আশি বছরের পাঠ : জীবনানন্দের ক্যাম্পে, সেকালে ও একালে

 প্রকাশিত: ২০১৭-০২-১৭ ২০:২৩:১৬

রেজওয়ান তানিম:

উত্তর রৈবিক যুগে বাংলা কাব্যধারায় নিজ শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়ে কবিতামনষ্ক পাঠক চেতনাকে উপমার নানামাত্রিক ব্যবহারে বুদ করে রেখেছেন যিনি, তিনি হলেন জীবনানন্দ দাশ। এ কথা বলা চলে নির্দ্বিধায়, বাংলা কাব্যের আধুনিকতম কবি তিনি। বিষয়ভাবনা ও নির্মাণকলার ভিন্নতায় বাংলা কাব্য ইতিহাসে স্বতন্ত্র ধারার স্রষ্টা। আপাত দৃষ্টিতে সহজ সরল তার কবিতা। কবিতায় নেই তৎসম ও সংস্কৃত ঘেঁষা শব্দমালা, নেই উচ্চকণ্ঠ বাগাড়ম্বর কিংবা হাহাকারের ক্ষুব্ধ প্রকাশ, বরং আবহমান বাংলার প্রকৃতিতে বাস করা কবি সারাজীবন খুঁজে বেড়িয়েছেন আমাদের চেতনার অর্ন্তগত অসুখ, মানবজীবনের হাহাকারের ক্রমবর্ধিষ্ণু ধারাটিকে। কাব্যে মানুষ ও প্রকৃতির ছবি আঁকা কবি কবিতায় এনেছেন জীবনের গভীর বোধ, সমাজ সচেতনতা এবং নগর জীবনের দ্বান্দিকতার নবতর ব্যাখ্যা।

বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার সূচনা মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরে। এর পরে গত দেড়শত বছর ধরে বাংলা কবিতা নিরন্তর সন্ধান করেছে আধুনিকতার, প্রকাশের নতুন মাত্রার। বাংলা কবিতা যখন রবীন্দ্রমন্দিরের প্রসাদের নিয়মিত গ্রাহক, অন্য সকল কাব্যমন্দির যখন তার প্রভার কাছে ব্রাত্য, তখন আমরা দেখেছি বিশের শেষাংশে ও ত্রিশের কবিদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা রবি বলয়ের রাহুগ্রাস খেকে বের হবার। ভাষা, ভাব, ভঙ্গি, অন্ত্যমিল ছন্দ, আঙ্গিক সকল বিষয়েই বদলের শুরু সে সময়টাতে। সেই ত্রিশের দশক থেকে আজ অব্ধি কবিতা রবীন্দ্রযুগের মত কখনোই স্থবির হয়ে নিজেকে সমর্পণ করেনি একক কবিসত্বার কাছে। বাংলা কবিতার এই দেড় শতাধিক বছর কালের বাঁকবদলের সময়ে বেশ কিছু কবিতা এসেছে যারা নিজেরাই একেকটি বিদ্রোহ, এক একটি পরিবর্তন। তেমন কিছু কবিতার নাম উল্লেখ করতে গেলে বলা যায় দুই বিঘা জমি, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, সোনার তরী, বিদ্রোহী, খেয়া পারের তরণী, ক্যাম্পে, বনলতা সেন, কেউ কথা রাখেনি, গোধূলি সন্ধির নৃত্য, আটবছর আগের একদিন, তোমাকে পাবার জন্যে হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো, নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়, ভাত দে হারামজাদা, প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার, বাতাসে লাশের গন্ধ প্রভৃতি যুগবদলকারী কবিতার কথা।

উপরোক্ত কবিতাগুলোর মত ক্যাম্পে কবিতাটিকেও যুগ বদলকারী কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যখন বাংলা কাব্যে অনিবার্যতা থেকেই এসেছে পরাবাস্তবতা ও কল্পজগতের নাতিদীর্ঘ বয়ান। জীবনানান্দিক কাব্য ঘরানার কবিতা যুগের সূচনা পর্বের গুরুত্বপূর্ণ কবিতা এটি। এছাড়াও রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবিতাপর্বের আধুনিকতার উন্মেষকারী কবিতা হিসেবেও এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এছাড়াও জীবনানন্দের আত্মানুসন্ধান ও নিজস্ব পথযাত্রার প্রারম্ভিকও এই সময়ের কবিতাগুলো (বোধ, ক্যাম্পে প্রভৃতি)। বিগত আশি বছরের অধিক কাল ধরে কবিতাটি আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে বিভিন্ন কারণে, যার মধ্যে প্রধানতম অশ্লীলতার অভিযোগ। সম্ভবত বাংলা কবিতা নিয়ে অশ্লীলতার প্রবল অভিযোগ এই প্রথম উত্থাপিত হয়, যার আক্রমণ এত তীব্র আকার ধারণ করেছিল।

জীবিতকালীন সময়ে জীবনানন্দ দাশ পাঠক কিংবা কবিসমাজে সমাদৃত ছিলেন না। বরং প্রচুর সমালোচনা তাকে অন্তর্মুখী ও লেখার মান নিয়ে সন্দিহান করে তুলেছিল। ফলে জীবদ্দশায় তার প্রকাশিত গ্রন্থ মাত্র সাতটা। পরবর্তীতে অগ্রন্থিত প্রচুর কবিতা, গল্প পাওয়া যায় লেখার খাতায়। সত্তর সালের পরে পাওয়া যায় উপন্যাস, যেগুলো প্রকাশিত হবার পরে দেখা যায়, সুলিখিত এবং মনোবিশ্লেষক চারটি উপন্যাস তিনি লিখেছেন। জীবনানন্দ যখন কবি হিসেবে এত প্রভাবশালী বলে ধরা দেননি তখনো তার কাব্যধারার একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তরুণ এবং নবীন লিখিয়েদের উপরে স্বীয় প্রভাব, যা আজও বর্তমান। জীবনানন্দের প্রভাব বাংলা সাহিত্যের পরবর্তীকালের অনেক বিখ্যাত কবি লেখকের উপর পড়েছিল। যাই হোক, ক্যাম্পে কবিতাটি জীবনানান্দিক বিপন্নতা নিয়ে পাঠকের সামনে প্রথম আসে পরিচয় পত্রিকায় ১৯৩২ সালে। পত্রিকাটির সম্পাদনায় ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। সুধীন দত্ত জীবনানন্দের লেখার আঙ্গিক তথা উপমার বাহুল্য এবং বিন্যাসের আঁটোসাঁটো বোধের অভাবের কারণে তার লেখার গুণগ্রাহী ছিলেন না। ক্ষেত্রবিশেষে তাকে কবি বলেও গণ্য করতেন না।১ তথাপি কবি বিষ্ণু দে’র চাপে বাধ্য হয়ে কবিতাটি পরিচয়ে প্রকাশিত হয় কেননা বিষ্ণু দে কবিতাটি জীবনবাবুর কাছ থেকে নিজে চেয়ে এনেছিলেন।২

প্রকাশের পরপরই কবিতাটি সমকালীন সমালোচক ও কবিসমাজের কাছে, জীবনানন্দের আরও কিছু মেটাফোরের নতুনত্বে সমুজ্জ্বল কবিতার মতই অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য বলে পরিগণিত হয়েছে। কবিতাটি নিয়ে রূঢ় সমালোচনার মুখে পড়েন কবি। ধারণা করে নেয়া যায়, এর বেশির ভাগই কবিতার পাঠে কবিতাটি অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য ঠেকার কারণেই। কবিতাটি নিবিড় পাঠে দেখা যাবে, কবিতাটি শুরু হয়েছে যদিও বনে মৃগয়া গমনের পরে ক্যাম্প ফেলবার কথা থেকে, তথাপি ক্যাম্পে যাওয়া এবং শিকার এই কবিতার মূল বিষয় নয়।

ভীষণ অন্তর্মুখী এবং নিজের গন্ডির ভেতরে চিরকাল বসবাস করা জীবনবাবু অদ্যাবধি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে কখনো শিকারে যাননি।৩ এছাড়া শিকারির শিকার প্রসঙ্গে আরেকটি কবিতায় তাঁর অসমর্থন প্রকাশ পেয়েছে (হরিণ কবিতাটিতে)। এই কবিতাটিতে একটি অসমীয়া শব্দ ঘাই ব্যবহৃত হয়েছে (টোপ অর্থে)। শব্দটি যদি আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে তিনি আসাম গিয়েছেন বা অসমীয়া ভাষী কারো সাথে মিশে থাকবেন, তবে বলতে হয় তিনি কখনোই আসাম যাননি। জীবনানন্দের ভাই অশোকানন্দের বিবৃতি হতে জানা যায়, তিনি মুনিরুদ্দি নামে একজনের সাথে কথা বলতেন প্রায়ই, যে ছিল কিনা একজন শিকারি।৪ তার কাছে জীবনবাবু শিকার সম্বন্ধীয় অনেক কিছুই শুনতেন। ধরে নেয়া যেতে পারে এই লোকটির কাছ থেকেই তিনি অসমীয়া এ শব্দটি শুনেছেন।

যাই হোক ক্যাম্পে কবিতার প্রতিবেশ এবং চরিত্র চিত্রণে কবি যেন সুনিপুণ নাট্যকারের ভূমিকা নিয়েছেন। কবিতাটির মূল সুর আদৌ যে ক্যাম্প বা হরিণ শিকার নয় সেই বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি কবিতার মধ্যভাগে। কবিতার সুরে ক্যাম্পে অবস্থানরত কথক (ধরে নেই ভ্রমণ উদ্দেশ্যে আগত, যেহেতু উল্লেখ নেই আগমনের কারণ) শুনতে পাচ্ছেন এক ঘাই হরিণীর ডাক

আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাকে শুনি –
কাহারে সে ডাকে!
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,
আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন

এই ঘাই হরিণী ডাকছে। কে কাকে ডাকছে ? প্রকৃতপক্ষে এই ঘাই হরিণীটি কি? এটা সবার জানা, ঘাই হরিণী বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে জ্যান্ত হরিণ, যাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রখ্যাত জীবনানন্দ গবেষক ক্লিনটন বি সিলি A Poet Apart বইয়ে উল্লেখ করেন, এই ঘাই হরিণীর ব্যবহার জীবনানন্দের জীবনের এক অসফল অধ্যায়ের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে প্রেমিকা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে অবজ্ঞা ভরে। এ ব্যাপারে জীবনানন্দের আত্মীয় পরিজনদের কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায় না, তার জীবনে কোন রমণীর সাথে এমন কোন সম্পর্ক ছিল বিয়ের আগে কিংবা পরে।৫ এই বিষয়ে কোন পরিষ্কার ধারণা না পাওয়া গেলেও আমরা ধরে নিতে পারি শিকারের অর্ন্তদ্বন্দ্বমূলক একটা প্রতিবেশ তৈরির জন্য তিনি শিকারি, শিকার ও প্রলোভনের এক জটিল ফাঁদ পেতেছেন।

ঘাই হরিণীর মৃদু শব্দময় বিষন্ন আর্তনাদ ইঙ্গিত দেয় হরিণের অথবা চিতার আগমনের। একই সাথে যেহেতু ঘাই হরিণী শিকারের টোপ, সে আরো ইঙ্গিত দেয় শিকারির দল আছে হয়তবা কাছে পিঠে বনের এই বিপন্ন আধারে। কবি পরের অংশে বর্ণনা দেন চঞ্চল হরিণের দল কিভাবে প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছে-

আজ এই বিস্ময়ের রাতে
তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;
তাহাদের হৃদয়ের বোন
বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে
জোছনায় –
পিপাসার সান্ত্বনায়—অঘ্রাণে—আস্বাদে!
কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেন!

তাহাদের হৃদয়ের বোন অর্থাৎ ঘাই হরিণীর দল ডেকে যাচ্ছে শুধু ফালগুণের এই সোনালি রাতে ঘাই হরিণের দলকে। বাঘের দল এখন অনুপস্থিত। লক্ষণীয় শিকারের দুই প্রকরণ এখানে উপস্থিত, যার একদল অপরদলকে আহ্বান করছে বিনাশের কাছাকাছি। অপরদিকে শিকারি হিসেবে বাঘ অনুপস্থিত। বাঘের অনুপস্থিতি আপাত নিশ্চয়তা দেয় হরিণের পাল কে, এখানে মৃত্যু বহুদূরে। কিন্তু শিকারি যদি ওত পেতে থাকে বাঘের অনুপস্থিতি কোন বড় বিষয় নয়। এখানে বাঘেরা অনুপস্থিত সম্ভবত স্বজাতির হাতে স্বজাতির ধ্বংসের এক মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণার জন্য।

একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে
দাঁতের—নখের কথা ভূলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই
সুন্দরী গাছের নীচে—জোছনায়!

বনপথ ছেড়ে ঘাইমৃগীর সাথে মৈথুনে লিপ্ত হতে আসা মৃগের দল জলের শব্দ পিছে ফেলে আসে সুন্দরী গাছের নীচে। কবিতাটি স্পষ্ট আমাদের নিয়ে যায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বিস্তৃত সুন্দরবন অঞ্চলে, যেখানে অসংখ্য খালে বিলে নদীতে ছেয়ে আছে বিপুলা বনাঞ্চল যার ক্রোড়ে খেলা করে অদ্ভুত এক শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদ-সুন্দরী । কথক পদশব্দ পেতে থাকেন, চারিদিকে অসহ্য আওয়াজ, সে আওয়াজ মৃত্যুর! অন্ধকারে তবু কিছু আশা ছিল, কিছু কল্পনা ছিল, সকাল হতেই, ভোরের আলো ফুটতেই দেখা যায় ঘাইহরিণীর পাশে মৃত মৃগের সারি।

চাঁদের আলোয় ঘাইহরিণী আবার ডাকে;
এইখানে পড়ে থেকে একা একা
আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জমে ওঠে
বন্দুকের শব্দ শুনে শুনে
হরিণীর ডাক শুনে শুনে।
কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া;
সকালে—আলোয় তারে দেখা যাবে –
পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা পড়ে আছে।

কথকের ভূমিকা পাঠকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দেখা দেয় এইবারে। পাতে আসা হরিণের মাংস তিনি আরাম করে খান, স্বাদ নেন ঝলসানো মাংসের। অথচ এর আগে মনে হয়েছিল তিনি ক্যাম্পে এসেছিলেন বিহারে। যেখানে তিনি শিকারির শিকারের নীরব দর্শক। প্রথমাংশে কবি তাকে উপস্থাপন করেছেন সহৃদয় এক ব্যক্তি হিসেবে যিনি হরিণের পালের প্রতারিত হবার দু:খে ব্যথিত। এই অংশ পাঠ করে নিশ্চিত হওয়া যায় না তিনি শিকারিদের সাথে ছিলেন কিনা, কিংবা নিজেই শিকারে মত্ত হয়েছেন কিনা।

আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাব,
মাংস খাওয়া হল তবু শেষ?
কেন শেষ হবে?
কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে
তাদের মতন নই আমিও কি?

কথক চরিত্রটি ধরে নেয়া যায় সময়ের একটা প্রতিভূ, যাকে নৈতিক অনৈতিক সব রকম কাজের শুধু দর্শক হতে হয়, দেখে যেতে হয় পরাজিত মানবতার বিপন্নতা, ক্রম অবক্ষয়। কবিতার বাঁক এখানেই বদলে যায় আশ্চর্য রূপে যখন কথক প্রশ্ন করেন তাদের মতন নই আমিও কি? কথক নিজেকেই প্রশ্ন করছে যে প্রশ্নের অসীম উত্তরের সবটুকুই তার জানা, কিন্তু মাঝে মাঝে অজানা হয়ে ধরা দেয়। চিতার চোখের ভয়, পৃথিবীর সব হিংসা ভোলা সাহসী মৃগশাবক ধরা দিতে চায়নি কি ঘাইহরিণীর মায়াজালে?

আমার হৃদয়—এক পুরুষহরিণ –
পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
চিতার চোখের ভয়—চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?

এই পঙক্তিগুলোতেই ফুটে ওঠে না পাওয়ার বোধ, হারানো ক্ষতের যন্ত্রণা। যখন বুকের আরশিতে জমাট হয়ে থাকা রক্তধারার মত উৎসারিত প্রেম মিশে যায় ধুলোয়, মৃত মৃগদের মতন। পরমুহূর্তেই কবির অন্তিম কৌতূহল আমাদের চিরন্তন মানবিক বোধটাকেই তুলে ধরে। নিজের বিনাশ মাঝে মাঝে তুচ্ছ মনে হয় যখন হৃদয়ের বোনের বেঁচে থাকাটা অনেক বড় অর্থ বহন করে।

আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো
যখন ধূলায় রক্তে মিশে গেছে
এই হরিণীর মতো তুমি বেঁচেছিল নাকি
জীবনের বিস্ময়ের রাতে
কোনো এক বসন্তের রাতে?

জীবনের বিস্ময় নিয়ে বেঁচে থাকা কোন প্রলোভন জাগানিয়া ঘাইহরিণীর মত এক সুররমণীর ভাবনা ভাবতে ভাবতে সময়ের অতলান্তে ডুব দেয় সমস্ত বনানী, নিঃস্পৃহ কথক, মৃত মৃগের দল, এমনকি দোনলা রাইফেলে যারা কিনে নেয় জীবন কেড়ে নেবার বিমূর্ততার ভীষণ অধিকার। কবিতা শেষ হয় আমাদের অন্তরের রক্তক্ষরণের শাশ্বত চিত্র তুলে ধরে। ক্যাম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে-

যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায়
হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে
তাহারাও তোমার মতন–
ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদের ও হৃদয়
কথা ভেবে— কথা ভেবে— ভেবে।

জীবনবাবু একটি বিশেষ প্রেক্ষিতে কবিতাটি বিষয়ে কিছু মতামত রেখেছিলেন। সেখান থেকে কিছুটা উদ্ধৃত না করে পারছি না প্রসঙ্গক্রমেই-

’যদি কোন একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এই কবিতাটিতে থেকে থাকে তবে তা জীবনের-মানুষের-কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নি:সঙ্গতার সুর। সৃষ্টির হাতে আমরা ঢের নি:সহায়- ক্যাম্পে কবিতাটির ইঙ্গিত এই; এইমাত্র’।৬

যথার্থ অর্থেই কবিতার মূল সুর তাই। কবিতাটি আমাদের জানান দেয় আমাদের জীবনের যাবতীয় অজাচার, প্রেমের অস্ফুট প্রকাশ, বেদনার নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব সব কিছুর শেষ কথা সার্বজনীনতা। যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের, কীটের, বন বেড়ালের সে জীবনের ছায়া মানবের মাঝেও বিদ্যমান। এ জীবনে হাসি কান্না আনন্দ বেদনার অন্তিমে আছে বিপন্ন বিস্ময়, অর্ন্তগত ক্ষয়ের সূত্র।

এই ব্যথা এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে—
কোথাও ফড়িঙে—কীটে, মানুষের বুকের ভিতরে,
আমাদের সবের জীবনে।
বসন্তের জোছনায় অই মৃত মৃগদের মতো
আমরা সবাই।

কবিতাটি বিষয়গত ও আঙ্গিকগত উভয় দিকেই ১৯৩২ এর বাংলাদেশের সমাজ ও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর ছিল। এরই ফলশ্রুতিতে কবিতাটি প্রকাশের পর থেকেই নানাবিধ সমালোচনার মুখোমুখি হয়। ত্রিশের দশকে নতুন কবি ও কবি যশোপ্রার্থীদের যম হিসেবে পরিচিত সজনীকান্ত দাশ ১৯৩১ এর সেপ্টেম্বর থেকে ২য় দফায় বের হওয়া শনিবারের চিঠিতে কবিতাটির সমালোচনা করে বিস্তর লেখেন। তার লেখায় ফুটে ওঠা কবিতাটির ব্যর্থ পাঠের ও ক্ষোভের সীমাহীন প্রকাশ-

“কবিতাচ্ছলে কবি যে বিরহিণী ঘাইহরিণীর আত্মকথা ও তাহার হৃদতুতো দা'র মর্মকথা কহিয়াছেন তাহা পরম রমণীয় হইয়াছে।”

বস্তুত ঘাই হরিণী শব্দটার ব্যবহারে তার কাছে কবিতাটিকে ভীষণ অশ্লীল মনে হয় এবং তিনি ঘাই হরিণী শব্দটিকে যৌন প্রলোভন হিসেবে নেন। এর পরবর্তীতে হৃদয়ের বোন শব্দটি ব্যবহার নিয়েও তিনি কবিকে কটাক্ষ করেন।

“বনের যাবতীয় ঘাই-হরিণকে 'তাহাদের হৃদয়ের বোন' ঘাই-হরিণী অঘ্রাণ ও আস্বাদে'র দ্বারা তাহার পিপাসার সান্ত্বনা'র জন্য ডাকিতেছে। পিসতুতো, মাসতুতো ভাইবোনদের আমরা চিনি। হৃদতুতো বোনের সাক্ষাৎ এই প্রথম পাইলাম।...

মৃগীর মুখের রূপে হয়ত চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়!
লালসা-আকাঙ্ক্ষা-সাধ-প্রেম-স্বপ্ন স্ফুট হয়ে উঠিতেছে সব দিকে
আজ এই বসন্তের রাতে
এইখানে আমার নকটার্ন-।

এতক্ষণ পরে বুঝিলাম কবিতার নাম ক্যাম্পে হইল কেন! যাহাই হউক নকটার্ন শব্দের পরে ড্যাশ মারিয়া কবি তাহার নৈশ রহস্যের সরস ইতিহাসটুকু চাপিয়া গিয়া আমাদিগকে নিরাশ করিয়াছেন। ...”৭

বাস্তবিক অর্থে কবিতার সমালোচনা করতে এসে সজনীকান্ত সকল ভব্যতা ও সাহিত্যিক শ্লীলতাকে অতিক্রম করে ইতর শ্রেণীর আক্ষরিক পাঠ দ্বারা কবিতাটির সমালোচনা করেন। আরেক অংশে সজনী পরিচয় এর মত উচ্চশ্রেণীর পত্রিকা, যাতে রবীন্দ্রনাথ, হীরেন্দ্রনাথের লেখা ছাপা হয় সেখানে এরূপ অশ্লীল কবিতা কিরূপে ছাপা হয় এই প্রশ্ন তোলেন। ক্যাম্পে কবিতাটি তার মতে, পরিচয়ের অশ্লীলতা চর্চার চূড়ান্ত নমুনা।৮

প্রকৃতপক্ষে সজনীকান্তের মত দ্বিতীয়শ্রেণীর নেতিবাচক সমালোচকের দ্বারা বাংলা কাব্য ধারার বাঁকবদলকারী এমন একটি কবিতার এমন রূঢ় সমালোচনা হবে এটা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়। এ কবিতায় এমনকি সুন্দরী গাছের কথাকে উল্লেখ করে কবিকে কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, কবির তন্ময়তায় না হয় গাছও সুন্দরী হইল!৯ (তিনি সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী গাছের কথা জানতেন না)। এছাড়াও নিজের পত্রিকায় জীবনানন্দের নাম বিকৃত করে ছাপতেন, লিখতেন জীবানন্দ। জীবনানন্দকে কবি গণ্ডার বলে ডাকতেন। এছাড়াও তাকে বর্ণবাদমূলক বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে প্রায়ই। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের লেখক কবিদের লেখাকে তিনি তাচ্ছিল্য করতেন পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্য বলে।১০ তিনি ব্যঙ্গ করে লেখেন,

“এই সাহিত্যের স্পেন্সার হইতেছেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দ দাস, ব্রাউন-কালীপ্রসন্ন ঘোষ, বিদ্যাসাগর এবং হুইটম্যান- শ্রী জীবানন্দ দাশগুপ্ত (লক্ষণীয় কবির নাম বিকৃতি); ইহার ম্যাথু আর্নল্ড ও ওয়াল্টার পেটার যথাক্রমে শ্রীমান বুদ্ধদেব বসু ও শ্রীমান অজিতকুমার দত্ত।”

যে রবিঠাকুর বুদ্ধদের বসুর কাছে লিখিত পত্রে জীবনানন্দের কবিতাকে চিত্ররূপময় বলে উল্লেখ করেছেন সেই কবিগুরুর কাছেও অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল ক্যাম্পে। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সুধীন দত্তের কাছে বলেন, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কোন স্টাইল নেই, আছে পাঁচমিশালী ভাব।১১ প্রকৃতপক্ষে বাংলা কাব্যজগতে রবীন্দ্রনাথের সমকালীন আর কোন কবি লেখকই তাদের আঙ্গিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেক রবীন্দ্রনাথের থেকে এত বেশি পৃথক ছিলেন না। সেই ক্ষেত্রে চিরকালীন রোম্যান্টিসিজম ও আধ্যাত্মবাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনানন্দ দাশের মানবের চিরন্তন বিপন্নতা এবং না পাওয়ার বোধে ন্যুব্জ স্যুরিয়ালিস্টিক কবিতাটি ভাল না লাগাটাই ছিল স্বাভাবিক।

বিরূপ সমালোচনায় অতিষ্ঠ হয়ে জীবনানন্দ প্রথম বারের মত তার কবিতার সমালোচনা বিষয়ে কলম ধরলেন। যদিও এই প্রতিক্রিয়াটি জীবনানন্দের স্বভাব সুলভ আচরণের কারণেই প্রকাশ পায়নি তার জীবদ্দশায়। পরবর্তীতে জীবনানন্দ অনুগ্রাহী কবি ভূমেন্দ্র গুহর কাছে লেখাটি ছিল। তিনি সেটি শতভিষা পত্রিকার ভাদ্র ১৩৮১ সংখ্যায় প্রকাশ করেন।

আমার ক্যাম্পে কবিতাটি সম্বন্ধে দু একটা কথা বলা দরকার বলে মনে করি। কবিতাটি যখন শেষ হয় তখন মনে হয়েছিল সহজ শব্দে-শাদা ভাষায় লিখেছি বটে, কিন্তু তবুও হয়তো অনেকে বুঝবে না। বাস্তবিকই ’ক্যাম্পে’ কবিতাটির মানে অনেকের কাছে এতই দুর্বোধ্য রয়ে গেছে যে এ কবিতাটিকে তাঁরা নির্বিবাদে অশ্লীল বলে মনে করেছেন।

কিন্তু তবুও ’ক্যাম্পে’ অশ্লীল নয়। যদি কোন একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এ কবিতাটিতে থেকে থাকে তবে তা জীবনের-মানুষের-কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নি:সহায়তার সুর। সৃষ্টির হাতে আমরা ঢের নি:সহায়- ক্যাম্পে কবিতাটির ইঙ্গিত এই; এইমাত্র। কবিতাটির এই সুর শিকারি, শিকার, হিংসা এবং প্রলোভনে ভুলিয়ে যে হিংসা সফল-পৃথিবীর এই সব ব্যবহারে বিরক্ত তত নয়- বিষন্ন যতখানি; বিষন্ন নিরাশ্রয়। ’ক্যাম্পে’ কবিতায় কবির মনে হ’য়েছে তবু যে স্থূল হরিণ শিকারিই শুধু প্রলোভনে ভুলিয়ে হিংসার আড়ম্বর জাঁকাচ্ছে না, সৃষ্টিই যেন তেমন এক শিকারি, আমাদের সকলের জীবন নিয়েই যেন তার সকল শিকার চলছে; প্রেম-প্রাণ-স্বপ্নের একটা ওলট পালট ধ্বংসের নিরবচ্ছিন্ন আয়োজন যেন সবদিকে: king Lear-এর 'As this to wanton toys are we to the gods, they kill us for their sport' এই আয়োজন।

বাংলা সাহিত্যে-অন্তত: কাব্যে এ সুর ’ক্যাম্পে’ কবিতাটির এই পবিত্র কঠিন নিরাশ্রয়তার সুর: 'জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মত আমরা সবাই'- এই সুর আগে এসেছে কিনা জানিনা। অন্তত: এ সুরের সঙ্গে চলতি বাঙালি পাঠক ও লেখক যে খুব কম পরিচিত তা নি:সঙ্কোচে বলা যেতে পারে। যে জিনিস অভ্যস্ত বুদ্ধি বিচার কল্পনাকে আঘাত করে-যা পরিচিত নয় তার অপরাধ ঢের। কিন্তু তবুও অশ্লীলতার দোষে ’ক্যাম্পে’ কবিতাটি সবচেয়ে কম অপরাধী। ইংরেজি, জার্মান বা ফ্রেঞ্চ এ কবিতাটি অনুবাদ ক’রে যদি বিদেশী literary circle-এ পাঠানো হ'ত তাহলে এ কবিতাটির কি রকম সমালোচনা হ'ত ধারনা করতে পারা যায়; ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির যে সুরের কথা আমি ইতিপূর্বে বলেছি তাই নিয়ে বিশ্লেষণ চলত।

দু একটি prurient মন ছাড়া এ কবিতাটির ভিতর থেকেই নিজেদের প্রয়োজনীয় খোরাক খুঁজে বার করবার অবাধ শক্তি যাদের রয়েছে; এই তাদের একমাত্র শক্তি, এই prurience-র কাছে ক্যাম্পে অশ্লীল- আকাশের নক্ষত্রও শ্লীল নয়। শেলীর ''souls' 'sisters' পাশ্চাত্য কবি ও সমালোচক ও পাঠকদের গভীর আদরের expression কিন্তু হৃদয়ের বোন (এই expressionটির জন্য আমি শেলীর কাছে ঋণী)- এই শব্দ দুটি prurient অন্ত:করণকে শুধু বুঝতে দেয় যে সে কত prurient-তার ভিতরে অন্য কোন চেতনা জাগায় না। Muteykeh (একটি ঘোটকী) সম্বন্ধে Browning বলেছেন, 'She was the child of his heart by day, the wife of his breast by night,' না জানি Browning সম্বন্ধে prurience কি বলত।

কিন্তু বাংলাদেশে সজনে গাছ ছাড়া যে আরো ঢের গাছ আছে-সুন্দরী গাছ বাংলার বিশাল সুন্দর-বন ছেয়ে রয়েছে যে সজনের কাছে তা অবিদিত থাকতে পারে- prurience এর কাছে প্রকৃত সমালোচকের অন্তরাত্মা যেমন চিরকালই অজ্ঞাত, অনাবিষ্কৃত।

বাংলাদেশের সব কবিই এই ১৯৩২ সালে কলেজীয় কবিতা যুদ্ধের naivete-র ভিতর রয়ে যায় নি। কিন্তু হায়, যদি তেমন হ'য়ে থাকতে পারা যেত। সহজ সরল বোধ নিয়ে সুসাধ্য-সুগম পথে চিন্তালেশশূন্যতার অপরূপ উল্লাসে জীবন কত মজারই না হ'ত তাহ'লে। শ্রী জীবনানন্দ দাশ১২

বুদ্ধদেব বসু এই বিষয়টির (সজনীকান্তের ক্রমাগত সমালোচনা) অনিবার্য ফল হিসেবে জীবনানন্দের কলকাতা সিটি কলেজ থেকে চাকরি যাবার কথা লেখেন। এই বিষয় নিয়ে কলকাতার দেশ পত্রিকায় (১৯৬৮ সালে) তিনি একটি নাটিকা লেখেন যেখানে একজন লেখক এবং একজন অধ্যাপক আলোচনা করছেন জীবনানন্দের চাকরি যাবার কারণ নিয়ে, যার উত্তর লুকিয়ে আছে ঘাইহরিণীতে।১৩

তিনি আরো এক জায়গায় লেখেন, এ কথাটি এখন আর অপ্রকাশ্য নেই যে, পরিচয়ে প্রকাশের পরে ক্যাম্পে কবিতাটির সম্বন্ধে অশ্লীলতার নির্বোধ ও দুর্বোধ্য অভিযোগ এমনভাবে রাষ্ট্র হয়েছিল যে কলকাতার কোন এক কলেজের শুচিবায়ুগ্রস্ত অধ্যক্ষ তাঁকে অধ্যাপনা থেকে অপসারিত করে দেন।১৪

বুদ্ধদেব বসু যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কেননা কলকাতা সিটি কলেজ থেকে তিনি অপসারিত হন ১৯২৮ সালে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে, হিন্দু কলেজে সরস্বতী পূজা পালন নিয়ে সৃষ্ট ছাত্র আন্দোলন ও তার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক ছাটাইকে কেন্দ্র করে। উপরোক্ত ধারনার উৎস হিসেবে অচিন্ত্যকুমার বসুর সাথে সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব বসু বলেন, এটা এমন একটা ব্যাপার যা সাহিত্যমহলের সবাই জানেন যে কবিতায় কথিত অশ্লীলতার কারণে জীবনানন্দ চাকরি হারিয়েছিলেন।১৫

প্রকৃতপক্ষে ১৯২৮ সালে ঘটে যাওয়া চাকরি ছাটাই এর সাথে ক্যাম্পে কবিতার কোন যোগসূত্র নেই কেননা তা প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। বুদ্ধদেব বসুর এই ধারণা প্রসঙ্গে বলেছেন সিটি কলেজে জীবনবাবুর সহকর্মী ইংরেজি বিভাগের সরোজেন্দ্রনাথ রায়। সরস্বতী পূজার ঘটনা থেকে তিনি ছাটাই সম্পর্কিত বিতর্কটিকে আরো টেনে নিয়ে গিয়ে বলেন:

‘মৈত্র মহাশয় অতি নীতিপরায়ন ও রুচিশীল বলে খ্যাত। তাঁর নীতিপরায়নতা সম্বন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে যার কিছু কিছু তিনি নিজেও জানতেন ও কৌতুক অনুভব করতেন। জীবনানন্দ বাবুর চাকুরী যাওয়া ও তাঁর নীতিপরায়নতাকে যুক্ত করে একটি কাহিনী রচিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শুধু বুদ্ধদেব বসু একলা নন, আরো কেউ কেউ করেছেন।’১৬

চাকরি ছাটাই এর ঘটনাটি ‘ক্যাম্পে’ কবিতার সাথে সংশ্লিষ্ট না হলেও এই কবিতাটি নিয়ে তৎকালে অব্যাহত সমালোচনায় বিরক্ত হয়েই হোক, কিংবা তৎকালীন লেখক সমাজের প্রতি অভিমানবশতই হোক, কিংবা নিজের সাহিত্য কীর্তির সামর্থ্য বিষয়ে সন্দিহান হয়েই হোক, ১৯৩৫ সালে বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমরসেন সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকাটি বের হবার আগে লেখা আর পত্রিকায় ছাপতে দেননি। এ সময়ে কল্লোল, প্রগতি বন্ধ হয়ে যায়। তবে আপন মনে নিভৃতে লিখে গেছেন এই নির্জনতার চাষী বিষাদ লিরিকের জন্মদাতা কবি জীবনানন্দ দাশ। সম্ভবত জীবনানন্দ এই সময়ের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আজকে জীবনানন্দ দাশ শুদ্ধতম কবি বলে খ্যাত।১৭

তথ্যসূত্র :

  • ১) সত্যপ্রসন্ন দত্ত ও পরমানন্দ সরস্বতী সাধুর (মৃণালকান্তি দাশ) সাক্ষাৎকার।
  • ২) বিষ্ণু দে’র সাক্ষাৎকার।
  • ৩) অনন্য জীবনানন্দ (A Poet Apart) Clinton. B. Silli
  • ৪) অশোকানন্দ দাশ, ‘বাল্যস্মৃতি’, ১৩৪।
  • ৫) অনন্য জীবনানন্দ (A Poet Apart) Clinton. B. Silli
  • ৬ ও ১২) সন্দীপ দত্ত সম্পাদিত : জীবনানন্দ প্রাসঙ্গিকী (কলকাতা: হার্দ্য,১৯৮৪), ১৫৮-১৫৯
  • ৭ ও ৮) শনিবারের চিঠি, মাঘ ১৩৩৪, ৬৬৯-৭২
  • ৯ ও ১০) ক্যাম্পে: জীবনানন্দের সেই বিতর্কিত কবিতা (শুদ্ধতম কবি) সংযোজন ১৩, পৃষ্ঠা ৩৭২ আব্দুল মান্নান সৈয়দ
  • ১১) জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রারম্ভিক সমালোচনা, মোহিত উল আলম। কালধারা দশম সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১৯৪।
  • ১৩) বুদ্ধদেব বসু, ‘চরম চিকিৎসা’, দেশ, ২৮ বৈশাখ,১৩৭৫, পৃষ্ঠা ২৩৭।
  • ১৪) কবিতা, পৌষ ১৩৬১ সংখ্যা।
  • ১৫) বুদ্ধদেব বসু ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সাক্ষাৎকার।
  • ১৬) দেশ, ২৯ আষাঢ়, ১৩৭৫, পৃষ্ঠা ১২২৪।
  • ১৭) প্রবেশক, শুদ্ধতম কবি; আব্দুল মান্নান সৈয়দ পৃষ্ঠা ১১।

আপনার মন্তব্য