ভূপেন্দ্র স্যারের পাঁচটি সমাপ্ত এবং একটি অসমাপ্ত চিঠি

 প্রকাশিত: ২০১৫-১১-১৬ ১২:৩২:১৯

 আপডেট: ২০১৫-১১-১৬ ১২:৩৫:৪৭

ছবি: সংগ্রহ

মিশু মিলন:

স্নেহের দীপালি,

    আশা করি ভাল আছিস। আমি ভাল নেই, মা। আমার মন ভীষণ ভারাক্রান্ত। মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়েছে। এখন অপেক্ষা সূর্যাস্তের। সারাদিন জামরুল গাছের তলায় আরামকেদারায় শুয়ে-বসে আমার দিন কাটে। বিকেলের দিকে কখনও সখনও রাস্তায় একটু হাঁটা-হাঁটি করি।  

এখন আমার সঙ্গী কেবল স্মৃতি। সম্পদও বলতে পারিস। স্ত্রী পৃথিবীর মায়াজাল ছিন্ন করার পর থেকে স্মৃতি-ই আমার দিবারাত্রির সার্বক্ষণিক সঙ্গী। আমি স্মৃতির অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াই মনের আনন্দে। সেখানে কেবল তোরা, আমার হাজার হাজার কচি কচি প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীর মুখ। আমি তোদের সাথে কথা বলি, হাসি, দুষ্টুমি করলে ধমকাই, আবার কাঁদিও। বলতে পারিস আমি এখন তোদের সঙ্গেই সময় কাটাই। তোরা হয়তো অনেকেই এখন তোদের শৈশব ভুলে গেছিস। কিন্তু তোদের এই বুড়ো মাষ্টার মশাই অনেক যত্নে বুকের বয়সী জীর্ণ কুঠিরে জামা করে রেখেছে তোদের শৈশব। বয়সের ভারে কিছু কিছু হয়তো খোঁয়া গেছে। কিন্তু যা আছে তাও নেহাত কম নয়!  

আমি জামরুল তলায় বসে থাকি আর দুটো টিয়াপাখি এসে নিশ্চিন্তে জামরুল খায়। আমি ঘাড় উঁচিয়ে ওদের খাওয়া দেখি। দেখতে বেশ লাগে! ওরা আমাকে তোয়াক্কাও করে না। বুড়ো হয়ে গেলে যা হয় আর কি! মানুষ, পশু-পাখি সবাই তার অক্ষমতা বুঝে যায়। এর ভেতরেই আমার কোন ছাত্রী-ছাত্রীর ভাল কোন খবর পেলে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। তাদের সাফল্যের কোন খবর শুনলে গর্বে আমার বুকটা ভরে ওঠে। মনে হয় আমার জীবনটা সার্থক। ধন্য আমার শিক্ষকতা জীবন। কিন্তু আজকাল ভাল খবরের চেয়ে মন্দ খবরই বেশি আসে।      
                  
    আমার মনে পড়ছে, তুই যেদিন সরকারী নার্সের চাকরিটা পেলি, সেদিন বিকেলেই আমার কাছে ছুটে এসেছিলি। আমাকে প্রণাম করে, আমার বুকে মুখ গুঁজে অবোধ বালিকার মতো এমনভাবে কেঁদেছিলি, যেন পুতুলের বিয়ে ভেঙে দিয়েছে কোন দস্যু ছেলে! কাঁদতে কাঁদতে তুই বলেছিলি, ‘স্যার, আপনি আশির্বাদ করবেন, আমি যেন সততার সাথে সারাজীবন মানুষের সেবা করতে পারি।’
    আমিও চোখের জল ফেলেছিলাম। তারপর তোকে প্রাণভরে আশির্বাদ করেছিলাম।  

    সেদিন তোর বাবার কথা আমার ভীষণ মনে পড়ছিলো। এই যেমন আজ তোকে চিঠি লিখতে বসে মনে পড়ছে তোর বাবা নিরাপদ’র কথা। তোর বাবা আমায় বলতো,‘মাষ্টারমশাই, আমি তো ল্যাহাপড়া শিহি নাই। অভাবের নাগি ছাওয়াল দুইডারেও কামে নাগায়ে দিলাম। মিয়াডারে আপনি এট্টু পড়ায়ে-শুনায়ে মানুষ করে দ্যান। যাতে পরের ঘরে যায়ে নাত্তি-গুত্তো না খায়।’
হাতেখড়ি থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত আমি তোকে পড়িয়েছি। কোনদিন একটা পয়সা নিইনি। একবার তোর বাবা পুজোর সময় একটা ধুতি আর গেঞ্জি উপহার দিয়েছিল আমাকে। আমি ওকে খুব করে ধমকেছিলাম। বলেছিলাম, ‘আগে মেয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক, একটা ভাল চাকরি পাক। তারপর আমাকে কিছু উপহার দিতে চাইলে ও দেবে। তুই দেবার কে রে? মেয়েকে একটু ভাল খাওয়াতে পারে না, আবার আমাকে ধুতি দেবার ফুটানি!’

    আমার পায়ে পড়ে কেঁদে-কেটে তোর বাবা বলেছিল, ‘এইবারের মতো নিয়ে আমারে ক্ষমা করেন মাস্টার মশাই। এমন ভুল জীবনে আর হবেন না।’
    তোর বাবা কষ্ট পাবে বলে আমি শেষ পর্যন্ত সেই উপহার গ্রহণ করেছিলাম।

    এর ক’দিন বাদেই তোর বাবা ভীষণ অসুখে পড়লো। ভাল মতো চিকিৎসাও হলো না টাকার অভাবে। এক শীতের ভোরে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিল তোর বাবা। সেই ভোরবেলা তোদের বাড়িতে গিয়ে দেখি তোর মা আর তোরা তিন ভাই-বোন বাবার লাশের পাশে বসে কাঁদছিস। তখনও তুই ফ্রক পরিস। তোর স্মরণে আছে কিনা জানিনা, যে তোর বাবা চিকিৎসার অভাবেই মারা গিয়েছিল। যাইহোক, আজ আমিও জীবনের অন্তিমলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু জীবনের এই বেলাভূমিতে এসে যে এত ব্যথা পাব তা কোনদিন ভাবিনি।  

মাগো, কিছুদিন আগে আমাদের গ্রামের সুনীল পায়ের জখম নিয়ে তোদের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলো। তোর ওপর বিশ্বাস আর ভরসা করেই এখানকার লোকজন তোদের হাসপাতালে যায়। গ্রামের মেয়ে বলে কথা! তারা তোর কাছ থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা আশা করে, আবার তোকে অন্ধের মতো বিশ্বাসও করে। কিন্তু মা, তুই তাদের সরল বিশ্বাসে এভাবে পদাঘাত করবি তা আমি কোনদিন কল্পনায়ও ভাবিনি। তুই নিজের আগ্রহে ওদের কাছ থেকে টাকা আর প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ আনতে যেতি। ওরা অন্ধের মতো তোর হাতে টাকা দিত। কিন্তু তুই যেসব ওষুধ আনতি তা বড্ড দামী। সুনীলের ছেলেটা কি মনে করে একবার দোকানে গিয়ে একটা ওষুধের দাম জ্ঞিসাসা করে জানতে পারে, একই ওষুধ তুই দ্বিগুণ দামে কিনেছিস। এরপর সব ওষুধের দাম জানার পর ও দেখতে পায়, তুই কোনটা দেড়গুণ, কোনটা দ্বিগুণ দাম নিয়েছিস। মাগো, এই কী বিশ্বাসের প্রতিদান! গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা আর কাকে বিশ্বাস করবে!       
         
    ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ক’দিন আগে আমাদের পাড়ার একজন ডাক্তার দেখাতে গিয়ে তোর বাসায় উঠেছিল। তোর ওখানে ছিল দু’দিন। তুই তখন হাসপাতালে। তোর স্বামীও বোধ করি অন্যত্র ছিলো। বাসায় ছিল সে আর তোর ছোট ছেলে-মেয়ে দুটো। তোর ছেলে-মেয়েরা ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি করতে করতে হঠাৎ একটা বস্তা ফেলে দেয়। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে গাদা গাদা ওষুধ। তখন সে তোর ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, ‘এতো ওষুধ কোথায় পেলো?’

‘মা হাসপাতালে চাকরি করে তো, তাই হাসপাতাল থেকে এই ওষুধ মাকে দেয়।’ তোর ছেলের সরল উত্তর।
    ‘এই ওষুধ দিয়ে কী করে তোমার মা?’

    ‘ঐ যে... ওষুধের দোকানের ভজন কাকা আছে না, ভজন কাকা এসে নিয়ে যায়। তারপর বেচে দেয়।’
তোর ছেলে এখনও ছোট তো, তাই জটিল তত্ত্ব আর মিথ্যে বলতে এখনও শেখেনি। কিন্তু একবার ভাব তো মা, এখন না হয় ছেলেকে একটা বুঝ দিয়ে রেখেছিস। কিন্তু বড় হয়ে ও যখন সত্যি সত্যি ওষুধ রহস্য উন্মোচন করতে শিখবে, তখন মা হিসেবে নিজের ছেলের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবি তুই!

ভাবছিস, আমি বুড়ো মানুষ। কোথাও যাই না। অথচ এত কথা কী করে জানলাম! মাগো, বুড়ো হয়েছি সত্য। কিন্তু চোখ-কান তো আর বন্ধ রাখতে পারিনা। বিশ্বাস কর তোর সম্পর্কে এইসব কথা আমি বিশ্বাস করতে চাইনি। কিন্তু এমন একজন মানুষ বলেছে যে, তাকে অবিশ্বাস করা মানে নিজেকে অবিশ্বাস করা। সুনীলের ছেলের মুখ থেকেও আমি ঘটনাটা শুনেছি। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছি।

তাছাড়া তুই চাকরিতে ঢুকেছিস এই বারো বছর হলো। আমাদের গরীব দেশ। গরীব দেশের সরকার তোদের যথার্থ পারিশ্রমিক দিতে পারে না এটা সত্য। যা দেয় তা দিয়ে মফস্বল শহরে মোটামুটিভাবে একটা সংসার চলে যাবার কথা। কিন্তু মা, তুই শহরে জমি কিনেছিস, তিনতলা বাড়ি করছিস। গ্রামের দিকেও জমিজমা কিনছিস। তোর বাবার বাড়ি-শ্বশুরবাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থাও আমার অজানা নয়। তাই কেউ আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে না দিলেও আমার বুঝতে অসুবিধার কথা নয়। তোর সম্পর্কে আরো নানাবিধ কথা আমি শুনতে পাই। যার কোনটাই শ্র“তি সুখকর নয়।  

    চারিদিকে এখন তোকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সুনীলের ব্যাপারটার পর থেকে আরো বেশি। আমি তোর কথা সবাইকে গর্ব করে বলতাম মাথা উঁচু করে। আমার সেই মাথা তুই হেঁট করে দিয়েছিস। সবাই যখন বলে, আপনার ছাত্রী এই করেছে, সেই করেছে। আমি মরমে মরে যাই, লজ্জায় মাটিতে মিশে যাই!   

এগারো-বারোটি বছর বছর আমি তোমাকে পড়িয়েছি। তোর বাবাকে ধমকে আমি বলেছিলাম, ‘মেয়ে লেখাপড়া করে মানুষ হবার পর ও আমাকে কিছু উপহার দিলে আমি নেব।’  
মাগো, আজ আমি নিজেই তোর কাছে একটি উপহার চাইছি। আমাকে নিরাশ করিস না তুই। এই বৃদ্ধের আকুতিটুকু শোন। তুই হাসপাতাল থেকে দরিদ্র রোগীদের বঞ্চিত করে যে ওষুধগুলো বাসায় আনিস, তার মধ্যে নিশ্চয় দু-চার পাতা ঘুমের ওষুধও থাকে। দয়া করে এই বৃদ্ধকে দু-পাতা ঘুমের ওষুধ পাঠাতে পারিস মা? যাতে করে আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্কে এমন কথা আর শুনতে না হয়, ঘুমের ওষুধ খেয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়তে পারি! 
                           
 ইতি
একজন হতভাগ্য শিক্ষক
শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত


প্রিয় ইমতিয়াজ,
    এই বছর বড্ড শীত পড়ছে। দুদিন ধরে আমি বলতে গেলে ঘর থেকেই বের হই না। বাইরে ঘন কুয়াশা আর বাতাস। ঘরে বসে বসে কেবল টিভি দেখি। খবরে দেখলাম তুই রংপুর গিয়েছিলি। তোর গায়ে পাতলা একটা শার্টের ওপর ব্লেজার। ওতে কী উত্তরবঙ্গের শীত মানে! তোদের বংশে কিন্তু হাঁফানীর রোগ ছিল, তোর দাদার। মন্ত্রী হয়েছিস বলে সাধারণ মানুষ না হয় তোর কাছে ভিড়তে পারে না। তা বলে অসুখ-বিসুখও যে ভিড়বে না তাতো নয়! শীতের সময়টা একটু সাবধানে থাকিস বাবা।

    দিন দশেক আগে তোকে ফোন করেছিলাম। তোর পি, এ ফোন ধরেছিল। বললো, ‘স্যার মিটিংয়ে।’
দু’দিন পর আবার ফোন করেছিলাম। এবারও বললো, ‘স্যার মিটিং এ।’
    তারপর আবারও ফোন করেছিলাম। এবার ফোনই ধরলো না।

    ইমু, গেল শীতের আগের শীতে তুই বলে গিয়েছিলি, ছয় মাসের মধ্যে আমাদের গ্রামে একটা খেলার মাঠ তৈরি করে দিবি। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম শুনে। জানিস, এখনকার ছেলে-মেয়েদের শারীরিক গঠন হচ্ছে ভীষণ দূর্বল। তার কারণ, এরা বিশেষ খেলাধুলা করে না। ঐ যে তোরা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিস প্রযুক্তি, ছেলেমেয়েরা তাই নিয়েই মেতে আছে। উঠতি ছেলে-মেয়েদের কেবলই দেখি নাওয়া-খাওয়া ভুলে মোবাইল টিপছে। আগে খেলাধুলার হইহুল্লোরে বিকেলটা সরগরম হয়ে থাকতো। আর এখন বিকেলটা যেন মরে গেছে!
    অবশ্য আমি একতরফা এইসব ছেলে-মেয়েদের দোষ দিই না। ওরা খেলবেই বা কোথায়!

বাংলাদেশ দল ফুটবল কিংবা ক্রিকেটে জিতলে সকল কৃতিত্ব সরকারী দল নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেয়। বিরোধী দলও ছেড়ে কথা বলে না। তোরা স্বপ্ন দেখাস জনগণকেÑবাংলাদেশ সহসাই বিশ্বকাপ জিতবে। মিথ্যে স্বপ্ন। বাবারে, বিশ্বকাপ খেলাটা হয় মাঠে, মোবাইলে নয়। বিশ্বকাপ জেতার জন্য যে পরিকাঠামো দরকার তা কী তোরা তৈরি করতে পেরেছিস? কয়টা গ্রামে খেলার মাঠ আছে বল দেখি? বাংলাদেশের ছেলেরা জিতুক বা না জিতুক, ওরা যে দেশের জার্সি গায়ে মাঠে দৌড়ে বেড়ায় ওতেই আমি ওদেরকে বাহবা দিই।

    গ্রামের যে হালটটা ছিল, যেখানটায় আমরা শৈশবে ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা খেলেছি। তোদের সময়েও হালটটা খেলার উপযোগী ছিল। তোরাও তো ওখানেই খেলাধুলা করে বড় হয়েছিস। এখন আর হালটটা নেই। দু’পাশের জমিওয়ালারা হালটটা কেটে জমি বানিয়ে ফেলেছে। হালটটের ওপর দিয়ে এখন কোনমতে একটা গরুর গাড়ি যেতে পারে!
    সারাটা বিকেলবেলা উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের মোবাইলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকাটা খুব একটা শুভ লক্ষণ নয়। এতে করে ওদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে বলেই আমার মনে হয়। তাই মাঠের ব্যাপারটা তোকে পুনরায় স্মরণ করাতেই এই চিঠি।

    একটা দুঃসংবাদ দিই তোকে। তোর ছেলেবেলার বন্ধু শরিফুল মারা গেছে। শেষদিকে টাকার অভাবে ওর চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তুই ওকে আশ্বাস দিয়েছিলি কিছু সাহায্যের। কাজের চাপে হয়তো ভুলে গেছিস।

যাক, বিনা চিকিৎসায় ভুগার চেয়ে মরে যাওয়াই বুঝি শ্রেয়! মারা যাওয়ার দুদিন আগেও শরিফুল তোকে নিয়ে গর্ব করে অনেক কথা বলেছিলো আমাকে। ও তোকে ভীষণ ভালবাসতো। আমি চোখ বুঝলেই দেখতে পাই, তুই আর শরিফুল গলাগলি ধরে হেঁটে যাচ্ছিস। হাফপ্যান্ট পরা, গায়ে স্যান্ড গেঞ্জি। দুজনেরই খালি পা, হাঁটু পর্যন্ত ধুলোর আস্তরণ!  তোর প্যান্টের পিছনে তালি মারা!  
    ইমু, আমার শরীরটাও ভাল না। তাই দুই বসায় এই চিঠিটা তোকে লিখতে হচ্ছে। কবে হয়তো শুনতে পাবি, শরিফুলের মতো আমিও নেই। তাহলে আমিও বেঁচে যাই। দুনিয়ার যত অনাসৃষ্টি কান্ডকারখানা আমাকে দেখতে হবে না। শুনতে পাচ্ছি আজকাল ক্লাস ফাইভের প্রশ্নপত্রও ফাঁস হচ্ছে। শিক্ষা বলে কী আর কিছু থাকবে না! ক্লাস ফাইভে এমন ঘটা করে পরীক্ষা রাখার দরকারটা কী বল তো! ওরা শিশু, ওদেরকে শিশুতোষ আনন্দটুকু উপভোগ করতে দেনা!

      আজকাল চাকরির বাজারটাও সত্যি সত্যিই মাছের বাজার হয়ে গেল! যার টাকা বেশি সেই বাজারের বড় মাছটি কেনে। যার টাকা কম সে কেনে চুনোপুঁটি। আর যার টাকা নেই, সে মাছের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চাকরির বাজারটাও এমন হয়েছে!

যার হয়তো যোগ্যতা আছে ফলের দোকানদারের, সে হয়ে যাচ্ছে খাদ্য ও পুষ্টি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। যার হয়তো যোগ্যতা আছে গ্রাম্য যাত্রাপালায় কৌতুক অভিনেতা হওয়ার, সে হয়ে যাচ্ছে কালচারাল অফিসার। যার হয়তো যোগ্যতা পোস্ট অফিসের বাইরে বসে খামের ওপর ঠিকানা লেখার, সে হয়ে যাচ্ছে স্কুলের শিক্ষক।

তুই কী জানিস, শহরের মতো গ্রামেও এখন প্রাইমারী স্কুল ক্রমশ মূমুর্ষ হয়ে পড়ছে? যে সে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হচ্ছে, অবিভাবকেরা প্রাইমারী স্কুলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আর এই সুযোগে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন। যাদের মূখ্য উদ্দেশ্য শিক্ষা দান নয়, মুনাফা অর্জন।            

শিক্ষকের কাজ কী শুধু পাঠ্যবই দেখে ছেলেমেয়েদের পড়ানো! এর বাইরে আর কিছু কী নেই? আজকাল দেখতে পাচ্ছি শিক্ষকেরা কোমলমতি শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন করছে। ছিঃ! কী লজ্জা! আমার ভাবতেও লজ্জা হয় যে একদিন আমি এই পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলাম!

    ইমু, তোর মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ। কোনটাই অমুলক নয়। তোর উচিত ছিল ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে নিয়ে আরো আগেই পদত্যাগ করা। কিন্তু তা না করে তুই সমস্তই অস্বীকার করছিস আর গড়গড় করে মিথ্যা বলছিস। যে সব বিজ্ঞজনেরা সমাজের মঙ্গল চান, তাদের পরামর্শের জবাবে তুই ভীষণ উদ্ধত আচরণ করছিস। অথচ এই আমি তোকে শিখিয়েছিলাম, সমালোচক পরম বন্ধু! কী হতো তুই যদি পদত্যাগ করতি? তুই হয়তো একটা উঁচু পদ হারাতি, মানুষ হিসেবে তো তুই উঁচুতে থাকতে পারতি। এখন তুই উঁচু পদে আছিস ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তি ইমতিয়াজ তুই অনেক নিচে মেনে গেছিস!   

তুই দেশের একজন সম্মানিত মন্ত্রী। অথচ তোরই এলাকার লোকে যখন তোকে চোর, জোচ্চর বলে গালি দেয়, তখন তোর শিক্ষক হিসেবে আমার বুকে বড় বাজে রে! সহ্য করতে কষ্ট হয়। অথচ সহ্য না করেও উপায় নেই!  

    যাকগে, অনেক অপ্রিয় কথা বললাম। তোর হয়তো ভাল লাগবে না। কুশলে থাকিস। বৌমা, ছেলে-মেয়েদের আমার øেহাশীষ জানাস।           

   ইতি
 একজন দুঃখ ভারাক্রান্ত শিক্ষক
 শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত


হাসান,
    তিন গ্রামের মাঝখানে তুই যে বিশাল মসজিদটা তৈরি করে দিয়েছিস, ওখানে এখন শতশত মুসল্লি নামাজ পড়ে। আমি মাঝে মাঝে রাস্তায় একটু হাঁটাচলার জন্য বের হলে দূর থেকে দেখি। মসজিদের সাদা রঙ রোদে ঝলমল করে। নামাজ পড়ে আসা-যাওয়ার পথে অনেকের সঙ্গে আমার কথাও হয়। ওরা তোর ওপর ভীষণ খুশি। তোকে প্রাণখুলে দোয়া করে, যেন একদিন তুই দেশের সেরা শিল্পপতি হতে পারিস। আমিও তোকে সেই আর্শিবাদ-ই করি।

    আমি তোকে অনুরোধ করেছিলাম একটা পাঠাগার তৈরি করে দিতে। যাতে ছেলেমেয়েদের সৃজন-মননের ভিতটা ছোট থেকেই পোক্ত হয়। আর আমরা বুড়োরাও মাঝে মাঝে গিয়ে কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে পারি। তুই আমায় কথা দিয়েছিলি, খুব দ্রুত পাঠাগারটি নির্মাণ করে দিবি।

অনেকদিন তো হলো, তুই বোধ হয় ভুলে গেছিস। ব্যবসায়ের কাজে তোকে দেশে-বিদেশে কত জায়গায় ছুটতে হয়! তুই এলাকায় আসার সময়ও পাস না তেমন। শুনলাম, চরের দিকে তুই একটা মাদ্রাসা তৈরি করে দিচ্ছিস। কাজও নাকি অনেকটা এগিয়েছে। পাঠাগারটাও যে খুব প্রয়োজনীয় বাবা। তবে এখন আর তোর ওপর জোর করবো না আমি।

হাসান, তোর মনে আছে একবার ক্লাসে তোকে ছাড়া আর সবাইকে আমি কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম! কবিতা মুখস্ত করতে দিয়েছিলাম। দু’দিন ছুটি পেয়েও একমাত্র তুই ছাড়া আর কেউ-ই কবিতাটা মুখস্ত বলতে পারেনি। তুই কী সুন্দর মুখস্ত বলেছিলি
        ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
         সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি..’
টিভির খবরে দেখলাম, খাদ্যে ভেজাল এবং বিষাক্ত দ্রব্য প্রয়োগের অপরাধে ভ্রামাম্যান আদালত তোর কোম্পানীকে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা করেছে। জানিস, আমি এতদিন তোর কোম্পানীর খাদ্যদ্রব্য খেতাম। অন্যদেরও বলতাম, হাসান আমাদের ঘরের ছেলে। তোমরা সবাই হাসানের কোম্পানীর খাদ্যদ্রব্য খাবে। রোজ সকালে এক কাপ রং চায়ের সঙ্গে তোর কোম্পানীর গোল গোল পাতলা ঐ বিস্কুটা আমার চাই-ই চাই। বিষ খেয়েছি আমি। টিভিতে নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না, হাসান এভাবে মানুষ ঠকাতে পারে! এখন নিজের কাছে বড্ড অপরাধ বোধ হচ্ছে। কেননা নিজে তো খেয়েছি-ই, অন্যদেরকেও ঐ বিষ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।

হাসান, তুই একদিকে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে মানুষের ইহকাল পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করছিস, অন্যদিকে বিষাক্ত খাদ্য খাইয়ে তাড়াতাড়ি পরকালে যাবার ব্যবস্থা করছিস। কী বিষ্ময়কর বৈপরীত্য!

শুনলাম, রাজনীতিতে নামবি। তাই বুঝি চতুর্দিকে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করছিস। অবশ্য ভোটের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য মসজিদ-মন্দির, মাদ্রাসা খুব ভাল নিভৃত হাতিয়ার। একটা পাঠাগার আর কয়টা ভোট টানতে পারে বল! বরং পাঠাগার মানুষের চোখ খুলে দিয়ে ভোট ছিনিয়ে নেয়। মানুষকে প্রতিবাদী করে তোলে। তাই বুঝি পাঠাগার নির্মাণে তোদের এত ভয়! এত অনীহা!

আমি ভেবে পাইনে, মানুষ আজকাল এক জীবনে এতো কিছু হতে চায় কেন? অনেক কাজ করতে চায়, অথচ কোন কাজই সঠিকভাবে করতে পারে না। একজন সৎ, আদর্শবান শিল্পপতি হতে পারলি না, অথচ এরই মধ্যে জনসেবার নামে রাজনীতিতে নামার পায়তারা করছিস। হুম, জনসেবা! কল্যাণ হোক তোর।    

 ইতি
একজন আর্তপীড়িত শিক্ষক
শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত


স্নেহের দেবাশিষ,

    বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছি, তোকে একখানা চিঠি লিখবো। তা আর হয়ে উঠছিল না। বড্ড গরম পড়েছে। গ্রামে তো কারেন্ট গেলে আর আসতেই চায় না। গরমে বড় কাহিল হয়ে পড়েছি। শরীরটা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। শেষে আজ অনেকটা শরীরের ওপর জুলুম করেই কলম ধরলাম।

    তোর বাবা সেদিন খুব দুঃখ করছিল, বাড়িতে আসা তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিস, খরচা-পাতিও নাকি তেমন পাঠাচ্ছিস না। তোর দাদা শুধু কৃষির ওপর নির্ভর করে সংসারটা কী করে চালাবে বলতো! তোর বাবা, তোর দাদাকে স্কুল ছাড়িয়েছিল কেন জানিস? তোকে পড়াবে বলে। শুভাশিষও যে লেখাপড়ায় খুব একটা খারাপ ছিল তা নয়। কিন্তু তোর বাবার সামর্থ্য ছিল না তোদের দু’জনকে পড়াবার। কেবল তোরা দু’জনই তো নস, ঘর ভর্তি আরও মেয়ে ছিল তার। তাদেরকে না পড়াক, অন্তত দুটো খেতে তো দিতে হতো! তুই লেখাপড়ায় শুভাশিষের চেয়ে ভাল ছিলি বলে তোকে রেখে শুভাশিষকে স্কুল ছাড়ালো তোর বাবা। তাই তোর জীবনে তোর বাবার চেয়ে তোর দাদার অবদান কিছু কম নয়। শুভাশিষ ওর প্রদীপটা তোকে দিয়ে নিজে অন্ধকারে যাত্রা শুরু করেছিল। তারপর থেকেই ও নিজেকে নিংড়ে দিয়েছে সংসারের জন্য।

    যাইহোক, পারিবারিক এই ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়ে বলার জন্য তোকে লিখতে বসিনি আমি। লিখতে বসে তোর বাবার কথাগুলো হঠাৎ মনে পড়লো তাই লিখলাম। তাছাড়া আমি গ্রামের অতি সাধারণ একজন স্কুল শিক্ষক ছিলাম। আর তুই ঢাকা শহরের নামী কলেজের শিক্ষক। তোর জ্ঞান আমার চেয়ে ঢের বেশি একথা স্বীকার করতে আমার কোন লজ্জাবোধ নেই। তাই তোর জ্ঞানে যেটা ভাল মনে হয় তাই করিস তুই।

    শুনলাম, কোচিং সেন্টার খুলেছিস, ঢাকায় অনেকগুলো শাখা তার। আজকাল শিক্ষার নামে বেশ এক রমরমা বাণিজ্য চলছে। আমাদের সময়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ক্লাসের বাইরের সময়টুকু লেখাপড়া-গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। প্রতিনিয়ত নিজেকে ঝালাই করে পান্ডিত্য অর্জন করতেন। আর তার প্রতিফলনও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে, সমাজের স্তরে স্তরে দেখা যেতো।
    আর এখন শুনি যে, শিক্ষকেরা নিজ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নিতেই বেশি আগ্রহী। কোচিং সহ নানান রকম বাণিজ্যের দিকেই তাদের মনযোগটা বেশি। আজকাল শুরু হয়েছে আর এক নতুন উৎপাত। টিভি খুললেই দেখি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা টক শো তে গলাবাজি করছে। একদল সরকারের পক্ষে সাফাই গাইছে, আরেক দল সরকারের বিরুদ্ধে কথার কামান দাগাচ্ছে। নিরপেক্ষ কথা বলার মতো লোকটি আজ আর দেখি না।

    সময়ের অগোচরে কখন যে শিক্ষকতাও আর পাঁচটা বাজারে পেশার মতো হয়ে গেল, তা বুঝতেই পারলাম না। শিক্ষকেরাই যদি জ্ঞানচর্চা ছেড়ে দেয়, তবে অন্যদের আর কী বলার থাকে!
    শুনলাম টাকার বিনিময়ে আজকাল অনেককে সরকারী চাকরি পাইয়ে দিচ্ছিস। তোর বাবা-ই বললো। লোকমুখেও শুনেছি। প্রাইমারীর শিক্ষক, পুলিশ, রেলওয়েসহ নানান সেক্টরে চাকরিভেদে নানান রকম দর হাঁকছিস নাকি! ট্রেনিং কিংবা পরীক্ষার খাতা আনার জন্য ঢাকায় গেলে দেখতাম, ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে হকাররা দর হেঁকে ক্রেতা সারধারণকে ডাকতো। আজকাল নিজেকে ঐ স্তরে নামিয়ে ফেলেছিস! আর তোর মাথার ওপর আশির্বাদের হাত বাড়িয়ে আছে আমারই আরেক কৃতি ছাত্র ইমতিয়াজ!   

আজকাল বড় মনোকষ্টে ভুগি জানিস, কেবলই মনে হয় জীবনটা ব্যর্থ। সারাজীবন কলুর বলদের মতো খেটেছি কিন্তু ফলাফল শূন্য। যেগুলোকে ফল ভাবতাম, ক্রমশই দেখতে পাচ্ছি সুন্দর অবয়বের ভেতর তা কেবলই বিষফল!

আমার যেসব ছাত্রছাত্রী একসময় লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিল, তারা কেউ এখন কৃষক, কেউ শ্রমিক, কেউ হয়তো ছোটখাটো মুদি দোকানদার, কেউ বা পরের ঘরে গিয়ে ঘরসংসারে ব্যস্ত। একসময় ওদের অনেক বকেছি। গাছের পরিপাটি জাম, জামরুল, লিচুর দিকে তাকিয়ে ওদেরকে অতি সহজলভ্য বুনোফল ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি। অথচ এখন দেখতে পাচ্ছি আমার সেই জাম, জামরুল, লিচুগুলোয় শহুরে ফরমালিন মিশে বিষফলে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বুনোফলগুলো স্বাদে কিছু কম হলেও বিষ ধারণ করেনি। মানবজতির জন্য এই বুনোফলই উত্তম। এখন ওদের নিয়ে আমার গর্ব হয়, কেননা ওরা সমাজের অগ্রযাত্রায় খুব বেশি ভূমিকা রাখতে না পারলেও, ওদের দ্বারা কোন ক্ষতিও সাধিত হয়নি।

ওরা যখন মাঠে-ঘাটে কাজ করে, আমি কখনও সখনও হাঁটতে হাঁটতে ওদের কাছে গিয়ে বসে থাকি। ওরা বলে, ‘স্যার এই রোদে বসে থাকবেন না। বাড়ি যান।’
আমি বসেই থাকি। ওরা গোছা থেকে ধানের চারা নিয়ে শক্ত আঙল দিয়ে রোপন করে পেলব মাটির বুক ফুঁড়ে। আমি ভাবি যদি ঐ আঙুলগুলো দিয়ে ওরা কলমটা শক্ত করে ধরে রাখতে পারতো, তবে কি ওরাও আজ হতো কলম সন্ত্রাস!

যাকগে, বয়স হয়েছে তো, কথায় কথায় অনেক কথা বলে ফেলি। ভাল থাকিস তুই। আমি জানি তুই যেভাবে উপরে উঠেছিস বা এখনও উঠছিস, তাতে ওখান থেকে ফেরাটা আর সহজ নয়। তবু যদি পারিস অন্তরচক্ষু দিয়ে একটুখানি দেখিস তো, উঁচুতে ওঠার জন্য তুই যে সিঁড়িগুলো ভাঙছিস তার মাথাটা কোথাও গিয়ে আবার নিচের দিকে কোন অন্ধকারে শেষ হয়েছে কিনা!                                  

 ইতি
একজন হৃতভাগ্য শিক্ষক
শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত


প্রিয় আকবর,
    কেমন আছিস বাবা? তুই কোথায় আছিস, কেমন আছিস, আমি কিছুই জানিনা। তবু আমি আজ তোকে এই চিঠিটা লিখতে বসেছি। তোর বাড়ির ঠিকানায় পোস্ট করবো। আমার বিশ্বাস বাড়ির সঙ্গে তোর কোন না কোনভাবে যোগাযোগ হয়। যে কোন প্রকারেই হোক চিঠিটা তোর হাতে পৌঁছুবে। আকবর, তুই ছিলি আমার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের একজন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবি। পেলি না। আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। তারপর তুই একদিন এসে জানালি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিস। আমি মনকে প্রবোধ দিলাম এই বলে যে, গরীবের ছেলে। মামাবাড়িতে থেকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। যাক, তবু তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। এখন ভালমতো জীবনটা গড়লেই হয়।

    আকবর, তোর মনে আছে হাতেখড়ির দিনের কথা! বোধ হয় নেই। আমার কিন্তু খুব মনে আছে। যেদিনই নতুন কোন ছাত্র বা ছাত্রীর হাতেখড়ি হতো, আমার গিন্নীকে বলতাম পায়েস রান্না করতে। আমি øান করে পড়াতে বসতাম। গিন্নী বাটিতে পায়েস আর ধান-দূর্বা নিয়ে আসতো। হাতেখড়ি হতো, ছোট পরিসরে খাওয়া-দাওয়াও হতো। হাতেখড়ির দিনটা ছিল উৎসবের মতো।
    তোর বেলাতেও তাই হয়েছিল। তুই আঙুলে চক ধরতে পারছিলি না। মুঠো করে ধরছিলি। তোর আঙুলগুলো ছিল খুবই ছোট। আঙুলগুলোর ভেতর চক ঢুকিয়ে তারপর আমি তোর আঙুল ধরে প্রথমদিন তোকে শিখিয়েছিলাম একটি বর্ণÑঅ। এরপর তোকে চক ধরতে শেখাতে আমার ভীষণ বেগ পেতে হয়েছিল। তারপর চক ধরতে না পারা সেই তুই-ই একদিন হয়ে গেলি ব্যাচের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। তুই বুঝতে পারতি কিনা জানি না, কেবল মেধাবী বলে নয়, এমনিতেও আমার খানিকটা বিশেষ øেহের দৃষ্টি থাকতো তোর ওপর। এর কারণ হয়তো বা এই যে তোর বাবা দরিদ্র কৃষক, তুই মামাবাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতি। এছাড়া তুই ছিলি ভীষণ রকমের শান্ত।

    সেই শান্ত ছেলেটি, একদিন আমি যার হাতেখড়ি দিয়েছিলাম, যার হাতে আমি চক আর শ্লেট তুলে দিয়েছিলাম সুন্দর জীবনের আশির্বাদ করে। আমার সেই প্রিয় ছাত্র একসময় সেই একই হাতে তুলে নিয়েছে মানুষের জীবন নাশ করা অস্ত্র! আমি ভাবতে পারিনা আকবর!

    রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একপিঠে আলো, আরেক পিঠে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তুই তো এখানে আলোতেই ছিলি বাবা, আলো থেকে গিয়ে তুই আলো খুঁজে পেলি না। অন্ধকার তোকে কাছে টানলো, অন্ধকার তোকে  গ্রাস করলো!

এখন তোর স্বপ্ন পথ বদলেছে। এখন তোর স্বপ্ন এই দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। এই দেশটা কাফের মুক্ত করা। নানা ছুতো-নাতায় তোরা হিন্দুদের ঘর-বাড়ি, মন্দিরে আগুন দিচ্ছিস। ভাঙচুর করছিস। এই দেশ ছেড়ে চলে না গেলে তাদেরকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছিস। পত্রিকায় একবার তোর মারমুখী ছবিও ছাপা হয়েছিল। আর আমাকে লজ্জায় মুখ লুকোতে হয়েছিল।  
    আকবর, তোদের ভাষায় আমিও তো কাফের রে! এই কাফের তোর হাতেখড়ি দিয়েছে, বর্ণমালা চিনিয়েছে। তোকে শিখিয়েছে অসাম্প্রদায়িক, আদর্শ মানুষ হতে। এই কাফেরের শিক্ষা পেয়েই তুই বড় হয়েছিস। এই দেশটা তো কাফেরমুক্ত করতে চাস, পারবি আকবর এই কাফেরের শেখানো বর্ণমালা মন থেকে মুছে ফেলতে। এই কাফের তোর জন্য যা যা করেছে, পারবি সবকিছু ফিরিয়ে দিতে!

    তোরা এই দেশের ভাষা-সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করিস না। অথচ তোর জীবনের অনেকটা বছর আমি তোকে এই দেশের সংস্কৃতির শিকড় দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম। কী করে যে শিকড় থেকে ছুটে গেলি এ আমার কাছে এক বিষ্ময়!

    আকবর, তোরা তো বলিস, মুসমান মুসলমান ভাই ভাই। কিন্তু তোরা বোমা মেরে যে সব সাধারণ মানুষ মারছিস, তারা সবাই তো কেবল হিন্দু কাফের নয় রে, মুসলমানই মরছে বেশি। তোরা বুকে লালন করছিস পাকিস্থানি আদর্শ। অথচ একদিন ঐ পাকিস্থানি মুসলমানরাই বাংলার মুসলমানের রক্তে ভাসিয়েছিল বাংলার সবুজ বক্ষ। এ কেমন মুসলমান পাকিস্থানিরা, এ কেমন মুসলমান তোরা!  

    আমার শেখানো বর্ণমালার দোহাই আকবর, বোমা মেরে আর একটা মানুষ মারার আগে এই বুড়ো কাফেরটাকে আগে শেষ করে যা। যাতে আমাকে আর দেখতে না হয়, শুনতে না হয় যে আমারই প্রিয় আকবর বোমা মেরে মানুষ মেরেছে! এই কাফেরটাকে মেরে যা বাবা, তাতে তোর ছোয়াব কিছুটা বাড়বে নিশ্চয়!            

  ইতি
তোর কাফের শিক্ষক
শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত


প্রিয় শরীফ,
    আজকাল এসব কী ধরণের টিভি নাটকে অভিনয় করছিস? তোর কী টাকা পয়সার এতই টানাটানি চলছে! আমার তো তেমনটা মনে হয় না। তোর শিল্পরুচি এতো নিন্ম স্তরে কী করে পৌঁছুলো তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। নাকি এতোদিনে মঞ্চ থেকে যে সম্মানটুকু অর্জন করেছিস, এই বয়সে এসে তা এখন বিলিয়ে না দিলেই নয়! তোরও তো বয়স কম হলো না। মাথার চুলে না হয় কলপ দিস, কিন্তু পাকা দাড়ি-গোঁফ লুকোবি কোথায়! নধর শরীরের যা অবস্থা দেখি, একশো মিটারে আমার কাছেও হেরে যাবি বলেই মনে হয়!

    শরীফ, লেখাপড়ার মতো নাটকেও তোর হাতেখড়ি হয়েছিল আমার হাতেই। রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্প অবলম্বনে আমার নাট্যরূপ আর পরিচালনায় তুই অভিনয় করেছিলি মাখন চরিত্রে। ছেলেরা সবাই গুঁড়িসুদ্ধ তোকে উল্টে দিলে তুই উঠে হামলে পড়েছিলি ফটিকরূপী কমলের ওপর। অকাতরে কিল-গুষি মেরেছিলি কমলকে। তুই ভুলেই গিয়েছিলি যে ওটা অভিনয়। পরে তোর নামে আমার কাছে নালিশ করেছিল কমল। আমি কমলকে বুঝিয়েছিলাম এই বলে যে, ‘অভিনয় করার সময় চরিত্রের ভেতর গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে কখনও কখনও এমন হয়। তুই কিছু মনে করিসনে।’

তোকে আর আমি কিছুই বলিনি। কী বলবো! তখন কি তোর অত-শত বোঝার বয়স! তবে মাখন চরিত্রে অভিনয় করে তুই আমার মন কেড়েছিলি। তারপর স্কুলের সব নাটকে তুই অভিনয় করেছিস। গ্রামে পহেলা বৈশাখের নাটকেও অভিনয় করেছিস আমার পরিচালনায়। তোর কচি মনে আমি যে নাটকের বীজ বুনেছিলাম, তা একদিন মহীরুহের আকৃতি পাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন ছন্দপতন হলো!

    তুই যখন ঢাকা গিয়ে নাটক করতে শুরু করলি। তখন তোর বাবা বেঁকে বসেছিল। তোকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল। তুই তোর বাবাকে বোঝানোর জন্য আমাকে চিঠি লিখেছিলি। বাড়িতে আসতে সাহস পাচ্ছিলি না। আমি গিয়ে নাটক আর শিল্প-সংস্কৃতির ভাল দিকটা তোর বাবাকে বোঝাই। বড় কঠিন একটা দায়িত্ব তুই দিয়েছিলি আমাকে। হজ্ব করে আসা একজন মানুষকে নাটকের সুফল বুঝিয়ে, তার ছেলেকে নাটক করার অনুমতি আদায় করা কী সহজ ব্যাপার! যে কিনা হজ্ব থেকে ফিরে টিভিতে খবর দেখাও বন্ধ করে দিয়েছিল! অনেক কষ্টে আমি তোর বাবাকে রাজি করিয়েছিলাম। কিন্তু তোর বাবা আমাকে স্বত্ত্ব দিয়ে বলেছিল,‘শোন মাস্টার, তোমার কথায় আমি ছেলেকে নাটক করার অনুমতি দিলাম। তবে ছেলে যদি উচ্ছন্নে যায় সে দায় কিন্তু তোমার।’  

আমি বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে ওর দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দিন। ও বিপথে গেলে আপনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেব।’
ভাগ্যিস আজ তোর বাবা বেঁচে নেই! নইলে এই বুড়ো বয়সে কী অপমানটাই না সইতে হতো আমাকে! লজ্জায় আমি তোর বাবার মুখোমুখি হতে পারতাম না।
    আজকাল নাকি ভোগ-বিলাস আর আমোদ-ফুর্তিতেই তোর সময় কাটছে! অথচ এই তুই-ই একদিন শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলতি। নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার কথা বলতি। এক জীবনে কী বিষ্ময়কর বৈপরীত্য!

ফুলপুরের আব্বাসের মেয়েটা ঢাকায় ভর্তি হওয়ার পর তোর কাছে গিয়েছিল। মেয়েটার অভিনয় করার সখ। তুই ওকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলি! মেয়েটা তোকে বিশ্বাস করে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। সরল মেয়েটিকে তুই লা.ি...

 

           


আপনার মন্তব্য