কমল শোভার মল্লিকা বাহার

 প্রকাশিত: ২০১৫-১০-২৭ ১৩:০১:০৭

 আপডেট: ২০১৫-১১-১৫ ১১:০৯:৪২

ফরিদ আহমেদ:

১. কমল শোভা
বাংলা সাহিত্যে কমলকুমার এক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। অনেকের ভিড়ে একা একজন নন তিনি, ভিড়ের থেকে বহু দূরে দাঁড়ানো, বৃত্তের একেবারে বাইরে তাঁর অবস্থান। এরকম ক্ষেত্রে মূল স্রোতের বাইরের সেই একাকী একজন সাধারণত হারিয়ে যাবার কথা। কিন্তু, তিনি যান নি। স্বাতন্ত্র্যের সৌন্দর্য নিয়ে জ্বলে উঠেছেন বাংলা সাহিত্যের সুবিস্তৃত আকাশে।

কল্লোল-কালিকলম, বা পরিচয় পত্রিকা থেকে উদ্ভুত লেখককুলেরই সমসাময়িক তিনি, কিন্তু তাঁকে এরা কেউ চিনতো না। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ চিনলেও, তিনি যে সাহিত্য সাধনা করতেন, লেখালেখি করতেন, সেটা তাঁদের কাছে ছিলো অজ্ঞাত বিষয়। খুব সযত্নে সমসাময়িকদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন তিনি। সাহিত্যসাধনা যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে সাধারণত নিজেকে প্রকাশের, অন্যের কাছে নিজের লেখা উপস্থাপন করার এক তীব্র তাগিদ কাজ করে। কমলকুমার ছিলেন এর একেবারেই ব্যতিক্রম।

ঝিনুক যেমন মুক্তোকে আড়াল করে রাখে প্রাণপনে নিজ শরীরের অন্তরালে, তেমনি নিজের সাহিত্য প্রতিভাকে সবার কাছ থেকে আড়াল করায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। নিজেকে আড়াল করার, অদৃশ্য করার, পর্দার অন্তরালে ঠেলে দেবার এই কাজটা কেনো তিনি করেছেন, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। এর ব্যাখ্যা জানার জন্য যে উপস্থিতি থাকা দরকার ছিলো সাহিত্য অঙ্গনে, সেটাও তাঁর ছিলো না। জীবিত অবস্থায় লেখক হিসাবে স্বীকৃতিই পান নি তিনি। কোনো সাহিত্য সভায় ডাক পড়ে নি তাঁর, তৈরি হয় নি কোনো ভক্তকুল। প্রথম থেকেই কমলকুমার মজুমদার চারিত্র্যে ও লেখকসত্তায় সবার থেকে আলাদা। দেশ-চতুরঙ্গ-পরিচয়, এই সব নামী পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে বটে, তবে তা খুবই অল্প পরিমাণে। এতোই অল্প পরিমাণে যে সেগুলো কারো চোখেই পড়ে নি।

তাঁর লেখা মূলত প্রকাশ হয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের ছোট্ট চত্বরে। কমলকুমারের মতো বিশালদেহী কেউ এর আগে কখনো লিটল ম্যাগাজিনের ছোট্ট জায়গায় দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন নি, চেষ্টা করে নি স্থায়িত্ব পেতে। তিনি শুধু দাঁড়ানই নি, পরিণত বয়সেও সেখানেই স্থির হয়ে থেকেছেন। লিটল ম্যাগাজিনের ছোট আধারে এমন বড় মাপের লেখক আর কখনোই পাওয়া যায় নি। এ এক অদ্ভুত আচরণ তাঁর, বিচিত্র এক খেয়াল যেনো। তিনি কী নিজের বিশালতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, নাকি ছোট্ট পরিসরেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন, স্বস্তি পেয়েছেন, আনন্দ পেয়েছেন, কিংবা ছোট বা বড় পরিসর, এই সব বিষয়গুলো তুচ্ছ ছিলো তাঁর কাছে? ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন নি এগুলোকে। সাহিত্যচর্চা করার কথা, সেটাই করে গেছেন আপন মনে, আন্তরিক নিষ্ঠার সাথে।

কমলকুমার মজুমদারের ভক্তকুল তৈরি না হবার জন্য অবশ্য অন্য কাউকে দায়ি করা যায় না। সব দায়-দায়িত্ব আসলে তাঁরই। সবাই যেখানে পাঠক চান, তিনি সেখানে পাঠককে দূরে সরিয়ে রাখার কঠিন পণ করে নেমেছিলেন মাঠে। হাতে গোণা কয়েকজন মাত্র পাঠক পেলেই যে কোনো সাহিত্যিক খুশি হন, সেটা কমলকুমারকে না দেখলে বিশ্বাস করাটা কঠিন। এক দুরূহ কঠিন, অপ্রচলিত এবং ব্যাকরণ না মানা কিন্তু অসম্ভব কাব্যধর্মী গদ্যশৈলীর প্রাচীর তুলে পাঠকের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিদারুণভাবে বিপন্ন করে তুলেছিলেন তিনি। সান্ধ্যভাষার মতো এক দুস্তর গদ্যচর্চায় তিনি অকম্পিত, অবিচল, অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং অবশীভূত। তাঁর সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে গেলে পাঠককে পরিশ্রম করতে হয় তাঁরই মতো করে, ইচ্ছাশক্তিটাকে বলিয়ান করতে হয়ে প্রবল পরাকাষ্ঠতায়।

পাঠকের প্রতি এমন দয়ামায়াহীন লেখক বিশ্বসাহিত্যে বিরল। অন্যেরা যেখানে সুধাপাত্র পাঠকের মুখে তুলে দিতে ব্যস্ত, তিনি সেখানে একে লুকিয়ে রেখেছেন গহীন অরণ্যের মাঝে লুকায়িত দুর্গম এক দুর্গের মধ্যে। পাঠককে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে, কঠিন পরিশ্রম করে, প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে, তারপরই পৌঁছাতে হয় সেই অমূল্য সুধাপাত্রের কাছে। এই দুর্গমতার জন্য শুধু যে পাঠক হারিয়েছেন তিনি তা নয়, সমঝদার সমালোচকরাও দূরে থেকেছে তাঁর কাছ থেকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা ছোটগল্পের তিন দিকপাল’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে, ‘কমলকুমার মজুমদার জীবিতকালে পাঠক পাননি, সমালোচকদেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি তাঁর দিকে, তাঁর নামে বঙ্কিম পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর এগারো বছর পর, যা এক নির্মম রসিকতার মতন।‘

কমলকুমারের ভাষা নিজস্ব সৃষ্ট, স্বতন্ত্র এবং অনুপম। এই ভাষায় তাঁর আগে আর কেউ লেখে নি, তাঁর সময়ে কেউ হাত চালায় নি, তাঁর চলে যাবার পরেও আর কেউ চেষ্টা করে নি এই ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে। এ এক অপার্থিব ভাষা, অনুভবে আবেশ ছড়ায় রাশি রাশি কিন্তু অনুকরণযোগ্য নয় মোটেই। বর্মাচ্ছিদ্য এই ভাষা গীতিময়, চিত্ররূপের ব্যঞ্জনাময়, কাব্যসুধায় পরিপুর্ণ। কমলকুমার সচেতনভাবেই এই ভাষাকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হিসাবে। একটি ছোট, কিন্তু সচেতন এবং মনোযোগী পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করার লক্ষ্যেই হয়তো এমনতর ভাষার উদ্ভাবন।

অথচ এই তিনিই খেলার প্রতিভা উপন্যাসে বিদ্যাসাগরের ভাষা ব্যবহারের স্বপ্ন দেখেছিলেন, কারণ প্রচলিত ভাষা জ্ঞানের উপর শ্রদ্ধা ছিলো না তাঁর। কিন্তু, এটা কী কথার কথা ছিলো, নাকি সত্যিকার অর্থেই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, তা জানার কোনো উপায় নেই। তিনি সেখানে লিখেছেন, ‘হে ঠাকুর, আমাদের ভাষাজ্ঞান অতীব ঘেয়ো, এখানে ঐ ‘উল্লাস’ শব্দপ্রয়োগে জানি আমাদের পাপ হইল। হায় উহাদের আমরা অনেক দূর হইতে, অনেক জন্মের এদিক হইতে নেহারিলাম। ইহাতে, এই ব্যবহারের, অখণ্ড মহারাজ আমাদের দুষমন বলিতেন! আঃ বিদ্যাসাগর, তোমার সূক্ষ্ণতা আমরা একদিন অন্তত স্বপ্নে দেখিব – তবে ঐ পাপ যাইবার!’ কিন্তু বাস্তবে তিনি বিদ্যাসাগরের ভাষা বেছে নেন নি, তা সে যতোই স্বপ্ন দেখুন না কেনো। শুধু বিদ্যাসাগরই বা কেনো, প্রচলিত কারো ভাষাই তিনি নেন নি, না সমসাময়িকদের, না পূর্বসূরীদের। আলোক সরকার তাঁর ‘কমল মজুমদারের মানুষ ও ভাষা’ প্রবন্ধে লিখেছেন,

‘খেলার প্রতিভা উপন্যাসের শুরুর দিকে কমলকুমার মজুমদার বিদ্যাসাগরের, অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের ভাষা, শব্দ ব্যবহারের সূক্ষ্ণতা একদিন অন্তত স্বপ্নে দেখবার আকাঙ্ক্ষা করেছেন। কমলকুমারের পাঠকেরা বলা বাহুল্য এই প্রস্তাবে সচকিত হবেন। ঈশ্বরচন্দ্রের ভাষায় একাগ্রতা এবং অনিবার্যতা কমলবাবুর গদ্যে নেই, এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই নেই; বিদ্যাসাগরের গদ্যের ঋজু অন্বয়ের দৃঢ়তা তিনি কেবল সচেতনভাবেই উপেক্ষা করতে চান নি, বাংলা ভাষার প্রচলিত অন্বয়ের রূপান্তর ঘটিয়ে তিনি এমন এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিতে চেয়েছেন যা পাঠকদের কাছে অপরিজ্ঞাত এবং তার অনুধাবন নিশ্চিতভাবেই শ্রমসাধ্য। বিদ্যাসাগরের ভাষার অন্বয় প্রাঞ্জল এবং শব্দপ্রয়োগ অমোঘ, স্থিরলক্ষ্য, তা পাঠককে অভীষ্ট অর্থের সঙ্গে অনিবার্যভাবে সংযুক্ত করে, কমলবাবুর গদ্য প্রত্যক্ষত তা করে না।

কমল মজুমদারের শেষদিকের সব রচনাই সাধু ভাষায় রচিত। সেই সাধু ভাষা বিদ্যাসাগরের সাধুভাষা নয়, বঙ্কিমচন্দ্রের নয়, এমনকি বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তীকালের সাধুভাষাও নয়। সেই ভাষার প্রসঙ্গে মনে পড়তে পারে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার অথবা রামমোহন রায় এর নাম। এবং সেই মনে পড়ার একমাত্র হেতু তাদের ভাষার অস্থিত অন্বয়-বিন্যাস। মৃত্যুঞ্জয় এবং রামমোহনের অপরিণত অন্বয়ের জটিলতা, বলাবাহুল্য, ইচ্ছাকৃত নয়, তা অবিমিশ্রিত অজ্ঞানতাই, স্বচ্ছ ধারণার অভাব, কমলকুমারের ভাষার জটিল অন্বয় ইচ্ছাকৃতি এবং উদ্দেশ্য-প্রণোদিত।‘

তাঁর ভাষা যে ইচ্ছাকৃতভাবেই এরকম কৃত্রিম, সেটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। যাঁরা তাঁকে জানতেন, তাঁরা জানেন যে, কমলকুমার তাঁর সাহিত্যরচিত ভাষায় নিজে কখনোই কথা বলেন নি। মধ্য কোলকাতার খাঁটি এক জীবন্ত ভাষায় কথা বলতেন তিনি। তাঁর মুখের ভাষা আর লিখিত ভাষার পার্থক্য শুধু সাগরসম ছিলো না, ছিলো একেবারের পৃথিবীর দুই মেরুর মতো বৈপরিত্যময়। এই বৈপিরত্য দেখে বিস্মিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কমলকুমার মজুমদারের গল্পগ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছেন,

‘কমলকুমারের মুখের ভাষার সঙ্গে তাঁর রচনার ভাষার দুস্তর ব্যবধান আমাদের বিশেষ ভাবে বিস্মিত করেছিল। কলকাতার বনেদী কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম, খাঁটি কলকাতার ভাষায় তিনি কথা বলতেন। কিন্তু তাঁর গদ্য, বিশেষত উপন্যাসের গদ্য, প্রবহমান বাংলা ভাষার চেয়ে একেবারে পৃথক, বাক্য-গঠন রীতি একেবারেই প্রথাসিদ্ধ নয়, যতি চিহ্নের ব্যবহার তাঁর নিজস্ব, কমা অজস্র, পূর্ণচ্ছেদের ব্যাপারে অতি কৃপণ, কখনো কখনো পাতার পর পাতায় পরিচ্ছেদ ভাগ নেই, মনে হয় অসমাপিকা ক্রিয়ায় একটিই বাক্য চলেছে। কমলকুমারের মতন দুঃসাহসী লেখক আমরা বাংলা ভাষায় আর দেখিনি, তিনি নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ‘সবুজ পত্রের’ আমল থেকে সাধু বাংলা একেবারে পরিত্যাগ করেন, চলতি ভাষা গ্রহণ করার পর আর ফিরে যাননি। কমলকুমার চলতি ভাষায় বেশ কয়েকটি গল্প লেখার পর সাধু বাংলা গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি, সাধু ক্রিয়াপদ এবং অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করেছেন বহুল পরিমাণে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ভাষা আধুনিক। তাঁর যে কোনো গ্রন্থের একটি ছিন্ন পৃষ্ঠা পেলেও মনে হবে না, তাতে অতীতের স্পর্শ আছে। তাঁর ভাষা ঠিক দুর্বোধ্য নয়। অতি সরলও নয়, তাঁর যে কোনো রচনাই দ্বিতীয় পাঠ দাবি করে।‘

কমলকুমার মজুমদারের ভাষার এই জটিলতা এবং দুরূহতা নিয়ে প্রবলভাবে কৌতুহলী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বেশ কয়েকবার তিনি তাঁকে জিজ্ঞেসও করেছেন। কিন্তু এই বিষয়ে কখনোই সদুত্তর পান নি তিনি। একেক সময় একেক কথা বলে বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছেন কমলকুমার। সুনীলকে এড়িয়ে গেলেও, নিজের স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদারের কাছে কিছুটা হলেও উন্মুক্ত হয়েছিলেন তিনি। দয়াময়ী মজুমদার তাঁর স্মৃতিচারণমুলক প্রবন্ধ ‘আমাদের কথা’- তে লিখেছেন,

‘একবার আমি ওনাকে প্রশ্ন করেছিলাম ওনার লেখার মধ্যে যে পদবিন্যাসটা দেখতে পাই সেটাতো আমরা ঈশ্বরচন্দ্র, বিদ্যাসাগর বা বঙ্কিমবাবু, যাঁরা বাংলাভাষায় পিতৃতুল্য তাঁদের মধ্যেও দেখতে পাই না। প্রচলিত পদবিন্যাসের ধারাতো এটা নয় – ‘ফজল হয় ভালোলোক’ এটা কেন হোল? উত্তরে উনি যা বলেছিলেন – “এটা অপ্রচলিত নয়, এ ধরণের পদবিন্যাস এককালে ছিল”। আমি আরও দু’একটা কথা জিজ্ঞাসা করায় উনি আমায় একটা বই বের কোরে দেখালেন। বইটা পড়ে আমি তো অবাক। তারপর থেকে আমি আর এ নিয়ে কখনো কথা বলিনি। বইটার পুরো নাম ঠিক মনে আছে কিনা বলতে পারি না তবে প্রথমটা ঠিক মনে আছে ‘ব্রাহ্মণ্য যুগের ভাষা’। ভাষা কথাটা ঠিক কি না মনে করতে পারছি না। অন্য কিছুও হতে পারে। তবে ‘ব্রাহ্মণ্য যুগের ….’ এটুকু ঠিক। আর একবার প্রশ্ন তুলেছিলাম ‘লেখাটা যদি পড়বার জন্যে ছাপা হয়, আর সেটা যদি পাঠকদের কাছে দুর্বোধ্য হয়, তাহলে …? উনি যা বোলেছিলেন, যা মনে আছে, লেখকদের পাঠক তৈরি করার একটা দায়িত্ব থাকে। তবে এটাতো ভাবা ঠিক নয় যে পাঠক মাত্রেই বুদ্ধিহীন হবে, তারা কিছু বুঝতে পারবে না। এই করে করে গোটা জাতটাই নষ্ট হয়ে গেল। তাদের mass ছাড়া ভাবা যাবে না। লেখাটা mass এর জন্য লিখছি ভেবেই লিখতে হবে। তাছাড়া বহু লেখাইতো আছে, এ-লেখাটা না পড়ে তারা অন্য লেখা পড়তে পারে, আমিতো কাউকে পড়তে বলিনি।‘

ভাষার এই দুর্ভেদ্যতার জন্য কমলকুমার মজুমদার থেকে গিয়েছিলেন সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্য জগৎ থেকে দূরে, মূল কেন্দ্র থেকে বাইরে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বৃহত্তম ধাঁধা তিনি। অসাধারণ মানের একজন লেখক তিনি, অথচ কোনো সংকলনে তাঁর গল্প নেওয়া হয় নি, কোনো সাহিত্য সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়নি তাঁকে। আমন্ত্রণ জানালেও হয়তো বা যেতেন না তিনি তাঁর দুর্বোধ্য আচরণের কারণে। অধিকাংশ পাঠকের কাছেই তিনি রয়ে গেছেন অজ্ঞাত, অচেনা, অন্য কোনো গ্রহের সাহিত্যিক হিসাবে। সমসাময়িক অনেক লেখক তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, কিন্তু তাও ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে, সাহিত্যিক হিসাবে নয়। কোলকাতার বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠীর একটা অংশের মধ্যে কমলকুমার সুপরিচিত ছিলেন। অনেক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী তাঁর কাছে ফরাসি ভাষা শিখেছেন। এই ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন তিনি। বিজ্ঞাপন জগতের রথি-মহারথিরা ছিলেন তাঁর আড্ডার সঙ্গী। কিন্তু, তাঁরা কেউই তাঁর রচনার সাথে পরিচিত ছিলেন না। ফলে, তাঁর রচনা কেউ পড়েন নি এক লাইনও। নিজের লেখার দুরূহতা বিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন তিনি। পাঠকের অনাগ্রহের বিষয়টাও জানতেন তিনি। কিন্তু, এ নিয়ে কোনো বিকার ছিলো না তাঁর। কোনো প্রকাশক তাঁর লেখা প্রকাশ করতে আগ্রহী হলে তিনি সত্যি সত্যি অবাক হতেন। সে কারণেই তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘নিম অন্নপূর্ণা’ প্রকাশিত হবার পরে রসিকতা করে বলেছিলেন যে, ‘আমার বই ঊনত্রিশখানা বিক্রি হয়েছিল, তারপর তিরিশজনই দোকানে ফেরত দিয়ে গেছে।‘

তাঁর ভাষার কিছু উদাহরণ দেই। তাঁর প্রথম উপন্যাস হচ্ছে অন্তর্জলী যাত্রা। এটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসও বটে। এই উপন্যাসের শুরু হয়েছে এভাবে। ‘আলো ক্রমে আসিতেছে। এ নভমণ্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিমানীলাভ। আর অল্পকাল গত হিলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে, পুনর্বার আমরা, প্রাকৃত জনেরা, পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। ক্রমে আলো আসিতেছে।‘ এটা হচ্ছে ঊষালগ্নের চিত্র। উপন্যাসের শেষে অন্য এক চিত্র একেছেন তিনি শব্দের মায়াজাল দিয়ে - ‘একটি মাত্র চোখ, হেমলকে প্রতিবিম্বিত চক্ষু সদৃশ, তাঁহার দিকেই, মিলন অভিলাষিনী নববধুর দিকে চাহিয়াছিল, সে চক্ষু কাঠের, কারণ নৌকাগাত্রে অঙ্কিত, তাহা সিন্দুরে অঙ্কিত এবং ক্রমাগত জলোচ্ছ্বাসে তাহা সিক্ত, অশ্রুপাতক্ষম, ফলে কোথাও এখনও মায়া রহিয়া গেল।‘ তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘গোলাপ সুন্দরী’-র সূত্রপাত হয়েছে এভাবে, ‘বিলাস অন্যত্রে, কেননা সম্মুখেই, নিম্নের আকাশে, তরুণসূর্য্যবর্ণ কখনও অচিরাৎ নীল, বুদ্বুদসকল, যদৃচ্ছাবশতঃ ভাসিয়া বেড়াইতেছে। একটি আর একটি এইরূপে অনেক অনেক – আসন্ন সন্ধ্যায়, ক্রমে নক্ষত্র পরম্পরা যেমন দেখা যায় – দূর কোন হরিত ক্ষেত্রের হেমন্তের অপরাহ্ন মন্থনকারী রাখালের বাঁশরীর শুদ্ধনিখাদে দেহ ধারণ করত সুডৌল দ্যুতিসম্পন্ন বুদ্বুদগুলি ইদানীং উঠানামা করে, এগুলি সুন্দর, উজ্জ্বল, বাবু, অভিমানী আশ্চর্য্য! এ কারণেই বিলাস, চমৎকার যাহার রূপ, যে বেশ সুস্থ, এখন অন্যদিকে আপনার দৃষ্টি ফিরাইয়াছিল কেননা এসকল বুদ্বুদ সম্মুখে থাকিয়াও পশ্চাদ্ধাবন করে কিন্তু এ-দৃষ্টিতে তাহার কোনরূপ অভিজ্ঞতা ছিল না, এ কথা সত্য যে, তাই মনেতে নিশ্চয় সে কুণ্ঠিত কেননা ইতঃপুর্ব্বে অজস্র দিনের আত্মসচেতনতার কুজঝটিকার মধ্যে সে একা বসিয়া কবিতা লিখিবার মনস্থ করে – কবি হইবার নয়, যেহেতু, সম্ভবত, রূপকে রূপান্তরিত না করিয়া ভালবাসার শুদ্ধতার দিব্য উষ্ণতা ক্রমে অস্পষ্ট অহঙ্কার পর্য্যন্ত, তাহার ছিল না যদিও – তাহার নিঃসঙ্গতা নাই শুধুমাত্র স্বতন্ত্রতা ছিল।‘

কমলকুমারের ভাষা নিয়ে অনেকেই আপ্লুত যেমন আছেন, তেমনি অনেকে বিরক্তও আছেন। শুধু বিরক্তই না, তাঁর ভাষা যে প্রতিক্রিয়াশীল ভাষা, সেটা বলতেও দ্বিধা করেন নি কেউ কেউ। অশ্রুকুমার সিকদার তাঁর ‘অন্তর্জলীযাত্রা’-র ঘোর বাস্তবতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তুলনাত্মক সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ একজন মনে করেন কমলকুমারের অতি-আধুনিক পরীক্ষামূলক বাকশৈলী বাঙলাভাষা নিয়ে ফুটবল খেলার নামান্তর। ফলে বাঙলা কথাসাহিত্য তাঁর ভূমিকা ‘প্রগতি-বিদ্বেষী, ইতিহাসবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল। তিনি মনে করেন, কমলকুমারের গদ্য ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্গের মতো দুষ্প্রবেশ্য, সেই ভাষা কিছু কমিউনিকেট করে না। ‘

কমলকুমারের ভাষাই শুধু জটিল এবং দুর্বোধ্য নয়, তিনি নিজেও মানুষটাও ছিলেন সেরকমই। অসংখ্য ধরনের বৈপরিত্য ছিলো তাঁর চরিত্রের মাঝে। তিনি ছিলেন নাট্য পরিচালক। চমকপ্রদ ছিলো তাঁর নির্দেশনা। নাট্য প্রযোজনায় নানা ধরনের নতুন পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন তিনি। নাটকে তাঁর কৃতিত্ব প্রমাণিত হবার পরেও, এটিকে সৌখিনতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে পেশাদারী পর্যায়ে নিতে কখনোই তিনি উৎসাহ দেখান নি। কেনো দেখান নি, কেউ জানে না। কাঠখোদাইয়ে শিল্পকর্ম করতেন তিনি, জলরঙে ছবি আঁকতেন, স্কেচও করেছেন অনেক। মন দিয়ে শুধু ছবি আঁকলেও শিল্পী হিসাবে অগ্রগণ্যদের তালিকায় চলে আসতে পারতেন, সেই প্রতিভা তাঁর ছিলো। কিন্তু, সেদিকেও তিনি যান নি। সাহিত্য সাধনাতেও সেভাবে মনোযোগী ছিলেন না কখনো। দুই একবার প্রতিভার দীপ্তি ছড়িয়েই আবার চলে গেছেন অভ্রমালার আড়ালে। আর দশজনের চেয়ে একেবারেই আলাদা হয়ে, এই রকম প্রহেলিকাময় জীবন কেনো যাপন করেছেন, সে রহস্য আজো কাটে নি। কাটবেও না হয়তো কোনো দিন।

সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘কমলবাবু’ প্রবন্ধে এই বিষয়ে লিখেছেন, ‘তিনি মানুষটা ছিলেন একটা বিশেষ ছাঁচে গড়া; আর পাঁচ জনের সঙ্গে সে গড়নে বিশেষ মিল নেই। তাঁকে যে না চিনত, তার কাছে অল্প কথায় মানুষটাকে ফুটিয়ে তোলা আমার সাধ্যের বাইরে। আপাতবিরোধী এতগুলো দিক তাঁর চরিত্রের মধ্যে ছিল যেমন আর কোনো একজন মানুষের মধ্যে দেখিনি। নানান অসামান্য গুণের অধিকারী হয়েও, সেই সব গুণের বর্ণণা দিয়ে সমগ্র মানুষটাকে ফুটিয়ে তোলা যায় না। তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মে তিনি যে শুদ্ধতা যে অসামান্য দরদ ও দীপ্তির পরিচয় দিয়েছেন; তাঁর নাট্যপ্রয়াসে যে সাবলীল ছন্দোময়তা ও নিটোল পারফেকশনিজমের নজির রেখে গেছেন; দেশী-বিদেশী শিল্পকলাবিষয়ক প্রবন্ধে যে অগাধ পাণ্ডিত্য ও তীক্ষ্ণ অনুভুতির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর বেশভুষায় চলনে-বলনে এসবের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল হত। তিনি যেন অত্যন্ত সাধারণ ভাবেই একটি রুক্ষ, অমার্জিত, আটপৌরে চেহারায় নিজেকে সবার সামনে হাজির করতেন। তাঁর কথার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যেত ঠিকই – সত্যি বলতে কি, বাকপটুতায় তাঁর সমকক্ষ কাউকে দেখিনি – কিন্তু প্রথম সাক্ষাতে সেই বাক্যের ধাক্কায় মানুষ টসকে গেছে, এমন উদাহরণের অভাব নেই।‘

তাঁর এই অগাধ পাণ্ডিত্য এমনি এমনিই আসে নি। প্রচণ্ড রকমের পড়ুয়া একজন মানুষ ছিলেন তিনি। সারাক্ষণই বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতেন। বাইরে বের হলে তাঁর কাছে একটা চটের ব্যাগ থাকতো সবসময় । অনেকটা রেশনের ব্যাগের মতো। সেখানে একগাদা বই থাকতো, যেগুলো তিনি সদ্য পড়া শুরু করেছেন। তাঁর পড়ার বাতিক এমনই ছিলো যে তিনি নাকি ফরাসি ভাষা শিখতেন খাটের নীচে লুকিয়ে লুকিয়ে, কারণ পরিবারের সম্মতি ছিলো না এই ভাষা শেখার ব্যাপারে। শুধু তাই নয়, তাঁর স্ত্রী দয়াময়ীর জবানিতে জানা যায় যে, তাঁরা একসময় এমন একটা বাড়িতে থাকতেন, যেখানে মশার ভয়াবহ আক্রমণ ছিলো। মশা শুধু রাতেই নয়, দিনেও ছেকে ধরতো। কমলকুমার মজুমদার সারাদিন মশারির ভিতরে বসে বই পড়তেন। তাঁর বই পড়ার এই বাতিক নিয়ে দয়াময়ী নীচের বাক্যগুলি ব্যয় করেছেন তাঁর ‘আমাদের কথা’ প্রবন্ধে।

‘বাড়ীতে থাকলে আমি ওনাকে কখনও দেখিনি এক মিনিট বই ছাড়া থাকতে। সঙ্গে সঙ্গে চলতো আঁকা অথবা লেখা। এমন ঐকান্তিক আগ্রহ একান্ত নিষ্ঠা আর অক্লান্ত পরিশ্রম, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না যে মানুষের পক্ষে সম্ভব হতে পারে। সত্যি, দিন নেই, রাত নেই, সকাল নেই, সন্ধ্যে নেই, শুধু পড়া আর পড়া, সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কাজ। ছুটির দিনগুলো এইভাবেই কাটতো। কাজের দিনেও যেটুকু সময় থাকতো তার মধ্যে বই এর মধ্যে ডুবে থাকতেন। অনেক সময় আমার নিজেরও রাগ হোতো, কি চব্বিশ ঘণ্টা বই আর বই। পরে বুঝেছিলাম এছাড়া প্রজ্ঞা, ধী, মেধা এ তিনের সংমিশ্রণ হয় না।‘

এই সুগভীর জ্ঞানের কারণেই হয়তো বা কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস ও গল্পগুলির প্রায় প্রত্যেকটিই বিষয়ের গভীরতায় অসাধারণ। এরকম চোখ দিয়ে মানুষের জীবনকে আর কেউ দেখেননি। ভাষার কঠিন আবরণের জন্য তা পাঠকদের কাছে হয়তো সেভাবে পৌঁছোয় নি। কিন্তু, এর মানে এই না যে এগুলো হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। বরং ভবিষ্যৎ কালের জন্য পড়ে রইবে সেগুলো, ভবিষ্যতের উদ্যমশীল রসভোক্তাদের জন্য। তাঁর রচনা আস্বাদনের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক যে ভাষা, সে ভাষা ভয়ঙ্কর সুন্দর, শক্তিশালী, দীপ্তিমণ্ডিত, তারকাখচিত অথচ অসম্ভব দুরূহ। কমলকুমার নিজে মনে করতেন ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে সেই ভাষাকে বাঁচায়।‘ কমলকুমার ভাষাকে আক্রমণ করেছিলেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু ভাষাকে বাঁচিয়েছেন কিনা, তার বিচার করার ভার ভবিষ্যতের সাহিত্যবোদ্ধাদের হাতে নিহিত রয়ে গিয়েছে। আমরা শুধু এটুকুই বলবো যে, বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন ব্যতিক্রমী লেখক, এমন এক শোভা তিনি ছড়িয়েছে, যে শোভা এর আগে আর কেউ দেখাতে পারে নি। এমন কিছু মণি-মানিক্য তিনি হেলায় ছুড়ে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে, যা আর কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিলো না। তাঁকে অনুসরণ করে তাঁর ধারাবাহিকতা রক্ষা করার মতো কেউ আর আসে নি। আসাটাও আসলে সম্ভব ছিলো না।। কমলকুমার এক অনুকরণীয় আভা, এক অনুপম সৌন্দর্য। অসংখ্য তারকাখচিত আকাশে তিনিই একমাত্র চন্দ্র শোভা।

২. মল্লিকা বাহার
কমলকুমার মজুমদার মোট আটটি উপন্যাস লিখেছেন। সেই সাথে লিখেছেন বেশ কিছু ছোট গল্পও। এই সব লেখার বেশিরভাগই ছাপা হয়েছে ‘এক্ষণ’, ‘কৃত্তিবাসের’ মতো লিটল ম্যাগাজিনে। দুই একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে, সেই সময়কার প্রসিদ্ধ এবং জনপ্রিয় কোনো পত্রিকাতেই তাঁর লেখা ছাপা হয় নি কখনো। তাঁর একটা ছোট গল্প আছে, নাম ‘মল্লিকা বাহার’। এই গল্পটা ছাপা হয়েছিলো চতুরঙ্গ নামের এক ছোট পত্রিকায় ঊনিশ শো পঞ্চাশ সালে। চতুরঙ্গের মতো ছোট পত্রিকায় ছাপা হবার কারণেই হয়তো এই গল্পটা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গিয়েছিলো। নইলে এ নিয়ে যে বিস্তর হইচই হতো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এক ব্যতিক্রমী, নিষিদ্ধ এবং কল্পনাতিক্রম্য বিষয় নিয়ে তিনি এই গল্পটি লিখেছিলেন, যা তাঁর সময়ের সাহিত্যিকরা খুব সম্ভবত তাঁদের ভাবনাতেও আনতে পারতেন না।

সুনীল যেমন বলেছেন, ‘মল্লিকা বাহার তাঁর প্রথম দুঃসাহসী, চমকপ্রদ গল্প। এরকম বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প লেখার কথা বাংলায় আগে কেউ চিন্তাও করেননি। গল্পের ভাষা দেখেও বোঝা যায়, এ আমাদের পরিচিত বাংলা ভাষা নয়, বিশুদ্ধ বর্ণনারীতি এর মধ্যে নেই, এর বাক্য গঠন ভিন্ন জাতের। “এখনও মল্লিকার আবক্ষ, সে আপনাকে আর এক ভবিষ্যৎ থেকে অদ্য নিরীক্ষণ করে; কেমনধারা মুখটা হয়ে আছে যে তার, অথবা পুরুষোচিত ক্লান্তি এখানে সেখানে। আয়নার সাক্ষাৎ নীচেই ব্রাকেটে, ওটা পাউডার এটা কাজল এটা এসেন্সের শিশি, তাতে শুধু স্বচ্ছতাই, তেল টসটসে ফিতে, কিছু কাঁটা – এ সকলই সদ্য মৃত কোনও জনের সমারোহ বা; আর যে, এই পুরুষচিত ক্লান্তির ক্ষেত্রে এ সকল যে, ম্রিয়মান, নিষ্ক্রিয়া।“ এই গদ্য বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম মানে না। অথচ অনাস্বাদিতপূর্ব একটা ব্যঞ্জনা যে রয়েছে তা-ও ঠিক।‘

মল্লিকা বাহার শুধু ভাষা ব্যবহারের জন্যই চমকপ্রদ এবং তাক লাগানো গল্প নয়। এর বিষয়বস্তুটাও ভিন্নতর। পুরুষের নিঃসঙ্গতা, কিংবা এক পুরুষের একাধিক নারী গমন কিংবা এর বিপরীতটা বাংলা সাহিত্যে অদৃষ্টপূর্ব কিংবা বিরল কিছু নয়। এ নিয়ে অনেক সাহিত্যকর্মই হয়েছে। কিন্তু, মল্লিকা বাহার এগুলোকে অতিক্রম করে গিয়ে একজন নারীর সাথে অন্য একজন নারীর নিষিদ্ধ সম্পর্ককে তুলে এনেছে বাংলা সাহিত্যে। এই বিষয়বস্তু নিয়ে লেখার সাহস, ইচ্ছা, কিংবা কল্পনা, এর আগে আর কারো হয়েছে বলে মনে হয় না।

মল্লিকা বাহার গল্পটা এমন। মল্লিকা নামের এক মেয়ে হঠাৎ করেই চাকরি পাবার চিঠি পায়। এই চাকরি তাকে স্বাধীনতা দেবে। কিন্তু, একই সঙ্গে তার মধ্যে এই আশংকাও জন্ম নিলো যে, একদিন তার যৌবন ফুরিয়ে যাবে। চাকুরিজীবি মেয়েদের দিকে পুরুষ লোকের আগ্রহ কম। সে এখনও সঙ্গীহীন। একদিন কতো জনে তার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। নিজেরও যে কারো কারো প্রতি আগ্রহ ছিলো না, তাও নয়। কিন্তু, লজ্জার কারণে বা অন্য কোনো কারণে কারো সাথেই প্রেম করা হয়ে ওঠে নি তার।

মল্লিকা হিসাব করে দেখলো যে খুব কাছে প্রায় চার-পাঁচজনই এসেছিলো। কাল থেকে চাকরি শুরু। আজই তার শেষ দিন। এর পরে হয়তো কোনো পুরুষই আর গভীর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করবে না তাকে। মল্লিকা সেজেগুঁজে বের হয় পূর্ব পরিচিত সেই সব ব্যক্তিদের সাথে দেখা করতে। আজ এতোদিন পরে তাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা খায় মল্লিকা। সময়ের নিষ্ঠুর আঁচড়ে বদলে গিয়েছে সব। সেই সব ব্যক্তিদের কেউ সংসারী হয়ে গিয়েছে পাকাদস্তরভাবে, কেউ বা আগের অসাধারণত্ব হারিয়ে হয়ে গিয়েছে নিতান্তই সাধারণ, কেউ বা আবার মল্লিকাকে দেখে ভয় পেয়েছে আচম্বিতে। এগুলো দেখে দেখে ক্লান্ত এবং হতাশ মল্লিকা যখন দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়, তখনই তার সাথে দেখা হয় পূর্ব পরিচিত শোভনা দির সাথে। শোভনা দি তাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে।

‘শোভনার চোখে অন্য এক আলো এসে পড়েছে, তার চোখে মুখে দেখা যাবে পুরুষালি দীপ্তি, যে দীপ্তি, যে কোন রমণী যে সে ঘাটের পথে বাটের পথে চিকের আড়ালে হতে দেখুক, ভাল এ দৃষ্টি লাগবেই।‘ শোভনা যখন হাত বাড়িয়ে মল্লিকার হাত ধরে, মল্লিকা অনুভব করে, ‘শোভনার স্পর্শের মধ্যে কেমন এক দিব্য উষ্ণতা, এ উষ্ণতা বহুকাল বয়সী বহুজন প্রিয়। মল্লিকার এ উষ্ণতা ভারি ভালো লেগেছিলো। কাজেই, সে আর অমত করে নি শোভনা দির বাড়িতে যেতে। শোভনা মল্লিকার হাত ধরে নিয়ে যায় নিজের বাড়িতে। ছাদে গিয়ে মাদুর পেতে বসে দুজনে। গরমের কারণে গায়ের ব্লাউজ খুলে ফেলে শোভনা। অঞ্জলিবদ্ধ ফুলসম্ভার উপহার দেয় শোভনা মল্লিকাকে। খোঁপায়, নয় গলায় পরতে বলে। নিজেই শেষে মল্লিকাকে কাছে টেনে সোহাগ করে মালা পরিয়ে দেয় গলায়।

মল্লিকা বাহার স্পষ্টতই নারীসমকামিতার গল্প। সমকামিতাকে এখনও আমাদের সমাজ গ্রহণ করার মতো উদারতা দেখাতে পারে নি। সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ এবং প্রচলিত সমাজসংস্কৃতিবিরুদ্ধ হিসাবেই ধরে নেয় বেশিরভাগ মানুষ। অধিকাংশ মানুষই এই সম্পর্ককে অশ্লীল আচরণ বলে চিহ্নিত করে এর প্রকাশে সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দেবার চেষ্টা করে। এই সম্পর্ক বিকৃত এবং অস্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তি বলে মনে করা হয়। ফলে, এটি সামাজিক ট্যাবু হিসাবেই রয়ে গিয়েছে সমাজের কাছে। সমকামিতা সামাজিক ট্যাবু বলে লেখক-লেখিকারাও এই বিষয় নিয়ে লেখালেখি করার ঝুঁকি নিতে দ্বিধান্বিত হন। তাঁরা সেই বিষয়েই লিখতে চান, যেটি সমাজসম্মত, অহেতুক প্রবল আন্দোলন তৈরি হবে না জলরাশিতে, তরী যাবে তীরের দিকে তুমুল বেগে।

সমকামিতার প্রতি শুধু আমাদের সমাজই যে শুচিবায়ুগ্রস্থ তা নয়, পাশ্চাত্যেও একে পাড়ি দিতে হয়েছে কঠিন এক সংগ্রামমুখর পথ। ইংরেজি সাহিত্যরের প্রথম স্বীকৃত নারী সমকামিতাভিত্তিক উপন্যাস হচ্ছে র‍্যাডক্লিফ হলের দ্য ওয়েল অব লোনলিনেস। এটি প্রকাশিত হয়েছিলো ঊনিশ শো আটাশ সালে। র‍্যাডক্লিফ হল নিজেও একজন সমকামী ছিলেন। বইটা প্রকাশ হবার পর পরই বৃটিশ কোর্ট এটিতে অশ্লীলতা আবিষ্কার করে ফেলে। কারণ, বইটাতে দুইজন নারীর অস্বাভাবিক কার্যক্রমকে অনু্মোদন দিয়েছে। কোর্টের কারণে বইটা দুই দশকেরও বেশি সময় নিষিদ্ধ থাকে বৃটেনে। একই ধরনের আইনগত চ্যালেঞ্জ বইটা আমেরিকাতে মোকাবেলা করেছিলো। তবে, এখানে ভাগ্য ভালো যে, বইটি নিষিদ্ধ হয় নি। র‍্যাডক্লিফ হল জীবিত থাকা অবস্থায় এই বই আর আলোর মুখ দেখে নি বৃটেনে। তিনি মারা যান ১৯৪৩ সালে আর বইটা বৃটেনে নিষিদ্ধতার জাল ছিড়ে মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে।

সমকামিতার প্রতি আধুনিক সমাজ এতোখানি খড়গহস্ত হবার পরেও, একথা বলা যায় যে, সমকামিতার ইতিহাস বহু প্রাচীন। মানুষের সমকামী হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। যদিও কিছু মানুষ সমকামিতার অঙ্কুর নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। সমকামিতা নিয়ে মানুষের ভুল ধারণা যে সমকামিতার ক্ষেত্র বুঝি শুধু শারীরিক, আসলে সমকামিতা ভীষণভাবে মনস্তাত্ত্বিক, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সমস্যাটাই তাদের বহুদিনের আত্মদমনের সংস্কৃতির পাঠ থেকেই অঙ্কুরিত হয়ে মন ও শরীর দুয়ের মধ্যে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গেছে। ফলে, সঠিক কারণগুলোর সনাক্তকরণ সবসময় সম্ভব হয় না। আধুনিক বিশ্বে নারী সমকামিতা সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে, এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের বহু ক্ষেত্রেই সম্যক ধারণা নেই।

সিমোন দ্য বোভেয়ার তাঁর ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ বইতে লিখেছেন, ‘নারী এমন একটা সত্তা যাকে ব্যবহার করা হয় বিষয় হিসেবে, ফলে তার যৌনক্ষুধা অনেক ক্ষেত্রেই যা পুরুষের দেহে তৃপ্ত হয় না, অতৃপ্ত থেকে যায়। তবে সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা হয় তার গর্ভে একটি শিশুকে স্থাপন করে। কিন্তু এই সমাজবিদিত স্বাভাবিকত্ব কম-বেশি সামাজিক স্বার্থের দ্বারা নির্দিষ্ট। এ বিষয়ে বিষমকামীরাও অন্যান্য সমাধান অনুমোদন করে। সমকামিতা নারীর শরীরের নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে, তার অপারগতার সঙ্গে, তার স্বাধীনতার সমন্বয়ের জন্য অন্যান্য প্রচেষ্টার মধ্যে একটা প্রচেষ্টা। বিভিন্ন মনোবৈজ্ঞানিক সমীক্ষার দ্বারা দেখা গেছে যে, প্রতিটা কিশোরী ভেদকরণ ও পুরুষ প্রাধান্যকে ভয় পায়। পক্ষান্তরে নারীদেহ তার কাছে একটা কামনার বস্তু। এবং পুরুষের কাছেও তা কামনার বস্তু। অন্যদিকে যদি প্রকৃতির কথা বলা হয়, তবে সব নারীই প্রাকৃতিকভাবে সুপ্ত সমকামী প্রবনতাসম্পন্ন। নারীদেহ নারীকে শঙ্কিত করে না, তার বোন ও মায়ের সঙ্গে তার প্রায়ই একটা অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়। যাতে অবচেতনে স্নেহ-ভালবাসা সূক্ষ্ণভাবে যৌন অনুভূতিতে রঞ্জিত হয়। মেয়েদের মধ্যে পারস্পরিক আদর-সোহাগে কোনও কুমারীত্ব নাশের ভয় থাকে না। যৌন ভেদকরণও থাকে না অথচ কৈশোরের যৌন উত্তেজনাতেও তৃপ্ত করে। কুমারী মেয়েটা কোনো নতুন অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা ছাড়াই তার বৃত্তিটা উপলব্ধি করতে পারে।

‘আমাদের দেহ আমাদের শরীরের এক সহৃদয় দর্পণ,
আমাদের চান্দ্র চুম্বনগুলি বিবর্ণ কোমল,
আমাদের আঙুলগুলি নয় বিক্ষত, নাই তাতে ধৃষ্টতার কণামাত্রও
আর বন্ধনী যখন সব আপনা থেকে খুলে যায়
আমরা একই সাথে প্রেমিকা ও ভগিনী।‘

শঙ্করী মুখোপাধ্যায়ও তাঁর 'বাংলা সাহিত্যে নারী সমকামিতা' বইতেও সিমোনের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বণি তুলেছেন, ‘যখন একটি মেয়ে শৈশবে মায়ের প্রাধান্যতা থেকে বেরিয়ে তরুণী হয়ে ওঠে, তখন সে তার মায়ের অধীনতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে চায় ও তার তারুণ্যের পুর্ণতাকে বাইরের জগতে উপলব্ধি করতে উৎসাহ পায়। ফলে সে অন্যের চেতনায় থাকার প্রয়োজনবোধ করে এবং প্রায়ই দেখা যায় যে এই উৎসাহ ও সাহায্য সে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে পেয়ে থাকে এবং বান্ধবীরা তাকে তার যৌনতার বিষয়ে বিভিন্ন নতুন তথ্য জানার বিষয়ে সাহায্য করে। বান্ধবীদের কাছে তার নারীদেহ তাকে শঙ্কিত করে না। কারণ শৈশব থেকেই তার বোনদের সঙ্গে ও মায়ের সঙ্গে তার একটা অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়। যাতে স্নেহ ভালবাসা সূক্ষ্ণভাবে যৌন অনুভূতিতে রঞ্জিত থাকে। এই সময় দুটি বান্ধবী একে অন্যকে পৃথক ভাবে না ও তাদের অহং সীমা ছাড়িয়ে যায় না। এভাবে পরস্পর পরস্পরের কাছে এক প্রকা্র মানসিক আশ্রয় পায়, যা তাদের দুজনকেই নিজের নিজের কাছে আত্মমর্যাদা দেয়। এর ফলে একটি মেয়ে তার বান্ধবীর কাছে নিজের নগ্নদেহ দেখায়, নিজের স্তনের তুলনা করে। যা আমরা বোর্ডিং স্কুল, মেয়েদের হোস্টেল, বেশ্যালয় ইত্যাদি জায়গাগুলোতে প্রায়ই দেখতে পাই। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবে বোনদের মধ্যে এই ব্যাপারগুলো খোলাখুলিভাবে হয়ে থাকে। তার সুস্পষ্টভাবে আদর-সোহাগ বিনিময় পর্যন্ত করে থাকে সেখানে যৌনতার তুলনায় – সমপ্রেমই বেশি লক্ষিত হয়।‘

কিন্তু, মল্লিকা বাহারে শোভনা আর মল্লিকার সম্পর্ক, শঙ্করী মুখোপাধ্যায়ের বর্ণনাকৃত নিষ্কাম সমপ্রেমের নয়, এই সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছে তীব্র যৌনতাও, পরস্পরের প্রতি দুজনের টান থেকে বের হচ্ছে দেহজ প্রেমের মাতাল গন্ধ। মল্লিকা বাহার গল্পের শেষাংশ পড়লে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্রও কোনো সংশয় থাকে না।

‘মল্লিকা বুক যেমন হিম শুধু অতিশয্যেই। আপনকার গলা পরিষ্কার করে বললে, ‘আচ্ছা সে আচ্ছা শোভনাদি … না থাক …?
‘বলো না, বলো না।‘
‘আচ্ছা আপনি কখনও কাউকে ভালবেসে ….’
মল্লিকা, শোভনা তার হাত দুটো ধরে টেনে আপনার কাছে আনল, কাঁচের চুড়ি ভেঙে টুকরো, ভাঙার শব্দ এতই অল্প যে, লোক জড় করলে না অথচ বিজ্ঞরা বলবেন প্রয়োজন ছিল। শোভনা আপনার মধ্যে মল্লিকাকে এনেছে, সোহাগ করে মালা পরিয়ে দিয়েছে, সে মালা তার কণ্ঠে বিলম্বিত, চুম্বনে চুম্বনে শোক ভুলিয়ে দিয়েছে।
এবার শোভনা খাদের গলায়, ‘কই তুমি তো আমায় খেলে না? তুমি আমায় ভালবাসো না?’
‘বাসি!’
‘মল্লিকা শোভনাকে বিশেষ অপটুতার সঙ্গে গভীরভাবে চুম্বন করলে।‘
শোভনা জিজ্ঞাসা করলে, ‘আগে কাউকে কখন এমনভাবে …’
‘হ্যাঁ, আচ্ছা আপনি?’
‘আমায় তুমি বলো, আমি তোমার কে? বলো?’
‘আচ্ছা তুমি?’
‘না’, দৃঢ়কণ্ঠে শোভনা বললে। বোধহয় মিথ্যা হেসে বললে, ‘আমি তোমার স্বামী, তুমি –‘
‘বউ’
শুনে শোভনা আবেগে চুম্বন করলে। শোভনার মুখসৃত লালা মল্লিকার গালে লাগল।‘

রোজামন্ড লেম্যান তাঁর ‘ডাস্টি আনসার’ উপন্যাসে এ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, প্রায় সমস্ত তরুণী মেয়েদের মধ্যে সমকাম প্রবণতা রয়েছে। যে প্রবণতা কদাচিৎ আত্মরতিমূলক উপভোগ থেকে পৃথক করা যায়। অ্যাড্রিয়েন রিচও মোটামুটি একই কথাই বলেছেন। তাঁর ভাষায় ‘প্রত্যেক নারীর মধ্যে রয়েছে একটি নারী সমকামী, সে অভিভুত হয় নারীশক্তি দিয়ে, সে আকর্ষণ বোধ করে শক্তিশালী নারীর প্রতি।‘ মল্লিকা বাহার গল্পের মল্লিকাও সেই একইভাবে আকৃষ্ট হয়েছে পুরুষালি আভা দীপ্ত, শক্তিশালী নারী শোভনা দির প্রতি।

সব নারীর মধ্যে যতোই সমকাম প্রবণতা থাকুক না কেনো, সমাজ এটাকে কখনোই স্বাভাবিক হিসাবে মেনে নিতে পারে নি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীর সমকামকে মেনে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে যে, নারীবাদীরাও চেপে রাখতে চেয়েছে এই বিষয়টাকে। বোনি জিমারম্যান তাঁর ‘যা কখনো ছিলো না’ প্রবন্ধে নারীসমকামবাদকে উপেক্ষার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। পিতৃতন্ত্র স্বীকার করে শুধু বিষমকামকে। এটা তাকে স্বস্তি দেয়, আধিপত্যের অপার আনন্দ দেয়। জিমারম্যান দেখান যে, শুধু পিতৃতন্ত্রই নয়, নারীবাদীরাও দীক্ষিত পিতৃতন্ত্রের বিষমকামবাদে। তাই নারীবাদী সংগ্রহ থেকে বাদ পড়েন নারীসমকামী রেনি ভিভিয়েন ও র‍্যাডক্লিফ হল, বা সংকলিত হয় ক্যাথেরিন ফিলিপস ও অ্যাড্রিয়েন রিচের বিষমকামী বা নিষ্কাম রচনা, যদিও তাঁরা বিখ্যাত নারীসমকামী লেখার জন্য। জিমারম্যান বলেন, ‘যখন পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত কোনো সংগ্রহে থাকে স্ত্রী, মাতা, যৌনসামগ্রী, তরুণী, বৃদ্ধা এবং মুক্ত নারী প্রভৃতি বিভাগ, কিন্তু থাকে না নারীসমকামী – তখন তা বিষমকামবাদ। নারীবাদী সংগ্রহে বিষমকামবাদ – পুংকেন্দ্রিক সংগ্রহে লিঙ্গবাদের মতো – মুছে ফেলে নারীসমকামবাদী অস্তিত্ব এবং লালন করে এ-মিথ্যেটি যে নারী শুধু পুরুষের মধ্যেই খোঁজে কাম ও আবেগের তৃপ্তি, বা একেবারেই খোঁজে না।‘ (নারী- হুমায়ুন আজাদ)

যে নারীসমকাম পশ্চিমেও এতো সংকট মোকাবেলা করেছে, সেই বিষয় নিয়ে লেখার দুঃসাহস যিনি বাংলাতে করতে পারেন, তিনি যে তাঁর সময়ের চেয়ে বহুগুণে এগিয়ে ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই রাখাটা শোভন নয়। এমন একটা সময়ে তিনি এই বিষয়টাকে নিয়ে এসেছেন যখন সমাজ এর জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়, এটা বললে কম বলা হবে, বলা যেতে পারে যে এর অস্তিত্ব সম্পর্কেই ধারণা ছিলো না সমাজের বেশির ভাগ মানুষের। তারপরেও এই গল্প নিয়ে নীতিবাগীশরা খড়গহস্ত হন নি, তেড়ে আসেন নি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সমাজকে শুদ্ধ রাখার অভিপ্রায়ে।
এর কারণ হিসাবে সুনীল গাঙ্গুলী বলেছেন যে, ‘চতুরঙ্গ পত্রিকায় প্রকাশিত এই গল্প অনেকেই ধৈর্য ধরে পড়েন নি, পড়ার চেষ্টা করলেও অনেকে বোঝেননি।‘ আমার নিজস্ব ধারণা অবশ্য ভিন্নতর। এটা ঠিক যে মল্লিকা বাহারে কমলকুমার মজুমদার কঠিন এবং ব্যতিক্রমী ভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু, তাঁর সুহাসিনী পমেটম উপন্যাসের মতো অমন কঠিন ভাষা ব্যবহৃত হয় নি মল্লিকা বাহারে। বরং বলা যেতে পারে যে, শুরুর দিকের তাঁর গল্পগুলোর ভাষা, পরের দিকের তাঁর উপন্যাসের ভাষার চেয়ে অনেক সহজ। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে এ গল্প বুঝতে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। বিশেষ করে শেষের অংশটুকু এতোই সরাসরি বলা হয়েছে যে শিক্ষিত যে কোনো বাঙালির জন্যই সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

এ নিয়ে হইচই না হবার মূল কারণ সম্ভবত এই যে, চতুরঙ্গ পত্রিকার পাঠক সংখ্যা প্রচণ্ড রকমের সীমিত ছিলো। হাতে গোনা অল্প কিছু সংখ্যক কিছু মানুষ গল্পটা পড়েছে। এবং সেই স্বল্প সংখ্যক মানুষ এই গল্পের অর্থ বুঝলেও, এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া কমলকুমার তখন একেবারে অপরিচিত একজন মানুষ সাহিত্যজগতে। তাঁর কোনো লেখা সমাজে সামান্যতম প্রভাব বিস্তার করার মতো অবস্থায়ও ছিলো না। এর অনেক পরে এসে সমরেশ বসু তাঁর বিবর এবং প্রজাপতি উপন্যাস নিয়ে এই সব নীতির কাণ্ডারীদের যে কঠিন সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন, সেটা দেখলেই এই বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যায়। বিবর প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৬৫ সালে। প্রকাশের পরেই একে অশ্লীল ঘোষণা দিয়ে সমরেশ বসুকে নিয়মিত আক্রমণ করা হয়েছে।

১৯৫০ সালে অপ্রস্তুত সমাজে যে বিপ্লবের চিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন কমলকুমার মজুমদার, তারই ফসল হিসাবে পরবর্তীতে অনেক লেখকই বিশেষ করে নারী লেখকেরা এগিয়ে এসেছেন নারীসমকামের এই অনালোকিত বিষয়ের উপরে লেখালেখি করার জন্য। বাধের কারণে আটকে পড়া নদীর প্রবেশমুখের অর্গল খুলে একে সাগরের দিকে ধাবিত করার প্রধান পুরুষ তিনি। মল্লিকা বাহারে যে বাহারি ভাবনা তিনি প্রকাশ করেছেন প্রথমবারের মতোন, সেই বাহারি ভাবনা আজকে নিত্য সত্যি হয়ে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে প্রতিটা ঘরে, প্রতিটা মানুষের মস্তিষ্কলোকে।

আপনার মন্তব্য