ভারমির, গোরিং এবং নকল ক্রাইস্ট অব দ্য এডাল্টারেস

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৪-২৩ ০৮:২৪:৫৭

 আপডেট: ২০১৭-০৪-২৩ ০৮:৪৫:৫৭

ফরিদ আহমেদ:

আমার আগের একটা লেখায় মিকেলএঞ্জেলোর ঘুমন্ত কিউপিডের গল্প বলেছিলাম। তাঁর নিজের করা ঘুমন্ত কিউপিড ভাস্কর্যকে পুরনো রোমান ভাস্কর্য বলে বিক্রি করা হয়েছিল কার্ডিনাল রিয়ারিও-র কাছে। কার্ডিনালকে প্রতারিত করার পিছনে কার্ডিনালের নিজেরও কিছুটা ভূমিকা ছিলো। শুধু কার্ডিনাল না, যাঁরাই নকল শিল্পকর্ম কেনেন, তাঁদের সকলেরই এই একই সমস্যা রয়েছে। এঁরা শিল্পকর্মটির যথার্থতা সঠিকভাবে যাচাই না করে অতি লোভে বিশ্বাস করে ফেলেন যে দুর্লভ কোনো শিল্পকর্ম তাঁদের হস্তগত হয়েছে। তাঁদের এই লোভজনিত বিশ্বাসই তাঁদের জন্য ফাঁদ হয়ে আসে। মিকেলএঞ্জেলোর ঘুমন্ত কিউপিড যখন কার্ডিনাল রিয়ারিও দেখেছিলেন, তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল এই ভেবে যে তিনি অনন্য সৌন্দর্যময় এক দুর্লভ এবং প্রাচীন শিল্পকর্মকে অবলোকন করছেন। এই বিশ্বাস তাঁকে এমনই অন্ধ করে দিয়েছিলো যে তিনি আর এর সত্যতা এবং যথার্থতা যাচাই করার কথা একবারও ভাবেন নি।

কার্ডিনাল রিয়ারিও-র মতোই একইভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন হিটলারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর হারমান গোরিংও।

হারমান গোরিং ছিলেন গেস্টাপোর প্রতিষ্ঠাতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান গোপন পুলিশের সংগঠন ছিল এটি। এই সংগঠনের মতো দুর্ধর্ষ এবং পৈশাচিক সংগঠন মানব ইতিহাসে খুব কমই আছে। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকটা এর আদলেই গড়ে তোলা হয়েছিলো আল-বদর বাহিনী। গেস্টাপোর নাম শুনলেই বহু লোকের পিলে চমকে যেত তখন। এর প্রধান হিসাবে গোরিংকেও মানুষ ভয় পেত যমের মতো। এরকম একজন নৃশংস, দুর্ধর্ষ এবং ভীতিজাগানিয়া লোককে প্রতারণা করাতো দূরের কথা, তাঁর ধারে কাছেই ভয়ে কেউ ঘেঁষত না। অথচ সেই তিনিই নিজে নিজে প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। এই প্রতারণার ফাঁদ অন্য কেউ পাতেনি তাঁর জন্য।

গোরিং খুনে লোক ছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু একই সাথে তিনি ছিলেন শিল্পরসিক এবং শিল্পপ্রেমী ব্যক্তি। শুধু তিনি একাই নন, হিটলারের মতো একজন রক্তপিপাসু ব্যক্তিও শিল্পপ্রেমী ছিলেন। হিটলার নিজেও শিল্পী ছিলেন। যদিও এই পেশায় ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। তা সত্ত্বে শিল্পকর্মের একটা সংগ্রহশালা ছিল তাঁর। সবাইকে এই সংগ্রহশালা দেখিয়ে আনন্দ পেতেন তিনি। এর বেশিরভাগ শিল্পকর্মই অবশ্য চুরি করা বা লুট করা। খুব কমই ছিল সেখানে যা তিনি পয়সা দিয়ে কিনেছেন।

হারমান গোরিং-এরও হিটলারের মতো একই ধরনের একটা সংগ্রহশালা ছিল। নানা জায়গা থেকে চিত্রকর্ম সংগ্রহ করতেন তিনি। হঠাৎ করেই একদিন ডাচ শিল্পী ভারমিরের একটা ছবি নজরে আসে তাঁর। ছবিটার নাম‘ক্রাইস্ট উইথ দ্য এডাল্টারেস’। ডাচ শিল্পী ভারমিরের মাত্র ৩৫ বা ৩৬টি অথেনটিক চিত্রকর্ম রয়েছে। সেই তালিকায় ক্রাইস্ট উইথ দ্য এডাল্টারেস নেই। শুধু যে নেই তা নয়, ছবিটাতে ডাচ শিল্পীর আঁকার যে বৈশিষ্ট্য, সেটাও অনুপস্থিত।

এই নকল ছবিটা আসলে এঁকেছিলেন আরেক ডাচ শিল্পী হ্যান ভ্যান মীগারেন। এই ভদ্রলোকের মতো নিখুঁত নকলবাজ শিল্পী খুব কমই ছিলেন। প্রচুর সংখ্যক নকল ছবি এঁকেছেন তিনি তাঁর জীবনে এবং সেগুলোকে বিশাল অংকের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন। ভারমিরকে নকল করে আঁকা এই ছবিটা তিনি বিক্রি করেন এক নাজি ব্যাংকার এবং শিল্প সংগ্রাহক আলেইস মিয়েডলের কাছে প্রায় সাত মিলিয়ন ডলারে। এই ব্যাংকার পরে ছবিটা বিনিময় করেন গোরিং এর সাথে। এই ছবির বিনিময়ে তাঁর নিজস্ব সংগ্রহশালা থেকে ১৩৭ টা চিত্রকর্ম ব্যাংকারকে দেন গোরিং। যেহেতু এটি নকল ছবি, এর যথার্থতা প্রমাণ করা নকলবাজদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে, তাঁরা এই ছবির ইতিহাস বর্ণনাকারী একটা চিঠি গোরিং-কে প্রদান করে এর সত্যতা নিশ্চিত করতে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, এই নকল চিঠির বিষয়বস্তুকেই গোরিং মেনে নেন, এবং ভেবে নেন যে আসলেই তিনি ভারমিরের অজ্ঞাত একটা ছবি কিনেছেন।

ছবিটা নিয়ে দারুণভাবে উচ্ছ্বসিত ছিলেন গোরিং। তাঁর ধারণা ছিল তিনি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ রত্নটি পেয়ে গিয়েছেন। নিজের বাসার দেয়ালে সগর্বে তিনি ঝুলিয়ে দেন এই নকল ছবিটাকে।

যুদ্ধ শেষে হ্যান ভ্যান মীগারেনের বিচার শুরু হয়। অভিযোগ হচ্ছে ডাচ ন্যাশনাল ট্রেজার চুরি এবং তছনছ করা করা। বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। কোর্টে ভ্যান মীগারেন বলেন যে, তিনি ডাচ ন্যাশনাল ট্রেজার চুরি করেন নি। যে সব ছবি তিনি ভারমিরের ছবি বলে বিক্রি করেছেন নানা জনের কাছে, সেগুলো আসলে সবই তাঁর আঁকা নকল ছবি। গোরিং এর কাছে তিনি যেটা বিক্রি করেছেন, সেটিও মূলত তাঁর নিজেরই আঁকা। তাঁর এই বক্তব্য সত্য কিনা, সেটা যাচাই করার জন্য একটা শেষ সুযোগ তাঁকে দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। তিনি প্রস্তাব দেন যে সাংবাদিক এবং কোর্টের নিযুক্ত সাক্ষীদের সামনে তিনি নকল ছবি এঁকে দেখাবেন। এই সুযোগটা তাঁকে দেওয়া হয়।

কোর্টের নিযুক্ত সাক্ষীর সামনে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন।ছবি আঁকার আগে বদ্ধ মাতাল হয়ে নেন তিনি। সাথে গাঁজার ছিলিমেও টান ছিল। তাঁর যুক্তি হচ্ছে প্রবল নেশাগ্রস্ত অবস্থায় না গেলে তিনি ছবি আঁকতে পারেন না। ছয় সপ্তাহ ধরে সবার সামনে তিনি আবারো আঁকেন ক্রাইস্ট এমং দ্য ডক্টরস ছবিটা। এই নকল ছবিটা এমনই উচ্চমানের ছিল যে, নকল ছবি বিশেষজ্ঞরা একমত হন যে, ভ্যান মীগারেন খুব সম্ভবত মিথ্যা কথা বলছেন না। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, আসলে ভারমিরের আঁকা ছবি তিনি চুরি করে গোরিং এর কাছে বিক্রি করেন নি। বরং গোরিং-কে নিজের আঁকা ছবি দিয়ে প্রতারিত করেছেন।

গোরিং এর নিজের বিচার যখন হচ্ছিল নুরেমবার্গে গণহত্যার এবং যুদ্ধাপরাধের, তখন তাঁকে জানানো হয় যে তাঁর প্রিয় ভারমিরের ছবিটা আসলে নকল ছবি। কিন্তু, ঘাড় ত্যাড়া গেস্টাপো প্রধান এই তথ্য বিশ্বাস করতে অস্বীকৃতি জানান। এই ছবি নকল হতে পারে না, এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে এক চুলও নড়ানো যায় না তাঁকে।

অবশ্য গোরিং-কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বিস্ময়করভাবে এখনও অনেক শিল্পবোদ্ধা ভ্যান মীগারেনের নকল করা ছবিটাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ভারমিরের আঁকা ছবি বলেই মনে করেন। অথচ এই ছবির অবিকল কপি ভ্যান মীগারেন এঁকে দেখিয়েছেন জীবন রক্ষার তাগিদে।

আপনার মন্তব্য