কাব্যকলির খামে : জাফর ওবায়েদের কাব্য ‘হৃদয়ে রাত্রি নামে’

লুৎফুন্নেসা লিলি

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৫-৩০ ১৯:০০:৪২

হৃদয়ে রাত্রি নামে/ জাফর ওবায়েদ। প্রকাশক: শুদ্ধস্বর। প্রচ্ছদ: আবু হাসান। মূল্য: ১০০টাকা। প্রথম প্রকাশ:

মানুষের মননশীল মন তার সৃজনী কল্পনায় অপরূপকে আবিষ্কার করে, আত্মানুভূতির বাসনা-কামনা, আনন্দ-বেদনা আবেগনির্ভর মাধুরীময় অভিব্যক্তিতে মূর্তমান করে তোলে। আর এ দায়িত্ব পালন এবং দায়ভার নিবারণ যেন কবিদের ওপর বর্তায়। কবিরা তাই জগতের রূপ-রস, স্পর্শ-শব্দ বা আপন মনের ভাবনা-বেদনার অনুভব অনুকরণকে ছন্দময় তনুশ্রী দান করেন। তাঁদের নিয়ত চিন্তা-চেতনার অপরিহার্য বাণীবিন্যাসে পুষ্ট হয়ে আছে কবিতাভুবন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, এ ধারায় অনুসন্ধিৎসু অনুগমন নেই বললেই চলে। অর্থাৎ সাহিত্যের এ শক্তিশালী শাখার পৃষ্ঠপোষক বা অনুরাগীর মাত্রা গণ্যসংখ্যায় আসে না।

কবিতা অনেকেই পড়েন না, বুঝতে পারেন না নাকি বুঝতে চান না। আর কবি? তাঁদের তো কোনও কাতার নেই, শিষ্টদৃষ্টিতে নেই স্বজনপ্রিয়তা। অকারণ অবহেলায় কবিতার প্রতি এই বিরাগভাজন মনোবৃত্তি যুক্তিহীনভাবে ঠাঁই পেয়েছে সমাজে। তাই কবি ও কাব্যাচার মোটামুটিভাবে অভিভাবকহীন আত্মসংগ্রামে আগুয়ান। সে কারণে কবিতা লালনে কবিমানসে রয়েছে প্রত্যয়ী প্রয়াস। অনেকে না পড়লেও কেউ কেউ কবিতা পড়ছেন, কাব্যানুরাগী ভালোবাসায় আপ্লুত হচ্ছেন। এই কেউ কেউ পড়ছেন বলে একান্ত প্রাণ-প্রণোদনায় কবিতা লেখা হচ্ছে, কবিদের সোচ্চার বাণী বন্দনায়। এমনই এক অনুরক্ত কবি জাফর ওবায়েদ তাঁর প্রথম কাব্য ‘হৃদয়ে রাত্রি নামে’ নিয়ে উদ্বেলিত কাব্য-কাননে। মেজাজ-মনন, বিষয়-বৈচিত্র্যে ২৮টি কবিতার কলি-পাপড়ি মেলেছে বর্ণিল এ বুননে।

জীবনের গতি-মতি, পরিবেশ-পরিস্থিতি কবিহৃদয়ের অলিন্দে আলোকরশ্মির পলায়নক্রিয়া সাঙ্গ করে যেন সীমায়িত সামর্থ্যের নিষ্ক্রিয় প্রেক্ষাপটকে স্থায়ী করে দিয়েছে, তাই তো দিবাকর আড়াল পড়েছে অনুজ্জ্বল রাত্রির তমসায়। এ কারণে হয়তো কবিজীবনের প্রতিকূলতা বিষাদময়তায় কবিতার ট্রেনে রাত্রির যাত্রি হয়েছে। পঠনপরিক্রমায় কবিতাগ্রন্থের এ নামকরণ উপলব্ধির উপাখ্যানে যথার্থ সঙ্গতি স্থাপন করেছে। নামাঙ্কিত নান্দনিকতা দৃশ্যমান হয়েছে।

এবার অন্তরঙ্গ অবলোকন কাব্যকলির পাপড়িমালায়। গ্রন্থের নাম-কবিতাকে প্রাথমিক আলোচনার বাইরে রেখে একান্ত পাঠপ্রতিক্রিয়া অগ্রবর্তী করতে চাই। মা-মাতৃভূমি-মাতৃভাষার আবেগে আকীর্ণ কবির ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উৎসারিত হয়েছে অন্তস্থ অঙ্গীকার এবং নিষ্পেষিত মর্মপীড়ন। শুধু তা-ই নয়, জিঘাংসা, হানাহানি, রাহাজানি, বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, অস্থির সমাজচিত্র কবিকে ভাবাবেগী করে তোলে। পক্ষান্তরে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, জন্মভূমির প্রতি গভীর মমত্ববোধে মথিত এদেশের কবিরা স্বদেশচেতনার প্রাবল্যে অর্জন-সংগ্রামের রূপ-চিত্রভিত্তিক কবিতার অবয়ব তৈরিতে নিরন্তর নিবিষ্ট থেকেছেন। ফলে আমরা পেয়েছি যশস্বী কবিদের অনেক বিখ্যাত শ্রুতিনন্দন, সুখপাঠ্য দেশপ্রেমমূলক কবিতা।

এ ধারাবাহিকতায় কবি জাফর ওবায়েদ কলমসৈনিক উদ্দামতায় যেমন স্মরণ করেছেন যুদ্ধলীলা, লক্ষ করেছেন বীজমন্ত্রের সুদৃঢ় প্রভাব, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাসহ প্রকৃতি এবং জীবনবৃত্তের প্রতিটি পরতে। কবির শব্দসূত্র-‘শোন জয়নুল আবেদীনের উত্তরসূরিগণ,/ আমাদের হৃদয়ে হৃদয়ে এঁকে দাও/ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের সোনার বাংলা,/ এবং অধুনা অর্জিত সুনীল বাংলার মানচিত্র!’ অন্যত্র- ‘বিশ্বাসের বিজন বনে বোনে নেবে যারা / নির্জলা নিদাঘ দেশপ্রেমের বীজমন্ত্র,/অমর ওদের প্রেম, অমর ওদের হৃদয়/ আমাদের আত্মার, পরমাত্মীয় হয়’ (বীজমন্ত্র: পৃষ্ঠা ১২-১৩)।

জীবন, রক্ত, লাশ ও সম্ভ্রমলব্ধ স্বাধীনতার দীর্ঘসময় পার করেও যাদের শুধু কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতার দাপট-নির্ভর রোষানলে অহরহ প্রাণবিনাশ ঘটছে, লালসার লেলিহান শিখায় পুড়ছে চারপাশ, কবির বিদ্রোহী কলম তাদের মাংসাশী নর-খাদক কিংবা মাংসাশী মীন বলে আখ্যায়িত করে। মনুষ্যত্ববর্জিত সেই অশুভ শক্তিধরদের প্রতি কবির খেদোক্তি- ‘তোমরা আমাদের দুশমন/ তোমরা মানবতার শক্র/ তোমরা দেশের শক্র’ (তোমরা কারা? : পৃষ্ঠা-১৫)

অনুপম প্রকৃতির এ লীলাভূমির প্রতি কবির রয়েছে নিবিড় পর্যবেক্ষণ। ‘রূপসী বাংলা’র কবি জীবনানন্দ দাশের আবহে সৃষ্ট কবিতা ‘আমার বাংলায়’ বাংলার রূপবৈচিত্র্য যেন জীবন্ত বাণীরূপ পেয়েছে। কবিতায় দেখি-‘আমি তো দেখেছি তারে সোনালি ধানের শীষে/ দেখেছি তারে সারসডানায়, দোয়েলের মিষ্টি শিসে। রুপালি মাছের পিঠে অনন্ত পথ ছুটে উড়ে সে পরির দেশে/ সুদীর্ঘ যাত্রা শেষে আবার সে অবশেষে আমার বাংলায় মিশে এসে।’ (আমার বাংলায়: পৃষ্ঠা-৩৫)

স্বাধীনতার প্রসঙ্গ বাংলাকাব্যে নানাস্বাদে উপস্থাপিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কবিতায় স্বাধীনতাবিষয়ক সন্নিবেশ-সংযুক্তি পেয়েছে। যা আমরা কবি শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কবি আলাউদ্দিন আজাদ, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ-সহ এ সময়ের উল্লেখযোগ্য কবিদের রচনায় অবলোকন করি। কবি শামসুর রাহমানের মতো হর্ষ-বিষাদেপূর্ণ স্বাধীনতাকে চমৎকার শব্দবিন্যাসে উপমায়িত করেছেন কবি জাফর ওবায়েদ-‘তুমি চৈতের দিনে খরতাপে দগ্ধ খণ্ড-বিখণ্ড মাঠ/ তুমি চাল, ডাল, তেল... নিত্যপণ্যের উষ্ণ বাজার-হাট।’ অন্যত্র- ‘স্বাধীনতা,/ তুমি যে আমার ভাবে অনুভবে রয়েছো স্বকীয় সত্তায়/ তোমার কারুময় দীপ্তি জ্বেলেছি আমার বুদ্ধিমত্তায়।’ (স্বাধীনতা, স্বকীয় সত্তায়: পৃষ্ঠা ৪১-৪২)

আবার স্বাধীনতাবিরোধী যে-চক্র সেদিন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বর্বরোচিত মানসিকতা নিয়ে বিপরীত ভূমিকায় দাঁড়িয়েছিল, সেই ঘটনার প্রতি কবি চরম ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়ে বলেন-
‘আজ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি/ওদের দোসর ওই মুসল্লি লোকটি ছিল ঘৃণ্য রাজাকার/ আমার দূরাত্মীয় :/ ধিক্কার জানাই, ঘৃণার থুতু ছিটাই তার মুখে।’ (পোড়া মাটি, পোড়া স্বপ্ন, আদরের পুতুল : পৃষ্ঠা- ৩৯)

মৌলিক চাহিদার ফরিয়াদ-প্রতিবাদে মুখর ‘আমাকে খেতে দাও’ কবির আরেকটি জীবনঘনিষ্ঠ কবিতা। নিরন্ন-নিরীহ-নিগৃহীত মানুষের তনু-মনের ক্ষুধা নিবারণে চিরচেনা উদাসী সমাজচিত্রের হৃদয়গ্রাহী প্রকাশ ঘটেছে এই কবিতায়। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, শান্তিবাণী, সম্প্রীতি ইত্যাদি কারও উদরপূর্তি করে না, আহাজারির ভাষা বোঝে না, অভাবে স্বভাবকাতর প্রাণকে করে না প্রীত। কবি রফিক আজাদের একটি বিখ্যাত কবিতার আদলে জাফর ওবায়েদ বলেন-‘তোমাদের গণতন্ত্র-শান্তি-সম্প্রীতির কাবাব/ রুচে না আমার জিভে, আমি ক্ষুধার্ত/ এবার আমি শাসনতন্ত্র খাবো / খাবো তোমাদের স্বপ্নশহর/ জাতীয় সংসদ খাবো, সচিবালয় খাবো/ খাবো গণভবন এবং বঙ্গভবন!’ (আমাকে খেতে দাও; পৃষ্ঠা- ৪৬)

‘প্রিয়তমা স্বদেশ আমার’ কবিতায় স্বদেশের প্রতি ভালোবাসায় আকণ্ঠনিমজ্জিত কবি শ্রুতিমধুর শোভন শব্দমালায় অত্যন্ত সুনিপুণভাবে সঞ্চারিত করেছেন ভাবনার আকুলতাকে। এ দেশের পরিবেশ-প্রকৃতির উপাদানে পুষ্ট এবং তুষ্ট কবি এ কবিতায় দেশমাতার প্রতি জ্ঞাপন করেছেন বিনম্র কৃতজ্ঞতা। তাই তো তিনি বলতে পারেন-‘আমার কাছে আরাধ্য তুমি, পূজ্য তুমি-প্রিয়তমা স্বদেশ আমার’ (পৃষ্ঠা-৫২)।

রক্ত ও জীবন দিয়ে বাঙালি জাতি বিরল অর্জনরূপে পেয়েছে মাতৃভাষাকে। এ আলোকে মাতৃভাষাভিত্তিক রচনায় বাংলা সাহিত্য হয়েছে সমৃদ্ধ এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত। কবি জাফর ওবায়েদ তাই মাতৃভাষার প্রতি সনিষ্ঠসমর্থন দিয়ে আশা-নিরাশায় সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান কিংবা দেশ-পাখি-প্রকৃতি ভেদে অভিন্ন এক ভাষার কথা বলেন-‘প্রকৃতির তেমনি ভাষা আছে/ নিঃশব্দ-নীরব সে ভাষা/ আশা-নিরাশা, সুখ-দুঃখ সবই আছে/ একান্তে, নীরবে-নিভৃতে প্রকাশে ওরা/ নেই কোন রূপ-লেখ্য কিংবা কথ্য।/ এরই নাম মাতৃভাষা, মিটায় মনের আশা।’ (এরই নাম মাতৃভাষা : পৃষ্ঠা-১৬)

ঈর্ষা-হিংসা, বৈষম্য, অসম-প্রতিযোগিতা আর নৈরাশ্যের ধূম্রজালে যখন আশপাশ আঁধারে নিষ্প্রভ হয়, অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা যখন তছনছ করে সব সনির্বদ্ধ সন্ধিৎসা, প্রণত পরিণাম যখন মানুষকে প্রণাশপ্রবণ করে তখন আমাদের উত্তরণস্পৃহ প্রদীপ্ত প্রত্যাশা অপারগ যন্ত্রণায় কখনও নিভৃতে কাঁদে, কখনও দ্রোহী হয়ে ওঠে। সমাজের এ অহেতুক অরাজক অবস্থা কবিকে যেমন আশাহত করে, তেমনই মাঝে মাঝে তিনি হারিয়ে ফেলেন স্বপ্ন-সফল মুহূর্তগুলো। আত্মজিজ্ঞাসার দ্বন্দ্বে দোলায়িত কবির কলম বলে-‘কী হবে স্বপ্নজাল বোনে/ যে জালে অধরা থাকে/ সুস্বাদু স্বপ্নমাছ/ শুধু শুধু প্রতীক্ষা আর ধৈর্য-খরচ!/ আমার সন্তানেরা, পুষ্টিহীনতায় ভোগে/ থেকেই যায় ওদের/ আমিষের অভাব!’ (স্বপ্নজাল: পৃষ্ঠা-১৯)। আবার ‘স্বপ্ন উপাখ্যান’ কবিতায় কবি তাঁর সৌম্যস্বপ্নের আরাধনায় বিফল অভিমানে ন্ব্যুজ হয়ে শোভিত কৃষ্ণচূড়া বন, একচিলতে ফুলের বাগান, দখিনের মাতাল হাওয়া কিংবা এক পশলা বৃষ্টি লাভের মতো স্বপ্ন-পরিচয় তুলে ধরেন।

কবিতায় বর্ণিত চাওয়া-পাওয়া সাধারণের প্রাণে দোলা দেয়। এই স্বাদের কবিতা ‘পতনের পশ্চাদপসরণ’। এখানে কবির সহজ সুখের মন পবনের নাও দৌড়ে চলে চিরপরিচিত জীবন-জগতের স্রোতে। কবি হৃত আশা-বিশ্বাস ফিরে পেতে উন্মুখ। আকুল আকুতিতাড়িত কবির জিজ্ঞাসা-‘আর কতো! আর কতো! আর কতকাল!/ পতনেরা পশ্চাদপসরণ করবে আমার?’ (পতনের পশ্চাদপসরণ: পৃষ্ঠা-৫০) কিংবা ‘যতোবার পাহাড়ের সান্নিধ্যে গেছি/ ততোবার মুগ্ধ হয়েছি তার দৃঢ়তায়/ জড়িয়েছি তার ভালোবাসায়/ ফিরে এসেছি বধির সেজে/ পশ্চাতে না-তাকিয়ে পাষাণের মতো!’ (তোমার তুলিতে আঁকা: পৃষ্ঠা-৩০)

প্রকৃতিপ্রেমী কবি প্রকৃতির অবারিত রূপ-সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে কখনও অভিমানী হয়ে উঠেছেন, তা আঁকড়ে ধরে রাখতে না-পারার অক্ষমতায়। বাহারি দৃশ্যপটের রূপ-রঙের কোনও উপাদান কবির কাছে উপেক্ষিত নয় বলে তাঁর আকুতি: ‘আমি আজ উদ্ভিন্ন/ আমি আজ উন্মত্ত/ তোমার তুলির আঁচড়ে অন্তর্হিত/ তোমার শিল্পের কোন তুলনা না-পেয়ে।’ (তোমার তুলিতে আঁকা: পৃষ্ঠা-৩২)

বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের কবি যেমন স্বদেশ-স্বভাষা-প্রকৃতিপ্রেমিক, রাজনীতি ও সমাজসচেতন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র-মুহূর্তে যেমন প্রতিক্রিয়াশীল, তেমনি নীতি-নৈতিকতার সক্রিয় চর্চায় তিনি মহীয়ান। তাঁর সমুদয় আত্মজিজ্ঞাসা তাই সহজ বর্ণনায় সরল পথ খুঁজেছে সিদ্ধির পথে। পরিচিত শব্দের পরিচর্যায় তিনি তাপিত অন্তরের তাবৎ বিনাশে মহাপ্রভুর কাছে এভাবে সমর্পিত হন-‘বিশ্বাসের বসন আমাকে পরিয়ে দাও/ উদ্ধত শির আমার নত করে দাও/ হে মহাজগতের মহাপ্রভু!/ আমি তো ভ্রান্তিসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি/... তোমার শাশ্বত শক্তি বলে/ আমাকে কূলে তোলে নাও!/ তোমার পদতলে সমর্পিত করো!’ (বিশ্বাসের বসন: পৃষ্ঠা-২৬) কবির এ সমর্পণেচ্ছা সামাজিক দীক্ষার একটি শক্তিধর হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমার মনে হয়।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ইতিহাসের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিও কবির রয়েছে অগাধ ভালোবাসা, অতল শ্রদ্ধা। তাঁর ‘জাদুর কাঠি, জাদুর বাঁশি’ কবিতায় দেশপ্রেমে উজ্জীবিত মহান এ নেতার সামগ্রিক পরিচয় প্রতিভাত। অভিব্যক্তির ছত্রেছত্রে প্রণীত হয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর মোহময় ব্যক্তিত্বের স্বরূপ। চিরায়ত চিত্রকল্পে চিত্রিত সেই বলিষ্ঠ পথনির্দেশকের দৃঢ় প্রত্যয়ী চেতনার আজও আমাদের বড়ো বেশি প্রয়োজন। কবির সেই বোধ থেকে উৎসারিত-‘বন্ধু, এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র/ সে-তো তোমারই বিম্বিত বৃহৎ এক আলোকচিত্র!/ এ-তো তোমারই রক্তের আঁকরে আঁকা/ কোন শিল্পকর্ম অথবা ত্যাগের সোনালি ফসল!/ অম্লান চিরঞ্জীব সে স্বদেশ তোমার। ...কোথায় রেখেছো সেই যাদুর কাঠি তোমার?/ সেই বাঁশি আর কাঠি আজ বড় বেশি প্রয়োজন! (জাদুর কাঠি, জাদুর বাঁশি : পৃষ্ঠা-৪৮)

নারকীয় হত্যাকাণ্ডের তাণ্ডবলীলায় মহান মুক্তিযুদ্ধ যেমন বাঙালিকে বিপন্নবিষাদে বিমর্ষ করেছে, তেমনই সংগ্রামের শেষ দিকে সূচিত বুদ্ধিজীবী হত্যার সেই ভয়াল শোকার্ত প্রেক্ষাপট আমাদের দগ্ধ করে। বাঙালি জাতীয়তার অধ্যায়ে ১৪ ডিসেম্বর তাই স্বকীয় মহিমা ও গৌরবের দাবিদার। আলোচিত কবিতাগ্রন্থের একটি কবিতায় এ দিনের ঘটনাসম্বলিত মর্মপীড়ক উৎসরণ-‘রায়েরবাজারের ভূমিতে বসেছিল নক্ষত্রের মিছিল/নক্ষত্রের গায়ে নক্ষত্র, টিক্রে পড়ছে আলোকরশ্মি/ হাত-পা বাঁধা, কবন্ধ শরীর কারও কারও/ কারও কারো হাতে আঙুল নেই। চোখে নেই চোখ কারও কারও/ আবার কেউ কেউ হৃৎপিণ্ডহীন!’ (চৌদ্দ ডিসেম্বরের গল্প: পৃষ্ঠা-৪৩)। শাব্দিক এ বয়ান বর্তমান প্রজন্মের জাগ্রত চেতনায় নিশ্চিত আলোড়ন জাগাবে।

পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করা প্রেম মানবজীবনের এক মৌলিক বিষয়। প্রেম শাশ্বত। মানব-মানবীর আবির্ভাবে প্রকাশিত প্রেম পৃথিবী সৃষ্টির মূলেও বিদ্যমান ছিল। মননশীল মানুষের সৃষ্টি যেহেতু সাহিত্য, সেহেতু তার প্রেমিকহৃদয়ের প্রতিফলন ঘটে থাকে সাহিত্যে। বিভিন্ন যুগের সাহিত্যধারায় প্রেমাসন তাই স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। কবি জাফর ওবায়েদও এমনতর প্রেমানুরাগের আবহকে এড়িয়ে যেতে পারেননি।

প্রেমাশ্রিত ১২টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর কাব্যে। কবির প্রেয়সী কখনও উড়ালিয়া বিহগী হলে কবির স্নিগ্ধ উচাটন মন তাঁর পিছু নেয়-‘কতো আকুলতা, কতো স্নিগ্ধতা/ তবু তোমার জন্য!’ (তবু তোমার জন্যে : পৃষ্ঠা-১৭)। নিসর্গ নামাখ্যায়িত কাছে না-থাকা প্রিয়ার উদ্দেশ্যে কবির সংসারী হওয়া বা বিবাগী বাসনা ব্যর্থ হলে বলেন- ‘মাকড়সার মতোই এগুই, দীর্ঘতর হয় সুতো/ ছিঁড়ে যায় না, সে সুতোয় টান পড়ে গেলে/ উৎসে ফিরতে হয়, আসামি কয়েদি যেমন/ হাতকড়া পরে জেল পুলিশের পিছু পিছু ছুটে/ আমার আর হলো না তাই/ তোমার মতো নির্জলা সংসার!’ (তোমার নাম দিলাম নিসর্গ: পৃষ্ঠা-২৪)।

‘হৃৎপিণ্ডের নীল রসে’ কবিতায় কবির প্রেমাকাঙ্ক্ষা প্রতিকূলতার বিষবাণে বিদ্ধ হয়েছে। ক্ষতচিহ্ন ঢেকে রেখে কবি অক্ষত থাকার ভানে যেন সেই ‘তুমি’র ধ্যান করেন। ‘জঙ্গি জলকন্যা সে’-কবিতায় আমরা প্রেমময় আহ্বান শুনি এভাবে-‘জঙ্গি জলকন্যা সে/ দুয়ারে দাঁড়িয়ে তোমার/ হাত বাড়াও, গ্রহণ করো তাকে/ ফেরানোর মনোবৃত্তি ঝেড়ে ফেলে।’ (জঙ্গি জলকন্যা সে: পৃষ্ঠা-২৮)। প্রিয়তমাতে একাকার থাকার আনন্দে আপ্লুত কবি অভিভূত উচ্চারণ রাখেন-‘আহা কী আনন্দ সাকি!/ কোথায় লুকিয়ে তারে রাখি?/ ... আহা কী কষ্টের কুণ্ডলি!/ পুড়ে যায়, যায় পুড়ে/ প্রেমের অঞ্জলি!’ (প্রেমের অঞ্জলি : পৃষ্ঠা-৩৪)।

‘মিশেলা’ ‘ছায়া সংসার’ ‘অনিন্দিতা’ ‘দাবানলের দহনে জ্বলছি’-কবিতাগুলোতে প্রিয়জনের অভাবে হাহাকারকৃত অন্তরের বাণী যেন বেদনার করুণ বিউগল শোনায়। স্মৃতিকাতর কবি রোমন্থনের নানা বিষয়ে দোদুল্যমান, কখনও-বা চরম ব্যথিত, কখনও আত্মপক্ষ সমর্থনে সোচ্চার, আবার মঙ্গল প্রার্থনায় ব্যাকুল। তাই তো বলতে শুনি-‘অযুত-লক্ষ-কোটি প্রার্থনা তোমার জন্য/ তুমি ভালো থেকো, তুমি সুখে থেকো’ (মিশেলা: পৃষ্ঠা-৫৭)। কিংবা, ‘ছায়াসংসার পেতেছি যার সাথে এই আমি/ কুড়িটি বন্ধ্যা বসন্ত অযথাই ঝরে গেছে/ বাসর রাতেও অনুপস্থিত বসন্তরাজ!’ (ছায়া সংসার: পৃষ্ঠা-৫৮)। কিংবা, ‘কোনও কলঙ্ক নয়/ কোনও পাপ নয়/ সুখ-দুঃখের অংশীদারিত্ব/ তাকেই বলে নিষ্পাপ প্রেম-প্লেটোনিক লাভ’ (অনিন্দিতা: পৃষ্ঠা-৬০)। কিংবা, ‘কালবোশেখি ঝড়ের নিষ্ঠুর তাণ্ডবে/ যে আমাকে লন্ডভন্ড করে দিলো/ তছনছ করে দিলো আমার সব/ তারে কি ভুলে থাকা যায়?/ বলো যায়?’ (দাবানলের দহনে জ্বলছি: পৃষ্ঠা- ৫৪)। 

বাহারি তুল্য-চিত্রে অঙ্কিত কবিতা-‘তুমি জুলিয়েট হলে রোমিও হবো আমি’। প্রেয়সীর সৌন্দর্যমুগ্ধ পিয়াস নিবৃত্তিতে কবি আশ্রয় নিয়েছেন অনেক উপমান-উপমেয় পদের। জীবনানন্দের রূপসী বনলতার আদলে সৃষ্ট যেন কবির প্রেমরূপ। এক পর্যায়ে কবির ইতস্তত প্রকাশ-‘সকল আঁধারে আলোর পশরা তুমি/ কী নামে প্রকাশি তোমায়? তুমি যে নিরুপমা!/ তুমি জলিয়েট হলে রোমিও হবো আমি’ (পৃষ্ঠা-৫৩)।

সাম্প্রতিক কালের চাকচিক্যময় পদ্মপাতার প্রেম ফুটে উঠেছে ‘ভালোবাসতে চাও, বাসো’ কবিতায়। বাহ্যিক আবরণে আবিষ্ট বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক ভালোবাসার এক জীবন্ত বাকচিত্র রূপায়িত হয়েছে এ কবিতার শব্দ-সুষমায়। বিলাস-বিত্তে বিপন্ন প্রেম কবির কলমে কথা বলে এমন ব্যঙ্গোক্তিতে-'ভালোবাসো চুটিয়ে, উদার আকাশের মতো/ ভালোবাসো অসীম সাগরের মতো, জোয়ার ভাটায়/ কিন্তু বিয়ে করো বাবা-মা’র পছন্দের প্রকৌশলী পাত্রকে’ (ভালোবাসতে চাও, বাসো: পৃষ্ঠা-৬২)। প্রচণ্ড জ্বরে পুড়ে যখন অনিন্দিতা কবিকে আকুতি জানায় কাছে পেতে, কবির প্রেমাকুল মন তখন সমুদয় সংশয়-সংকট অতিক্রম করে অনিন্দিতার কাছে অকপটে ছুটে যেতে উদ্বিগ্ন হয়, তাড়িত হয় তাঁর ভালোবাসার সুপ্ত অনুরাগ। তাই তার আহলাদি আহ্বান উপেক্ষা না করে তিনি বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনি বাজার আগেই প্রগাঢ় মমত্বে নিষ্প্রভ মমতাময়ীকে আশ্বস্ত করে তোলেন-‘ওর পেলব হস্ত দুটো বিশ্বস্ত হাতে তুলে নিই/ আমি জানিয়ে দিই, কস্মিনকালেও না’ (পুড়ছে জ্বরে অনিন্দিতা: শেষ পৃষ্ঠা) 

পরিশেষে কবিতাগ্রন্থটির নির্ঘণ্ট নির্ণীত হলো যে বিষয়াবয়বে-সেই নাম-কবিতা ‘হৃদয়ে রাত্রি নামে’। এখানে কবির চিন্তন জগতে চিড় ধরিয়েছে এক ঘুণশাবক। সে আর কেউ নয়-সকল অনুকূল ইচ্ছার হস্তারক। আশা-ভরসা-প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি দাঁড়ালে কবির কাব্যাকাশ থেকে অপসারিত হয় সমূহ আলোকছটা, আঁধারাচ্ছাদিত রাত মর্মগভীরে বসতি গড়ে। তিনি স্বস্তিহীন হয়ে যান ভিটে মাটি হারাবার আশঙ্কায়। অস্থির এ অনুভূতি স্পষ্ট রূপ পেয়েছে কবিতাটিতে। 

পাঠোত্তর আলোকপাতে আদ্যন্ত বিচরণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, কবি জাফর ওবায়েদের প্রথম গ্রন্থ ‘হৃদয়ে রাত্রি নামে’ তাঁর সাহিত্য সাধনার ধারায় অব্যাহত গতি সঞ্চার করবে, কর্মসফল প্রাপ্তির কাণ্ডারি হবে। পাঠককুলের আশাময় পথ চাওয়া এই তো। 

কবি পেশায় একজন শিক্ষক। জ্ঞানের আলো বিতরণের পাশাপাশি তিনি প্রতিনিয়ত সাহিত্যসেবকের ভূমিকায়। জীবনঘনিষ্ঠ শাণিত অনুভূতির পরিশীলিত পরিণয়ে প্রমত্ত কবি মাঝে মাঝে হতাশায় নুয়ে পড়লেও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতায় তিনি প্রদীপ্ত। সুন্দরের সাধনায় জীবনমুখি আবাহন তাঁর কবিতার মূল সুর। উপমা, অনুপ্রাস, যমক এবং প্রকাশসারল্য তাঁর রচনাশৈলীকে অন্তরঙ্গ করে তুলেছে। কাব্যনদে সার্থক সন্তরণে সম্ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে নিপুণ শব্দচয়ণ আর সহজ বাকচাতুর্যে। কবির অনায়াস অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে না কখনও-এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। 

গ্রন্থখানির মূল্য রাখা হয়েছে ১০০ টাকা। এর প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা ‘শুদ্ধস্বর’। প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছেন ‘আবু হাসান’। কাগজ এবং ছাপার মান ভালো। বইটির আঙ্গিক সৌন্দর্যও আকর্ষণীয়। প্রাক-কথনে কবিকে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী এবং সত্য প্রকাশে অঙ্গীকারাবদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এ বাতাসই বইছে তাঁর কবিতার চরণে চরণে। উৎসর্গ বিষয়টি মা-বাবার প্রতি কবির অতল শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। শেষান্তে সন্নিবিষ্ট কবি পরিচিতি কবিকে জানতে পাঠকবৃন্দের সহায়ক হয়েছে। এই গ্রন্থখানা তাঁর তাপসকর্মের অগ্রসরতায় অনবদ্য সূচক হোক। মনোরঞ্জিত পাঠ্যসুখে কবিতাগুলো হোক আদরনীয়, পরবর্তী প্রকাশনা হোক ত্বরান্বিত।

 

লুৎফুন্নেসা লিলি, প্রভাষক (বাংলা), ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিলেট।

আপনার মন্তব্য