অপরিমেয় দূরত্বের গৃহস্থীকরণ : একটি প্রদর্শনী ও একজন শিল্পী

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-০৪ ২৩:৪০:৫৫

 আপডেট: ২০১৬-০১-০৪ ২৩:৪৫:১৭

কাজী মাহবুব হাসান:

চারপাশে ঘেরা
অদৃশ্য আয়না,
বাতাসে প্রতিফলিত
প্রতিকৃতি আমার
ফিরে আসে বুমেরাং হয়ে,
অহংকারী একাকিত্ব
প্রতিধ্বনিত হয়
শেওলা অন্ধকারে,
আবার ফিরে আসে
আমারই অশ্রুজলে,
চারপাশে ঘেরা
অদৃশ্য আয়না
চমকে উঠি
প্রতিবিম্বে
তোমাকে দেখে!
(বুমেরাং : আসমা সুলতানা)

শিল্পীর শিল্পী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় রহস্যময়তা অনুপস্থিত থাকে যখন শিল্পী আজন্মই শিল্পী। আসমা সুলতানা শিল্পী হয়েই জন্মেছিলেন। যার সহজাত অন্তর্গত ভাবনাগুলোই সৃজনশীল রূপে বিবর্তিত হয়েছে পরিশীলিত একটি অভিব্যক্তিতে, যেখানে সৌন্দর্য, আবেগ, সময়ের অতিক্রমণ আর সযত্নে লালিত স্বপ্নগুলো তাদের থমকে থাকা শ্বাস ফেলতে পারে মহাকাব্যের পরিসরে।

যারা মনের সংযোগকে সুনিশ্চিত করে ২০০৪ এ আসমা সুলতানার প্রথম একক প্রদর্শনী ‘এপিক’- এর ক্যানভাসগুলোয় চোখ রেখেছিলেন, কিংবা শিল্পীর বিবৃতিটি পড়েছিলেন,তারা হয়তো আসমার সাম্প্রতিক কাজ দেখলেই অনুভব করতে পারবেন শিল্পীর সেই মহাকাব্যিক যাত্রার গন্তব্যটির অভিমুখ। আর যারা প্রথম বারের মত দেখছেন, তাদের মনের ভিতর ভেসে ওঠা প্রশ্নটির উত্তর প্রশ্নের সম্পূরক হয়ে ওঠে যখন মৃদুভাষী শিল্পী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, তার সৃষ্টিকর্মে তিনি তার জীবনের কথাই বলছেন, এবং তিনি তাদেরই একজন আমাদের আগেই যারা আমাদের কথা বলেন।আমাদের পক্ষে অনুভব করার সম্ভাবনা আরো ত্বরান্বিত হয় যখন আমরা বুঝতে পারি, আসমা সুলতানা ক্রমশ দুর্লভ হয়ে ওঠা সেই শিল্পীদের একজন যার শিল্পকর্মের মূলভাবনা আত্মজৈবনিক। শিল্পী হিসাবে বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক-ভৌগলিক পরিবেশে নিজের পরিচয় খুঁজে নেবার সংগ্রাম, মানুষ হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার নিরন্তর যুদ্ধ, অপমান, বঞ্চনা আর আত্মত্যাগের নানা আখ্যান প্রতীকী রূপ খুঁজে পেয়েছে তার ক্যানভাস, প্রিন্ট এবং স্থাপনা শিল্পে।

সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের কৃষ্ণতম অধ্যায়ের প্রেক্ষাপটে জন্ম নেয়া শিল্পী তার পরিবারের টিকে থাকার অর্থনৈতিক সংগ্রাম, অবহেলিত শৈশবের অমোচনীয় স্মৃতিকে অনায়াসেই চিহ্নিত করতে পারেন তার জীবনের গল্প বলার জন্য শিল্পকলায় আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞানে। নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার অমসৃণ সংগ্রামটিকে আসমা নিঃসংকোচে তুলনা করতে পারেন দমকা বাতাস থেকে সারাক্ষণই মোমের প্রায় নিভু নিভু শিখাকে বাঁচানোর অন্তহীন প্রচেষ্টার সাথে। বিশুদ্ধ সুন্দরকে অনুসরণ করেই একদিন আকাশের ওপারে অন্য আকাশের ঠিকানায় দেশান্তরী হয়েছেন, স্থায়ী হবার জন্য এখনও যে যাযাবর জীবন খুঁজে পায়নি উর্বর মাটি। চলমান জীবনের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছেন তার শিল্পে, নিজের জীবনটাকেই একান্ত নিজের করে নিয়ে সৃষ্টিতে আত্মমগ্ন হয়েছেন, যেখানে নিজের অস্তিত্ব মানচিত্রে জায়গা পেয়েছে শিল্পীর যাপিত জীবনের অসংখ্য অভিজ্ঞতার স্মারক।

আত্মপরিচয় খোঁজার প্রত্যয়ে তার শরীরেরই অনন্য অংশ, হাতের আঙ্গুলের ছাপ প্রতিস্থাপিত করে তুলি, মাথার চুল জায়গা নেয় সুতোর – প্রতীকীরূপে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে শিল্পীর জীবনের কোলাজ। অবশ্যই এই মহাকাব্য এখনও পরিণতি পায়নি, শিল্পী মনে করিয়ে দেন; আর তার সেই মহাকাব্যকে বুঝতে আমাদের সচেতন স্মৃতিতে ধরে রাখতে হবে মহাকাব্যের সূচনাটিকে। আর অতীত, অতীত হবার কারণে আমাদের কাছে যা অস্পৃশ্য রয়ে যায় চিরকালই – সময়ের ধ্বংসলীলায় টিকে থাকা অবশিষ্টাংশগুলোই কেবল টিকে থাকে সময়ের সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে পুনঃসৃষ্টি করার জন্য। আর স্মৃতির সেই কথোপকথনের অনুরণন শিল্পীর সৃষ্টিতে প্রাণ খুঁজে পায়।

শিল্পী আসমা সুলতানাকে নিয়ে এই লেখার প্রাসঙ্গিকতা একটি প্রদর্শনী। Beyond Measure: Domesticating Distance শীর্ষক এই প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছে ( সেপ্টেম্বর ৫ ২০১৫ থেকে ৩ জানুয়ারি ২০১৬) দি রবার্ট ম্যাকলঘলিন গ্যালারী (The Robert McLaughlin Gallery), কানাডার সহযোগিতায় সাউথ এশিয়ান ভিজুয়াল আর্ট সেন্টার (সংক্ষেপে SAVAC)। প্রদর্শনীতে দক্ষিণ এশিয়ার মোট পাঁচজন সমসাময়িক শিল্পীর শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে যারা প্রত্যেকেই জন্মভূমির বাইরে প্রবাস জীবনের শূন্যতা আর প্রাপ্তি নিয়ে কাজ করছেন। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা - তাজিন কাইয়ুম, আব্দুল্লাহ এম.আই সাইয়েদ, আসমা সুলতানা, সুরেন্দ্র লাওটি এবং মীরা মার্গারেট সিং – প্রত্যেকেই তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দ্বৈততা এবং এর মাধ্যমে উদ্ভূত মিশ্র পরিচয়ের ব্যবচ্ছেদ করেছেন সহজাত বিশ্লেষণী দক্ষতায়।

তাদের শিল্পকর্মে সম্মিলিতভাবে অনুভব করা কাহিনীতে এই দুটি পরিচয় আর স্থানের মধ্যবর্তী শূন্যতা আরো বেশী অর্থবহ হয়ে ওঠে। স্মৃতিচারণ, আখ্যান এবং পর্যবেক্ষণ আর ভাবনায় পুষ্ট তাদের কাজ অচেনা ভূমিতে চেনা প্রান্তর আর বর্তমানের সময়ের কাঠামোয় অতীতকে পুনঃব্যবহার করে দেশান্তরের প্রাসঙ্গিকতায় নিজেদের আত্মপরিচয় খোঁজার প্রচেষ্টাকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখি। স্থাপনা শিল্প, পারফরমেন্স, আলোকচিত্র, ভিডিও, ভাস্কর্য নানা মাধ্যমের সম্মিলনে শিল্পীদের বহুমাত্রিক সৃষ্টির এই প্রদর্শনীটি তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বৈচিত্রময়তায় সমৃদ্ধ। ওন্টারিও আর্ট কাউন্সিল এর Culturally Diverse Curatorial Project grant এর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন আম্ব্রিন সিদ্দিকী।

আসমা সুলতানা তার যে স্থাপনা শিল্পটি এই প্রদর্শনীর অংশ সেটির শিরোনাম Wherever the glimpse of a free spirit exists, That will be my home’ ; শিল্পীর ধারাবাহিক কাজেরই একটি - যে প্রধান ধারণার শিকড়ের উপর দাড়িয়ে আছে, তাহলো শরীরের বাইরে বেড়ে ওঠা শিল্পীর স্বপ্নশিশু। এবার শিল্পীর এই স্বপ্নশিশুটি নকশিকাঁথার বুননে মাথার চুল দিয়ে সেলাই করা একটি সাদা শাড়ি, পেটিকোট এবং ব্লাউজ। নিজের মাথার চুল দিয়ে সেলাই এর বুনন সেই তীব্র আবেগের ইশারা দেয়, প্রতিটি স্বপ্ন তার মত করে বেড়ে ওঠার জন্য ঠিক কতটুকু আত্মত্যাগের পুষ্টি দাবী করে। যেন পরিত্যক্ত, নির্বাসিত কোন অবয়বহীন অশরীরীর সত্ত্বাকে আকড়ে ধরে রাখা সফেদ শাড়ি সহস্র মাইল পেরিয়ে আসা দূরত্বকে সংক্ষেপিত করে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাসে। ভাঁজ করে রাখা পেটিকোট আর ব্লাউজ ভাঁজে ভাঁজে মাথার চুলের বুনন উঁকি দেয়, গোলাপের নক্সা আঁকা চুলের সুতোয় দেখি ব্যস্ততা, নির্ভার কোন শরীরের উষ্ণতা যেখানে এখনও মাকড়শার জালের মত আঁকড়ে আছে।

আজ আমার ঘরের নম্বরটি মুছে দিয়েছি,
মুছে দিয়েছি গলির মাথায় গলির নামও
মুছে দিয়েছি প্রতিটি রাস্তায় আমার ঠিকানা দেখানো সব চিহ্নগুলো
কিন্তু তারপরও আমার সাথে
যদি সত্যি দেখা করতে চাও
তাহলে প্রতিটি দেশের প্রতিটি শহরের প্রতিটি রাস্তায়
প্রতিটি দরজায় কড়া নেড়ো -
এ এক আশীর্বাদ, আবার অভিশাপও –
আর যেখানেই দেখা মিলবে মুক্ত কোন আত্মার,
জানবে সেটাই আমার ঘর।
(আমার ঠিকানা – কবি অমৃতা প্রিতমের মেরা পাতা কবিতার অনুবাদ- কাজী মাহবুব হাসান)

শিল্পীর নিজের ভাষায় - তার সাম্প্রতিকতম কাজটির আংশিক অনুপ্রেরণা অমৃতা প্রিতম এর মেরা পাতা কবিতাটি। তার স্থাপনা শিল্পটির শিরোনাম হিসাবে বেঁছে নিয়েছেন কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদের শেষ দুটি পঙক্তি। আর সেখান থেকে শিল্পীর সৃষ্টিটি অনুভব করার আগেই আমরা শিল্পীর মনে প্রবেশ করতে পারি, অনুভব করতে পারি ঠিকানা থেকে ঠিকানায় যাযাবরের মত ঘর বদলানো শিল্পীর কাছে টিকে থাকা একটি ধ্রুব - যেখানে মুক্ত আত্মা শ্বাস নিতে পারে – যে আকাশের নিচেই সেই ঠিকানা হোক না কেন, সেখানেই তার বসবাস।

দ্বিখণ্ডিত আমি
সত্তায় সত্তায়
মাটি থেকে আকাশ
আর আকাশ মেঘে
দেহ থেকে আত্মা হারালে
বলে মৃত
আর
আত্মা থেকে দেহ হারালে
বলে স্খলিত
আমি দুটোই
তাই
নেই ঘর
নেই কবর।
(স্বাধিষ্ঠ: আসমা সুলতানা)

প্রায় পাঁচ বছর আগে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এই কবিতা তিনি পড়েছিলেন- কবিতার শব্দগুলো তাকে স্পর্শ করেছিল কারণ নিজের জীবনের প্রেক্ষাপটে অর্থবহ ছিল এর মূলসুর। এই কবিতার মতই তাকে পরিত্যাগ করতে হয়েছে পরিচিত পরিসর, পরিবার, বন্ধু. ঠিকানা, দেশ এবং মহাদেশ - নিজেকে বিকশিত করার অপরিহার্য কিছু স্বপ্ন। পাখির মত বাতাসে ভর করা ডানায় তাকে বহু পথ অতিক্রম করতে হয়েছে বেশ কিছু ভৌগলিক সীমারেখাকে শঙ্কা আশা আর উৎকণ্ঠায় দ্রবীভূত করে। অচেনা ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর প্রবাহিত কোন নদীর মত। শিল্পী মনে করিয়ে দেন যখনই কোন প্রবহমান নদী কিংবা আকাশে মুক্ত পাখির দেখা মেলে – তখন শিল্পীকেও আমরা মনে রাখবো।

নিজের কাজকে তিনি চিহ্নিত করেছেন আত্মজীবনীমূলক হিসাবে। আমরা কাছাকাছি পৌঁছে অনুভব করতে পারি শিল্পী কেন তার শিল্পকলার সাথে সম্পর্কটাকে উপস্থাপন করছেন জীবন্ত কোন চরিত্রের মত - বিদ্যমান সম্পর্কগুলো যেখানে অনির্বচনীয় জটিলতায় ভারাক্রান্ত। আর সেই সম্পর্কগুলো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো আমাদের বোধগম্যতার কাছে অতিক্রম্য হয়ে ওঠে শিল্পী যখন নিজের পরিবার আর স্বদেশের সাথে নিজের সম্পর্কটাকে একই সমান্তরালে তুলনা করেন। তার সাহসী স্বীকারোক্তি জানান দেয়ে শব্দতো বটেই শিল্পের প্রেক্ষাপটে যা ব্যাখ্যা করা যন্ত্রণাময় আর কঠিন – তারপরও তার সৃষ্টিকর্মের মূল ভিত্তি সেই সম্পর্কগুলোই, নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাকেই আমরা তার কাজে মুখর হয়ে উঠতে দেখি প্রত্যাখ্যান আর বিসর্জনের তীব্র নীরবতায়।

শব্দগুলো তখনো পায়নি কবিতার শরীর
অনুভূতিগুলো পায়নি নাম সেইদিনও, যাকে বলা যায় কবিতা
কবিতাগুলো তখনো অলিখিত, ছড়ানো ছিটানো ছিল
নক্ষত্রের বুদ বুদে, জলের ঢেউয়ের কন্টুরে কন্টুরে,
আমার চুলের ক্লিপের দুই বাহুতে...আঙ্গুলে...
তোমার হাতে বাধা সুইস ঘড়ির কাঁটায়,
শব্দগুলো ছিল ; আমাদের হৃদয়ের বোতাম বন্ধ জামাগুলোতে
অক্ষরগুলো ছিল রূপকথার খাঁচায় পোরা
সোনার টিয়া পাখির হিরেয় বাধানো ঠোঁটের ভাঁজে--
কবিতাগুলো তখনো কবিতা হয়ে ওঠেনি
আমার জরায়ুর ভেতর তখনও ঘুমন্ত ভ্রূণের মত ছিল,
শেষ হেমন্তের সন্ধ্যাবেলায়, কালপুরুষকে সাক্ষী রেখে...
(মার্গিক মূর্ছনা: আসমা সুলতানা)

শিল্পীর জন্মের সময় বাংলাদেশে বয়স মাত্র পাঁচ, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শেষে বিধ্বস্ত, ক্ষত বিক্ষত মানুষগুলো তখন কেবল দেশটাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সময়ের সেই অনিশ্চয়তাকে ভাষা দিয়েছিল অস্থির রাজনীতি আর ষড়যন্ত্রের পাত্রপাত্রীরা, দীর্ঘদিনের সামরিক দুঃশাসনের শৈত্য প্রবাহ থমকে দিয়েছিল সব সৃজনশীলতার বিকাশ। শিল্পীও সেই সব অনিশ্চয়তাকে আত্মীকৃত করে বেড়ে উঠেছিলেন সমস্যা জর্জরিত একটি পরিবারে। শৈশবের সেই সংগ্রামের সময়গুলো তাকে পরিবর্তনও করেছিল ভিন্ন একটি পরিচয়ে, যে পরিবর্তনগুলো তিনি শনাক্ত করেছেন আরো অনেকদিন পর- কাল অতিক্রমণের পর অতীতমুখী পর্যবেক্ষণ তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে কেন তাকে এই পথেই হাটতে হয়েছে। অনুভব করতে পেরেছেন, কিভাবে সবাই তার সংবেদনশীল মনন থেকে নিজেদেরকে আবেগময়তার স্তরে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে কোন দ্বীপের মত। শুধু মানসিক স্তরেই নয় – শারীরিকভাবেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভেবেছেন তিনি।

এই সঙ্গিহীন উপেক্ষিত অস্তিত্বের একটি আশ্রয় তাকে কখনো পরিত্যাগ করেনি। শৈশবের প্রথম অনুভবগুলো তাই তিনি অনায়াসে খুঁজে পান নিজের সৃজনশীলতায় – শিল্পী হবার সংকল্পে। সৃষ্টি করার তীব্র স্পৃহা যেন রক্ষাব্যুহের মত তাকে ঘিরে রেখে রেখেছিল একটি মাত্র স্বপ্নের হাতছানি দিয়ে- একটি মাত্র স্বপ্ন যা কখনই বিস্মৃত হয়নি – শিল্পী হবার স্বপ্ন। বিষণ্ণ আত্মবিশ্বাস সহ তাই শিল্পীকে আমরা বলতে শুনি এখনও তার পথ চলা অনেক বাকী – এই বর্তমানটি শুধু বলা যাবে কেবল নিজেকে শিল্পী হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় একটি পদক্ষেপ। কোথায় শিকড় না গাড়তে পারা অস্থির জীবনের একমাত্র স্থিরতা, একমাত্র ধ্রুব এই স্বপ্নটিকে অনুসরণ করতে তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে বহু প্রতিবন্ধকতা। শিল্পীর এই সংগ্রাম সেকারণেই তার সৃষ্টি কর্মে – কবিতা কিংবা শিল্পকর্ম – যুক্ত করে প্রায় স্পর্শযোগ্য একটি সততা। অনুভব তো বটেই – আমরা প্রায় সেটি স্পর্শ করতে পারি।

২০০৪ সালে প্রথম একক প্রদর্শনীর পর শিল্পী প্রথম বারের মত বহু সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করে প্রবাসী হয়েছিলেন – কিন্তু সেখানে সহজতর হয়ে ওঠেনি তার সংগ্রাম। তবে নতুন আবহাওয়া, সংস্কৃতি, ভাষা মানুষের মাঝে খাপ খাইয়ে নেবার প্রচেষ্টা তার দৃষ্টিভঙ্গির দিগন্তকে প্রসারিত করেছিল। সাংস্কৃতিক সংঘর্ষের নমনীয় একটি স্থিতিস্থাপকতা তাকে সুযোগ করেছিল দুটি সমাজের সাদৃশ্য আর বৈসাদৃশ্যকে মূল্যায়ন করার জন্য, পরিশেষে যা তাকে সেই সব শিল্পীদের মত ভাবতে সাহায্য করেছিল - স্বদেশ থেকে নির্বাসিত যে শিল্পীরা ভিন্ন পরিবেশে দাড়িয়ে যেভাবে সৃজনশীল সংবেদনশীলতায় নতুন করে অনুভব করেন পরিত্যক্ত স্বদেশকে। আসমা সুলতানার সৃষ্টিতে – কবিতা কিংবা ক্যানভাসে – শামুকের ধীর দৃঢ়তা নিয়ে ফিরে আসে স্বদেশ - নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে।

আমরা তার শিল্পী হিসাবে প্রসারিত হবার একটি নিয়ামক, তার বক্তব্য অনুযায়ী দেখতে পাই - ইউরোপ জুড়ে বহু চিত্রকর্ম দেখার অভিজ্ঞতা, আরাধ্য শিল্পীদের ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ানো সেই অতুলনীয় স্বর্গীয় অনুভূতি তাকে শুধু অনুপ্রাণিত করেনি, নিজের মৌলিক স্বকীয়তা খোঁজার তাড়নায় রূপান্তরিত হয়েছিল। যে নির্দেশনাটি তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিতে পারেনি কখনো। শিল্পকলার ইতিহাসে তার আগ্রহী মন ব্যাখ্যা খুঁজেছে শিল্পীরা কিভাবে সভ্যতার অনুঘটকের কাজ করেছে, আমাদের সংবেদনশীলতাকে পরিশীলিত আর সৌন্দর্যকে ভালোবাসতে শেখানোর মাধ্যমে। তার বর্তমান কাজটি অনুপ্রেরণা আমরা শুধুমাত্র অমৃতা প্রিতমের কবিতা না, তার অভিজ্ঞতাও প্রসূত হিসাবে আমরা অনায়াসে কল্পনা করতে পারি।

প্রথম প্রবাসে সংক্ষিপ্ত সময়ে নিয়তির অন্য পরিকল্পনা ছিল, তাকে আবার দেশান্তরী হতে হয়, শিল্পী তার জীবনের সব একাকীত্ব আর নির্জনতা, কষ্টগুলোকে পাতন করে ঘনীভূত করেন তার শিল্পকর্মে ব্যবহৃত সব প্রতীকে। পরিবার বিচ্ছিন্ন এবং পরিবারহীন শিল্পী তার সেই শিল্পকর্মকে লালন করেন তার সন্তানের মত – যা তার একান্ত নিজস্ব পরিবার। কখনো তারা অতীত কোন সময়ে নিয়ে যাবার যন্ত্রযানের মত, যা অনায়াসে তাকে তার হারানো শৈশবে নিয়ে যেতে পারে, যাদের সামনে দাড়িয়ে ফেলা প্রতিটি পলক রূপান্তরিত হয় টাইম ট্রাভেলে।

আমার শব যাত্রায়
সেদিন সকলে উপস্থিত ছিলো
সেই মধ্য মে তে
দম বন্ধ করা ঢাকার গরমে
সকলেই উপস্থিত ছিলো সেদিন,
আমার মা,
আমার নানী মায়ের
দেয়া রূপার চামচ,
চাচাতো বোন
তার যত সব, তাবিজ-কবচ
বাবা আর বাবার চশমায়
ঝাপসা কুয়াশা...
ভাইয়ের পাঞ্জাবীতে
রক্তের অমাবস্যা।
আমার শব যাত্রায়
সেদিন সকলেই উপস্থিত
ছিলো
আত্মীয়,অনাত্মীয়
জীবিত বন্ধু সকল,
মৃত বন্ধু আর
তার আত্মাও জ্বলজ্বল,
আমার শব যাত্রায়
সেদিন সকলেই উপস্থিত
ছিলো
যদিও অনেকের
আসায় ছিলো বারণ,
হঠাৎ এক পশলা
বৃষ্টি এসে জানিয়ে দিলো
তোমার না আসার কারণ!
(২০ মে, ২০০৪: আসমা সুলতানা)

ড্রইং এবং পেইন্টিং এ প্রধানত প্রশিক্ষিত হলেও শিল্পী বহু মাধ্যমেই কাজ করেন। রবার্ট ম্যাকলঘলিন গ্যালারীতে প্রদর্শিত কাজগুলো চিরায়ত নক্সী কাঁথা সেলাইয়ের একটি ভিন্ন রূপের উপস্থাপন। ২০১২ সালে আসমা সুলতানা কাপড়ের কোলাজ নির্ভর কিছু মিক্সড মিডিয়ার কাজ থেকেই মূলত তার কাজের উপাদান হিসাবে জায়গা করে নেয় কাপড়। আর সেলাই করার দক্ষতাও তাকে আরো সাবলীল করেছে এই মাধ্যমে। এই একই সময় আমরা তার কাজে দেখতে পারি তুলি নয় বরং আঙ্গুল আর হাতে ছাপ জায়গা করে নিয়ে ড্রইংয়ের টুল হিসাবে। আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করার সাথে নিজের স্বকীয়তা আর আত্মপরিচয়ের ভাবনাটি ছিল প্রগাঢ়। সুবিশাল কাগজের উপর অসংখ্য আঙ্গুলের ছাপ - যা আমার জানি প্রতিটি মানুষের জন্য অনন্য– শিল্পী আত্মপরিচয় খোঁজার অস্তিত্ববাদের টানাপোড়েন এর তীব্র ইঙ্গিত হয়ে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। নিজের অনন্য চিহ্নকে গর্ভজাত সন্তানের মত শিল্পকলার নিজের শিল্পকর্মের সৃষ্টির সাথে একাত্ম করার প্রচেষ্টা আমরা অনুভব করতে পারি। ঠিক যেন প্রজন্মান্তরে নতুন জীবনের নিজের অমর ডিএনএ হস্তান্তর।

সেই একই তাড়নায় তিনি অনুসন্ধান করেন আর কি আছে যা তার একান্ত নিজস্ব, যাকে আঙুলের ছাপের মত নিজেরই শিল্পকর্মে অমর করে রাখা যেতে পারে। যা শিল্পকর্মের সাথে অবিচ্ছের্যক একটি সেতুবন্ধন রচনা করবে – নিজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশের সাথে। সন্তানহীন শিল্পীর কাছে তার শিল্পকর্মই নিজের গর্ভজাত সন্তানের মত, শরীরের বাইরে বেড়ে ওঠা সেই সৃষ্টি তার নিজের অংশ – যারা জরায়ুতে নয়, শরীরের বাইরে শিল্পীর গভীর মমতায় বেড়ে ওঠে। এই ভাবনা থেকে সূত্রপাত হয় কাজে তার নিজের মাথার চুলের ব্যবহার। তার বৈশিষ্ট্যসূচক বড় চুল যখন মাথা থেকে পড়ে যায়, কিংবা চিরুনির ভাঁজে আটকে যাওয়া চুল পরম যত্ন সহকারে সংগ্রহ করতে শুরু করেন। পরিত্যক্ত সেই চুল একটি একটি করে তিনি সংগ্রহ করেন সযত্নে, যে যত্ন আর আবেগময় ভালোবাসা তিনি কারো কাছে পাননি, তিনি সেই পরিত্যক্ত চুলকে তার শিল্পকলার অংশ করে নেন। আর এই ঝরে পড়া আর কিংবা শিকড়চ্যুত চুল প্রতীকী তাৎপর্যে অর্থবহ উঠে শিল্পী জীবনের অভিজ্ঞতার নানা স্তরে। এই চুল সংগ্রহ,পরিষ্কার তাদের সংরক্ষণ সব কিছুই তার কাছে হয়ে উঠে একটি আচার অনুষ্ঠান, যেন খুব সতর্কতার সাথে পরিকল্পিত ধারাবাহিক কাজ –শিশুর প্রতিপালনের মত। এভাবেই শিল্পী নিজের সাথে নিজের একটি সম্পর্ক গড়ে তোলেন, তিনি রূপান্তরিত হন তার নিজেরই জননী এবং সন্তানে।

মাথার দীর্ঘ চুল এখনও বাঙালি রমণীর সৌন্দর্যর সংজ্ঞার অংশ হয়ে আছে – সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে দীর্ঘ ঘন চুলের গুরুত্ব তার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে বহু দিন আগেই। চুল আমাদের আমাদের শরীরের চামড়ারই একটি সম্প্রসারিত অংশ। চামড়ার নীচে ডুবে থাকা লোমকূপের গভীরে যারা নিরন্তরভাবে তৈরি হতে থাকে – লোমকূপের গোঁড়া থেকে জন্ম নেয়া কোষগুলোই মৃত সুসজ্জিত হয়ে তৈরি করে চুল। এই চুলের মূলেও থাকে আমাদের সবার নিজস্ব একটি অনন্য শনাক্তকারী ডিএনএ – শিল্পীরও আত্মপরিচয় – শিল্পী আমাদের জানান এই আত্মপরিচয়টাকে তিনি চেয়েছেন তার শিল্পকর্মে জায়গা করে দেবার জন্য। আঙ্গুলের ছাপ আর চুলের ব্যবহার তার স্বতন্ত্র সত্ত্বারও প্রতীক। পরিচিত সম্পর্কগুলোয় ক্রমশ বাড়তে থাকা দূরত্ব কখনোই কমাতে পারেননি তিন – বিচ্ছিন্ন একটি জীবনে সেই উদ্বাসনের যন্ত্রণাকে ভুলতে নিজের শরীরের অংশ দিয়ে সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন তার শিল্পকর্ম। সেই শূন্যস্থানটাকে পূর্ণ করার চেষ্টাই তার শিল্পকর্ম। আবারো নতুন করে নিজের আত্মপরিচয় খোঁজার প্রচেষ্টা এই বিশাল বিশ্বে- সেই পার্চমেন্টের প্যালিমসেস্ট এর মত যেখানে পুরনো সব লেখা মুছে আবারো নতুন করে লেখা হয় নতুন শব্দমালা।

২০১২ সালে নিজের চুল দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন একটি বিশাল চাদর, সেলাই করেছেন বেশ কিছু শিশুদের পরনের জামা। প্রদর্শিত কাজটি শিল্পীর সেই সৃষ্টিরই ধারাবাহিকতা। এবারে তিনি কাজটি করেছেন একটি সাদা থান শাড়ীর উপর । শিল্পীর খুব প্রিয় একটি পরিচ্ছদ শাড়ি, যখন সাধারণ পরিস্থিতিতে শাড়ি পরা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে তখনও তার নিয়মিত পোশাক ছিল শাড়ি –সেলাইহীন যে কাপড়ের পরিসর তার কাছে প্রবাহিত নদী কিংবা দীর্ঘ চুলের মতই অর্থবহ। দেশ ছাড়ার পর শাড়ি পরার সেই সুযোগটাকে তিনি স্মৃতিবেদনার অংশ করে নিয়েছেন – জীবন থেকে হারানো জিনিসের তালিকায় এখন যার জায়গা। সেই ধারণার উপর ভিত্তি করে এই প্রদর্শনীর কাজটি ছিল একটি শাড়ী। যারা সারা জমিন জুড়ে শিল্পী তার মাথার চুল দিয়ে সেলাই করেছেন।

শিল্পীর কাছ থেকেই জানা যায় এই সেলাই করা তার জন্য অনেকটাই ধ্যান করার মত। কাপড়ের সুতোর বুননের মধ্যেই তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলে হেলান দেয় সুচ তার নিজের অনমনীয় নমনীয়তার সাথে তার পথ খুঁজে নেয়, টেনে নিয়ে যায় শিল্পীর চুল – শিল্পীর মনোজগতের সব অভিব্যক্তিকে সে প্রতীকের রূপ দেয় কাপড়ের জমিনে। শাড়ীর সুতোর বুনটের গোলকধাঁধায় সুচ যেন শিল্পীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় অস্থির এক প্রশান্তির প্রতিজ্ঞা সহ। যেন কেউ সাতার কাটছে ঢেউয়ে উত্তাল নিরন্তর উৎস থেকে গন্তব্যে ছুটে চলা কোন নদীর বুকে। যেখানে কোন কিছু চলতে চাইলে থেমে থাকতে পারেনা। ছুটে চলতে হয় প্রবাহের সাথে। নতুন কোন গন্তব্যে – যেমন শিল্পী নিজেকে জন্ম দিয়েছের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে।

এই শাড়ীটি বাংলাদেশ থেকেই সংগ্রহ করা তুলোর সুতোয় বোনা শাড়ি। ছয় গজ কাপড়ের পরিসরের খুব কাছে গেলে আমরা দেখতে পাবো শিল্পীর চুলের সুতোয় তোলা ঢেউ এর বঙ্কিম রেখাগুলো। যে রেখাগুলো আমরা যখন অনুসরণ করি শিল্পীর নদীটিকে আমরা অনুভব করি, যা জীবনের মতই নিরন্তর প্রবহমান। আমরা শাড়ি ছাড়াও পেটিকোট আর ব্লাউজ দেখি। চুল দিয়ে সেলাই করা এই শাড়ীর এই অনুষঙ্গ সাদা কাপড়েই সৃষ্টি করা একটি পেটিকোট এবং ব্লাউজ। খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাবো, চুলের সেই সেলাইগুলো নানা ভাঁজে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে – স্থাপনায় তারা যেভাবে সাজানো, মনে হতে পারে কেউ যেন এখনই বিছিয়ে রেখেছে হয়তো পরার পর কিংবা এখনই কেউ সেগুলো তুলে নেবে পরিধানের জন্য।

ভাঁজ করে রাখা ব্লাউজটির পেছনে আমরা চুলের সেলাই দিয়ে করা একটি গোলাপের নকশা দেখতে পাই। গোলাপের খুব পরিচিত রূপ যা সেলাইয়ের ক্ষেত্রে। এই ফুলটি শুধু ব্যতিক্রম ঢেউ এর মত সরল রৈখিক বাকী সেলাইয়ের প্রেক্ষাপটে – আমাদের কাছে এই আটপৌরে সাদা পরিচ্ছদে যখনই মনে হবে এই গোলাপটির উপস্থিতি কেন – আমরা অনুভব করতে পারবো এটি যে কোন বঞ্চনা আর দুর্ভোগের মুখোমুখি এটি সুন্দরের উদ্ধত উপস্থিতি – বৈরী পরিস্থিতির অতিক্রান্ত হলে আবারো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসার সেই স্থিতিস্থাপকতা যা আমাদের বদ্বীপকে এখনও জনশূন্য করে দেয়নি। সেই স্বপ্নময় আশা নিয়ে বেঁচে থাকা – শিল্পীর কাছে যে স্বপ্নময় আশা শিল্পকলা, গোলাপের মতই যে তার সুন্দরকে চির আরাধ্য করে রেখেছে।

শাড়ির সাদা রঙ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এটি বিসর্জনের রঙ – কোন কিছু হারাবার রঙ– একই সাথে রঙটি পরিশুদ্ধতার- আশারও। নতুন করে কিছু শুরু করারও – যার সাথে যুক্ত হওয়া লাল রঙ উৎসব আর নতুন বছরের সূচনার চিরন্তন প্রতীক আমাদের সংস্কৃতিতে। শিল্পীর কাছে শাড়ির সাদা জমিন কাগজেরও মত, চুলের কালো রেখা যেখানে কোন মহাকাব্যের পঙক্তির মত, শিল্পীকে তার কবি সত্তার কথা মনে করিয়ে দেয়, কাগজে ড্রইং এর রেখার বিরামে যে শব্দগুলো তার নিজের জীবনের কথা বলে অপ্রস্তুত করে দেয়ার মত সততায়।

এই শাড়ি শিল্পীর মুক্ত আত্মার মত – ঠিকানা বিহীন পরিশুদ্ধ যে আত্মা অদম্য আশায় – নতুন সূচনায়।বহু মহাদেশ পেরিয়ে – বহুদেশকে আপন করে নিলেও শিল্পীর শিকড়কে আমরা অনুভব করি বাংলাদেশের পলিমাটিতে – পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম যে বদ্বীপে - অসংখ্য নদী যেখানে শিল্পীর শরীরীর জমিনের তোলা চুলের নকশার মত তাদের পথ খুঁজে নিয়েছে মানুষ তাদের জীবনের অংশ করে নেবার বহু হাজার বছর আগেই। মহাকাব্য আর কিংবদন্তীর চরিত্র তারা, সময়ের সীমানায় যারা বন্দী নয় কখনোই । আর এটাই শিল্পীর আত্মপরিচয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুভব – যে পরিচয় তাকে সাহসী করেছে আর শক্তি যুগিয়েছে একজন শিল্পী আর মুক্তমনের মানুষ হিসাবে নিজের নিয়তি পুনর্লিখনে।

কষ্টের পেয়ালা পূর্ণ
আজ আমার
পূর্ণিমার চাঁদের মতো
ভরপুর
সক্রেটিসের হেমলকের
পাত্র থেকেও বিষাক্ত
বুঝি সে সুরা
সাকি ও অনেক নিষ্ঠুর,
বস্ত্র হরণে দ্রৌপদী
হয়ে যায় নাকি
দুঃশাসনের ?
তাই ---
কুন্তলার কেশের চাইতেও
দীর্ঘ আমার অভিশপ্ত
মহাভারত
কুঁকড়ে যাই
আর যেতে যেতে ...
ভাবি
আমি তবু
অনুতপ্ত নই !
(হেমলকের পাত্র – আসমা সুলতানা)

আপনার মন্তব্য