জীবনানন্দ দাশের প্রথম কবিতা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-১৪ ০১:৩৪:৪৩

 আপডেট: ২০১৬-০৫-১৪ ০১:৪১:৫৪

ফরিদ আহমেদ:

ছাপার হরফে জীবনানন্দের প্রথম কবিতা কোনটি? এর উত্তর আসলে কেউ জানে না। জীবনানন্দের দাশের প্রথম দিকের প্রায় সব কবিতাই ছাপা হয়েছে মূলত বরিশাল থেকে প্রকাশিত'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকায়। এই পত্রিকার সাথে তাঁর পরিবারের লোকেরাও খানিকটা যুক্ত ছিল। তারপরেও কেন কেউ জানে না, সেটা বলছি।

'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকার জন্ম বাংলা ১৩০৭ সালে অর্থাৎ ইংরেজি ১৯০১ সালে। এটা জীবনানন্দ দাশের জন্মের দুই বছর পরের ঘটনা। বরিশাল শহরের ব্রাহ্মরা এই পত্রিকা বের করে। ধর্ম, নীতি, শিক্ষা, সমাজতত্ত্ব এগুলো ছিল এই পত্রিকার আলোচ্য বিষয়।

এই পত্রিকার প্রথম দিকের সম্পাদক ছিলেন জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাসগুপ্ত। পরে যদিও তিনি আর সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন না, তবুও এই পত্রিকা অনেকটা জীবনানন্দ দাশদের পারিবারিক পত্রিকার মতোই ছিল। তাঁর মা কুসুমকুমারী দেবীও এখানে কবিতা লিখতেন। বাবা সত্যানন্দও লিখতেন। জীবনানন্দ দাশের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এর সম্পাদক ছিলেন তাঁর পিসেমশায় আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী। এই সম্পাদক মহাশয় পত্রিকা প্রেসে থাকার সময়েও তাঁদের বাড়িতে এসে তাঁর মায়ের কাছ থেকে কবিতা লিখিয়ে নিয়ে যেতেন।

কাজেই, এই পত্রিকাতেই যে জীবনানন্দ কবিতার প্রথম প্রকাশ ঘটেছে, এটা নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ খুবই কম।জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ জীবনানন্দের একেবারে কৈশোরের একটা কবিতার দুই লাইন মাত্র স্মরণ করতে পেরেছিলেন। সে দুই লাইন এমন-

এল বুঝি বৃষ্টি এল
পায়রাগুলো উড়ে যায় কার্নিশের দিকে এলোমেলো।

এই কবিতা কোথাও ছাপা হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে তিনি অবশ্য কিছু বলেন নি। গবেষকরাও এটা খুঁজে পান নি কোথাও।

বরিশালের মতো দুর্গম একটা প্রান্তিক মফস্বল শহর থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকা যে, খুব একটা প্রচার পায় নি, এটাই স্বাভাবিক। এর সংখ্যাগুলোও আর পাওয়া যায় না। ফলে, জানা যায় না ঠিক কোন কবিতাটা তাঁর ছাপা হয়েছিল সবার আগে।

আরও পড়ুন : জীবনানন্দ দাশ : দাস আর দাশ নিয়ে চলে হাঁসফাঁস

‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার সবগুলো সংখ্যা  অদৃশ্য হয় নি অবশ্য। কয়েকটা মাত্র সংখ্যা দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় খুঁজে পেয়েছিলেন কোলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। এখানেই ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ২০শ বর্ষের বৈশাখ সংখ্যায় (বাংলা ১৩২৬, ইংরেজি ১৯২০) 'বর্ষা আবাহন' নামে একটা কবিতা দেখতে পান তিনি। কিন্তু, এই কবিতার শেষে কবির কোনো নাম ছিল না। শুধু 'শ্রী.." লেখা ছিল। স্পষ্টতই এটা ছাপার ভুল নয়। কবি হয়তো নিজের নাম দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন বলেই এম করে লেখা হয়েছিল।

এই কবিতাটা যে জীবনানন্দের লেখা, সেটা কখনোই জানা যেতো না, যদি না সৌভাগ্যক্রমে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে একই বর্ষের শেষ সংখ্যা অর্থাৎ চৈত্র সংখ্যা হাতে না পড়তো। চৈত্র সংখ্যায় ব্রহ্মবাদী পত্রিকার সারা বছরের লেখা ও লেখক-লেখিকাদের বাৎসরিক সূচী ছাপা হয়েছিল। সেখানে বর্ষা আবাহন কবিতার কবির নাম উহ্য রাখা হয় নি আগের মতো। পরিষ্কারভাবে সেখানে লেখা ছিল এই কবিতার কবি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাস, বি.এ.।

এটাই যে ছাপার হরফে জীবনানন্দের প্রথম কবিতা সেটা নিয়ে অসংশয়ী ছিলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তাই নয়, এই কবিতায় কেন জীবনানন্দের নাম ছিল না, সে বিষয়েও একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তিনি। তিনি তাঁর 'জীবনানন্দ: জীবন ও কবিতার আলোচনা' বইতে লিখেছেন,

"বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় জীবনানন্দের যে সব প্রকাশিত কবিতা দেখা যায়, তাঁর মধ্যে এই কবিতাটিকেই এখন তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলেই মনে হয়। খুব সম্ভব জীবনানন্দ স্বেচ্ছায় ব্রহ্মবাদী-তে এই কবিতাটি লেখেননি, কারও অনুরোধ বা নির্দেশেই এই কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন। তাই নিজের নাম কবিতার সঙ্গে প্রকাশ করতে দেননি। এই নাম প্রকাশে তাঁর সংকোচ সম্বন্ধে আমার মনে হয়, যেহেতু ব্রহ্মবাদী ব্রাহ্মদের পত্রিকা এবং জীবনানন্দ নিজে ব্রাহ্ম হলেও ব্রাহ্মদের আচার অনুষ্ঠান, এমন কি সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানই এড়িয়ে চলতে ভালবাসতেন; সেই জন্যই হয়ত ঐ পত্রিকায় নাম প্রকাশ করতে চাননি।"

কারণ যাই হোক না কেন, ব্রহ্মবাদী পত্রিকার প্রকাশিত সেই 'বর্ষা-আবাহন' কবিতাটাই জীবনানন্দ দাশের প্রথম মুদ্রিত কবিতা হিসাবে স্বীকৃত হয়ে রয়েছে। আসুন দেখি, সেই কবিতাটা কেমন ছিল। বাংলা ভাষার একজন সেরা কবির প্রথম ছাপা হওয়া কবিতা দেখতে পাওয়াটাও একটা রোমাঞ্চকর ঘটনা নিঃসন্দেহে।

বর্ষা-আবাহন
জীবনানন্দ দাশ
ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে
দীপ্ত-নীলে, শুভ্র রাগে
প্রভাত রবি উঠল জেগে
দিব্য পরশ পেয়ে।
নাই গগনে মেঘের ছায়া
যেন স্বচ্ছ স্বর্গ ছায়া
ভূবনভরা মুক্ত মায়া
মুগ্ধ - হৃদয় চেয়ে।
অতীত নিশি গেছে চলে,
চির-বিদায়-বার্তা ব'লে,
কোন আঁধারের গভীর তলে
রেখে স্মৃতি-লেখা।
এস এস ওগো নবীন,
চলে গেছে জীর্ণ মলিন
আজকে তুমি মৃত্যু-বিহীন
মুক্ত-সীমা-রেখা।

আপনার মন্তব্য