বোকার ডায়েরি...

 প্রকাশিত: ২০১৫-১০-২৩ ১৫:৫৮:০২

 আপডেট: ২০১৫-১০-২৪ ২৩:২০:৪৬

ইয়াহইয়া ফজল:

তখন সম্ভবত নবম শ্রেণীতেই পড়ি। রেলে ঢাকা যাচ্ছি। এই আমার প্রথমবার রেলে চড়া। প্রথমবার আব্বা-আম্মাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়া। তারচেয়েও বড় কথা এই প্রথমবার রাজধানি যাচ্ছি। খালামণির বাসায়। তবে একা নয়, সাথে নানা। আম্মা এমনিতেই তাঁর বড় ছেলের হাত ছাড়তে চান না কখনো। আজও তাঁর ধারণা আমি একটু বোকা-সোকা গোছের। তার উপর সুদূর ঢাকা। আম্মার তাই দুই’দিন আগে থেকেই দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। যাবার বেলা বার বার করে বলে দিলেন, নানার কাছ ছাড়া যেন না হই।

সাহস করে যাচ্ছি বটে, তবে ভেতরে ভেতরে আমারও কি ভয়ের কমতি নেই। তাই আম্মা না বললেও আমি কি আর নানার কাছ ছাড়া হবো? ভয়ে ভয়ে রেলে চড়ে বসলাম। বেশ মনে আছে, আব্বা রেলের সিটে বসিয়ে দিয়েই থামলেন না, রেল যতক্ষণ না ছাড়লো ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকলেন প্লাটফর্মের পাশে। রেল ছাড়ার মুহূর্তে আব্বার সেই উদ্বিগ্নমাখা চেহারা আমার মন খারাপ করে দিলো। রেলে দীর্ঘক্ষণ আমি মন খারাপ করে বসে থাকলাম।

আমার নানা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। শিক্ষক মানুষ হলে যা হয়, তিনি সবকিছু দেখেন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মেজাজে। তাঁর সাথে তাই প্রচলিত ‘নানা-নাতি সম্পর্ক’ আমার কোনকালেই ছিলো না। কেমন ভয় ভয় লাগতো।

যা হোক, রেলে উঠার পর ঘন্টাখানেক মনমরা হয়েই বসে থাকলাম। কিছুটা ভয় ভয়ও করছিলো। তবে এসময় তা কেটে গেলো। প্রথম প্রথম সিটের আসে পাশে হাঁটাহাঁটি করলাম। বুঝার চেষ্টা করলাম নানার প্রতিক্রিয়া। কিছু বলছেন না দেখে খানিকটা সাহস হলো, দুই কামরার সংযোগস্থলের পাশে যে জানালা আছে তা দিয়ে মাথা বের করে হাওয়া খেলাম কিছুক্ষণ। এর মাঝে একজনের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে ভাব জমে গেলো। এতদিন পর ভদ্রলোকের চেহারাটা আজ আর মনে নেই। তবে এতটুকু বেশ মনে আছে, ভদ্রলোক বয়সে আমার চেয়ে খানিকটা বড়ো হবেন। ট্রেন যখন আখাউড়া এসে থামলো ততক্ষণে মোটামুটি ভালোই জমে গেছে দু’জনের।

আখাউড়া জংশনে ট্রেন থামলো। ভদ্রলোক আমাকে বললেন, চলেন নিচে গিয়ে চা-টা খেয়ে আসি। রেলে হাঁটাহাঁটি করতে করতে ততক্ষণে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। নিজেকে কেমন বড় বড়ও মনে হচ্ছে। কিন্তু ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে আম্মার বার বার বারণ করে দেওয়ার কথা মনে পড়ে গেলো। হোঁচট খেলাম। তারপর ভাবলাম নানা যদি দেখেন ট্রেন থেকে নেমেছি তাহলে কপালে দুঃখ আছে। চট করে সিটের কাছে ঘুরে এলাম। নানা ঘুমুচ্ছেন। ভাবলাম তাহলে একটা ঝুঁকি নেওয়া যেতে পারে। ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম।

ভদ্রলোকের সাথে কাছের একটা চা’র টংগে বসে চা খেলাম, সাথে বিস্কিট বা কেক কিছু একটা খেলাম। তারপর এসে দেখি ট্রেন ছাড়তে তখনও অনেক দেরি। স্টেশনে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন, সময় যখন আছে কিছু সাগর কলা কিনে নেই।

আমি তাঁর কথায় সায় দিয়ে সঙ্গে গেলাম। অনেকক্ষণ দেখাদেখি শেষে কলা পছন্দ হলো তাঁর। কলার দাম পরিশোধ করতে গিয়ে তিনি বিক্রেতার হাতে ধরিয়ে দিলেন পাঁচশত টাকার একটা নোট। বিক্রেতা সেটা হাতে নিয়ে ভাংতির উছিলায় সময় ক্ষেপন করতে লাগলেন। এদিকে ততক্ষণে ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে আস্তে আস্তে নড়তে শুরু করেছে। ক্রমেই বাড়ছে তার গতি। কিন্তু কলা বিক্রেতা আর ভাংতি দেন না। তিনি নানা টালবাহানা করতেই থাকলেন। আমরা যত তাড়া দেই তিনি তত আস্তে আস্তে খুঁচরো নোটগুলো এক করতে থাকেন। আমি একটা সময় ভয় পেয়ে গেলাম। ভদ্রলোককে বললাম, ট্রেন তো চলে যাচ্ছে। আপনি কলা কেনা বাদ দেন। টাকা নিয়ে চলেন যাই।

কিন্তু বিক্রেতার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি ভাংতিও দিচ্ছেন না আবার টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। এরই মধ্যে ট্রেনের অর্ধেক শরীর স্টেশনের বাইরে চলে গেছে। আমার কিশোর মনে তখন নানা দুশ্চিন্তা খেলতে শুরু করেছে। প্রথমতো নানা বয়স্ক মানুষ, ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন আমি নেই তখন দুশ্চিন্তায় যদি অসুস্থ হয়ে যান, দ্বিতীয়ত আম্মা শোনলে তখন কি হবে। আরো কত কি?

আমি আবারও তাড়া দেই ভদ্রলোককে। কিন্তু তিনি তার পাঁচশত টাকার মায়া কাটাতে পারেন না অন্যদিকে কলা বিক্রেতাও যেন নড়তে চাইছেন না। আমি একবার তাকাই তাঁদের দিকে, আরেকবার ট্রেনের দিকে। কি করবো বুঝে উঠতে পারি না। এভাবে কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। হঠাৎ দেখি ট্রেনের শেষ অংশটাও প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে। এবার আর থাকা যায় না। আমি এবার রেগে গেলাম। ভদ্রলোককে শেষবারের মতো বললাম, আপনি আসলে আসেন, না হলে পাঁচশত টাকার জন্য বসে থাকেন, আমি গেলাম।

আমি এবার সবকিছু ভুলে ট্রেনের পেছনে পেছনে ছুটতে লাগলাম। দৌড়তে দৌড়াতে একটা দরজা পাওয়া গেলো, কিন্তু সেটা বন্ধ। প্রাণপণে পরের দরজা লক্ষ্য করে দৌড়াতে থাকলাম। কাছে গিয়ে দেখি সেটাও ভেতর থেকে বন্ধ। এখন কি করা? ট্রেনের গতি বেড়ে যাচ্ছে। একটা সময় শেষ দরজাটাও আমার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো। এবার আমি মরিয়া। সাত-পাঁচ না ভেবেই সেটার হাতল ধরে ঝুঁলে পড়লাম। ঝুলে থাকলাম কিছুক্ষণ। ট্রেনের গতি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। বুঝে গেলাম এভাবে বন্ধ দরজার হাতল ধরে খুব বেশিক্ষণ বাইরে ঝুঁলে থাকা যাবে না। কি করবো। মরিয়া হয়ে প্রচ- ঝুঁকি নিয়ে বসলাম। পাশের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। জানি চলতি রেলে এভাবে ঝুলে জানালা দিয়ে ঢুকার চেষ্টা করাটাই পাগলামি ছাড়া কিছু না। কিন্তু এর বিকল্পও তো নাই। অন্তত বাঁচার চেষ্টা তো করতে হবে। এবং একাজ করতে হলে যত দ্রুত সম্ভব করে ফেলতে হবে। কারণ প্রতিনিয়ত গতি বাড়ছে। যত দেরি হবে তত ঝুঁকি বাড়বে।

আমি দুই হাতে দরজার দুই হাতল শক্ত করে ধরে রেখে জানালায় পা রাখলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য! কে যেন আমার পা ঠেলে বাইরে বের করে দিলো। আবার রাখলাম। আবারও একই কাহিনী। এভাবে তিন চারবার চেষ্টার পর মেজাজ বিগড়ে গেলো। আমি আবার পা রাখলাম এবং এবার হাতটি আমার পা ঠেলতে আসার সাথে সাথে প্রচন্ড ক্ষিপ্রতায় সজোরে লাথি দিলাম সেই হাতের মধ্যে। এবার কাজ হলো। এবার আর পা রাখার পর কেউ ঠেলে বের করে দিলো না। আমি প্রথমে পা হাটু পর্যন্ত জানালা গলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে হাতল থেকে একহাত ছেড়ে জানালার কোন ধরলাম। তারপর হাতের উপর ভর নিয়ে আস্তে আস্তে টেনে শরীরের অর্ধেকটা ভেতরে নিয়ে আসলাম। তারপর অন্য হাতটাও হাতল থেকে ছেড়ে জানালার কোনায় রাখলাম। এটা ছিলো সবচেয়ে কঠিন কাজ। যা হোক এরপর পুরো শরীরটাকে দুই হাতে টেনে ট্রেনের ভেতরে নিয়ে গেলাম। ট্রেনের ভেতরে ঢুকে দেখি মানুষজন অবাক হয়ে দেখছে আমার কা- কারখানা। তারা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলো। আর আমি দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনা এবার আমাকে আকড়ে ধরেছে।

শেষপর্যন্ত যে রক্ষা পেয়েছি তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। এভাবে কতক্ষণ ছিলাম বলতে পারবো না, সৎবিৎ ফিরে পেয়েই ছুটলাম নিজের আসনের দিকে, নানা ঘুম থেকে জাগেননি তো?

এই ঘটনার পর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। এরপর কতবার ঢাকা গেছি। কতবার ট্রেন চড়েছি। যতবারই রেলে উঠেছি ততবারই মনে পড়ে গেছে ঘটনাটা। মনে হয় মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম সেই যাত্রায়। কখনও শিহরিত হয়েছি, কখন আনন্দিত আবার কখনও নিজেকে বোকা বোকা মনে হয়েছে। তবে এ ঘটনা আজও আম্মাকে বলা হয়নি। বাসার কাউকেও না। কারণ যেই শোনবে সেই আমাকে বোকা বলবে। আম্মার তো আরো পোক্ত হবে আমার প্রতি তাঁর ধারণাটির। তাই স্বাভাবিক। কারণ চিনি না জানি না, ক্ষণিকের পরিচিত একজনের জন্য এতটা ঝুঁকি নেওয়াকে বোকামি ছাড়া কি ই বা বলা যায়। কিন্তু আমার তাতে কোন আক্ষেপ নেই। আমি তো এমনই। বাইরে থেকে দেখলে আত্মকেন্দ্রিক, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি এমনই। বিপদের মুখে কাউকে রেখে সরতে আমার বড্ড বাঁধে। হোক তা পরিবার-পরিজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবের বেলায়। নিজের ক্ষতি করে হলেও আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করি পাশে থাকার।

এ ঘটনাটা রেলে চড়লেই সাধারণতো আমার মনে পড়ে। আজ ব্যতিক্রম হলো। অনেকদিন পর ঘটনাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। তবে আজ রেলে চড়তে গিয়ে নয়, রাতেরবেলা হেঁটে বাসায় ফেরার সময়। আসলেই কাজটা বোকামি পর্যায়ের হয়ে গিয়েছিলো। হয়তো আসলেই আমি বোকা। মানুষের সম্মিলিত হাসি যদিও মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত করে, নিজেকে বোকাই লাগে। তাতে দুঃখ লাগারই কথা। কিন্তু আসলে দুঃখের কি আছে। পৃথিবীর সবাই বুদ্ধিমান হতে চায়, চালাক হতে চায়। আমি না হয় বোকাই হলাম...

আপনার মন্তব্য