বেড়াল-বাঘ

মাসকাওয়াথ আহসান

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৭-০৩ ০১:০২:৪৩

বেড়াল-বাঘ কিংবা বাঘ-বেড়াল রূপান্তরের কিছু কী তা পাঠকের বিষয় হয়ত তবে সমসাময়িক বৈশ্বিক কিংবা জাতীয় বাস:

নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক বেড়াল কুস্তি প্রতিযোগিতা হচ্ছে। চারিদিকে সাজ সাজ রব। গোটা পৃথিবীর বেড়াল এসেছে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ফাইনালে চ্যাম্পিয়ানশীপের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এমেরিকা বনাম বাংলাদেশের দুটি বেড়াল।

রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ান হয় বাংলাদেশের বেড়াল। উপস্থিত বাংলাদেশীদের মাঝে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। এমেরিকান বেড়ালকে যে বেড়াল হারিয়েছে; সে তো আর যা-তা বেড়াল নয়। জাতির গর্ব।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশন প্রধানকে জানানো হয় এ সুসংবাদ। উনি খুব খুশী হন আবার খটকাও লাগে। বাংলাদেশের বেড়াল গোটা পৃথিবীর বেড়ালকে হারিয়ে দিলো! এ কী করে সম্ভব!

নিউইয়র্কের গণ্যমান্য বাংলাদেশীরা কুস্তিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ান বেড়ালটিকে বাংলাদেশ মিশনে নিয়ে আসে। বেড়ালটি বেশ স্টাইলিশ। চুলে জেল দিয়ে চলে যায় মিশন প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে। মিশন প্রধান বেড়ালটির গলায় বাঁধা চ্যাম্পিয়ানশীপের বো-টাইটি দেখে মুগ্ধ হন। বেড়ালকে জিজ্ঞেস করেন,
--হে বিজয়ী বেড়াল বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি!
--আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই; দেশকে কিছু দিতে চাই।

মিশন প্রধান অবাক হন; এইটুকু বেড়াল দেশকে কী দেবে। এমনি দেশ কালো বেড়ালে পরিপূর্ণ; তারপর এই কুস্তিতে চ্যাম্পিয়ান হুলো বেড়ালকে দেশে পাঠানো কী ঠিক হবে!
--আপনার দেশকে যা দেবার তাতো দিয়েই দিলেন; এই যে বেড়াল কুস্তি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ানশীপ; এতো কম কথা নয়।

মিশন প্রধান বেড়ালের জন্য স্পেশাল ফুড আনিয়ে রেখেছিলেন। সেটা পরিবেশন করতে বলেন। খাবার দেখে চ্যাম্পিয়ান বেড়াল বলে, কাঁচা গোশত ছাড়া আমি কিছু খাইনা; মানুষের গোশত হলে ভালো হয়।

মিশন প্রধানের বুকের মাঝে কেঁপে ওঠে। নরখাদক বেড়াল জীবনে এই প্রথম দেখা। এ আপদ এমেরিকাতেই থাকা ভালো। উনি কোনমতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে বিদায় জানান। ক্যানিবাল ক্যাট; ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক।

স্থানীয় লোকজন বেড়ালটাকে বলে, চ্যাম্পিয়ান হইছো কুস্তিতে; খুব ভালো কথা; মিশন প্রধানের সামনে কেদ্দানি করে মানুষের গোশত খাইতে চাওয়াডা ভুল হইলোরে বিল্লু। দেশে যাওনের চান্স মিস। এমেরিকায় মানুষের গোশত কই পাবা চান্দু। দেশে গিয়া খাইতে পারতা; ঐখানেতো এভেইলএবল।

একজন দয়াপরবশ হয়ে বলে, এইবার তোমারে যেইখানে নিয়া যাবো; ভদ্রবেড়ালের মত ক্যাট-ফুড খাইবা। কথা কম বলবা।

বেড়ালটা দুঃখ পায়। কিন্তু মেনে নেয়। নরমাংসের জন্য সে মরিয়া। এমেরিকায় আসার পর নরমাংস না পেয়ে সে শুকিয়ে গেছে। তবুও হসপিটালের অপারেশান থিয়েটারের গার্ভেজ ব্যাগ থেকে মানুষের কিছু কেটে ফেলে দেয়া এপেন্ডিক্স খেয়ে কোনমতে এই বেঁচে থাকা। এও আবার বেঁচে থাকা। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দেয় বেড়ালটা। কোন কুক্ষণে এই মরার দেশে এসেছিলাম। দেশে থাকলে মানুষের গোশতটাই সবচেয়ে সস্তায় পাওয়া যায়। বিনামূল্যে আর কী! গরু-মহিষ-ছাগল-হাঁস-মুরগীর গোশতের তা-ও দাম আছে। মানুষের গোশতের আর দাম কী; ক্রসফায়ার কইরা মাইরা দিলেই গিয়া বিনা পয়সায় খাও; ফাইভ স্টার বুফে ডিনার যারে কয়।

এক ভদ্রলোক ল্যাপটপে বসে কাজ করছিলেন। খুব হাসি খুশী মানুষ। স্থানীয় গণ্যমান্যরা চ্যাম্পিয়ান বেড়ালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই উনি বলেন, মারাত্মক খুশীর খবর। কনগ্রাচুলেশনস ডিয়ার ক্যাট। বলুন আপনি কী গিফট চান!
--আমার কিচ্ছু লাগবে না; আমি দেশে ফিরতে চাই; আর সম্ভব হইলে একটা চাকরী দিতে পারেন; দেখতে বিড়াল হইলেও আমি বাঘের শক্তি রাখি।
--হ্যা আর আপনার চুলে জেল দেবার কায়দাও ইউনিক; এতো স্মার্ট বেড়াল আমি জীবনেও দেখিনি। আমাকে দুটো দিন সময় দিন। দেখি কিছু করা যায় কীনা।

খুশী মনে চ্যাম্পিয়ান বেড়াল ফিরে আসে। তারপর সন্তর্পণে ঢুকে পড়ে একটা হসপিটালে। গন্তব্য অপারেশান থিয়েটারের বর্জ্য ব্যাগ; যদি একটা এপেন্ডিক্স থাকে। থাকারই কথা। যুক্তরাষ্ট্র তার সেনাদের ইরাক-আফগানিস্তানে পাঠানোর আগে এপেন্ডিক্স অপারেশান করে ফেলে দিচ্ছে; যাতে যুদ্ধের মধ্যে এপেন্ডিক্সের ব্যথা উঠে ঝামেলা না হয়।

স্থানীয় গণ্যমান্য এক ব্যক্তি বেড়ালটাকে পরদিন খবর দেয়, তোমার বাংলাদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ঔ ভদ্রলোক বললেন, উনার মা বাসায় পশুপাখী রাখতে পছন্দ করেন। উনি জীবে দয়া করে ঈশ্বরের সেবা করেন। তুমি সাহসী বেড়াল রাতে বাড়ীটাও পাহারা দিতে পারবে।
বেড়াল গর্ব করে বলে আমি মধ্যরাতের বেড়াল। সব পাহারা দিয়ে রাখবো।

বাংলাদেশে এসে দেখে আলিশান বাড়ী। ঐ ভদ্রলোকের আম্মাও খুব ভালো। বাড়ীতে যে পশুপাখী থাকে; বাইরে থেকে যারা দল বেঁধে আসে তাদের সবার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন। পশুপাখীরা উনার সঙ্গে সেলফি তুলে আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায়। বাড়ীর পশু বলে এমেরিকা ফেরত বেড়ালটির বেশ কদর। বাইরে থেকে যে পশুপাখী আসে তারা খুব ভাই ভাই করে; এমনকি তার সঙ্গেও সেলফি তোলে। বেড়ালটি বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু মানুষের গোশতের ব্যবস্থা না হওয়াতে মনটা অস্থির হয়ে থাকে।

একদিন বাগানে ঘোরাঘুরির সময় একদল ইঁদুরের সঙ্গে দেখা হয়। বেড়াল তাদের বস হয়ে ওঠে দ্রুত। ইঁদুরদের বলে, মানুষের গোশতের ব্যবস্থা কর। আমি তগো এ বাড়ীর পেস্ট্রি খাওয়াবো। এখানে লোকজন কেক-পেস্ট্রি আর ফুল নিয়া আসে; ওতে আমার পেট ভরবে না; ঐগুলা তোরা খাবি। এক ধেড়ে ইঁদুর খবর দেয়, পাশেই পঙ্গু হসপিটাল; ডাক্তাররা হাত-পা কাইটা ফালাইয়া দেয় অহরহ। ঐগুলি খাইতে পারেন। বেড়াল চিৎকার করে বলে, লইয়া আই।

ইঁদুরের দলটি সবাই মিলে টেনে হিঁচড়ে একটা কাটা হাত নিয়ে আসে। বেড়ালটা সেটা আমোদে চোখ মুদে খায়। তারপর ধেড়ে ইঁদুরগুলোকে মুখে তুলে পেস্ট্রি খেতে দেয়। বেড়ালটা এভাবে নিয়মিত পঙ্গু হাসপাতাল থেকে ইঁদুর গ্যাং-এর ঘাড়ে করে নিয়ে আসা মানুষের গোশত খেয়ে খেয়ে দশাসই হতে থাকে। ইঁদুরগুলোরও নরভোজের অভ্যাস হয়। ক্রমশঃ হিংস্র হয়ে ওঠে।

একদিন এক অতিথি বেড়ালটিকে দেখে বলে, তুমি তো দিন দিন বাঘ হয়ে উঠছো হে বেড়াল!

বেড়ালটা চিৎকার করে বলে, ওরে বোকা আমি বাঘই; খাওয়ার অভাবে শুকাইয়া বিড়াল হইয়া গেছিলাম।

আপনার মন্তব্য