প্রকাশিত: ২০২০-০৩-০২ ০১:৪৮:১৭
রেজা ঘটক:
শেষ হলো ভাষার মাস, বাঙালির চিরন্তন প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। এ বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় মোট ৪৯১৯টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমির মতে এর মধ্যে বইমেলায় মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা ৭৫১টি। এবার মোট প্রায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা বেশি।
২৮ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় ব্যাপক আড্ডা, ঘোরাঘুরি আর বইকেনা হয়েছে। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে, শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে, আড্ডা হয়েছে। এবছর কেবল ২৬ ফেব্রুয়ারি ছাড়া অবশিষ্ট ২৭ দিন আমার বইমেলায় থাকার সুযোগ হয়েছে। বইমেলার সার্বিক পর্যবেক্ষণ এবং আমার পরামর্শ অথবা আমি কেমন বইমেলা চাই, তা নিয়ে পরবর্তী সময় বিস্তারিত লিখব।
তবে এবছর শান্তিপূর্ণ এবং কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়াই অমর একুশে বইমেলা শেষ করতে পারার জন্য বাংলা একাডেমি এবং আইন শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই সকল প্রকাশক, প্রেস-মালিক, বাইন্ডার, প্রুফরিডার, এডিটর, কবি-সাহিত্যিক-লেখক, লিটলম্যাগ সম্পাদক এবং বইমেলায় আগত সকল বইপ্রেমীকে। প্রাণের বইমেলার এই অমূল্য স্মৃতিটুকু আমার সারা বছরের খোরাক হয়ে থাকবে।
এবারের বইমেলায় সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইটির নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখিত 'আমার দেখা নয়াচীন'। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে সবাই অন্তর থেকে ভালবেসেই এই বইটির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়েছেন। পাশাপাশি অতিভক্তি, তোষামোদি এবং কাটপিস বা চুরি করে হলেও আদিখ্যেতা দেখাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু'র নামে অসংখ্য অখাদ্য-কুখাদ্য বইও ছাপা হয়েছে এবছর। আমার মতে বঙ্গবন্ধু'র উপরে লিখিত বইগুলো একটি সম্পাদকমণ্ডলী কর্তৃক যাচাই বাছাই হয়ে প্রকাশ হলে বিষয়টি অনেক সুন্দর হতো। খোদ বাংলা একাডেমি অনেক লেখক-পণ্ডিতদের দিয়ে এই কাজটি করাতে পারতো।
ব্যাঙের ছাতার মত নতুন প্রকাশনা সংস্থা গজিয়ে উঠলেও মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। এমনকি বড় বড় প্রকাশনা থেকেও মানসম্পন্ন বইয়ের তুলনায় অখাদ্য-কুখাদ্য বইয়ের প্রকাশনা ছিল ভুরি ভুরি। লেখালেখিতে চর্চা না করেই যার যেমন যখন খুশি বইমেলার সময় বই প্রকাশ করার একটা হিড়িক এবারও লেগেছিল। তবে ব্যতিক্রমী দু'একটা নতুন প্রকাশনা সংস্থা এবং দু'-একজন লেখক চোখে পড়েছে সবার।
ছোটকাগজের সংখ্যা বাড়লেও এবছর ছোটকাগজের নতুন সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি। লিটলম্যাগ তুর্কিরা যুদ্ধে দিনদিন যেমন পিছু হটছে, তেমনি বাংলা একাডেমি'র তাদের প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ছিল নজর কাড়ার মত। ছোটকাগজ যেন তার যৌবন হারিয়েছে। আবার ছোটকাগজের নামে অসংখ্য অখাদ্য-কুখাদ্য ছোটকাগজের উদয় হয়েছে। যাদের লেখা বা প্রকাশিত কাগজ বইমেলায় কেন জায়গা পাবে, তা নিয়েই অনেকের প্রশ্ন উঠেছে।
টয়লেট ব্যবস্থাপনায় বাংলা একাডেমি এবারও ফেল করেছে। বইমেলায় পুলিশের বাড়াবাড়ি এবং মাদ্রাসা ছাত্রদের নজরদারি ছিল গোঁদের উপর বিষফোড়ার মত। বইমেলার পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশু ও বয়স্ক মানুষের পক্ষে একদিনে পুরো বইমেলা ঘোরা সম্ভব হয়নি। বইমেলায় বাংলা একাডেমি চত্বর ছিল ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধি রাম সর্দারের মত।
'লেখক বলছি' মঞ্চে এবার জমজমাট আলোচনা ছিল। কিন্তু এই আলোচনায় কেবল বাংলা একাডেমি'র কর্মকর্তাদের দিয়ে সঞ্চালনা করিয়ে এক ধরনের একঘেয়েমি এবং জবরদস্তি করানোর মত ব্যাপার ছিল। একাডেমি'র বাইরের কবি-লেখকদের দিয়ে সঞ্চালনের এই কাজটি করালে সেটি যে আরও উপভোগ্য হতে পারতো, সেই বুদ্ধি বা কৌশল বাংলা একাডেমির নজরে আসেনি অথবা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
সবমিলিয়ে বাংলা একাডেমিকে একটা বড় ধন্যবাদ দেয়া যেতে পারে। একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী ও বইমেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদকে আলাদাভাবে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই। সবাইকে একুশের শুভেচ্ছা।
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বইমেলা থেকে ফিরে।
রেজা ঘটক: নির্মাতা ও কথাসাহিত্যিক।
আপনার মন্তব্য