প্রেমের সুবর্ণ তরঙ্গ রুমী

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৯-৩০ ০১:৫৭:০৫

 আপডেট: ২০১৭-০৯-৩০ ০২:০৫:০৮

গোঁসাই পাহ্‌লভী:

Show Thy Face

show me your face
i crave
flowers and gardens

open your lips
i crave
the taste of honey

come out from
behind the clouds
i desire a sunny face

your voice echoed
saying “leave me alone”
i wish to hear your voice
again saying “leave me alone”

i swear this city without you
is a prison
i am dying to get out
to roam in deserts and mountains

i am tired of
flimsy friends and
submissive companions
i die to walk with the brave

am blue hearing
nagging voices and meek cries
i desire loud music
drunken parties and
wild dances

one hand holding
a cup of wine
one hand caressing your hair
then dancing in orbital circle
that is what i yearn for

i can sing better than any nightingale
but because of
this city’s freaks
i seal my lips
while my heart weeps

yesterday the wisest man
holding a lit lantern
in daylight
was searching around town saying

i am tired of
all these beasts and brutes
i seek
a true human

we have all looked
for one but
no one could be found
they said

yes he replied
but my search is
for the one
who cannot be found

Rumi
Translated by Nader Khalili, Fountain of Fire, page:22

ভূমিকার প্রশ্নে
সত্য প্রকাশের পূর্বেই সংবাদদাতা প্রস্তুতি নিয়েছেন আত্মকে বিসর্জনের প্রতিজ্ঞায়। যে আত্ম এমনকি সত্যকে খুঁজেছে, ভালবেসেছে, সত্যের উপরে স্থাপন করেছে, সত্যের সাধনা সাধতে সাধতে সত্য হয়ে গিয়েছে। এই সত্য মিথ্যার বিপরীত কিছু নয়, এই সত্য ব্যবহার্য আপেক্ষিকতায় বন্দী নয়, ধর্মের ন্যায়-অন্যায়, রাজনীতিবিজ্ঞানের নয়; অধিকন্তু এই সত্য দর্শনের পরমভাবনার প্রকাশকও হয় না!

কি এই সত্য যে সত্যের জন্যে বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়? আত্মাকে বিসর্জন দেবার জন্যে সদা উদগ্রীব? যেখানে জীব মৃত্যুকে এড়িয়ে প্রাচীর সৌধ গড়ে, সেখানে সত্য এমনকি বস্তু যার হাতে জীবন সোপে দিয়ে মৃত্যুকে পরম মমতায় আলিঙ্গন করে? এই সত্য ভাষায় সম্ভব নহে। এই সত্য অনুধাবণপ্রবণ। এই সত্য সৎ, যার চিৎ এবং আনন্দ আছে! ‘রুমী আমাদের সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, যা তাঁর ঘটেছিল, সেই রহস্যের কথা, যা প্রকাশ করা যায় না কেবল অনুভব করা যায়, চিরন্তন ঐশী সঙ্গীতের রহস্য, সৃষ্টির মধ্যে এবং সৃষ্টিরূপে ইশ্বরের অন্তহীন অগ্নি-নৃত্য’।

রুমীকে আমরা এই আনন্দের মধ্যে দিয়ে চিনতে পারি। তাঁর খবর পাই। যেভাবে গৌতম বুদ্ধের কথা আমরা আনন্দের মাধ্যমেই জানতে পারি। শিব ততটুকুই মূর্ত যতটুকু আনন্দে। যিশুও মৃত্যুকে আনন্দের মধ্যে দিয়েই গ্রহণ করেছেন। হক বা সত্য প্রকাশের কারণে মনসুর আল-হাল্লাজকেও দণ্ড দেয়া হয়েছিল। অত্যন্ত আনন্দের সাথে তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন।

সাধকের মৃত্যু আগেই ঘটে যায়। ফকির লালন এই মরার পূর্বে মরে যাওয়াটাকেই বলেছেন জিয়ন্তে মরা। মৃত্যুর সাথে সত্যের সম্পর্ক কী? জীবিত মৃত্যুর কি সম্পর্ক? এই মৃত্যুটা এক প্রকার রূপান্তর। ফলে, প্রতিটি রূপান্তরই এক প্রকার মৃত্যু। রূপান্তরের এই প্রয়োজনীয়তা প্রাকৃতিক, মানুষের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বোধনির্ভর। এটা ,মানুষেরই আবিষ্কার যে, সে যা, সে আসলে তা হতে চায় না, সে, সে হতে চায়। প্রেমিক প্রেমাস্পদ হ’তে চায়। বান্দা আল্লাময় হ’তে হ’তে আল্লাহ হ’য়ে যেতে চায়। এই হতে চাওয়াটা সাধনা, হয়ে যাওয়াটা হচ্ছে ফানা। ‘আপনার আপনি ফানা হ’লে সে ভেদ জানা যাবে’! ফানা হয়ে গেলে কি ভেদ জানা যায়, আমি তুমির ভেদমুক্তি ঘটলেই কেবল ফানা হয়ে যায়, ফানা হয়ে গেলে ভেদবুদ্ধির প্রশ্ন আর থাকে না। কিন্তু, প্রেমাস্পদের সাথে নিরন্তর এই যে লেগে থাকা, এই লেগে থাকা খুব বেশি শর্ত নির্ভর। শর্তের ভার এইখানে থাকেন। ফলে, প্রেমাস্পদের প্রতি এই যে টান, এই টান থেকেও অবমুক্তির সাধনা করতে হয়। ফকির লালন সাঁইজীর সিদ্ধি পর্যায়ের কালামগুলো জিয়ন্তে মরার থেকেও অবমুক্তির ইশারা-ইঙ্গিতবাহী। রুমীর কালামগুলোও তাবরিজের প্রতি টানের থেকেও অবমুক্তির ইশারা দেয়। এন্ড্রু হার্ভে রাগমার্গ পুস্তকে লিখেছেন,‘শামসের প্রতি রুমীর পবিত্র আকর্ষণ।এই সর্বশেষ বাধা অপসারিত হওয়ার প্রয়োজন ছিলো। শামস্‌কে তাঁর দেহের আশ্রয় থেকে দূরীভূত হতে হয়েছিল, রুমীর নিকট থেকে শামসের দৈহিক উপস্থিতি প্রত্যাহার হয়েছিল যাতে তাঁর দেহাতীত সত্তা রুমীর হৃদয়ের কন্দরে তাঁর চূড়ান্ত গৌরবে পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে পারে এবং স্বর্গীয় ভালবাসা স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে তাঁর বিজয় ঘোষণা করতে পারে’।

স্থূল
রুমী যে সময়টাকে ঘিরে জন্ম এবং বেড়ে উঠছিলেন, ‘তখন আমাদের যুগের মতোই ভয়াবহ এক আলোড়ন চলছিল। অটোম্যান সাম্রাজ্য ভিতর এবং বাইরে থেকে আক্রান্ত ছিল; ভিতরে ছিলো ধর্মীয় অধঃপতন এবং সার্বিক রাজনৈতিক দুর্নীতি; আর বাইরে একদিকে ছিল খ্রিস্টান আক্রমণকারীরা এবং অপরদিকে চেঙ্গিস খানের দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনী। এই সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়ন রুমীকে তরুণকাল থেকে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা দ্বারা দহন করেছিল। ধর্মীয় বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতা এবং সম্ভাব্য মোঙ্গল আক্রমণের আশংকায় ১২১৯ খ্রিস্টাব্দে মাত্র বার বছর বয়সে রুমী তাঁর পিতাসহ বলখ্ ত্যাগ করেন। বাহাউদ্দিনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। এক বৎসর পরেই বলখ্ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়’।এবং আজও বলখ্‌ সেই ধ্বংসকে কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়নি। খেয়াল করতে হবে যে, প্রতিটি সভ্যতাই সত্য এবং মিথ্যার সম্পর্কে অত্যন্ত সূক্ষ্ম পর্যায়ে জানার পরেও নিজেদের মধ্যকার ধ্বংসকে অতিক্রম করতে পারেনি। ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। নিজেরা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাহলে, সেই ধ্বংস প্রমাণ করে যে, জানার মধ্যে দিয়ে যে সূক্ষ্মতা, চূড়ান্ততা, সেই চূড়ান্ততা ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে অক্ষম। মিশরীয় সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে, পিরামিডের উচ্চতার নিচে চাপা পড়ে হয়েছে কংকাল। এরপর নতুন সভ্যতার কাল। মানুষ আবিষ্কার করেছে সেই সমস্ত সূক্ষ্মতার সূক্ষ্মতাকে যা অতিক্রম করতে না পেরেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। নতুন সূক্ষ্মতার সন্ধান মিলেছে। জোয়ারের মতো সেদিকে ছুটছে মানুষ। এইভাবে সূক্ষ্মের দিকে ছুটে যাওয়ার ফলে, দাঁড়ানোর অভ্যাসটা মানুষ হারিয়েছে। স্থির হওয়ার বিষয়টা আজ প্রায় বিস্মৃত। এখনকার স্থিরতা গতির শর্তাবদ্ধ; ফলে, বর্তমান মানুষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞান, এইসব জ্ঞান নিজেই জটিলতার ভেতর পতিত হয়েছে। নতুন কোনও ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছি আমরা।

এই চক্রাবর্তের কালের মধ্যকার ঘটনা। ১২১৯ খৃষ্টাব্দে রুমী বলখ্ ত্যাগ করেন। দীর্ঘ দশ বছর এশিয়া মাইনর আরব অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। দামাস্কাস সমরখন্দ হয়ে লারান্দা এবং আরমেনিয়ায় পরিভ্রমণ করে যখন কেনিয়ায় পৌঁছান ততদিনে রুমীর গঠনশৈলী সত্যের জন্য প্রস্তুত। এই দীর্ঘ সময়কাল ধরে রুমীর যে ‘আমি’ বা পরিচয় চিহ্ন গড়ে উঠেছিল, আশ্চর্যের বিষয়ে তাঁর প্রেমের পথে বিলীন হওয়ার আগের দশায় তাঁর স্বভাবের ভেতর এমন বৈশিষ্ট্য ছিল যে বিখ্যাত মওলানা এবং শাস্ত্রবিদ হিসাবে তার যে খেতাব, তিনি তার সত্ত্ব গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ ঐসকল পরিচয় চিহ্নকে তিনি বরং অহং গঠনের হাতিয়ার ভেবে ওসব মোহ থেকে দূরেই ছিলেন। নিষ্ঠাবান শিক্ষকের সাত্ত্বিক কর্মময় জীবন-যাপন করেছেন। কিন্তু এরই মধ্যে রুমীর যে চিহ্ন তার পিতা কিংবা সমকালীন সূফিদের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল, সেখানকার ইঙ্গিত, ভবিষ্যৎ মানব সভ্যতার জন্যে এমন এক অনন্ত দিকনির্দেশনা যেখানে মানব মনের অতলে লুকিয়ে থাকা আত্মের বিনাশে যে আনন্দ, খোদ সেই বিনাশ থেকেই প্রেমের চূড়ান্ত অবস্থায় মানুষের পৌঁছানোর ইতিহাস কথা হয়।

রুমীর জীবন অনেকগুলো পর্বেই বিভক্ত। অথচ সকল পর্বের সূত্রপাতের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে শামসকেই পাওয়া যায়। শামসের সাথে রুমীর পরিচয়ের পূর্বরাগ, এবং পরবর্তী ধারা; পরিচয়ক্ষণ, রুমীর যে পরিচয় জ্ঞান, সেখান থেকে শামসের প্রশ্ন রুমীর ভেতর এমন এক উত্তর সমাধিস্থ হলো যে, সেখানে, উত্তরেই ক্রমশ: লীন হয়ে গেছেন রুমী। যেখান থেকে নতুন কোনও প্রশ্নের সূত্রপাত হয় না। তরুণ রুমীর ভেতর যে অগ্নিপ্রজ্বলিত ছিলো, সে সম্পর্কে রুমী খুব সচেতন ছিলেন যে তার প্রমাণ বিভিন্নভাবেই পাওয়া যায়। তিনি নিজের পরিচয়চিহ্ন বিষয়ে এতটা সচেতন ছিলেন যে, কোনও ভাবেই অন্তস্থ প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে কোনও প্রকার তাপ দ্বারা নিজেকে আরাম প্রদান করেননি, অন্যদিকে তাপদাহে গলে কিংবা জ্বলেও যাননি।

বিখ্যাত সুফি কবি আত্তার রুমী সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘ এই বালকটি ভালোবাসার অন্তরে একটি দ্বার উদ্‌ঘাটন করবে’। কি সেই ভালোবাসা যা ইশ্বর হওয়ার মধ্যে দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে! আত্তার সম্পর্কেও রুমীর বক্তব্য পরিষ্কার। পাখিদের সম্মেলন গ্রন্থে এই রচয়িতাকে ভোলেননি এবং আত্তার সম্পর্কে তিনি বলতেন,‘আত্তার ভালবাসার সাতটি নগরই ভ্রমণ করেছেন আর আমি এখনও একটি গলির প্রান্তে অবস্থান করছি’। সে কালের দার্শনিক ইবনুল আরাবীর সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাত হয়েছে । আরাবীর বক্তব্য পরবর্তী সাধারণের দৃশ্যগোচর হলো।-‘শোনা যায়,ইবনুল আরাবী যখন রুমীকে তাঁর পিতার পিছনে হাঁটতে দেখেন তখন বলেছিলেন,‘ইশ্বরের কি মহিমা, একটি হ্রদের পিছনে এক সমুদ্র যাচ্ছে’।

প্রবর্ত: তোমার নগণ্য দাস
সে বললো: দরজায় কে?
আমি বললাম: তোমার নগণ্য দাস।
সে বললো: তোমার কি দরকার?
আমি বললাম: তোমাকে অভিবাদন জানাতে এসেছি।
সে বললো: তুমি কতক্ষণ দ্বারে করাঘাত করবে?
আমি বললাম: যতক্ষণ তুমি না ডাকো।
সে বললো: তুমি কতক্ষণ প্রদীপ্ত থাকবে?
আমি বললাম: পুনর্জন্মের দিন পর্যন্ত।
আমি ভালবাসার দাবী করলাম, আমি শপথ করলাম
বললাম যে ভালবাসার জন্য আমি শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতা হারিয়েছি।
সে বললো: একজন বিচারক কোন দাবীর জন্য সাক্ষ্য চায়।
আমি বললাম: অশ্রুধারাই আমার সাক্ষ্য, মুখমণ্ডলের মলিনতা আমার প্রমাণ।
সে বললো: তোমার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়; তোমার চক্ষু কলুষিত।
আমি বললাম: তোমার বিচারের গৌরবে তারা ন্যায়শীল ও পাপমুক্ত।
সে বললো তুমি কি চাও?
আমি বললাম: নিশ্চয়তা এবং বন্ধুত্ব।
সে বললো: তুমি আমার কাছ থেকে কী আশা করো?
আমি বললাম: তোমার সর্বব্যাপী অনুগ্রহ।
সে বললো তোমার সঙ্গী কে ছিলো?
আমি বললাম: তোমার চিন্তা, হে রাজাধিরাজ।
সে বললো: কে তোমাকে এখানে ডেকেছে?
আমি বললাম: তোমার পেয়ালার ঘ্রাণ
সে বললো: কোন স্থান সবচেয়ে সুখপ্রদ?
আমি বললাম: রাজপ্রসাদ।
সে বললো: ওটা জনহীন কেন?
আমি বললাম: দস্যুর ভয়ে।
সে বললো: কে দস্যু?
আমি বললাম: এ বিষয়রাশি।
সে বললো: কোথায় নিরাপদ?
আমি বললাম: ত্যাগ ও নিষ্ঠার মধ্যে।
সে বললো: ত্যাগ কী?
আমি বললাম: মুক্তির পথ।
সে বললো: বিপদ কোথায়?
আমি বললাম: তোমার ভালোবাসার নৈকট্যে।
সে বললো: তুমি সেখানে কীভাবে এলে?
আমি বললাম: দৃঢ়তার সঙ্গে।
আমি তোমাকে দীর্ঘক্ষণ পরীক্ষা করলাম, কিন্তু কিছুই পেলাম না;
পরীক্ষিতকে যে পুনরায় পরীক্ষা করে তাঁর অনুতাপ আসে।
শান্তি! আমি যদি তাঁর অতীন্দ্রিয় বাক্যগুলি উচ্চারণ করি,
তুমি উন্মাদ হবে, কোনো দ্বার কোনো ছাদই তোমাকে রুদ্ধ করতে পারবে না”।

রুমীর সাথে শামসই তাবরীজের সাক্ষাতের ঘটনা বিষয়ক যতগুলো কিংবদন্তী পাওয়া সেখানে একটি প্রশ্ন খুব সাধারণভাবেই আছে। প্রশ্নটি হচ্ছে সীমাবদ্ধতা, এবং পরিচয় চিহ্ন। রুমীর সাথে শামসের সাক্ষাতে শামস কর্তৃক রুমীর প্রতি যে প্রশ্ন পাওয়া যায় প্রত্যেকটি আখ্যানেই, সেখানে সেই প্রশ্নে রুমীর সকল প্রজ্ঞাই মূর্ছা যায়, নবতর প্রজ্ঞার আভায়। কিংবদন্তীগুলোতে রুমী এবং শামসের একে অপরের জন্যে প্রাসঙ্গিকতার যুক্তিও প্রচলিত। শামসের আর্জি,‘ আমাকে এমন এক ব্যক্তির সন্ধান দাও যে আমাকে সহ্য করতে পারে, এমন ব্যক্তি যে নির্ভীক, দৃঢ়চেতা, স্বচ্ছমনসম্পন্ন এবং উন্মত্ত যাকে আমি চূর্ণবিচূর্ণ করে এমনভাবে পুনর্নির্মাণ করতে পারেন এবং তাঁর মাধ্যমে বিশ্বকে আমার যা কিছু দেওয়ার আছে তা দিতে সক্ষম হই। ইশ্বর শামসকে প্রশ্ন করলেন, এর পরিবর্তে তুমি আমাকে কি দেবে? শামস উত্তর দিলেন,‘ আমার জীবন”। সে জীবন মূলত তিনি সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন জালালুদ্দিন রুমীর অস্তিত্বে। যার পরিণতি উভয়ে উভয়ময়। ওয়ালাদনামায়, সুলতান ওয়ালাদ পিতা সম্পর্কে লিখেছেন,‘অতীন্দ্রিয়তার পথে তাঁর চূড়ান্ত পথ প্রদর্শক ছিলেন শামস্-ই-তাবরিজ, ইশ্বরের অভিপ্রায় ছিলো যে, শামস্ বিশেষ করে তাঁর নিকটেই প্রকাশিত হবেন এবং এটা কেবলমাত্র তাঁর জন্যই… এরূপ দর্শনের উপযুক্ত আর কেউ হয় না.. তিনি তাঁকে দেখেছিলেন, যাঁকে দেখা যায় না, তিনি তাঁকে শ্রবণ করেছিলেন যা ইতিপূর্বে অন্য কেউ কারো কাছ থেকে শ্রবণ করেননি…তিনি তাঁকে ভালবেসেছিলেন এবং বিলুপ্ত হয়েছিলেন’। শামস এ তাবরীজের সাথে রুমীর এই সাক্ষাৎ এবং বায়াত গ্রহণের মধ্যে দিয়ে রুমী তার দ্বিতীয় পর্যায়ে উপনীত হলো। এই পর্যায়ে রূপান্তরের দৃশ্যকে ঠিকঠাক অনুধাবন করতে পারলে ভীত হয়ে অনেকেই সাধনার পথ ছেড়ে দিয়েছেন। একটি বর্ণিল কুর্তা থেকে ধীরে ধীরে তার সব রং বের করে নিয়ে সাদা শুভ্রতায় উপনীত করার মধ্যে দিয়ে যে পর্যায়গুলো অতিক্রম হয়, সেখানে আত্মদানের মতো ব্যাপার ঘটে। এই আত্ম অবশ্যই মানুষের ভেতর মায়াজনিত কৈবল্য। সেই আত্মবলিদান গুরুর প্রতি নিঃসঙ্কোচ সমর্পণে। তার দহন, তার ভয়াবহতার চিত্র রুমী নিজেই লিপিবদ্ধ করেছেন এইভাবে,‘আমার দেহরূপ দ্রাক্ষা কেবল তখনই সুরা হতে পারে, যখন সুরা প্রস্তুতকারী আমাকে পদদলিত করে।

আমার সত্তাকে আমি দ্রাক্ষার মতই তাঁর পদতলে সমর্পণ করি
যাতে আমার অন্তরাত্মা আনন্দে প্রদীপ্ত হয়ে নাচতে পারে।
যদিও আঙ্গুরের রক্ত ঝরতে থাকে এবং সে ক্রন্দন করে বলে
‘আমি আর সহ্য করতে পারছি না এই যন্ত্রণা, এই নিষ্ঠুরতা’

পদদলিতকারী কানে তুলো গুঁজে বলে,‘আমি অবুঝের মত কাজ করছি না। তুমি চাইলে আমাকে অস্বীকার করতে পার, তোমার বহুবিধ কারণ রয়েছে।, কিন্তু আমিই হচ্ছি সেই ব্যক্তি যে এই কাজে পারদর্শী। এবং আমার আবেগে মথিত হয়ে তুমি যখন পূর্ণতা লাভ করবে

তখন আমার প্রশংসা করতে তুমি কোনোদিনই ভুলবে না’। দীক্ষাপর্বের এই নির্মমতাকে স্বীকার করেছেন রুমী। সহজ-স্বীকারোক্তি,‘ আমার জীবন নিজের দু’হাতে নিয়ে আছড়ে পরিষ্কার করছো। চিরন্তন মানসের নির্মম পাথরের উপর। যে পর্যন্ত সাদা না হলো, সে পর্যন্ত কীভাবে এর রঙ প্রবাহিত হলো’!

সাধক: ‘জলস্রোত সর্বদাই নিম্নগামী তা ঊর্ধ্বগামী হবে কি করে’?
স্বাভাবিক অভ্যস্ততা অতিক্রমক ঘটনাই রহস্যাবৃত। রহস্যের বিমোচনেই ইতি। ইশ্বরের বা ই> স্বরের ধ্বনি। শরীর এবং মনের এক বিশেষ অবস্থায় যে স্বর ধ্বনিত। ‘ইশ্বর কোথাও নেই’, দৃষ্টির সামান্য অবস্থা; ‘ইশ্বর সর্বত্র বিরাজমান’, দৃষ্টির বিশেষ অবস্থা। রহস্যের ইতি। সাবসট্যান্স হচ্ছে দৃষ্টির সামান্য অবস্থা, বস্তুর ভেতর ধারণার উপস্থিতি হচ্ছে দৃষ্টির বিশেষ অবস্থার সাক্ষ্য। ফলে, সামান্যে বিশেষকে হাজির দেখতে পারাই হচ্ছে সর্বত্র বিরাজমানের নমুনা। সে কারণেই প্রশ্ন, পাবে সামান্যে কী তার দেখা? আপনি প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্ত বস্তুর সাথে জড়িত, আপনার ফর্মেশনে তার প্রভাব থাকবে। গরুর মাংস খাবেন না, ডাক্তারের পরামর্শ। গরুর মাংসের গুণাগুণ মানব দেহে প্রভাব ফেলবে। এভাবেই, মানুষ যে সমস্ত উপাদান গ্রহণ করছে, সেই সমস্ত উপাদানগুলোর প্রভাব মানুষের দেহে থাকবে, দেহ থেকে চিন্তায় ছড়াবে, এক সময় চিন্তা, এই বস্তুগুণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে। এভাবেই বস্তুর থানায় যুগ যুগ ধরে মানুষ বন্দী। ‘তোমরা আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হও’। এই আল্লাহর রঙটা কি? সেটা বুঝে নিয়ে এগিয়ে যাবে। প্রয়োজন নেই, বরং আপনি এভাবেই শুরু করে দেখুন যে, আপনি নিজে আপনার নামের উপর স্বতন্ত্র। আপনি কারো সাথে যুক্ত নন, এবং বিযুক্ত হওয়া কতটাই কষ্টের, বেদনার। ‘পেইন অব সেপারেশন’। কিন্তু, স্থিতি, এবং গ্রহণের বিষয়ে আত্মসান্তনা এই যে, আপনি যখনই বিযুক্ত হবেন, পাশাপাশি আপনি অন্য কিছুর সাথে যুক্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ কোনও একটা কিছুর থেকে বিযুক্ত হয়ে কোনও একটা কিছুর সাথে যুক্ত হচ্ছেন। তাহলে ঘটনা কিন্তু একই। বিযুক্তের মধ্যে দিয়ে যোগ আর যোগে পার্থক্য কী? উভয় ক্ষেত্রে সেই যোগে থাকাই হচ্ছে সে আলু-পটলের সাথে হোক আর আইনস্টাইনের সাথে হোক। এখন আইনস্টাইন আর আলু-পটলে মাহাত্ম্য বাড়ানোর প্রয়োজন কী? উত্তম-অধম, উচ্চাঙ্গের নিম্নাঙ্গের বিচার করাবার প্রয়োজন কী? উভয়েই তো যোগ, উভয় ক্ষেত্রেই তো মানুষ নিজেকে বন্দী করে ফেলছে, মানুষ তার নিজের চোখ, জিহ্বার স্বাদ হারিয়ে ফেলছে! যেহেতু যোগ, এই ক্ষেত্রে শঙ্কা তৈরি হয়, রুমীরও হয়েছিল। তাবরিজের প্রতি শিষ্যদের তীব্র ঈর্ষা রুমীর ভেতর বিচ্ছেদের শঙ্কা তৈরি করেছিল। এবং সেই আশঙ্কা অতিশিগ্রই এসেছিলো রুমীর জীবনে,‘আমার সময় এসেছে। আমি যাচ্ছি। মৃত্যু আমাকে আহ্বান করছে’। এন্ডু হার্ভে দ্য ওয়ে অব প্যাশন গ্রন্থে লিখেছেন,‘ শামসের যখন শেষবার অন্তর্ধান ঘটলো, সম্ভবত: তিনি নিহত হলেন এবং হয়তোবা রুমীর জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বারাই, তখন রুমী পুনর্বার হতচেতন হলেন। দীর্ঘকাল তিনি কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাননি। শোকে উন্মাদ হয়ে পথে পথে গান গেয়ে, নেচে এবং কেঁদে বেড়াতেন। নৃশংস বেদনার দহনে মিথ্যা অহংয়ের সর্বশেষ অংশ, আত্মসচেতনতার অবশেষ, শামসের সঙ্গে বিচ্ছেদজনিত পিপাসাদগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তারপর, অতিধীরে, অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে এই অলৌকিকতা তাঁর কাছে ধরা পড়লো যে, শামসের মৃত্যু ঘটেছে তাঁরই অন্তরে পুনরায় জন্ম নেওয়ার জন্য’।

সিদ্ধি: ‘ওর কোন চিহ্ন থাকে না, সে নিজেই চিহ্ন হয়ে যায়’

শক্তি কি শক্তিমানের মধ্যে হারিয়ে যায়? না শক্তিমান শক্তির ভেতর হারাতে পারে? শক্তি এবং শক্তিমান উভয়েরই অন্তর্ধান সম্ভব কিনা, যেখানে শক্তি এবং শক্তিমানের ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা, লক্ষ্য উদ্দেশ্যে কোনও ভেদ থাকে না। শর্ত ভুলে অনেক আগেই তারা নিশ্চিহ্ন হয়েছেন। সেই ব্যক্তি যাঁর নিকট প্রেমের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে/ তাঁর অস্তিত্ব থাকে না, সে ভালোবাসায় অন্তর্হিত হয়।/ সূর্যের সম্মুখে একটি প্রজ্বলিত মোমবাতি রাখ/ এবং এর উজ্জ্বলতাকে সেই অগ্নিকুণ্ডের সামনে হারিয়ে যেতে দেখ, মোমবাতির কোন অস্তিত্ব থাকে না, সে আলোকে পরিণত হয়,/ ওর কোন চিহ্ন থাকে না, সে নিজেই চিহ্ন হয়ে যায়’।‘

রুমী মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক চিহ্ন বিশেষ। সূক্ষ্ম এবং বিশেষের ভেদ তাঁর কাছে এসে বিলুপ্তি ঘটে। মানব মনের অন্তঃস্থিত প্রেম এবং আকাঙ্ক্ষাকে কামনা করে সেই আকাঙ্ক্ষার ধনকে আবার অত্যন্ত বাৎসল্যস্নেহে বিসর্জন করবার সক্ষমতার দ্বিতীয় উদাহরণ আমাদের কাছে নাই। ‘যেহেতু আমিই সে, তবে আমি কি খুঁজে বেড়াচ্ছি? বর্তমানে আমিই সে এবং আমি আমার কথা বলছি’ রুমীর এই স্থিতি এবং চূড়ান্ত বিকাশের ব্যক্ততা নি:সন্দেহে মানব সভ্যতার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

মানুষের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা এবং ধ্যানবিন্দু কতটুকু লোক থেকে আলোকে বিচরণ করে, রুমী তাঁর উদাহরণ । উপনিষদেও আমরা একই প্রতিধ্বনি শুনি তত্ত্বমসি তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে। প্রেম, প্রেমিক এবং প্রেমাস্পদের ভেতরকার আকুলতার ঘূর্ণন ভয়াবহ, সহ্য করা তো দূরের কথা, কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করাও সবার পক্ষে সম্ভব নয়। রুমীর শিষ্যদের ক্ষেত্রে এই বিশৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছিল। রুমী যেভাবে তাবরীজের সান্নিধ্য চাইতেন, একইভাবে রুমীর শিষ্যদেরও রুমীর প্রতি একই টান, একই আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। ‘রুমী আমাদের সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, যা তাঁর হয়েছিল, সেই রহস্যের কথা, যা প্রকাশ করা যায় না কেবল অনুভব করা যায়, চিরন্তন ঐশী সঙ্গীতের রহস্য, সৃষ্টির মধ্যে এবং সৃষ্টিরূপে ইশ্বরের অন্তহীন অগ্নি-নৃত্য। রুমী দেখেছেন এবং জেনেছেন যে, যা কিছু ঘটে এবং যা কিছু অস্তিত্বময় আর সবকিছু নিজ সৌন্দর্য এবং নিজের প্রতি ভালবাসায় ঐশী দীপ্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। এবং তিনি যখন এই সত্য জেনেছিলেন এবং দেখেছিলেন তাঁর নিজের সত্তা সেই দীপ্তির সাগরে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এই বিলুপ্তি থেকে আরও গভীর একটি দর্শন হয়;রুমী দেখেন যে, সমুদ্র তরঙ্গায়িত হচ্ছে এবং দীপ্ত সমুদ্রের সেই তরঙ্গের আনন্দময় ফেনা থেকে সকল সৃষ্টির উত্থান ঘটছে। সেজন্য সমুদ্র। সেজন্য নিখিল ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে সেই পূর্ণ দৃষ্টি রুমী প্রাপ্ত হয়েছিলেন -কীভাবে, প্রতি মুহূর্তে, সকল প্রকাশ্য এবং পৃথক সৃষ্টি গোপনভাবে সেই দীপ্তির উৎসের সঙ্গে এবং একে অপরের সঙ্গে একীভূত। তাঁর ঐশী গুরু শামস্‌- ই-তাবরিজের রক্ষাকারী এবং পুনর্জাগরণকারী অনুগ্রহে রুমী অবশেষে স্বয়ং ভালবাসার নয়নে পরিণত হয়েছিলেন, ভালবাসায় নেত্রপাত করেছিলেন, সেই ভালোবাসা অভিমুখে যা বর্ধমান, নৃত্যরত এবং প্রবাহিত এবং সকল সৃষ্টির মধ্যে প্রেমের দীপ্ত। প্রেম ভালবাসা একটি সমুদ্র যাঁর আকাশ ফেনার বুদবুদ স্বরূপ।/ জেনে রেখো যে, এই প্রেম তরঙ্গ আবর্তিত করে/স্বর্গের চাকাকে/ ভালবাসা ছাড়া, বিশ্বের কোনো কিছুই জীবন পেত না।/ কীভাবে এক অজৈব পদার্থ একটি বৃক্ষে পরিণত হলো?/ কিভাবে আত্মা উৎসর্গীকৃত হলো একটি শ্বাস হওয়ার জন্য,/ যে শ্বাসের একটু গন্ধ মরিয়মকে গর্ভবতী করার জন্য যথেষ্ট ছিল?/ প্রতিটি পরমাণু এই পূর্ণতায় মাতাল এবং সেই দিকেই ধাবিত/ এবং এই ধাবমানতা গোপনে এই কথাই বলে যে,/ ‘সকল মহিমা ইশ্বরের’।

উপসংহার
রুমী কেবলমাত্র একজন মরমী কবি বা সিদ্ধ পুরুষই নন,পুত্র সুলতান ওয়ালাদ বলেছেন, ১২৪৪ খৃস্টাব্দে রুমীর দশ হাজার অনুসারী ছিল। বর্তমানের সংখ্যাটা তার নির্ণয় সংখ্যার থেকেও অধিক হবে এমনটাই আমাদের বিশ্বাস। জালালুদ্দিন রুমী মানব সত্তার জন্যে একটি দিশা, কীভাবে সে তাঁর প্রেমাস্পদের কাছে পৌঁছাবো, যাকে ভালোবাসা হয়, তার মতো হয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই মুক্তি। এইসব কথা রুমী বলেননি, রুমী স্বয়ং ভালোবাসাই হয়ে গিয়েছিলেন।

‘প্রেমের নেশায় যখন তোমার বসন অনাবৃত হয়ে যায়,/তখন স্বর্গের বিজয় আর কালপুরুষের বিহ্বলতা লক্ষ্য কর!/ কীভাবে বিশ্বের উচ্চ ও নীচ অশান্ত/ তা প্রেমের দ্বারা, যা উচ্চ ও নীচ হতে শুদ্ধিকৃত!/ যখন সূর্য উদিত হয় তখন রাত্রির অমানিশা কোথায় থাকে?/ যখন দানের আনন্দ এসেছিল, তখন বেদনা কোথায় পিছিয়ে যায়?/ আমি নিশ্চুপ হয়েছি। হে আত্মার আত্মা তুমি বাঙ্ময় হও/ যাঁর মুখমণ্ডলের আকাঙ্ক্ষা সকল পরমাণু ভাষা পেয়েছে’।

সংহার

তাবরিজময় নিজ আত্মার বর্ণনা তিনি এভাবেই দিয়েছেন,‘ আমি সেদিন ছিলাম যখন কোনো নাম ছিল না,/ অথবা নামধারী কোনো অস্তিত্বের লক্ষণও ছিল না।/ আমার দ্বারা নাম এবং নামধারীদের দৃশ্যমান করা হলো।/সেদিন যখন কোনো “আমি” বা “আমার” ছিল না।/চিহ্নস্বরূপ প্রেমাস্পদের কুন্তল কেন্দ্রবিন্দুরূপে ব্যক্ত হ’ল;/ তখন সেই সুন্দর কুন্তলদামের অগ্রভাগ অস্তিত্বহীন ছিল।/ ক্রুশ এবং খ্রিস্টান, একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত,/ আমি খুঁজছিলাম; তিনি ক্রুশে ছিলেন না।/ আমি হেরাট ও কান্দাহারের পর্বতে গেলাম;/ সেখানে দেখলাম; তিনি পর্বত ও উপত্যকায় ছিলেন না।/ দৃঢ় সংকল্প হয়ে আমি কাফ পর্বতের চূড়ায় উঠলাম;/ সে স্থানে কেবল আনকা পাখির বসবাস ছিল।/ আমি খোঁজ করতে কা’বায় গেলাম;/ তিনি সেই প্রাচীন এবং নবীনের আবাসস্থলেও ছিলেন না।/ আমি ইবনে সিনাকে তাঁর অবস্থা জিজ্ঞেস করলাম;/ তিনি ইবনে সিনার আওতার মধ্যে ছিলেন না।/ আমি ‘দুই ধনুকের দূরত্বে’ পরিভ্রমণ করলাম;/ তিনি সেই মহিমান্বিত প্রাঙ্গণেও ছিলেন না।/ আমি নিজের হৃদয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম;/ সেখানেই তাঁকে দেখলাম, তিনি আর কোথাও ছিলেন না।/ পবিত্র হৃদয় শামসি তাবরিজ ছাড়া/ আর কেউ এত মাতাল এবং প্রমত্ত এবং উন্মাদ ছিল না’।

প্রেমিক তো বটেই, সাধকের জন্যেও নীরবতা, শব্দহীন শব্দের জগতের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করে এককে লীন হওয়াই কাঙ্ক্ষিত। ‘পার্থিব বিশ্বের ছাদে স্বর্গ থেকে আসা বৃষ্টি ধারার মতো/তুমি সকল দিকে ধাবিত হয়েছিলে যে পর্যন্ত নালা দিয়ে নিষ্ক্রান্ত না হয়েছো।/ নিশ্চুপ হও এবং বাক্যের বেদনা থেকে মুক্ত হও. নিদ্রিত হয়ো না,/ কারণ, তুমি এমন প্রেমময় এক বন্ধুর কাছে আশ্রয় নিয়েছো’।

জোড়াতালির ক্রমানুসার:

  • The Way of Passion: A Celebration of Rumi; Andrew Harvey; ISBN978-1-88331-920-5; Publisher Frog Ltd
  • জালালউদ্দিন রুমী; দিওয়ান ই শামস্‌ ই তাবরিজ; অনুবাদ: এস. থলিলউল্লাহ; র‌্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা; ২০০৬
  • Nader Khalili, Fountain of Fire, Cal-Earth Press; 1994

আপনার মন্তব্য

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন