পাড়ি

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-০৫ ১২:৩৬:১৪

ছবি: সংগ্রহ

মিশু মিলন:

নিশ্চিন্তপুরের মহাদুশ্চিন্তা

আমাগের গিরামের নাম নিশ্চিন্তপুর। কিডা কোন কালে এই নাম রাখছিল, তাই বা কিডা জানে! বাবার কাছে জিজ্ঞেস করছিলাম, বাবা কবার পারে নাই। দাদুও কবার পারে নাই। কেউ-ই জানতো না এই নামকরণের ইতিহাস।  

নিশ্চিন্তপুর! আহা, কী প্রশান্তির নাম! নামডা শুনলি-ই কেমন যেন নির্ভার লাগে। ছুঁত লাগা লজ্জাবতী লতার মতো চক্ষু মুদে আসে। শীতের রোদ পোয়ানো বিলাইয়ের মতো শরীলে ঝিম ধরে। কিন্তু আমি জন্মে ইস্তক এই গিরামের মানুষরে কোনদিন নিশ্চিন্তে থাকতি দ্যাকলাম না! নদী পাড়ের গিরাম। বারো মাস চোর-ডাহাতের মচ্ছব লাগেই থাকতো। নৌকা নিয়ে আসতো তারা। আজ এ বাড়ি চোরে সিঁদ কাটতো তো, কাল ও বাড়ি ডাহাত পড়তো। মানষির খাটে খাওয়া শরীল, অথচ রাত্তিরি এট্টু নিশ্চিন্তে ঘুমাবি তার জো নাই। রাত-দুপুরে গিরামে হইহই পড়ে যাতো। মশাল, লাঠি-সরকি নিয়ে বিটা মানষির দৌড়ঝাঁপ শুরু হতো। ছোটরা ভয়ে মা-খুড়ি, জেঠি-পিসিেেগর গলা জড়ায়ে ধরে বান্দরের বাচ্চার মতোন ঘাপটি মারে থাকতো। এ এক নিত্যিদিনের ব্যাপার ছিল!

তাছাড়া গিরামের মানুষে মানুষেও নাড়াই-কাজিয়া, ঠাপাঠাপি লাগেই থাকতো। জমি-জিরাত নিয়ে, গরু-বাছুর কিংবা মেয়েমানুষ নিয়ে, তাস-হাডুডু খেলা নিয়ে জবর নাড়াই লাগতো। যুদ্ধের আগের বছর, ঐ যে... যে বছর বিরাট ঘূর্ণিঝড় হলো, অনেক মানুষ ঝড়ে উড়ে-বানে ভাসে গেল, সেই বছর আলঠেলা হরিপদ’র মাতায় শাবল দিয়ে বাড়ি মারলো ট্যারা নিমাই। জমির আল ঠেলাঠেলি নিয়েই বিবাদের শুরু। তারপর আলঠেলা হরিপদ গেল পরপারে আর ট্যারা নিমাই গেল জেলে। আরো কয় বছর আগে অবিনাশের বড় মিয়া পাচীর প্যাট বাঁধালো গুটি সতীশের মাজে ছাওয়াল পঙ্কু। এই নিয়ে কতো থানা-পুলিশ, কেসাকেসি হলো। কিন্তু গুটি সতীশের গুটির চালে অবিনাশ মাত। গুটির চালে পঙ্কু পালায়ে যায়ে পড়লো ভারতের নদীয়ায় আর অবিনাশের মিয়া পাচী দিল গলায় দড়ি। সতীশের টিকিটাও ছিঁঁড়বার পারলো না কেউ। আমি তহন ছোট। সব জায়গায় বড়গের মুহি খালি শুনতাম, ‘অবিনাশের মিয়া পাচীর প্যাট বাঁধাইছে পঙ্কু।’ আমি তো মানে বুঝিনে, প্যাট আবার বাঁধায় ক্যামনে! শ্যাষে একদিন কি মনে করে বাবার কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা, পাচী পিসির প্যাট পঙ্কুকাকা কী দিয়ে বাঁধাইছে?’

বাবা ঠাস করে চড় মারলো আমার গালে। আমি ভিরমি খায়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। এক চড় খায়ে ছয়দিনের জ্বরে আমি শয্যাশায়ী!

এরপর আর একদিন ভয়ে ভয়ে দীনুকাকার কাছে জিজ্ঞেস করলাম। তহনও পাচী পিসি গলায় দড়ি দেয় নাই। প্রশ্নডা করলাম এট্টু ঘুরোয়ে। বাবার মতো চড় না দিক যদি ধমক দেয় দীনুকাকা! দীনুকাকা তহন আমাগের পোষা কুত্তো ভুলুর গা’র আটালু বাছতেছিলো শান বাঁধানো পুষ্কনির ঘাটে বসে। আর আমাগের সতের দিনের কচি বাছুরডা ভুলুর পাছা শুকতেছিল। ভুলুর সাথে বাছুরডার বেজায় ভাব ছিল! দুইজনে গোল্লাছুট খেলতো। আমি কাছে যায়ে কলাম, ‘আচ্ছা দীনুকাকা, পাচী পিসির প্যাট বাঁধায়ে পঙ্কুকাকা কী খুব অন্যায় করছে?’  
        

দীনুকাকা আমার দিকে তাকালো। তারপর ভুলুর গা’র তে এট্টা আটালু নিয়ে শানের ওপর রাহে খাপড়ার ঘষায় আটালুর অন্ত্যষ্টিক্রিয়া সাঙ্গ করে কোলো, ‘সমাজের এট্টা নিয়ম আছে। প্যাট বাঁধাতি হলি বাওনের অনুমোদন লাগে। পঙ্কু বাওনের অনুমোদন না দিয়েই প্যাট বাঁধাইছে। এই জন্যে সমাজের কাছে পঙ্কু অপরাধী। আমি অবশ্য এইডারে অপরাধ মনে করি নে। দুইজন রাজি থাকলি প্যাট বাঁধাইতেই পারে। তয় পঙ্কু হারামজাদাডা অপরাধ করছে পালায়ে যায়ে। ও যদি পাচীর সাথে ঘরসংসার করতো তাইলে আর অপরাধ হতো না।’

আমি না বুঝেই দীনুকাকার সাথে একমত হলাম, আবার এট্টু সাহসও পালাম। তারপর কলাম, ‘আচ্ছা দীনুকাকা, পঙ্কুকাকা কী দিয়ে পাচী পিসির প্যাট বাঁধাইছে?’

‘সোনা দিয়ে।’ কোয়েই দীনুকাকা হো হো করে হাসতি হাসতি একবার শানের ওপর গড়ায়ে পড়ে আবার ভুলুর গলা জড়ায়ে ধরে।

আমি তো অবাক! একই প্রশ্ন করে বাবার কাছে খালাম বেদম চড়, আর দীনুকাকা হাসতি হাসতি ভুলুর গলা জড়ায়ে ধরে! কী আজব কান্ড!  

তারপর দীনুকাকার হাসির দমক এট্টু কমলি আমি কলাম, ‘দীনুকাকা, আমি বড় হয়ে বাওনের অনুমোদন না নিয়েই প্যাট বাঁধাবো। তয় পঙ্কু কাকার মতো পালাবো না।’  

ওমা! দীনুকাকার প্যাটে যেন হাসির বান ডাহিছে, মুহির বাঁধ ভাঙে উপচে পড়তেছে হাসি! হাসি শুনে যেন মাথার ওপরের তেঁতুল গাছের তে চিকন তেঁতুল পাতা ঝরঝরায়ে পড়তেছে। তারপর দীনুকাকা হাসির তোড়ে ভুলুরে মাথার ওপরে তুলে ছুঁড়ে দিল জলের ভিতর। জলপোকারা ছুটে পালালো পড়িমরি করে, পুষ্কনির জলে জলকেলিরত কয়ডা বালিহাঁস আতঙ্কে উড়ে গেল পশ্চিমের আকাশে, জলের ঢেউয়ে দুলে ওঠা রক্ত শাপলার বুকের কন্দরের তে বাইর হয়ে কয়ডা মৌমাছি উড়বার লাগলো তাল-বেতাল। দীনুকাকার হাসি তবু থামেই না!   

শালার বাওনগের ওপর আমার বেজায় রাগ। একবার আমাগের পাড়ায় বায়স্কোপ আইছিলো। আমি মা’র কাছ তে দুই আনা নিয়ে ফুর্তিতে দে ছুট। মোড়ের কাছে যায়ে ঝোঁক সামলাবার না পারে উল্টোদিক থেকে চান করে আসা দেবরাজ বাওনের হাতের সাথে আমার হাতের এট্টু ছোঁয়া লাগছিলো। অমনি শালার বাওন আমারে কাছে ডাহে ঠাস করে  গালে মারলো এক চড়। আমার সাধের দুই আনা পয়সার এক আনা গড়গড়ায়ে যায়ে পড়লো পুষ্কনির জলে। আর এক আনা অনেক খোঁজা-খুঁজি করে পাইছিলাম শুকনো পাতার মইধ্যে। ততক্ষণে বায়স্কোপওয়ালা হাওয়া। সেই থেকেই আমি বাওন দ্যাকপার পারিনে। বাওনরা যা করে আমি তার বিরোধী। তাই আমি বাওনগের অনুমোদন নিয়ে প্যাট বাঁধাবো না। এই আমার প্রতিজ্ঞা।

তা যে কতা কোতেছিলাম। নিশ্চিন্তপুরের কতা। নিশ্চিন্তপুরের মানুষের মোটে নিশ্চিন্ত হবার জো ছিল না। কেউ এট্টু নিশ্চিন্তে থাকপার চালি-ই গুটি সতীশ গুটির চালে তার দুশ্চিন্তা বাড়ায়ে দিত। সবাই গুটি সতীশের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো। গুটি সতীশের গুটির চালে কোন সময় যে  কিডা মাত হতো তার ঠিক ছিল না। তাছাড়া নিশ্চিন্তপুরে মারামারি-ঝগড়াঝাটি, বিটি মানষির চুলোচুলি তো নিত্যি দিনের ব্যাপার ছিল!

নিশ্চিন্তপুরের পুবদিকে শূদ্রপাড়া। বাওন-কায়েত আর মাহিষ্যরা কেউ কোতো, চাড়ালপাড়া, কেউ কোতো শূদ্রপাড়া অথবা শুদ্দুরপাড়া। নমো পাড়াও কোতো কেউ কেউ। যার যেমন ইচ্ছে!  

গৃহস্থবাড়ির যেমন আদার থাহেÑ ভাঙা হাঁড়ি-পাতিল, এঁটো-কুটো, বাচ্চার ছেঁড়া ক্যাতা, গু-মুতের ত্যানা ফ্যালে, তেমনি নিশ্চিন্তপুরের পুবদিকটা ছিল যেন সারা গ্রামের আদার। গ্রামের অন্যদিকে ছিল বাওন, কায়েত আর মাহিষ্যগের বাস। শূদ্রগের এরা মানুষই মনে করতো না! মনে করতো চাড়াল, বাওন-কায়েতের পা চাটার জন্যে ওগের জন্ম! যেন আলাদা এক জন্তু! অথচ এই চাড়ালরা বাওন-কায়েত বাড়ি কাম না করলি, বাওন-কায়েতগেরও মুহি অন্ন জুটতো না।
শূদ্রপাড়ার পাশেই তিনঘর মুসলমানের বাস ছিল। ওগের অবস্থা ছিল আরো খারাপ। বাওনরা তো মুসলমানগের কামেই নিতো না। উপরন্তু এমনভাবে তাহাতো যেন ওরা লম্বা লম্বা হাত-পা ওয়ালা গুয়ের পোকা!

শূদ্রপাড়ার লোকজন কাম করতো বাওন, কায়েত আর মাহিষ্য পাড়ায়। বাওন পাড়ায় ভিতর বাড়িতে ঢোকার অনুমতি ছিল না শূদ্রগের। বাহির বাড়িতে কাম, বাহির বাড়ির থেকেই বিদায়। কেবল দুই-এট্টা বাড়িতে কামের ঝি’র ভিতর বাড়িতে যাবার অনুমতি ছিল। কয়েত পাড়াতেও প্রায় তাই। মাহিষ্য পাড়ার কড়াকড়ি এট্টু কম ছিল। 
 

মুসলমানরা বেশিরভাগই কাম করতো মাহিষ্য পাড়ায়। মাহিষ্যরা খানিকটা বেশি উদার। এর কারণ এই যে, বাওন-কায়েতরা মাহিষ্যগের নিচুজাত মনে করতো। কতায় কতায় হাইল্যা দাস কোয়ে খোঁটা দিতো। গালাগাল করতো। তাই মাহিষ্যরা মুসলমান আর শূদ্রগের ক্ষেত্রে বেশ উদার ছিল। অবশ্য সবাই যে উদার ছিল তা না। কারো কারো বাওনগের মতো জাত্যাভিমান ছিল। ন্যাজ নাই কুত্তোর বাঘা নাম!     

দীনুকাকার বাড়ি ছিল শূদ্রপাড়ায়। আপনজন কেউ ছিল না তার। বাবা আগেই মরছিল, আর মা মরার পর দীনকাকা এক্কেবারে একলা মানুষ। সারাদিন বাওন-কায়েত, মাহিষ্যপাড়ায় কাম করতো। সন্ধ্যেবেলা তাস খেলতো, বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দিতো।

আমি এট্টা গোপন কতা জানতাম। দীনুকাকার বাড়ির কাছেই তো তিনঘর মুসলমানের বাস। তাইজুল শেখের ছাওয়াল ছনু শেখের সাথে বেজায় খাতির ছিল দীনুকাকার। দীনুকাকা মাঝে মাঝে ঐ বাড়িতে ভাত খাতো। গরুর মাংসও খাতো। দীনুকাকা তো আমাগের বাড়ি-ই বেশি কাম করতো। তাই আমার সাথে বেজায় ভাব। আমি কতাম, ‘ও দীনুকাকা, তোমার জাত যায় না?’

দীনুকাকা কোতো, ‘ধুর! মানুষির আবার জাত কী! সব মানুষ একজাত, মানুষ জাত!’          
    দীনুকাকার কতাডা আমার মনে ধরিছিল। তাছাড়া দীনুকাকা না হয় অশিক্ষিত, লেহাপড়া জানতো না। কিন্তু মাধব মামা? সে তো শিক্ষিত ছিল। শহরে লেহাপড়া করতো। অনেক জানতো, মোটামোটা বই পড়তো। মাধব মামা কোতো, ‘এসব পুজোপার্বণ, আচার-বিধান হলো বাওনগের কারসাজি। এসব ওগের প্যাট বাঁচানের ধান্দা। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করছে এই বাওনরা।’

মাধব মামার মুহি-ই শুনছি, কোন কালে কোন রাজা নাকি কনৌজ না ফনৌজ কোন রাজ্যের তে ভুগানাগা, না খাইতে পাওয়া, লম্বা লম্বা হাত-পা ওয়ালা চিমসে বাওন ধরে আনছিলো এই বঙ্গদেশে যজমানি করার জন্যে। তারপর নাকি এক একটা বাওন হালি হালি, ডজন ডজন বিয়ে করে বিলেই-কুত্তোর মতো বংশ বৃদ্ধি করিছে। নিচু জাতের চল-কলায় জীবন-ধারণ করে, আবার তাগের ঘাড়ে পা দিয়েই নাচা শুরু করিছে! এরেই কয় পৈতের প্যাচ! মাধব মামা ছড়া কাটতো

‘চাল-কলায় পোষা বাওন
রাতে রাতে চাঁদ মাপে,
পুজো আসপি কহন!’

    যাইহোক, আমি এমনিতেই ছাই, তায় আবার বাতাস। এমনিতেই বাওন দ্যাকপার পারিনে, তার ওপর মাধব মামার মুহি এইসব কতা শুনে বাওন আমার ছায়া মাড়াবি কি, আমি-ই বাওনের ছায়া মাড়াতাম না! মাধব মামা বাড়ি আসলি আমি তার ন্যাওটা অয়ে যাতাম। আমার বাবা কোতো, ‘খবরদার, মাধবের পিছন পিছন ঘুর ঘুর করবি তো ঠ্যাং ভাঙে দেব! মাধব একটা নাস্তিক, কুলাঙ্গার, উচ্ছন্নে যাওয়া ছাওয়াল!’   

    তারপরও আমি চুপি চুপি মাধব মামার পিছন পিছন ঘুরঘুর করতাম।  
আমারও একটা গোপন কতা ছিল। একদিন বিকেলে বাবা কোলো, ‘দীনুরে ডাহে নিয়ে আয় তো।’
আমি গেলাম। যায়ে দেহি দীনুকাকা ছনু চাচাগের বাড়ির দিকে যাতেছে। আমি কলাম, ‘বাবা তোমারে ডাহে।’
‘ক্যান?’
‘তাতো জানিনে।’
‘আচ্ছা সে যাবানে। আগে দাওয়াত খায়ে আসি।’     
‘কিসির দাওয়াত?’
‘সবেবরাতের দাওয়াত। যাবি তুই? গরুর মাংস আর চালের রুটি। বেজায় স্বাদ। মুরগীর মাংসও আছে। তুই চাইলে মুরগীর মাংস খাবি। যাবি?’    

আমার চোহের সামনে ছনু চাচাগের বড় মোরগডা যেন তার ইয়া মোটা ঠ্যাংয়ে ভর দিয়ে তিড়িং-বিড়িং করে নাচে উঠলো। কলাম, ‘যাব। কিন্তু কাউরে কবা না তো?’

দীনুকাকা আমার পিঠ চাপড়ায়ে কোলো, ‘তাই কি কই! চল।’    
চালের রুটি আর ছনু চাচার মা’র হাতের রান্না করা মুরগীর মাংস। কী যে স্বাদ!
    আমার বাড়ির কেউ জানে নাই যে আমি মুসলমান বাড়ি যায়ে মুরগীর মাংস খাইছি! আমার ডান পা-ও তো খোঁড়া আছেই, জানলি আমার বাঁ পা-টাও খোঁড়া করে দিতো।

    আর একদিন দীনুকাকা আমারে ব্যাঙ খাওয়াইছিলো, ঐ ছনুচাচাগের বাড়ির থেকেই। সে কতাও কেউ জানে নাই। ছনুচাচাগের বাড়ির মানুষও খুব ভাল। কারো কাছে কিছু কয় নাই।

    দীনুকাকা আমারে খুব ভালবাসতো। আমিও দীনুকাকারে খুব পছন্দ করতাম। দীনুকাকা হাডুডু খেলায় ফাস্ট। দুই পায়ে দুইজন খেলোয়ার জোঁকের মতো আঁকড়ায়ে ধরে থাকতো আর দীনুকাকা হাঁটে চলে আসতো। যেমন তাগড়া স্বাস্থ্য, তেমনই শক্তি দীনুকাকার। গা’র রঙ শ্যামলা। মানুষ খালি দীনুকাকারে দিয়ে ফাও খাটাতো। দীনুকাকাও ফাও খাটতো। মনডা বড় ভাল ছিল দীনুকাকার।

    তো, আমাগের এই নিশ্চিন্তপুরের মানুষ এমনিতেই নিশ্চিন্ত হবার পারতো না, নানান রহম দুশ্চিন্তায় জেরবার জীবন। তার ওপর সবার মাতায় ভর করলো এক মহাদুশ্চিন্তা! এমনকি গুটি সতীশের মাতায়ও। গুটি সতীশ যতই গুটি চালুক, পাকিস্থানী মিলিটারির বন্দুকের সামনে সব গুটি মাত!      

নিশ্চিন্তপুরবাসীর অনিশ্চিত যাত্রা

নান্টুটা ছিল বেজায় ঢ্যামনা।
দীনুকাকা কোতো, ‘তে-ঢ্যামনা’।
নান্টুর মা অবশ্য কোতো, ‘আমার ছাওয়ালের মতন ছাওয়াল-ই অয়না!’

সবাই বারণ করা সত্ত্বেও জলে নামলো নান্টু। ও একাই গাঙ পাড়ি দিবি। দিবি দে, আচ্ছা মদ্দ কিনা! খানিক যাওয়ার পর ফস করে ডুবে গেল জলের মইদ্যে। আমি তহন দীনুকাকার কাঁধে। ভাগ্যিস আমরা কাছেই ছিলাম, নইলে নান্টুটা মা গঙ্গার ভোগে চলে যাতো। দীনুকাকা ডানদিকে কাত অয়ে নান্টুর বাম হাত ধরে টানে তুললো। নান্টু বেজায় ভয় পাইছিল। তার ওপর দীনুকাকা ওরে জলের ভেতর আবার এক চুবানি দিছিল! দীনু কাকার গা’য় যা শক্তি! নান্টু ঢোক খানিক জল খায়ে কাশাকাশি শুরু করলো। ঘন ঘন শ্বাস নিবার লাগলো। নান্টুর মা তহন আমাগের চেয়ে খানিকটা পিছনে।


রাঙা জেঠি চিল্লালো, ‘ও দীনু। ওরে আর মারিসনে। কোলে নে।’
কোলে না ছাই! দীনু কাকা ব্যাঙের ঠ্যাঙ  ধরার  মতো নান্টুর ড্যানা ধরে জলের ভিতর দিয়ে ছ্যাঁচড়াতি ছ্যাঁচড়াতি গাঙ পার করলো। জলের যদি মাটির মতো ধার থাকতো, তালি তো নান্টুর হাত-পাও, পাছা-মাছা ছুলে যাতো! বেশ হতো।
যা হইছিল, আমি তাতেই বেজায় খুশি। খুশিতে আড়চোহে বারবার নান্টুর দিকে তাহাতেছি। বেচারার কাহিল দশা। গাঙ পাড়ে থাকতি কি তার ভাব আর চ্যাটাং চ্যাটাং কতা, ‘আমি একাই এইটুক গাঙ পার হবার পারি!’ আমি মনে মনে কই-‘এহন দ্যাক, কেমন লাগে ঘোলা জল খাতি! ভাল অইছে, বেশ মজা অইছে।’ দিনরাত আমারে ল্যাংড়া কানু, ল্যাংড়া কানু কোয়ে ডাকতো।


আমার বাঁ পা এট্টু খাটো, আবার ব্যাঁহাও। জন্মেরতে-ই এমন। তাই আমি খুঁড়ায়ে খুঁড়ায়ে হাঁটতাম। কিন্তু শালার বিটার নান্টু, সারাক্ষণ আমারে খালি ল্যাংড়া কানু কয়ে ডাকতো। ওর দ্যাহাদেহি সারা গ্রামের মানুষও আমারে ল্যাংড়া কানু কোতো।

আমার বেজায় কষ্ট লাগতো। আচ্ছা, কানারে কানা, ল্যাংড়ারে ল্যাংড়া, পাগলারে পাগলা কতি আছে? কানা, ল্যাংড়া, পাগলারও তো মন আছে, তাগেরও তো কষ্ট অয়। তা কেউ বুঝতো না। সবাই নান্টুর সাথে সুর মিলাতো। শালার বিটার নান্টু, আচ্ছা মতোন জব্দ হওয়ায় তহন আমি বেজায় খুশি!  

দীনুকাকা এই পাড়ে আসে বালির ভিতর ধপ করে ফেললো নান্টুরে। তারপর আমারে কাঁধের তে নামায়ে আবার গেল ঐ পাড়ে। গাঙটা ছোট। তার ওপর গ্রীষ্মকাল। জল কমে কোন জায়গা কোমর, কোন জায়গা বুক জল। তয় স্রোত ছিল, পাকও ছিল। নান্টুটা তো ঐ পাকেই পড়ছিল।

দীনুকাকা আবার ঐ পাড়ে যায়ে নেপাল ঠাহুরির মা’রে কাঁধে করলো। আমি মনে মনে ভাবলাম, শালার বুড়ি, বাওনের বিধবে মাগি! খুব তো শুচিবাই দ্যাহাতে। নিচুজাত দূরে থাক, অনাত্মীয় কারো হাতের খাবার খাতে না। ভিতর বাড়িতে নিচু জাতের কাউরে ঢুকপার দিতে না। মুসলমান দেকলি আবার চান করতে! আর এহন? এট্টা মদ্দ চাড়ালের ঘাড়ে চড়ে নদী পার অতেছো, এহন তোমার জাত যায় না! ঠেলার নাম বাবাজি! আবার এক দাদু কোতো, ‘চোদনে পড়লি গাছে বিলেই ওঠে!’ বাওনের বিধবেও তাই!   

এর আগে আর এট্টা খাল পার অবার সময় বুড়িডা ভয়ে দীনুকাকার কাঁধে মুতে দিছিলো, গুলির শব্দ শুনে। আমরা সবাই-ই ভয় পাইছিলাম বেজায়। ভাবছিলাম, সবাইরে মারে বুঝি ঐ খালেই ভাসায়ে দেয়। খালের পাশের জঙ্গলে সবাই ঘাপটি মারে বসে ছিলাম দুই-তিন ঘন্টা। তারপর গোলাগুলি বন্ধ হলি সন্ধের আবছা অন্ধকারে বাইর অয়ে আবার আমরা হাঁটা শুরু করি।

এই বুড়িডার ওপর আমার বেজায় রাগ ছিল। আগের বছর চত্তির মাসে বেজায় খরা হলো। মানুষজন-পাখপাহালি, গাছপালা সব জলবিনে ট্যাঁ ট্যাঁ শুরু করলো। মাঠ-ঘাট ফাটে সব চৌচির। কিন্তু বৃষ্টি আর অয় না। তহন গিরামের সবাই মিলে ঠিক করলো বৃষ্টির জন্যে হাজরা তলায় পুজো দিবি। কীর্তনের দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান করে, জলকেলি-কাদাকেলি খেলে মাঙন মাঙে কদমা-বাতাসা কিনে আনলো। বিকেলবেলা পুজো। দলে দলে মানুষজন আসপার লাগলো হাজরা তলায়। সব মেয়েমানুষের হাতে কাঁচা দুধ। কারো হাতে দুধের গ্লাস, কারো হাতে জগ। যার যার সামর্থ মতো দুধ নিয়ে আইছিল হাজরা ঠাহুররে ঠান্ডা করার জন্যে। হাজরা ঠাহুরির দেহ শীতল হলি, তবেই না তিনি খুশি হয়ে ইন্দির দেবতার কাছে তদবির করে বৃষ্টি নামাবেন! ধরণী শীতল করবেন! 

   
ওমা! দেহি কী কান্ড! হাজরা ঠাহুর শীতল হবি কী! শীতল হবার লাগলো তো নেপাল ঠাহুরির মা’র কলস! তাও আবার এট্টা না দুইটা! নেপাল ঠাহুর হলো পুজোর পুরোহিত। তাই সবার হাতের তে দুধের জগ-গ্লাস নিয়ে হাজরা ঠাহুরির (আসলে হিজল গাছ) গোড়ায় কয়েক ফোঁটা দিয়ে বাকি দুধ কলসে ঢালবার লাগলো বিধবে মাটিডা। পুজো হলো, কদমা-বাতাসা বিতরণ হলো। ছেলেপুলেরা সব বাবা-মা’র হাত ধরে ধুলো ভাঙে কদমা চাটতি চাটতি বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু হাজরা ঠাহুরির দেহও শীতল হলো না, বৃষ্টিও হলো না। চোহের সামনে দিয়ে ম্যাঘগুলোন লোভ দ্যাহায়ে কোমর দুলাতি দুলাতি উড়ে চলে গেল উত্তরে। পরে বড়রা কেউ কেউ কোলো, ‘সব ঐ বাওনের বিধবে মাগিডার দোষ! দুধ কলসে ভরলো বলেই তো বৃষ্টি হলো না!’    

তিনদিন হয়ে আমরা নিশ্চিন্তপুর থেকে যাত্রা শুরু করছি ভারতের উদ্দেশ্যে। ভারত আর কদ্দুর কিডা জানে! আমরা কেবল হাঁটতেছি আর হাঁটতেছি। বন-জঙ্গল, লোকালয়, নদী-খাল পার হয়ে কেবল হাঁটতেছি। হাঁটতি হাঁটতি পায়ে ফোঁসকা পড়ে গেছে কারো কারো। আমার অবশ্য তেমন কষ্ট নাই। খানিক পর পরই দীনুকাকা আমারে কাঁধে নিতেছে।
ঐ তিনদিন ধরে কতো যে মানুষ দ্যাকলাম! নানান জায়গার থেকে দলে দলে মানুষ আসতেছে। কেউ আমাগের সঙ্গ নিতেছে, কেউ হাঁটে আগে চলে যাতেছে, কেউ আবার পিছনে পড়ে যাতেছে। সবার গন্তব্য একÑভারত। দুঃখের কথা কেউ কেউ মরেও যাতেছে। সকালে মরে, বিকেলে মরে, রাত্তিরিও মরে। সবাই কলেরায় মরে। কলেরা যেন পাকিস্থানী মিলিটারিগের জ্ঞাতি ভাই!

মরণ তো সবার কপালেই লেহা আছে। একদিন সবারই মরতি হবি। কিন্তু  সে কী মরণ! হায়, কপাল! শবদেহ না পালো আগুন, না পালো মাটি। স্বজনের শবদেহ রাস্তার পাশে ফ্যালায়ে চোহের জল ফেলতি ফেলতি নিজের জীবন নিয়ে সামনে আগালো মানুষ! না আগায়ে উপায় কী, পিছনে মিলিটারি!  
   

হাঁটতি হাঁটতি পা-ও ব্যতা করে। ক্ষিদে লাগে ঘন ঘন। ঘন বন-জঙ্গলের মইদ্যে আমরা জিরেই-খাই। খাবার বুলতি কাপড়ে বাঁধা শুকনো চিড়ে আর গুড়। চাবাতি চাবাতি মুখ ব্যতা হয়ে যায়। গলা দিয়ে নামবার চায় না। জলের তাড়া দিয়ে নিচে নামাই। কিন্তু জলও কি আর সহজলভ্য! হাঁটতি হাঁটতি কোন এক ভিন গাঁয়ে কল পাই। তহন জগে জল ভরে নেয় বড়রা। সেই জল তো খানিক পরেই ফুরোয়ে যায়। তারপর দ্যাহা যায় সামনে আর কোন কল পাইনে মেলা সময়। তহন বাধ্য হয়ে পুষ্কনি, নয়তো নদীর জল খাই। ঐ জল খায়েই তো কলেরা হয় কারো কারো। মানুষ জল বিনে মরে, জল খায়েও মরে!

এর মইদ্যে মাঝে মাঝেই শুনি, মিলিটারি আসতেছে। তহন পরি-মরি করে সবাই দৌড় দিই। বন-জঙ্গলে যায়ে লুকোই। যেন সাপের মুহির ব্যাঙ আমরা। জীবন নিয়ে কী লুকোচুরি! তারপর দ্যাহা গেল রাত্তিরি আমরা হাঁটে সামনে আগাতেছি, হঠাৎ সামনের কোন গিরামে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। তহন আবার পিছন দিক দৌড় দিই। বিল-বাওড় ঘুরে সামনে যাই। কী যে কষ্ট! সাপে খায় না বাঘে খায় তার ঠিক নাই। আর চলতি পথে কতো যে লাশ সামনে পড়ে তার কোন হিসেব নাই। পচা-গলা লাশ, শিয়েল-কুত্তোয় খাওয়া লাশ!

একবার এট্টা গিরামের ভিতর দিয়ে হাঁটতেছি। দুপুরবেলা। তৃষ্ণায় বুক ফাটে যাতেছে। কারো কাছে এক ফোঁটা জল নাই। গিরামে এট্টা কলও খুঁজে পাতেছিনে। কোন মানুষও নাই। শ্মশানের মতো নীরব। মানষির সাথে সাথে পাখপাহালিও যেন ভয়ে পালাইছে। কোন প্রাণের সাড়া নাই। এট্টা পুষ্কনি পালাম। তলায় খানিক জল আছে। কিন্তু সবুজ আর ঘন। খাওয়ার জো নাই। চত্তির-বোশেখ মাসে বেশিরভাগ পুষ্কনিরই এই অবস্থা। শ্যাষ পর্যন্ত এট্টা কল খুঁজে পালাম। কিন্তু জল নাই। পুষ্কনির জল কলের মইদ্যে ঢালে খানিকক্ষণ চাপাচাপি করেও কোন লাভ হলো না। মনে হয় ওয়াসার-টার নষ্ট।

আমি দীনুকাকার ঘাড়ে চড়ে যাতেছি। হঠাৎ এট্টা নারকেল গাছের দিকে চোক পড়তি-ই কলাম, ‘দীনুকাকা, আমরা তো ডাব পাড়ে জল খাবার পারি।’

অনেকগুলো নারকেল গাছ ছিল, ডাবও ছিল অনেক। খালি নারকেল গাছের মালিক ছিল না। ফাঁকা বাড়ি। সবাই আমার বুদ্ধির জন্যে বাহবা দিল। আমি নান্টুর দিকে তাকালাম। মনে মনে কলাম, ‘দ্যাক নান্টু, আমি ল্যাংড়া হবার পারি। তোর চেয়ে আমার বুদ্ধি বেশি!’  
   

    নান্টু পট করে এট্টা ছোট নারকেল গাছে উঠে পড়লো। আরেকটায় দীনুকাকা। নান্টু এক হাতে নারকেলের বাগড়ো ধরে, আরেক হাত দিয়ে কেবল একটা ডাব ধরছে। ওমনি বাগড়োর ভিতর থেকে এট্টা গুক্ষু সাপ নান্টুর দিক ফণা তুলে ফোঁস করে উঠলো। নান্টু তো ‘উরে মা’ কোয়ে এক চিক্কেরে এক্কেবারে গাছের তলায়! ভাগ্যিস ছোবল দিছিল না!

    তৃষ্ণা মিটলো। এরপর আবার হাঁটা শুরু করলাম। সামনে আবার এট্টা ছোট নদী। কী নাম তার কিডা জানে। কয়দিনের যাত্রাপথে কত যে নদী দ্যাকলাম, বাপের জন্মে এতো নদী দেহি নাই। সেই নদীডাও ছোট ছিল। তয় স্রোত ছিল, পাকও বেজায়। নদীর পাড়ে এট্টা কলাগাছ তাক ধিন ধিন তাক করে ঢেউয়ের তালে তালে নাচতেছিল। গলায় দড়ি দিয়ে পাড়ের খুঁটোর সাথে বাঁধা। নান্টু আগে দৌড়য়ে যায়ে কলাগাছটা নিয়ে ভাসে নদী পার হওয়া শুরু করলো। আমার আফসোস হলো, ইস, আমি যদি কলাগাছ নিয়ে ভাসে পার হবার পারতাম! কিন্তু আমার ভাইগ্যে নাই। অগত্যা দীনুকাকার ঘাড়ে চড়ে নান্টুর দিকে দৃষ্টির ঈর্ষাবাণ ছুঁড়ে দিতি দিতি নদী পার হতেছি। মাঝ নদীতে দীনুকাকার বুক জল। আর বেজায় পাক। আমি মাঝে মাঝে হাত দিয়ে জল ছুঁতেছি। হঠাৎ পাকের ভিতর থেকে এট্টা মরা ভাসে উঠলো দীনুকাকার বুকের কাছে! পচা লাশের দূর্গন্ধ প্যাটে পাক দিয়ে উঠলো। আমি ভয়ে দুই হাতের মুঠোর মইদ্যে দীনুকাকার চুল আঁকড়ায়ে ধরলাম।     

    ভোররাত থেকে দীনুকাকার দাস্ত বমি শুরু হলো। আমরা তহন এট্টা বাগানের ভিতর রাত্তিরযাপন করতেছিলাম। দীনুকাকার বমির শব্দে আমার ঘুম ভাঙে গেল। বমি মানেই এক আতঙ্ক। এর আগে যার-ই বমি অইছে সে-ই আর বাঁচে নাই। আমি দীনুকাকার কাছে গিলাম। মনের মইদ্যে ভয়, দীনুকাকার যদি কিছু হয়! মা আমার হাত ধরে দীনুকাকার কাছ থেকে দূরে সরায়ে আনলো। ভয়ে কেউ-ই দীনুকাকার কাছে যাতেছে না। আমাগের পাড়ার নারান একবার দীনুকাকার কাছে যায়ে জলের জগডা দিয়ে আসলো। দীনুকাকা বমি করে, আবার কাইত হয়ে শোয় বমির পাশেই।

আবছা অন্ধকার থাকতি-ই আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। দীনুকাকাও হাঁটতেছে পিছন পিছন। আমি বারবার পিছন ফিরে দীনুকাকার দিকে তাহাই। মা, নয়তো বাবা আমার হাত ধরে রাহে। দীনুকাকার কাছে যাবার দেয় না। দীনুকাকার দিক তাহায়ে আমার চোখ ফাটে জল আসে। এট্টা মানুষ, যার আপনজন কেউ নাই। সে সারাপথ অপর মানুষরে কাঁধে বয়ে আনলো, নদী পার করে দিল। অথচ তার বিপদের সময় তার পাশে কেউ নাই। আবার সে নিশ্চিন্তপুরের মতোন অচ্ছুত! না, তার চেয়েও বেশি অচ্ছুত!   

বিকেলের দিকে দীনুকাকার অবস্থা খুব খারাপ হলো। তার আর হাঁটার শক্তি নাই। যেমন দাস্ত বমি, তেমন পাতলা পায়খানা! বুড়িডা দীনুকাকার অবস্থা দেহে চোহের জল ফেলে তার ছাওয়ালরে কোলো, ‘ও নেপু, ছ্যামরাডা সবার জন্যে এতো করলো। ওরে এমনে ফ্যালায়ে চলে যাব! জ্যান্ত ছাওয়ালডারে শিয়েল-কুত্তোয় খাবেনে। তোরা যা আমি থাহি।’

নেপাল ঠাহুর বুড়িরে ধমকায়ে কোলো, ‘চলো তুমি। অতো দরদ দ্যাহানে লাগবেন না। দীনু আর এক-আধবেলার বেশি টিকপেন না।’    


নেপাল টাহুরির শ্যাষ কতাডা বল্লমের খোঁচার মতোন বিঁধলো আমার বুকের মইদ্যে। দীনুকাকারে এট্টা আম গাছের নিচে ফেলেই আমরা হাঁটা শুরু করলাম। কেবল আমি আর ঐ বুড়িডা দীনুকাকার জন্যে চোহের জল ফ্যাললাম।

রাত্তির বেলা আমরা আশ্রয় নিলাম এট্টা স্কুলের ঘর-বারান্দায়। ঘরটা তালা দেওয়া ছিল। হারানকাকা তালা ভাঙলো। পাঁচদিন হলো আমরা নিশ্চিন্তপুর ছাড়ছি। পরদিন বিকেলের মইদ্যেই নাকি পৌঁছে যাব ভারতে। সবার মনে উঁকি দিতেছে আশার আলো। আমার মনে তহন অন্ধকার। এতো কাছে আসেও দীনুকাকা ভারতে পাড়ি দিবার পারবিনে! এহন কেমন আছে দীনুকাকা? বাঁচে আছে, না মরে গেছে! নানান ভাবনা আমার মাতার মইদ্যে ঘুরপাক খাবার লাগলো।
রাত্তিরবেলা কেউ শুইছে, কেউ বসে আছে, কেউ চিড়ে চাবাতেছে, কেউবা বাচ্চা-কাচ্চা ঘুম পাড়াতেছে। আমার চাপলো পায়খানা। আমি মা’র কাছে কলাম, ‘ওমা আমি পায়খানা করবো।’

কাছেই ছিল নান্টু। ও পট করে কোলো, ‘চল পিছনের মাঠে যাই। আমিও পায়খানা করবো।’
আমি এট্টু দ্বিধাদন্দ্বে পড়লাম, ওর সাথে যাব কিনা। মা কোলো, ‘যা ওর সাথে। বেশি দূর যাসনে।’
নান্টু ওর বাবার কাছ তে টর্চ লাইট নিল। ওর বাবা সাবধান করে দিল, ‘বেশিক্ষণ জ্বালায়ে রাহিসনে। ব্যাটারী কম।’
আমি আর নান্টু স্কুল ঘরের পাশ দিয়ে পিছন দিকে হাঁটা শুরু করলাম। নান্টু আগে আগে টর্চ মারে যাতেছে, আমি পিছন পিছন। শালার নান্টু সবসময়ই বড় মানষির মতো ভাব! ও বড় মানষির মতো টর্চ মারে আগে আগে হাঁটপার লাগলো, আর আমি পুচকে পোলাপানের মতোন পিচন পিছন। আমি আর নান্টুর চেয়ে বড় হবার পারলাম না!   
হঠাৎ-ই নান্টু থমকে দাঁড়ালো। আমিও সামনের দিক তাহালাম। আবছা অন্ধকারে দুইজন মানুষ দৌড়ে মোটা এট্টা গাছের আড়ালে চলে গেল। নান্টু গাছের দিকে লাইট মারে কোলো, ‘কিডা?’

কেউ কতা কয় না। নান্টু কোলো, ‘আয়তো ল্যাংড়া, দেহি কোন শালার বিটা, কতা কয় না ক্যা?’
আমার ভয় করতেছে, ভূত-টুত নাতো! নান্টুর সাহসটা বরাবরই এট্টু বেশি। নান্টু আম গাছটার দিক লাইট মারে দুই পা আগাতেই নেপাল ঠাহুরির ধমক, ‘খবরদার হারামজাদা, এদিক আসপি না। যেদিক যাতেছিস যা।’
নান্টু কোলো, ‘ও, নেপাল জ্যাঠা! এহানে কী করেন?’

‘তোর গুষ্টির ষষ্টি পুজো করি হারামজাদা। রাত-বিরেতেও টো টো করে বেড়ায় নচ্ছারটা। যা ভাগ!’
খালি খালি ধমকালো। আমার হেভি রাগ হলো। মনে হলো নান্টুও রাগে গেছে।  

‘আয় ল্যাংড়া’ কয়েই নান্টু ঘুরে লাইট মারলো। অমনি লাইটের সামনে পড়লো লুঙ্গি, কাপড়, ছায়া-ব্লাইজ! কাপড়খান আমার চেনা, শূদ্রপাড়ার পাড়ার মিনতি মাসির। মিনতি মাসি নেপাল ঠাহুরির বাড়ির কামের ঝি।
নান্টু আমার মুহির দিক তাহালো। তারপর আমগাছের দিক ঘুরে দাঁড়ায়ে ফিক ফিক করে বেজায় শব্দে হাসে উঠলো সেই গা ছমছম করা অন্ধকারে!       

 পায়খানা করে ফেরার সময় নান্টু কোলো, ‘ল্যাংড়া, দীনুকাকার কাছে যাবি?’
আমি অবাক হয়ে ওর মুহির দিক তাহালাম। ও কোলো, ‘দীনুকাকার জন্যে আমার মনডা কেমন করতেছে রে! দীনুকাকা না থাকলি আমি তো গাঙে ভাসে যাতাম! দীনুকাকা সবার জন্যে এতো কষ্ট করলো অথচ সবাই দীনুকাকারে ফ্যালায়ে চলে আসলো। মানুষ বড় নিষ্ঠুররে ল্যাংড়া! যাবি তুই দীনুকাকার কাছে?’
আমি কলাম, ‘ক্যাম্বা?’

‘ভোরবেলা সবাই যহন ঘুমাবি, তুই আর আমি চুপচাপ চলে যাব। দীনুকাকারে আমরা সুস্থ করে নিয়ে আসপো।’
‘আচ্ছা।’
কোয়ে আমি আবছা অন্ধকারে মাঠের মইদ্যে নান্টুরে জড়ায়ে ধরলাম। নান্টুর ওপর আমার আর কোন রাগ থাকলো না! এতোদিনের জমা সব রাগ ওর এক কতায় ধুয়ে গেল!  


ভোরবেলা আমার যহন ঘুম ভাঙলো, দেহি আমি মা’র কোলের মইদ্যে মাতা দিয়ে শুয়ে আছি। সবাই উঠে পড়ছে। আবার যাত্রা শুরু করার জন্যে তৈরি হতেছে। ইস, আমাগের না পালায়ে যাওয়ার কতা ছিল! এহন ক্যাম্বা যাব! আমি তাহায়ে নান্টুরে খুঁজবার লাগলাম। নান্টু নাই। খানিক পর নান্টুর বাড়ির লোকজনও নান্টুরে খুঁজা শুরু করলো। কিন্তু কোন জায়গায় নান্টু নাই। নান্টুর মা আর ওর বাড়ির লোকজন কান্নাকাটি শুরু করলো। আমি বুঝলাম, নান্টু দীনুকাকার কাছে গেছে। মা’র কোলে মাতা দিয়ে শুয়ে ছিলাম বলে ও হয়তো আমারে ডাহে নাই কিংবা ডাকলি-উ আমি বুঝি নাই।
আমি কাউরে কিছু কলাম না। শ্যাষে যদি কেউ যায়ে নান্টুরে ফিরায়ে আনে! তালি তো দীনুকাকা বাঁচপেন না। নান্টুর জন্যে দরদে আমার বুকটা ভরে গেল। কোনকিছুতে নান্টুরে হারাবার পারলি আমি খুব খুশি হতাম। কিন্তু সেদিন আমি নান্টুর কাছে হারেও খুশি হলাম। সবার কাছে আমি ‘ভাল ছাওয়াল’ পারলাম না দীনুকাকার জন্যে কিছু করবার। অথচ ‘তেঢ্যামনা’ হয়েও নান্টু দীনুকাকারে বাঁচানের জন্যে ছুটে গেল। আমি হারে গেলাম তেঢ্যামনা নান্টুর কাছে। কিন্তু আমার কোন দুঃখ নাই। আমি বেজায় খুশি। নান্টুর জন্যে গর্বে আমার বুক ভরে গেল, কষ্টে ভরে গেল দুই চোক। মনে মনে কলাম, নান্টু, তুই দীনুকাকারে সুস্থ করে নিয়ে আয়। আমি তোগের অপেক্ষায় থাকপো নান্টু।   
 
পাড়ি

সারাডা পথ আমি হাঁটি আর পিছন ফিরে তাহায়ে দেহি, নান্টু আর দীনুকাকারে দ্যাহা যায় কিনা! না, কত মানুষ আসে, কিন্তু তাগের ভিতর দীনুকাকা আর নান্টুর মুখ খুঁজে পাইনে। আমি চুপি চুপি কাঁদি, চোহের জল মুছি। কেউ বোঝে না। কেবল বোঝে আমার অন্তর্যামী। দীনুকাকার জন্যে বুকটা জ্বলে-পুড়ে যায়। নান্টুর জন্যে মন কেমন করে।    
তারপর সারাডাদিন হাঁটার পর আমরা বিকেলের দিকে পাড়ি দিলাম ভারতে। সবাই যেন হাঁফ ছাড়ে বাঁচলো। সত্যি, সেই মুহূর্তে সবার কাছে ভারত যেন স্বর্গ! ভারত এক সত্যিকারের নিশ্চিন্তপুর। ছয়ডা দিন দেহের ভিতর জীবনডা ছিল কচুপাতায় একফোঁটা জলের মতোন। ভারতে পৌঁছামাত্র সেই কচুপাতার দেহ-ই যেন হয়ে গেল সোনার পাত্র। যা ধারণ করে ছিল মহামূল্যবান জীবন। জীবনের মূল্য  যে কী, ভারতে পৌঁছে তা খুব করে উপলব্ধি হলো সাবার। কম-বেশি খানিকটা আমারও।

ভারতে পৌঁছে দেহি খালি মানুষ আর মানুষ। মানুষ গিজগিজ করতেছে। এতো মানুষ আমি আর একবার দেকছি জীবনে। আগের বছর ঝড়ের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইছিলো আমাগের এলাকায়। আমি দীনুকাকার সাথে গিছিলাম দ্যাকপার। বাবা রে বাবা! এলাকার মানুষ আর কেউ ঘরে ছিল না। সব ছুটে আইছিলো বঙ্গবন্ধুরে দ্যাকপার। তারপরে ভারতে পৌঁছে দ্যাকলাম মানুষ।


এতো মানুষের ভিড়েও আমি তহন দীনুকাকা আর নান্টুরে খুঁজি। রাস্তার দিকে আসে বসে থাহি। ওরা আর আসে না। একদিন দুইদিন করে সপ্তাহ ঘুরে মাসও যায়। আমি রাস্তায় আসে দাঁড়ায়ে থাহি। চোহের জলে আমার গাল ভিজে যায়। বর্ষার বর্ষণে ধুয়ে যায় সে জল। দীনুকাকা আসে না, নান্টু আসে না। মনে তহন প্রায়-ই কু-ভাবনা উঁকি দেয়, আমরা তো ক্ষণকালের নিশ্চিন্তপুর ভারতে পাড়ি দিছি, দীনুকাকা আর নান্টু কি তয় চিরদিনের নিশ্চিন্তপুর পাড়ি দিল!            


আপনার মন্তব্য