মাসকাওয়াথ আহসান’র গল্প: প্রভাবশালী

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৭-১৮ ১৭:২২:৪৬

প্রচ্ছদচিত্র গুগল থেকে সংগৃহীত

লোকটা থতমত খেয়ে চলে যায়। শুধু মনে মনে ভাবে, এই প্রভাবশালীর দাদাও ঘাড়ে গামছা নিয়ে হাটে বেচতো; ওর দাদা:

প্রভাবশালী ঈদ করতে তার গ্রামের বাড়ীতে এসেছে। তার বিশালাকার গাড়ীটিকে ঘিরে এলাকাবাসীর ঔতসুক্য। ড্রাইভার অভি মিয়া ধমক দিয়ে সবাইকে সরিয়ে দেয়। গ্রামের মানুষ গাড়ীটির দাম নিয়ে নানা কল্পনা করতে থাকে। যে কল্পনাশক্তি গাড়ীটির আসল দাম নির্ধারণে ব্যর্থ হয়। একজন সাহস করে ড্রাইভার অভি মিয়াকে জিজ্ঞেস করে,

- মিয়ে ভাই এ গাড়ীর দাম কত নেছে!
- দাম শুইনা কী লাভ! কিনবা নাকি একখান।

লোকটা থতমত খেয়ে চলে যায়। শুধু মনে মনে ভাবে, এই প্রভাবশালীর দাদাও ঘাড়ে গামছা নিয়ে হাটে বেচতো; ওর দাদাও একই ব্যবসা করতো। এর মধ্যে কী এমন চেরাগ প্রভাবশালী পেলো যে ঘষা দিতেই এতো বড় গাড়ী।
অভিমিয়া চ-বর্গীয় গালি দিয়ে উপস্থিত জনতাকে জানিয়ে দেয় আগামীকাল সকাল দশটায় যাকাতের কাপড় বিতরণ করা হবে। আশে পাশের গ্রামে রটে যায় এ মহা যাকাত বিতরণের খবর। মানুষ পড়িমরি করে ছুটতে থাকে প্রভাবশালীর বাড়ীর দিকে।

প্রভাবশালী তার আব্বাকে ধমক দিয়ে বলে, সিল্কের পাঞ্জাবী নিয়ে আইছি; পরোনা ক্যা; কী একখান পুরান পাঞ্জাবী পরি ঘুরতিছাও!
আব্বা পাল্টা ধমক দিয়ে বলে, বড়লোকি ঢাকাত যায়া দেখা; ‘ভেড়া চুয়াডাঙ্গা’ কী করি তুমি এতো বড়লোক হইছাও আমি জানি।

প্রভাবশালীর মা তার আব্বাকে বোঝায়, ছেলি ঈদের ছুটিত আইছে; তুমি এইরম করো ক্যা!
-তুমার ছেলি ঢাকাত ডাকাত হইছে তা বুজিছাও! হারামের পয়সার সিল্কের পাঞ্জাবী আমার লাগবিনানে।

পরদিন সকালে প্রভাবশালীর বাড়ীতে যাকাতের কাপড় সংগ্রহে এসে হাজির হয় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। প্রভাবশালীর ঢাকার বাড়ীর চাকর ছোঁড়াটা সঙ্গে এসেছে। নাম তার রিমন মিয়া। প্রভাবশালী অভি মিয়া ও রিমন মিয়াকে ভীড় সামলাতে বলে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যাকাতের কাপড় সংগ্রহের সময় ভীড়ের চাপে দুজন শিশু ও পাঁচজন নারীর মৃত্যু ঘটে। লাশগুলো পড়ে থাকে। অন্যেরা যাকাতের কাপড় নিয়ে ফিরে যায় মৃতদেহের দিকে ফিরে না তাকিয়ে।

রিমন মিয়া দৌড়ে এসে খবর দেয় প্রভাবশালীকে।
- স্যার সাতটা লাশ পইড়া আছে; ভীড়ের চাপে মরছে; অহন করি কী!
- স্থানীয় মার্কেট থিকা কাফনের কাপড় কিইনা কবর দেও। আর অভিরে কও এর পর থিকা যাকাতের কাপড়ের লগে কিছু কাফনের কাপড়ও আনতে। সব কথা কী কইয়া দিতে হয়। নাদান কোনেকার।

প্রভাবশালীর স্ত্রী ঢাকার মেয়ে; ঢাকার মেয়েরা ঢাকায় ছাড়া ঈদ করতে পারেনা। অবশ্য সিঙ্গাপুর-কুয়ালালামপুর হলে সেটা অন্য ব্যাপার। তাই বেচারাকে একা একাই গ্রামে আসতে হয় ঈদে। প্রভাবশালীর বউ তার শ্বশুর-শাশুড়ীতে সহ্য করতে পারেনা। ঢাকায় গেলে দুইদিনের মধ্যে তাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করে। প্রভাবশালীর স্ত্রীর গালিগালাজে অসম্ভব দক্ষতা। এর ফলে ফেসবুকে সে একজন সেলিব্রেটি। তরুণ ছেলেদের মোবাইল ফোন-টোন গিফট করে। রাতে টয়বয়দের সঙ্গে চ্যাটিং করে; নেত্রী হয়ে উঠেছে সে দেশপ্রেম নিয়ন্ত্রণ সমিতির। আর প্রভাবশালী যতই প্রভাবশালী হোক এই গালিশালী স্ত্রীর সামনে কথা বলার সাহস পায়না। ঢাকার মেয়ে, বিরাট ব্যাপার; হোকনা ঘুপচির মধ্যে ফুচকি মারা মন নিয়ে বেড়ে ওঠা চলিষ্ণুখিস্তিকল্পদ্রুম।

প্রভাবশালীর এলাকার মুরুব্বী সমাজ তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। প্রভাবশালী তাদের মুখের ওপর বেনসন হেজেসের ধুম্র ছেড়ে এলাকার উন্নয়নের রুপকল্প টোয়েন্টি-টোয়েন্টি বোঝাতে থাকে। সবার মনে হয় সাক্ষাত ঈশ্বর বসে তাদের সামনে। এই গ্রামেরই গামছা বিক্রেতার ছেলে আজ এতো প্রভাবশালী; বিস্ময়ে হতবাক স্থানীয় এক সাংবাদিক তার জীবনী লেখার প্রস্তাব দেয়।

এরমধ্যে এক বেয়াদব সাংবাদিক জিজ্ঞেস করে বসে, যাকাতের কাপড় দিতি গিয়ে যে এমন সাতটে মানুষ মারা গেলো; আপনের কুনো অনুতাপ নাই!
- এই ভেড়া চুয়াডাঙ্গা এতো সাহস কতি থাকি আসে! তুই চিনিস আমি কেডা!

স্থানীয় প্রশমন সমাজের এক মুরুব্বী সাংবাদিকটিকে একটু শাসনের ভণিতা করে ঘর থেকে বের করে দেয়। এলাকার কিছু তরুণ এসে প্রভাবশালীর সঙ্গে সেলফি তোলে। প্রভাবশালী হাসতে হাসতে ঈদ সালামী দিয়ে বলে, এবা মানিক ছবিত তুলবু পঞ্চাশ টেকার নোট; এইডা সোসাইটি চয়েস করে। আর টেকাটুকার বান্ডিল অভি-রিমন দিয়া আসপে; বুজলু কীনা!

প্রভাবশালীর ড্রাইভার আর চাকর দুটি কর্মহীনতায় বসে বসে মোবাইলে গান শুনে। এলাকার এক ছেলেকে টাকা দিয়ে বলে, ফেনসিডিলের বোতল নিয়া আয়। বোতল এসে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই। ফেনসি খাওয়ার পরেই লাভলি লাভলি ফিলিংস; মনে হয় শূণ্যে ভেসে আছে দুজন। মোড়ের দোকানে গিয়ে অতিরিক্ত চিনি দেয়া চা খায়। নেশাটা জমে ওঠে। দোকানে দু’তিনজন এসে তিনটা চাকরীর দরখাস্ত দিয়ে অনুনয় বিনয় করে।

- এ ভাই আপনেরে সারেক ব্যুলি এক্ষেন চাকরীর বন্দোবস্ত করি দেন।
নেশার ঘোরে অভি-রিমনেরা নিজেরাই চাকরীদাতা হয়ে ওঠে। গলা খেঁকিয়ে বলে,
- দরখাস্তগুলি রাইখা যাও; দেহি কী করবার পারি।

এরপর দুজন একটু হাঁটতে বের হয়। একটা তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলেকে দেখে ভেতরে থিকথিকে রিরংসা জাগে; মাথার মধ্যে লিবিডোর তোলপাড় হয়। বাচ্চাটা প্রাণপণে বাধা দেয়। মুহূর্তে অভি-রিমনের শরীরের লোমগুলো বড় হতে থাকে; নখ গুলো লম্বা হয়, দুটো কুকুর দাঁত লম্বাতর হয়ে যায়। বাচ্চাটাকে দুজন মিলে হত্যা করে। দরখাস্ত জমা দেয়া ছেলেদের দিয়ে মৃতদেহটি দাফন করে দেয়। নিহত শিশুটির আব্বার গলায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলে,
- একদম চুপ; কথা কইলেই ফুটাইয়া দিমু।

প্রভাবশালী তার জীবনীকার সাংবাদিককে নিয়ে একটু ব্ল্যাক লেবেলে চুমুক দেয়। এমন সময় স্থানীয় কিছু মোল্লা ফুল নিয়ে হাজির হয় প্রভাবশালীর দলে যোগদান করতে। প্রভাবশালী মোল্লাদের সামনে ব্ল্যাক লেবেল নিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করে। একজন মোল্লা হেসে বলে, ভাইডি অসুবিধা কী মসজিদ নির্মাণ করিয়াছেন; আল্লাহ এইসব ছোটখাট গুণাহ মাফ করিয়া দিবেন। আপনার জন্য নিশ্চয়ই বেহেশতে একটি কক্ষ নির্মিত হইয়াছে।

যোগদান পর্ব শেষে মোল্লারা ফিরে যায়। ফেনসিডিলের ঘোরে অভি-রিমন নীচতলার একটি ঘরে সাপের মত কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে। তাদের হাতে-গেঞ্জিতে এখনো নিহত শিশুটির রক্ত লেগে।

জীবনীকার দুঃস্থ সাংবাদিক প্রভাবশালীর অনুদান নিয়ে বাড়ী ফিরে যায়। এমন সময় একটি ফোন আসে। মডেল সিনথিয়ার ফোন। সে নিকটবর্তী একটি বাগানবাড়ীতে উঠেছে। ওটিও প্রভাবশালীর শখের বালাখানা।
- এঁই তুমি আসবানা; আমি একা একা বোর ফিল করছি।
- আসবো বেইব; জাস্ট হাফ এন আওয়ার।
- হাফ এন আওয়ার যেনো হাফ এন আওয়ারই হয়।

প্রভাবশালী নীচের গেস্ট রুমে দেখে ড্রাইভার অভি চাকর রিমনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। ব্ল্যাক লেবেলের আলেয়ায় মনে হয় যেন রংধনু রঙ ছড়িয়ে পড়েছে সারাঘরে।

নিজেই গাড়ী ড্রাইভ করে বাগানবাড়ীতে পৌঁছে প্রভাবশালী। সিনথিয়া একটা ব্লু টি শার্ট আর শর্টস পরে বিরক্ত ভঙ্গিতে টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করছে; সেতো আর অনুষ্ঠান দেখতে চায় না; তার বিজ্ঞাপন কখন দেখাবে সেই অপেক্ষা করে।

প্রভাবশালী আসার পরেই শুরু হয় ঘ্যান ঘ্যান।
- আমারে বিয়ে করতেছো কবে! নাইলে মামলা করবো; হিজাব পরে প্রেস কনফারেন্স করবো।
- এখন এইসব রাখোতো; ওই একই ঘ্যান ঘ্যান ভালো লাগেনা।
- ঐ গালিনা বেটিরে ছাড়লে তোমার প্রবলেম কী! ওইডা কী একটা মানুষ; দেখছো তার মুখের ভাষা।
- মাথা ব্যথা করতেছে সিনথিয়া।
- আমারে তাইলে ঢাকা থিকা আনলা ক্যান; এতোই যদি অসহ্য লাগে।

হঠাত খুন চেপে যায় প্রভাবশালীর মাথায়। সে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করে সিনথিয়ার মাথা বরাবর গুলি চালায়। সিনথিয়া মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। লাশটা পাঁজাকোলা করে গাড়ীতে তোলে প্রভাবশালী। তারপর শোঁ শোঁ হাওয়া কেটে হাইওয়েতে গিয়ে একটা ব্রীজে উঠে একজায়গায় গাড়ী থামিয়ে সিনথিয়ার মৃতদেহটা নদীতে ফেলে দেয়।

বাগান বাড়ীতে এসে অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নেয় প্রভাবশালী। সিনথিয়ার রক্ত প্রভাবশালীর শরীর ধুয়ে ওয়াশরুমের ড্রেন দিয়ে নেমে যায়। বেরিয়ে এসে ধোপ দুরস্ত সাদা পাঞ্জাবী পরে; আতর দিয়ে খুনের গন্ধটা তাড়ায়। একটা টুপি পরে। ঈদের নামাজ আদায়ে সে ঈদগাহে গাড়ী নিয়ে পৌঁছাতেই মাইকে ঘোষণা হয়, অত্র এলাকার গর্ব, দেশ ও দশের সেবায় নিয়োজিত, দানবীর মহৎ হৃদয় দেশপ্রেমিক আজ আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি ঈদগাহ সংস্কারের সমুদয় ব্যয়ভার বহন করেছেন; আল্লাহ উনাকে অশেষ ছওয়াবের মালিক করুক; আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নাই।

মানুষ তাকে একনজর দেখার জন্য ঔতসুক্য হয়ে পড়ে, তারপাশে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য একটা সুতীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

নামাজে সেজদা দেয়ার সময় প্রভাবশালী খেয়াল করে তার কড়ে আঙ্গুলে নখের খাঁজে রক্ত লেগে আছে।

আপনার মন্তব্য