রবীন্দ্রনাথ ও আমার শৈশব

 প্রকাশিত: ২০১৮-০৫-০৮ ১৬:৩৩:৫৩

 আপডেট: ২০১৮-০৫-০৮ ১৭:২৭:২৪

জ্যোতি ভট্টাচার্য্য:

হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব
ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভ জটিল বন্ধ

আমি যখন রবিঠাকুরের গান শুনে একটু একটু করে বড় হচ্ছি মায়ের মধ্যে, তখন থেকেই কবির সাথে আমার সখ্যতা শুরু। আমার মা গান ভালবাসতেন, সেই পরিবেশেই বড় হয়ে ওঠেছিলেন। মা ভাল গান গাইতেন। যখন আমি পৃথিবীর আলোয় এসে নামলাম এবং বড় হতে থাকলাম তখন দেখলাম আমাদের বাসায় সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনা সংগীতের মধ্যে অন্যতম ছিল-

বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।

বাবা একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘তোমার মনে যদি শক্তি না থাকে, তুমি সামনে এগিয়ে যাবে কিভাবে? তাই প্রতিদিনের নিত্য কাজের সাথে এ গানকে অন্তরে স্থান দাও। দেখবে একদিন এ গান তোমার শোকে-দুঃখে তোমাকে সাহস দেবে।

এটা কোন সাধারণ মানুষের মনের কথা না। তিনি ছিলেন ঋষিপুরুষ তাইতো এটা তাঁর দ্বারাই লেখা সম্ভব।’ তখন এগুলো বুঝতাম না, কখনও রাগ করে কিংবা বিরক্ত হয়ে বাবার ভয়ে জোরে জোরে সুরে-বেসুরে ত্রিসন্ধ্যায় গেয়েছি।

আমাদের বাসায় প্রায় বিকেলবেলা গানের আসর বসত, শুধু রবিবার ছাড়া। এ আসরের মধ্যমণি ছিলেন আমার মিষ্টি পিসি (গায়ত্রী), তাঁর বান্ধবীরাও আসতেন মাঝে মাঝে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আভা পিসি, অপর্ণা পিসি (তিনি হচ্ছেন জামতলার দেবেন্দ্র মহাজনের মেয়ে)। আমার পিসি সহ এরা সবাই সরকারি চাকুরি করতেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। রবিবার দিন বন্ধ থাকায় সেদিন আমার দাদু হাফ ছেড়ে বাঁচতেন। বাবাতো যথারীতি চেম্বারে চলে যেতেন। দাদু চাইতেন তাঁর একমাত্র নাতনী গান করুক। কিন্তু মা সহ পিসিদের গান দাদু পছন্দ করতেন না। কি আর করা, আমি গান ভালবাসতাম, পিসি অফিস থেকে আসার সাথে সাথে শুরু হত আমার আবদার। মায়ের আত্মীয় স্বজনও কম যান না। আসতেন মায়ের পিসতুতো বড় ভাই বুলু মিশ্র, মঞ্জু মিশ্র, উনারা খুব ভাল গান গাইতেন। আসতেন আরতি ধর (প্রখ্যাত লোকশিল্পী), বাবার ভাতিজা ছাতকের মিলন গোস্বামী (প্রখ্যাত শিল্পী হিমাংশু গোস্বামী, বর্তমান লন্ডনপ্রবাসী), আমার আরও এক কাকু জয়ন্ত (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা) আমার ঠাকুমার বড়বোনের ছেলে। উনিও মাঝে মাঝে এসে আমাদের আসরে বসতেন। তখন আমি খুব ছোট। সংগীত ছিল আমাদের বাসায় নিত্যদিনের একটা বিষয়। আরেকটা কথা না লিখলে নয়, মাঝে মাঝে আমার এক দাদু আসতেন নাতনির গলায় গান শুনতে, তিনি আমার আরও একজন ভাললাগার মানুষ- আমার দাদুর পিসতুতো ভাই (স্বর্গীয় অবনী কান্ত চৌধুরী) এইডেড হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

তখন আমার একটা প্রিয় গান ছিল পিসির কাছে শুনতাম ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’। তখন প্রায় দিনই একটা প্রশ্ন করতাম তাঁকে- দুঃখের আবার প্রদীপ হয় কিভাবে? পিসি শিক্ষিত মানুষ, যা বলতেন আমার মাথার উপর দিয়ে চলে যেতো। রবীঠাকুরের গানের আমি ভীষণ ভক্ত ছিলাম সেই থেকেই। আমার মামারাও ভাল গান গাইতেন। বড় মামা পেশায় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেই সুবাদে সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতিও ছিল তার গভীর অনুরাগ। বড় মামার ছাত্রের মধ্যে আমার কয়েক জনের সাথে ভাল যোগাযোগ ছিল এর কারণে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডা. মৃগেন চৌধুরী ও সাহিত্যিক নন্দলাল শর্মা। এই সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তিরাও আমাদের বাসায় প্রায়ই আসতেন। বিশেষ করে মামা যখন বাসায় আসতেন তাদের অনেক সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কিত কথা বা আলোচনা আমি আড়ালে আবডালে থেকে শুনতাম। তবে সেই বয়সে তার বেশিরভাগই বুঝতাম না।

মনে আছে একবার বড় মামা একটা গান তুলে দিলেন হারমোনিয়ামে, ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে।’ আমার রাঙ্গা মামা তিনিও শিখিয়ে দিলেন ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলারে ভাই’ এ গানটি। এভাবেই আমার শৈশব কেটেছে রবীঠাকুরের কথায়, সুরে, ভাবনায়। সেই থেকে কবি আমার আত্মার আত্মীয়। আমার নিত্যদিনের পথচলায় আমার অবলম্বন। আমার মায়ের সাথে কবিগুরুর কোথায় একটি যোগসূত্র খুঁজে পাই। সিলেটের চৌহাট্টার ‘সিংহবাড়িটি আমার আরেকটা মামার বাড়ি, ‘সিংহবাড়ি’র মামারা ভীষণ ভালবাসতেন আমার মাকে। দিদিমাতো (স্বর্গীয় বীণাপাণি মজুমদার) কোন উৎসব, পালা-পার্বণে মা না গেলে ফোন করে খোঁজ নিতেন। কত রবীন্দ্র জয়ন্তী, কবির প্রয়াণ দিবস ঘটা করে সিংহবাড়িতে উদযাপন হয়েছে তা আজ শুধু স্মৃতি। আমি কত অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি, আবৃত্তি করেছি। অনুষ্ঠানের শেষে মামীদের হাতে তৈরি লুচি আলুরদম- ভাবলেই জিভে জল আসে।

এ বাড়ির ছোট ছেলে (ডা. সুধাময় মজুমদার) আমার সুধা মামা, আমাদের বাসায় ভাতৃদ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা খেতে যেতেন। মা পরম যত্নে এটা সেটা বানাতেন ভাইয়ের জন্য। এই সিংহবাড়িতে রবিঠাকুর এসেছিলেন ১৯১৯ সালে। কাজেই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে এ বাড়িটি এখনও ঐতিহ্য বহন করে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ নতুনত্ব খোঁজে তাই এই দীর্ঘ বছরের পথচলার বাঁকে বাঁকে কবিকে আমি খুঁজে পাই নবরূপে। কবি সর্বযুগের সর্বকালের সকল মানুষের মনে বর্তমান। এভাবেই যুগে যুগে বিভিন্ন ধারার সাথে পাল্লা দিয়ে রবীন্দ্র ভাবনা হয়ে উঠেছে শাশ্বত। তাঁর গানের ব্যাপ্তি বিস্ময়কর, তাই সাধারণভাবে শিক্ষিত মানুষ তাদের জীবনের বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রভাবনার সাথে একাত্ম হতে পারেন।

ভাবতে পারেন এটা তাঁরই কথা। তাই আজও কবির কবিতা, গান এত বেশি জনপ্রিয়। কতবার যে রবীন্দ্রসংগীত শিখতে গিয়ে মায়ের কাছে ধমক খেয়েছি। এখন মনে হলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ‘আজি তোমায় আবার’’ গান এর সঞ্চারী গাওয়া, মিড় বোঝাতে কি যে মায়ের প্রাণপণ চেষ্টা। আজ বুঝি, এত আলোর মধ্যে থেকেও আমি কেন এতটুকু আলো ধার হিসেবে নিতে পারলাম না। এ আমার ব্যর্থতা। আসলে আমরা অনেক সুন্দর কিছুকে পেয়েও নিতে পারি না। কবি নিতে পেরেছিলেন ভালবেসেছিলেন এ জগতকে, এ জগতের কীটপতঙ্গ, পশুপাখি, মানব মানবীকে। কবি চন্দ্র-সূর্যগ্রহ-তারার চাঁদোয়াতলে এ ভুবনে জন্ম লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন। এ বিশ্বে তাঁর জায়গাটিকে চিনে নিয়েছিলেন তাই মুগ্ধ বিস্ময়ে জেগে উঠে তাঁর গান- ‘আকাশ ভরা সূর্যতারা বিশ্ব ভরা প্রাণ’; এ মাটির রূপ-রস-গন্ধ ঋদ্ধ করেছে কবিকে। তিনি অপার বিস্ময়ে মনের ভাব প্রকাশ করেছেন এ গানের সঞ্চারীতে।

ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে,
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে,
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।
কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান

রবীন্দ্র সাহিত্যে বাদ পড়েছে কোন বিষয়? ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেহ নাহি দিবে অধিকার’- এ কবিতায় নারী স্বাধীনতা বা সম অধিকার ভাবনার বিষয়টি কিছুটা উচ্চকিত ভাবেই প্রকাশ যেন, তবু নিজের মনে একটু নাড়া দেয়, যখন দেখি স্বাধিকারের সব প্রশ্ন মিশে সেই ‘বরমাল্য লব একদিন’ এ। ‘কভু তারে দিব না ভুলিতে মোর দীপ্ত কঠিনতায়?’

আরে বাবা! কোনও সহ গমন হয় নাকি তেমন করে! তার চেয়ে চিত্রাঙ্গদা অনেক স্বাভাবিক- ‘যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে, যদি সুখে-দুঃখে মোরে কর সহচরী, আমার পাইবে তবে পরিচয়।’ কবি নিজেতো জানতেন বিনম্র ‘দীনতার শক্তি’, যে শক্তি ছিল কবি সৃষ্ট নিতান্ততুচ্ছ সেই আনন্দী বৈষ্ণবীর মতো আরও চরিত্রের মধ্যে। পদ্মার বুকে ঘুরে বেড়াবার সময়ে দেশে বিদেশে মেয়েদের জীবনযাপনের যে বন্ধন ও মুক্তি, লাঞ্ছনা গঞ্জনা ও প্রতিরোধ ধরা দেয়নি কবির চোখে? মেয়েদের নিয়ে ভাবনায় নিজের যে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন প্রায় বালিকা বয়সে, তাদের জীবন বিশেষত মাধুরীলতার শেষ দিনগুলির মর্যাদাবিহীন যন্ত্রণা, কেবল মৃত্যুতেই যার অবসান। শেষবারের মতো মৃতা মেয়ের মুখখানি না দেখে ফিরে আসা, রেনুকার মৃত্যু, মীরাদেবীর বঞ্চিত জীবন। কবির হৃদয়কে কতটুকু নাড়া দিয়েছিল জানি না। শমীর অকাল মৃত্যুতে বড় বেদনা ছিল, অপমান ছিল না, শুধু অসম্মান দুঃখ নয় অন্তঃপুর বাসিনীরও যে আকাশ দেখার ইচ্ছা থাকে তাও কবির চোখ এড়ায়নি। যদি চোখে না পড়ত তবে কি ভাবে উঠে আসত একজন নারীর বোধের সুন্দর প্রকাশটি। কবির কথায়- আমি নারী, আমি মহীয়সী, আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্নাবীণায় নিদ্রাবিহীন শশী। আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা, মিথ্যা হতো কাননে ফুলফোঁটা।

কবির সমস্ত জীবন ও কাজের মধ্যে দেখতে পাই বিশ্ব মানবের আবির্ভাব, মানব কল্যাণের তাগিদ। তাই নিজের সন্তানের মঙ্গলচিন্তায় তৃপ্ত না থেকে বিশ্ব মানবের কল্যাণে বিশ্বের মানুষকে ডাক দিয়ে আনেন। এক পরম সত্য ঘোষণা করেন। ‘‘মানুষের যা শ্রেষ্ঠ দান তা যে দেশে, যে কালেই সৃষ্ট হোক তাতে সকল মানুষের অধিকার’’। ‘‘যেখানেই যে তপস্বী করেছে দুষ্কর যজ্ঞযাগ, আমি তার লভিয়াছি ভাগ।’’

রবীঠাকুরের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে কোথায় পড়েছিল শান বাঁধানো ঘাটে কলসি রাখার সেই গোলাকার দাগ, জানিনা তবে আমার শৈশবে এতো আলো পেয়েও এতটুকু আলো ধার হিসেবে নিতে না পারায় যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা এ শূন্য পাত্রে একটু একটু করে ভরে নিতে চাই-

আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বালিয়ে।

  • লেখক: অভিনয় শিল্পী ও আবৃত্তিকার, প্রশিক্ষক- জেলা শিল্পকলা একাডেমি; সিলেট এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, সিলেট জেলা শাখা।

আপনার মন্তব্য