প্রকাশিত: ২০১৮-০৯-২০ ১৪:২৪:১১
জহিরুল হক মজুমদার:
একটি বিশেষ ঘোষণা। একটি বিশেষ ঘোষণা। মেলায় মায়ের সাথে আসা একটি ছোট বাচ্চা পাওয়া গেছে। বাচ্চার বয়স আনুমানিক চার বছর। বাচ্চাটি আমাদের ঘোষণা কক্ষে আছে। বাচ্চাটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার সাথে আসা অভিভাবককে অনুরোধ করছি।
বার বার এই ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ঘোষিকা।
অধ্যাপক রাজ্জাক মনোযোগ দিয়ে ঘোষণাটি শুনছেন। আর বার বার তাঁর ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে। তিনি অস্থির বোধ করছেন।
-স্যার কেমন আছেন?
-ভাল। তুমি কেমন আছ?
-ভাল আছি স্যার। আমাকে চিনতে পারছেন?
-না। তুমি কোন ব্যাচ?
-স্যার, আমি আপনার প্রথম দিককার ছাত্রী।
-কোথায়? চট্টগ্রামে না ঢাকায়?
-মা-নে, মানে স্যার?
-আমি আগে চট্টগ্রামে পড়িয়েছি। এখন ঢাকায় পড়াচ্ছি।
-চট্টগ্রামে স্যার।
-স্যার, আপনাকে অস্থির মনে হচ্ছে। কোন সমস্যা?ভাবী কোথায়?
-আমি বিয়ে করিনি। তুমি বোধ হয় জানোনা।
-স্যার, আপনি অস্থির কেন?
-ওই ঘোষণাটার জন্য।
-কোন ঘোষণা স্যার?ওই বাচ্চাটা?
-হ্যাঁ, মন লাগিয়ে শোন। খুব খারাপ কথা।
-খারাপ কেন স্যার?
-বাচ্চাটাকে তার মা ইচ্ছা করে ফেলে গেছে।
-তাই মনে হয় স্যার? খুব খারাপ কথা।
-তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবে বাচ্চাটা। নিরীহ নিষ্পাপ বাচ্চা।
-কী ভুল স্যার?
-বাচ্চাটা হয়তো তার বৈধ সন্তান নয়। তার ভুলের স্বীকৃতি সমাজ দেবেনা।এতদিন কোথাও আড়াল করে রেখেছিল। এখন সুযোগ পেয়েছে।তাই মেলা দেখানোর নাম করে এখানে এনে ফেলে গেছে।
-আমার মনে হয় স্যার বাচ্চার মা এখনি এসে নিয়ে যাবে।
- না, নেবেনা। তুমি বোধ হয় এখনই মেলায় ঢুকেছ। আমি অনেকক্ষণ ধরেই ঘোষণাটা শুনছি।
-না স্যার। আমিও অনেকক্ষণ থেকেই আছি। স্যার, আপনিতো কিছু কিনলেন না। মেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আজ আবার শেষ দিন।
-না, আমি কিছু কিনতে আসিনি। ভাঙা মেলা দেখতে আমার ভালো লাগে। সেই গ্রাম জীবন থেকে অভ্যস্ত। ওই শোন আবার।
একটি বিশেষ ঘোষণা। একটি বিশেষ ঘোষণা। মেলায় মায়ের সাথে আসা একটি ছোট বাচ্চা পাওয়া গেছে। বাচ্চার বয়স আনুমানিক চার বছর। বাচ্চাটি আমাদের ঘোষণা কক্ষে আছে। বাচ্চাটিকে কেউ নিতে না আসায় আমরা বাচ্চাটিকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করছি।
-যাক ভালোই হল, কি বলো?
-জি স্যার।
-কিন্তু তোমার চোখে পানি কেন?
-না স্যার। এমনিতেই।
-স্যার একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?
-বলো, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন করলে ভালোই লাগে।
-সবচেয়ে ভাল সমাজ কোনটা স্যার?
-সবচেয়ে ভাল সমাজ হচ্ছে সেটাই যে সমাজ মানুষের ভুলগুলোকে মমতার সাথে ধারণ করে।
-আর সবচেয়ে খারাপ সমাজ?
-সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে সেটাই যেখানে সংবেদনশীল মানুষেরা কষ্টে থাকে।
-স্যার, আমার বাচ্চাটার একটু খবর রাখবেন স্যার।
-তোমার বাচ্চা? কী হয়েছে তার? অসুস্থ? কোন হাসপাতালে আছে? স্বাস্থ্য সচিব আমার বন্ধু। তাঁকে বলতে পারি। মন্ত্রীও আমাকে চেনেন। সম্মান করেন।
-স্যার, আমার বাচ্চাটা এই মেলায় হারিয়ে গেছে।
-কী বলছ তুমি! মেলাতো শেষ। কন্ট্রোল রুম ক্লোজড। তাহলে পুলিশ কমিশনার---। না ডি সি আমার ছাত্র। তাকে বলতে পারি।
- স্যার, আপনি অস্থির হবেন না। আমার আরেকটা কথা ----।
- তোমার বাচ্চা হারিয়ে গেছে --------।
-স্যার, আমি আপনার সরাসরি ছাত্রী নই। আপনার অসাধারণ পড়ানোর কথা শুনে পাশের বিভাগ থেকে ক্লাস করতে আসতাম।
- সেসব কথা এখন রাখ। চলো আমার ডি সি ছাত্রের অফিসে। আমি ওকে ফোন দিচ্ছি। ও গাড়ি পাঠিয়ে দেবে।
- স্যার, আমি যাই। ওই বাচ্চাটা আমারই।আপনি একটু ভালমন্দের খোঁজ রাখবেন, স্যার।
-এই মেয়ে, এই মেয়ে--------।
একজন পরাজিত মা অনেক মানুষের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। এইসব মানুষেরা ঘরে ফিরে সন্তানের মুখে চুমু খাবে পরম আদরে। আর সে তার প্রিয় সন্তানকে ফেলে যাচ্ছে এক পরিচয়হীনতার মধ্যে।
অধ্যাপক রাজ্জাক কিছুক্ষণ ডেকে, কিছুদূর এগিয়ে গিয়েও বিশাল চলমান জনসমুদ্রে তাঁর ছাত্রীকে আর খুঁজে না পেয়ে, হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এক বিশাল বিস্ময় চিহ্ন হয়ে।
আপনার মন্তব্য