে তো সেটা করার মত কোনো টাকা হাতে নেই’।

‘হ্যাঁ, নতুন’, পেত্রোভিচ নিষ্ঠুর শীতলতার সাথে আবার বলেন।

‘কিন্তু যদি, ধরো, ধরো একটা নতুন কোট হতে হয়, তাহলে সেটা..মানে ইয়ে?’

‘আপনি কি জানতে চাইছেন, কত টাকা লাগবে? ’

‘হ্যাঁ’।

‘বেশ, দেড়শ রুবল আর কিছুটা বেশী হবে’, পেত্রোভিচ বলেন তার ঠোঁটগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে চেপে রাখেন। নাটকীয় প্রভাব সৃষ্টি করার প্রতি তার বিশেষ অনুরক্ততা আছে, তিনি পছন্দ করেন কোনো না কোনোভাবে একটি মানুষকে হঠাৎ করে পুরোপুরিভাবে সংশয়ে ফেলে দিতে, তারপর আড়চোখে তার মুখটা দেখতে, যাকে কেবলই তিনি হতভম্ব করেছেন কিছু বলে।

‘একটা গ্রেটকোটের জন্য একশ পঞ্চাশ রুবল!’ অসহায় আকাকি আকাকিয়েভিচ চিৎকার করে ওঠেন - চিৎকার করে, তার জন্মের পর হয়তো এই প্রথমবারের মত, কারণ তিনি সবসময়েই তার কণ্ঠস্বরে মৃদু সূক্ষ্মতার জন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিলেন।

‘জি স্যার, আর তারপরও সেটি খুবই সাধারণ কোট হবে, যদি আমরা কলারে মার্টেন (১৭) লাগাই আর রেশমি কাপড়ের লাইনিং সহ একটি মাথার ঢাকনি যোগ করি, তাহলে সেটি বানাতে আপনার খরচ নিয়ে যাবে প্রায় দুইশ রুবলের কাছাকাছি’।

‘দয়া করে, পেত্রোভিচ’, আকাকি আকাকিয়েভিচ আবারো অনুনয়ের স্বরে বলেন, পেত্রোভিচের কথা না শুনে কিংবা এমনকি তার সব নাটকীয় প্রভাবসহ কথাগুলো শোনার কোনো চেষ্টা না করেই, ‘কোনো না কোনোভাবে তুমি একটু ঠিক করে দাও, অন্ততপক্ষে আরো কিছুদিন যেন চালাতে পারি’।

‘না, সেটি ভালো হবে না, পরিশ্রমের অপচয় হবে শুধু, টাকা বাতাসে ওড়ানো হবে’, পেত্রোভিচ বলেন।

এই কথাগুলো বলার পর আকাকি আকাকিয়েভিচ প্রস্থান করেন পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে। তবে পেত্রোভিচ, দীর্ঘক্ষণ সেখানে দাড়িয়ে ছিলেন, ঠোট টিপে গম্ভীরভাবে তার কাজ শুরু না করেই, সন্তুষ্ট যে তিনি নিজেকে যেমন ছোট করেননি, তেমনি দর্জি শিল্পের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাও করেননি।

আকাকি আকাকিয়েভিচ যখন বাইরে বের হয়ে আসেন, তখন তিনি একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ভাসছিলেন, ‘তাহলে…, অবস্থা এরকম তাহলে।’ তিনি স্বগতোক্তি করেন, ‘আমি সত্যিই কখনো ভাবিনি, মানে, অনেকটা যেন..’ আর তারপর, বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর, তিনি যোগ করেন, ‘তাহলে অবস্থা হচ্ছে এটাই, অবশেষে পরিস্থিতি এমন হবে আমি কখনো ভাবিনি, আসলেই আমি কখনোই কল্পনা করতে পারিনি যে পরিস্থিতি এতটাই ..’; তারপর আরো একটি দীর্ঘবিরতি, এরপর তিনি উচ্চারণ করেন, ‘তাহলে সেটাই একমাত্র উপায়, আসলেই, পুরোপুরিভাবে, অপ্রত্যাশিত .. কে ভাবতে পেরেছিল .. কি অপ্রত্যাশিত ঘটনা’। এটি বলার পর, বাড়ি যাবার বদলে, তিনি পুরোপুরি বিপরীত দিক বরাবর হাটতে শুরু করেন, তিনি কি করছেন সেটি আদৌ খেয়াল না করে। যাবার পথে, একজন চিমনি পরিষ্কারক তার শরীরের অপরিষ্কার অংশের দিক দিয়ে তার গায়ে একটি ঘষা দিয়ে চলে যায়, তার কাঁধের অংশটা পুরোটাই কালো রঙ ধারণ করে চিমনীর কালো ঝুলে , এক টুপি ভর্তি চুন তার উপরে ঢেলে দেয়া হয় নির্মাণাধীন কোনো একটি দালানের উপর থেকে। তিনি এর কোনোটাই লক্ষ্য করেন না, আর শুধুমাত্র যখনই তিনি একজন নৈশ প্রহরীর সাথে ধাক্কা খান, যে কিনা তার হাতিয়ার, বল্লম আর বর্শার মিশ্রণ, পাশে হেলান দিয়ে রেখে, তার নস্যির কৌটা থেকে নস্যি ঝাঁকিয়ে বের করছিল তার শক্ত তালুতে, তখনই কেবল আকাকি আকাকিয়েভিচ তার সম্বিত ফিরে পান, কিন্তু তাও হতো না, কারণ প্রহরী তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এভাবে সরাসরি আমার সাথে ধাক্কা দেবার কারণ কি? ফুটপাথে কি যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা নেই আপনার জন্য?’ এই প্রশ্নটি তাকে পেছন ফিরে তাকাতে বাধ্য করে আর তিনি বাড়ি অভিমুখে ফিরতি যাত্রা শুরু করেন। শুধুমাত্র তখনই তিনি তার চিন্তাগুলো একসাথে জড়ো করতে শুরু করেন, স্পষ্টভাবে তার অবস্থান আসলে কোথায় সেটি তিনি দেখতে পান, নিজের সাথে তিনি কথা বলতে শুরু করেন, তবে ভাঙ্গা বাক্য বা অসংলগ্ন ভাবনায় নয়, বরং যুক্তিযুক্তভাবে, আর স্পষ্টভাবে, যেন কোনো বুদ্ধিমান পরিচিত এমন কারো সাথে তিনি কথা বলছেন, যার সাথে হৃদয়ের অন্তরঙ্গ সব বিষয়গুলো নিয়ে তিনি আলোচনা করতে পারেন। ‘না’, আকাকি আকাকিয়েভিচ বলে, ‘পেত্রোভিচের সাথে এখন কথা বলে কোনো লাভ নেই। এখন সে, ইয়ে.. মনে হয় তার স্ত্রী তাকে খানিকটা গালমন্দ করছে। ভালো হয় আমি তার সাথে যদি রোববার সকালে কোনো সময় দেখা করি। শনিবারের রাতের পর নিশ্চয় তার মাথা ভার থাকবে আগের রাতের অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য, এবং সকালে সেটি কাটানোর জন্য তার আরো খানিকটা মদ্য পান করার দরকার পড়বে, কিন্তু তার স্ত্রী যেহেতু আর তাকে কোনো টাকা দেবে না, সুতরাং ঠিক সেই সময়ে, আমি তার হাতে দশ কোপেক গুজে দেবো, এবং সে আরো বেশী নমনীয় হবে পারিশ্রমিকের ব্যাপারে আর গ্রেটকোটটি .. ’, এভাবে আকাকি আকাকিয়েভিচ যুক্তি দিচ্ছিলেন নিজেকে, তার মেজাজ খানিকটা উৎফুল্ল করার জন্য।

তিনি পরের রোববার অবধি অপেক্ষা করলেন। রোববার দূর থেকে লক্ষ্য করেন যখনই পেত্রোভিচের স্ত্রী কোথাও যাবার জন্য বের হয়েছে, তখনই সরাসরি পেত্রোভিচে ঘরে ভিতরে ঢুকলেন। পেত্রোভিচ তখন আসলেই শনিবার রাতের অতিমাত্রায় মদ্যপানের খেসারত দিতে হচ্ছে মাথার যন্ত্রণায়; তখনও সে আধো ঘুমে, তার পক্ষে কোনোমতে মাথাটা তোলা সম্ভব তখন, যাই হোক যখন সে বুঝতে পেরেছে আকাকি আকাকিয়েভিচ কেন এসেছেন, যেন শয়তান স্বয়ং তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘না, আমি পারবো না’, সে বলে, ‘দয়া করে নতুন একটা গ্রেটকোট বানানোর অর্ডার দেন।’ এই পর্যায়ে আকাকি আকাকিয়েভিচ তার হাতে দশ কোপেক হাতে গুজে দেয়। ‘আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি স্যার, আপনি আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে এক ফোটা পান করবো’, পেত্রোভিচ বলে সাথে সাথে, ‘কিন্তু দয়া করে স্যার, আপনার গ্রেটকোট নিয়ে আর ঝামেলায় যাবার দরকার নেই, ওটার দিন ফুরিয়ে গেছে, কোনো কাজে আর আসবে না। আপনাকে আমি নতুন একটা কোট সেলাই করে দেবো। হ্যাঁ, স্যার, আমি আপনাকে কথা দিলাম!’

আকাকি আকাকিয়েভিচ আবার চেষ্টা করেন তালি দিয়ে আপাতত কাজ চালানোর মত কিছু করে দেয়া সংক্রান্ত কিছু বলতে, কিন্তু পেত্রোভিচ তা শুনতে অস্বীকার করেন, আর বলেন, ‘আমি অবশ্যই আপনাকে নতুন একটা কোট সেলাই করে দেবো, আমার কথার উপর ভরসা রাখুন, আমি সব চেষ্টাই করবো, আর যেহেতু এখন ফ্যাশন, আমরা এমনকি একটা রুপালী কাপড়ও লাগাতে পারবো কলারে’।

এই পর্যায়ে আকাকি আকাকিয়েভিচ অনুধাবন করেন তার এই নতুন গ্রেটকোট বানানো থেকে পালাবার আর কোনো উপায় নেই, পুরোপুরিভাবে হতাশা তাকে আচ্ছন্ন করে। আসলেই, সত্যি কিভাবে তিনি পারবেন? টাকা কোথা থেকে আসবে? অবশ্যই, আসন্ন ছুটির বোনাসের উপর তিনি ভরসা করতে পারেন, কিন্তু সেই টাকা বহুদিন আগে থেকেই ঠিক করা আছে কি কাজে লাগানো হবে। তার একটা নতুন প্যান্ট কেনা লাগবে, মুচির সাথে বহুদিনের ঋণ বোঝাপড়া করতে হবে, যে তার বুট জুতায় নতুন একটা তলা লাগিয়ে দেবে, দর্জির দোকান থেকে তার তিনটি শার্ট ও কয়েক জোড়া অন্তর্বাসের উপকরণ কিনতে হবে, ছাপার অক্ষরে যেগুলোর নাম প্রকাশ করাটা ভদ্রতা হবেনা। এক কথায়, পুরোপুরিভাবে সব টাকাই আগেই খরচ হয়ে গেছে, আর এমনকি যদি পরিচালক দয়াপরবশ হয়ে তাকে আরো একটি বোনাস দেয়, চল্লিশ রুবল না,পঁয়তাল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ, তারপরও খুব সামান্যই বাঁচবে সেখান থেকে- গ্রেটকোট বানানোর জন্য যে মূলধন দরকার সেই সাগরের সেটি এক ফোটা মাত্র।

যদিও তিনি অবশ্য জানতেন, পেত্রোভিচের অভ্যাস আছে - কেউ জানে না কোথা থেকে হঠাৎ করে সেই খেয়াল আসতো - অস্বাভাবিক দাম চেয়ে বসার, সে কারণে এমনকি তার স্ত্রীও চিৎকার না করে পারতো না, ‘তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান সব লোপ পেয়েছে, গাধা কোথাকার? একদিন বিনাপয়সায় কাজ নেয়, পরের দিন কাঁধে শয়তান চাপে আর যা যোগ্যতা নেই তার চেয়ে বেশী দাম হেঁকে বসে।’ যদিও তিনি অবশ্য জানতেন যে, পেত্রোভিচ আশি রুবল হাতে পেলে কোট বানাবার কাজ হাতে নেবে, কিন্তু কোথায় পাবেন তিনি সেই আশি রুবল? এর অর্ধেক পরিমাণ টাকা তিনি হয়তো যোগাড় করতে পারবেন, অর্ধেক পরিমাণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে- বা হয়তো অর্ধেকের সামান্য কিছুটা বেশী। কিন্তু কোথায় তিনি বাকি অর্ধেকটা খুঁজে পাবেন? কিন্তু প্রথমে পাঠকদের জানা প্রয়োজন কিভাবে তিনি টাকাটির প্রথম অংশ যোগাড় করবেন। আকাকি আকাকিয়েভিচের একটা অভ্যাস ছিল, যখনই তিনি এক রুবল খরচ করতেন, তিনি আধা কোপেক সরিয়ে রাখতেন একটি ছোট তালা লাগানো বাক্সে, যার ঢাকনিতে একটা ছিদ্র আছে পয়সা ঢালার জন্য। প্রতি ছয় মাস পর পর তিনি জমানো তামার পয়সাগুলো গুনে জড়ো করে সেগুলো বদলে নিতেন রুপার মুদ্রা দিয়ে। এই কাজটি তিনি করছেন বহুদিন ধরেই, সুতরাং জমানো টাকার পরিমাণটাও কয়েক বছর ধরে বেড়েছে, যেখানে দেখা যায় চল্লিশ রুবলেরও বেশী আছে। সুতরাং অর্ধেক টাকা তার হাতে আছে, কিন্তু বাকী অর্ধেক তিনি কোথা থেকে যোগাড় করবেন? কোথা থেকে তিনি বাকী চল্লিশ রুবল যোগাড় করবেন? আকাকি আকাকিয়েভিচ অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, অন্তত এক বছরের জন্য তিনি তার জীবনযাত্রার খরচ আরো কমাবেন: তার সন্ধ্যাবেলায় চা খাবার অভ্যাসটি বাদ দেবেন, সন্ধ্যাবেলায় মোমবাতি জ্বালানো বাদ দেবেন, যদি কিছু তাকে অবশ্যই করতে হয়, তাহলে বাড়িওয়ালীর ঘরে গিয়ে তার মোমবাতির আলোয় কাজ করবেন, খুব সাবধানে হালকাভাবে হাঁটবেন, প্রায় পায়ের আঙ্গুলে ভর করে, পাথর আর টালিপাথরের উপর, যেন তার জুতার তলি খুব দ্রুত ক্ষয় না হয়ে যায়, যতটা কম সম্ভব কাপড় তিনি ধোপায় ধুতে পাঠাবেন, সেগুলো যেন বেশী ময়লা না হয়, বাসায় ফিরে সেগুলো দ্রুত খুলে ফেলবেন আর দিনের বাকী অংশে তিনি শুধু ঘরে পরার সুতির কাপড়টি পড়বেন, একটি হাউসকোট, যে কাপড়টি এতই প্রাচীন এমনকি সময়ও সেটি স্পর্শ করতে ভুলে গেছে।

সত্যি কথা যদি বলতে হয়, প্রথম দিকে এই সব বিধিনিষেধ মানা তার জন্য বেশ কষ্টকর মনে হয়েছিল, কিন্তু তারপর সবকিছুই তার অভ্যাসে পরিণত হয়, সব কিছুই মসৃণভাবেই চলতে শুরু করে। সন্ধ্যাবেলায় কোনো কিছু না খেয়ে নিজেকে অভুক্ত রাখার ক্ষেত্রে নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে সফল হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অন্যদিকে আবার চিন্তায় ভবিষ্যৎ গ্রেটকোটের একটি চিরন্তন ধারণা সারাক্ষণ বহন করার মাধ্যমে তিনি আধ্যাত্মিক পুষ্টিও পেয়েছিলেন, আর তখন থেকেই যেন মনে হয়েছিল তার অস্তিত্বটাই কোনো না কোনোভাবে আরো বেশী পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, যেন তিনি কাউকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেয়েছেন, যেন তার পাশে সেখানে কেউ আছে, যেন তার একাকীত্বের দিন অবশেষে শেষ হয়েছে, আর চমৎকার কোনো আত্মার বান্ধব রাজী হয়ে হয়েছে তার পাশে জীবনের পথে হাটতে – আর এই সঙ্গীটি আর কেউ না তার সেই ভবিষ্যৎ গ্রেটকোটটি ছাড়া, যার সেলাই করা পুরু কাপড় এবং শক্তিশালী ভিতরের আবরণ কখনোই ক্ষয়ে যাবে না।
তিনি কোনো না কোনোভাবে আরো বেশী জীবন্ত, এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন, সেই মানুষের মত যিনি তার নিজের জন্য একটি লক্ষ্য চিহ্নিত করেছেন এবং সেটি অর্জন করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন। সংশয় আর সিদ্ধান্তহীনতা, এক কথায় তার চরিত্রের সব অনিশ্চয়তা আর অনির্দিষ্টতা অদৃশ্য হয়েছিল - তার চেহারা ও কাজ থেকেও, যেন স্বেচ্ছায়। একটি আগুন মাঝে মাঝে তার চোখে জ্বলতে দেখা যেত সেই সময়, এমনকি তার মনে আরো বেশী সাহসী আর উদ্ধত চিন্তা জ্বলে উঠতো: আসলেই তার কি উচিৎ ছিল একটি মার্টেন কলার নেবার, যত খরচই হোকনা কেন? আর এই ভাবনাগুলো প্রায়ই তাকে অন্যমনস্ক করে তুলতো। একবার, কিছু কাগজ অনুলিপি করার সময়, তিনি প্রায় একটি ভুল করে ফেলেছিলেন, যার ফলে তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলেন জোরে, ‘ওহ!’ বলে, তারপর সাথে সাথে নিজের উপর ক্রুশ চিহ্ন এঁকেছিলেন।

প্রতি মাসে তিনি অন্তত একবার করে পেত্রোভিচের সাথে দেখা করতেন তার গ্রেটকোটটি নিয়ে কথা বলার জন্য আর আলোচনা করার জন্য কোথা থেকে কাপড় কেনা উত্তম হবে, কাপড়ের কি রঙ হওয়া উচিৎ, আর দামই বা কেমন – আর, যদিও, কিছুটা চিন্তিত, তবে তিনি সবসময়ই বাড়ি ফিরতেন সন্তুষ্ট হয়ে এই ভেবে যে, অবশেষে একটি সময় আসবে যখন সব কিছু কেনা হয়ে যাবে এবং তার গ্রেটকোটটি বানানোও শেষ হবে। তার প্রত্যাশা যেমন ছিল সবকিছু তার চেয়ে দ্রুত সামনে অগ্রসর হতে থাকে। সব প্রত্যাশার বিপরীত, পরিচালক আকাকি আকাকিয়েভিচকে চল্লিশ বা পঁয়তাল্লিশ না বরং ষাট রুবলের কোনো অংশে কম নয় এমন একটি বোনাসের ব্যবস্থা করে দেন: তিনি হয়তো ধারণা করেছিলেন আকাকি আকাকিয়েভিচের একটি নতুন গ্রেটকোটের প্রয়োজন আছে অথবা শুধুমাত্র ঘটনাচক্রেই হতে পারে, কিন্তু যাই হোক এর ফলে, আকাকি আকাকিয়েভিচ বাড়তি বিশ রুবল হাতে পেয়েছিলেন। পরিস্থিতিটি তাই ঘটনা প্রবাহকে আরো তরান্বিত করেছিল।

আরো দুই তিন মাসের মোটামুটি অভুক্ত থাকার পর আকাকি আকাকিয়েভিচ সত্যিই আশি রুবল যোগাড় করেছিলেন। তার হৃৎপিণ্ড, এমনিতে যা খুব শান্ত, দ্রুত স্পন্দিত হতে থাকে। ঠিক পরের দিনই তিনি পেত্রোভিচকে সাথে নিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে বের হন। খুব দেখে শুনে ভালো মানের একটি কাপড় কেনেন তারা, আর সেটাই স্বাভাবিক, কারণ তারা এই কাপড় নিয়ে কথা বলছেন গত ছয় মাস ধরে। আর খুব কম মাসই অতিক্রম হয়েছে যে মাসে তারা নানা দোকানে ঘুরে বিভিন্ন কাপড়ের দাম তুলনা আর দরদাম করেননি। এখন পেত্রোভিচ নিজেই বলছেন, এর চেয়ে ভালো মানের কোনো কাপড় আর হবেনা । ভিতরের কাপড়ের আস্তরণের জন্য তারা ক্যালিকো কাপড় বেছে নেয়, কিন্তু এত শক্তিশালী, ভালো মানের ক্যালিকো, পেত্রোভিচের ভাষায় যা সিল্কের চেয়েও উত্তম, আরো বেশী চকচকে, আর দেখতেও অনেক ভালো। তারা অবশ্য মারটেন কেনেননি, কারণ আসলেই সেটির দাম ছিল বেশ চড়া, বরং এর বদলে তারা বিড়ালের ফার পছন্দ করেন, দোকানের সবচেয়ে সেরাটি, এমনই যে, দূর থেকে যা দেখে সবসময়ই মনে হবে যেন মার্টেন।

পেত্রোভিচ পুরো দুই সপ্তাহ ধরে কাজ করেন গ্রেটকোটটা নিয়ে, কারণ অনেক সেলাই করার কাজ ছিল, নয়তো অনেক আগেই এটি তৈরি হয়ে যেত। তার কাজের জন্য পেত্রোভিচ বারো রুবল পারিশ্রমিক দাবী করেছিলেন, এর চেয়ে কম নেবার প্রশ্নই ওঠেনা। সবকিছু বেশ শক্তভাবে রেশমি সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়েছে, সূক্ষ্ম জোড় সেলাই, তারপর পেত্রোভেচ প্রতিটি সেলাই তার নিজের দাঁত দিয়ে পরীক্ষা করেও দেখেছে, এছাড়াও নানা ধরনের নক্সাও সেলাই করেছিলেন তিনি।
(চলবে)


টিকা:

  • ১২ চিজক্লথ – খুব শিথিল করে বোনা তুলোর কাপড়, সাধারণত পনির বা চিজ বেধে রাখার জন্য ব্যবহার হয়।
  • ১৩ পেত্রোভিচ: অপেক্ষাকৃত কম বয়সী আর অবিবাহিত কৃষক যারা সাধারণ পরিচিত তাদের খ্রিস্টীয় নাম বা ডাকনামে। আর বাবার নামে তাকে ডাকা হোক দর্জির সামাজিক মর্যাদা পাবার ইচ্ছাই প্রকাশ করছে।
  • ১৪ খ্রিস্টীয় অর্থোডক্স ক্যালেন্ডার মোট ১২ টি বড় উৎসব আছে, লাল রঙ দিয়ে সেই তারিখগুলো মুদ্রণ করা হয়, আর সাধু বা সেইন্টের কোনো দিনকে বড় অক্ষর আর ছোট একটি ক্রুশ চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।
  • ১৫ বনেট - কৃষক মহিলাদের মাথার চাদর নয়, কোনো ভদ্র মহিলাদের মত টুপি বা বনেট।
  • ১৬ ফুট-ক্লোথ, পা আর গোড়ালি পেঁচিয়ে রাখা কাপড়ের একটি টুকরো, বিংশ শতাব্দীর আগে বেশীর ভাগ রুশরাই কখনো মোজা পরেনি।
  • ১৭ মার্টেন এক ধরনের প্রাণি (family Mustelidae), যাদের গায়ের লোমশ চামড়া বা ফার ব্যবহার হতো কোটের কলারে লাগানোর জন্য।

আপনার মন্তব্য