মোনালিসার রহস্যময় হাসির রহস্য

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-২৬ ১০:৩৬:০৭

ফরিদ আহমেদ:

যৌবনের কোন না কোন সময় মোনালিসার প্রেমে পড়ে নি এমন পুরুষ খুঁজে পাওয়া রীতিমত বিরল। মোনালিসার কৌতুকপ্রিয় চোখ আর ঠোঁটের কোনে ঝুলে থাকা এক টুকরো রহস্যময় হাসি অনেকে যুবকেরই রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। শত শত বছর ধরে মোনালিসার হাসির রহস্য উদঘাটনে ব্রতী হয়েছেন অসংখ্য কবি শিল্পী এবং সাহিত্যিকেরা। তা সত্ত্বেও রহস্যময়ী মোনালিসার রহস্যময় হাসি রয়ে গেছে রহস্যের অন্তরালে।

যুগে যুগে বিপুল গবেষণা, সাহিত্য, কাব্য আর সংগীত রচিত হয়েছে মোনালিসাকে ঘিরে। প্রেমিকেরা তাদের প্রেয়সীর মধ্যে খুঁজে পেতে চেয়েছেন ভুবনমোহিনী অপরূপা মোনালিসাকে। প্রেমিকার রসালো ঠোঁটে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন মোনালিসার ঠোঁটের অপার রহস্য, চোখের গভীরে পেতে চেয়েছেন মোনালিসার অনন্য ঝিকিমিকি কৌতুককে। সে কারণেই বোধহয় সব যুগেই পুরুষেরারা তাদের স্বপ্নচারিনীদের তুলনা করে এসেছে মোনালিসার সাথে। মোনালিসা হয়ে উঠেছে সৌন্দর্য আর রহস্যময়তার প্রতীক হিসাবে।

কী আছে পাঁচশো বছর আগে ইতালীয় রেঁনেসার শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার মধ্যে যে যার কারণে তাকে নিয়ে এত উন্মাদনা, এত আগ্রহ, এত ভালবাসা, এত প্রচার? এ রহস্যেরও সমাধান কেউ দিতে পারে নি এখন পর্যন্ত। শত শত পণ্ডিত, গবেষক এবং ঐতিহাসিকেরা পৃথিবীর দূর দূরান্তের লাইব্রেরিতে গিয়ে পুরনো দলিলপত্রে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন মোনালিসার রহস্য উদ্ধার করার জন্য।

যাঁরা মোনালিসা দেখেছেন তাদের কাছে মনে হবে যেন কোন প্রতিকৃতি নয়, পুরোপুরি জীবন্ত এই নারী। ঠোঁটের কোনে রহস্যময় এক চিলতে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে দর্শকের দিকে। ক্ষণে ক্ষণে আবার এই হাসির রূপও বদলে যায়। কখনো এই হাসিকে মনে হয় নিস্পাপ, বড় পবিত্র আবার কখনো বা মনে হয় বিদ্রুপ করছে আশেপাশের সবাইকে। আবার কখনো বা মনে হয় কোন হাসিই নেই তার ঠোঁটে। জীবন্ত কাউকে যেন পুরে রাখা হয়েছে ক্যানভাসে। এক্ষুনি হয়তো বের হয়ে আসবে ক্যানভাস ছেড়ে। আর দশটা জীবন্ত মানুষের মতই মনে হয় যেন তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। সে কী চিন্তা করছে বা তার অনুভূতি কী তা বলা মহা দুঃসাধ্যের কাজ। সে কি আনন্দিত নাকি বিষাদগ্রস্থ? ধূর্ত নাকি সহজ সরল? অস্থির চিত্তের নাকি শান্ত সমাহিত? নাকি পারিপার্শ্বিক সব কিছু থেকে উদাসীন কোন নারী? যারাই মোনালিসার ছবি দেখেছেন তারা কেউই একমত হতে পারেননি। প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে মোনালিসার মেজাজ মর্জিকে ব্যাখ্যা করেছেন।

ভিঞ্চি তাঁর এই পোর্ট্রেটে যে কৌশলে এই রহস্যময়তা এনেছেন তাকে বলা হয় ফুমাটো কৌশল বা পদ্ধতি। এই ইটালিয়ান শব্দটির মানে হচ্ছে ধোঁয়াশা বা ঝাঁপসা। তাঁর সময়ের অন্যান্য শিল্পীরা যেখানে সুস্পষ্ট বহির্সীমা ব্যবহার করতেন সেখানে ভিঞ্চি এই ক্ষেত্রে তার বিপরিতটা করেছিলেন। মোনালিসার দেহের প্রান্তসীমাসমূহ, তার সামগ্রিক মুখমণ্ডল, হাতদ্বয় এবং কাপড়ের রয়েছে হালকা প্রান্তসীমা। এই প্রান্তসীমাসমূহ ঘিরে থাকা আলো বা ছায়ার মধ্যে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে। আলো এবং ছায়ার মধ্যে অদৃশ্য উত্তরন, কখনো কখনো বিভিন্ন রঙ এর কোন দৃশ্যমান চিহ্ন¡ ছাড়াই একের সাথে অন্যের মিশে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি সবকিছুকেই ধোঁয়ার মত মিশিয়ে দিয়েছেন তিনি কোন প্রান্তসীমা ছাড়াই। যে কোন প্রতিকৃতির অভিব্যক্তি মূলত নির্ভর করে দুটি বিষয়ের উপর, মুখের এবং চোখের প্রান্ত। কিন্তু মোনালিসায় লিওনার্দো সচেতনভাবেই এই দূটি জায়গাকেই হালকা ছায়ার সাথে অন্তলীন হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে অস্পষ্ট করে রেখেছেন। একারনে আমরা কখনোই নিশ্চিত না যে মোনালিসা কোন মেজাজে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার অভিব্যক্তি সবসময়ই দর্শককে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখে দেয়।

তবে শুধুমাত্র অস্পষ্টতাই এই এফেক্ট তৈরি করেনি। এর পিছনে আরো অনেক কিছুই আছে। লিওনার্দো অত্যন্ত দুঃসাহসী একটা কাজ করেছিলেন যা শুধুমাত্র তাঁর মত অসম্ভব প্রতিভাবানরাই করতে পারে। মোনালিসাকে খুব ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এর দুই পাশ পুরোপুরি মেলে না। এটা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান পটভূমিকার স্বপ্নিল প্রাকৃতিক দৃশ্যে। বাম দিকের দিগন্ত রেখা ডানদিকের দিগন্ত রেখার তুলনায় অনেক নিচে। ফলে, আমরা যখন ছবিটির বা দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তখন মোনালিসাকে মনে হয় বেশ কিছুটা লম্বা। এ ছাড়া খেয়াল করলে দেখা যাবে যে মোনালিসার এক চোখ আরেক চোখের তুলনায় সামান্য উচুতে অবস্থিত। এই পরিবর্তনের ফলে এবং তার মুখের দুইপাশ না মেলার কারণে তার মুখচ্ছবিও পালটে যায় বিভিন্ন কৌণিক অবস্থান থেকে দেখার সময়। আলো এবং ছায়ার সচেতন ব্যবহার ছাড়াও মোনালিসার অবস্থান নিয়েও লিওনার্দো বেশ যত্নশীল ছিলেন। মোনালিসার শরীর সামান্য কাত হয়ে আছে। হাত দুটো হালকাভাবে বাহুর উপরে রেখে সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে সে।

পাঁচ শতাব্দী ধরে লোকজন মোনালিসার হাসিকে দেখে চলেছে চরম বিস্ময় নিয়ে, বিহ্বলের মত। পৃথিবীর সমস্ত রহস্যের আধার যেন তার হাসি। এই মনে হবে মোনালিসা হাসছে, পরক্ষণেই দেখা যাবে সে হাসি মিলিয়ে গেছে। কী আছে মোনালিসার ঠোঁটে? লিওনার্দো কীভাবে মোনালিসার মুখে এই রহস্যময় অভিব্যক্তি তুলে দিয়েছিলেন? অন্য কোন শিল্পীরা তা পারেন নি কেন?

হার্ভাডের নিউরো সায়েন্টিষ্ট ডঃ মার্গারেট লিভিংস্টোন এগিয়ে এসেছিলেন এই রহস্য ব্যাখ্যা করার জন্য। বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি এর। তাঁর মতে এর আরো শক্তিশালী অন্য একটা ব্যাখ্যা আছে। মোনালিসার হাসি ক্ষণে ক্ষণে আসা যাওয়ার জন্য তার দুর্বোধ্য অভিব্যক্তি মোটেই দায়ী নয়। বরং মানুষের দর্শনেন্দ্রিয় যেভাবে ডিজাইন করা তাই এর মুখ্য কারণ।

বিশ্বজগতকে দেখার জন্য মানব চোখের সুস্পষ্ট দুটো আলাদা এলাকা রয়েছে। কেন্দ্রীয় এলাকাকে বলা হয় ফোভিয়া। এখান দিয়েই মানুষ বর্ণ দেখতে পায়, অক্ষর পড়তে পারে এবং খুঁটিনাটি সবকিছুকে আত্মস্থ করতে পারে। ফোভিয়ার চারপাশের এলাক্‌ যাকে বলা হয় পেরিফেরাল, তা দিয়ে মানুষ সাদা-কালো রঙ, গতি এবং ছায়া দেখে থাকে।

মানুষ যখন অন্য কারো মুখের দিকে তাকায় তখন বেশিরভাগ সময়ই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে সেই ব্যক্তির চোখের দিকে। কাজেই ডঃ লিভিংস্টোনের মতে যখন কোন ব্যক্তির দৃষ্টি কেন্দ্রিভূত হয় মোনালিসার চোখের উপর তখন তার তুলনামূলকভাবে কম নির্ভুল প্রান্তিক দৃষ্টি এসে পড়ে মুখের উপর। যেহেতু প্রান্তিক দৃষ্টি খুঁটিনাটির বিষয়ে মোটেই আগ্রহী নয়, কাজেই স্বাভাবিকভাবে তার কাছে ধরা পড়ে মোনালিসার চোয়ালের হাড়ের ছায়াগুলো।

এই ছায়াই হাসির রূপ নেয়। কিন্তু যখনই দর্শকের চোখ সরাসরি মোনালিসার মুখের উপর পড়ে, তার কেন্দ্রীয় দৃষ্টি ছায়াকে আর দেখে না। ডঃ লিভিংস্টোনের মতে মোনালিসার মুখের দিকে তাকিয়ে কখনোই তার হাসি দেখতে পাওয়া যাবে না। ক্ষণে ক্ষণে হাসির আসা যাওয়া ঘটতে থাকে কারণ মানুষ তাদের দৃষ্টি মোনলিসার মুখের বিভিন্ন যায়গায় সরাতে থাকে বলে। মোনালিসার মধ্যে রসিকতা করার একধরনের সকৌতুক প্রবনতা আছে। যখন আপনি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকবেন তখন সে আপনার পিছনে হাসবে। আর আপনি তার দিকে তাকানোর সাথে সাথেই সে তার হাসি বন্ধ করে দেবে।

অভিনেত্রী জিনা ডেভিসের মধ্যে মোনালিসা এফেক্ট আছে। সবসময় মনে হয় হাসি যেন ঝুলে আছে ঠোঁটে। এমনকি যখন হাসেন না তখনও মনে হয় হাসছেন। ডঃ লিভিংস্টোনের মতে, যেহেতু জিনা ডেভিসের চোয়ালের হাড় খুবই দৃশ্যমান সেকারণেই এরকম মনে হয়।

মোনালিসার রহস্যময় হাসির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া সত্ত্বেও এর নান্দনিক রূপের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন ড. লিভিংস্টোন। কাজেই এই রহস্যটুকুকে হরণ করে এর প্রতি মানুষের আগ্রহকে কেড়ে নিতে চান নি তিনি।

“আমি চাই না লিওনার্দোর রহস্যটুকু কেড়ে নিতে। অসাধারণ প্রতিভাবান এই শিল্পী জীবন থেকেই এই রহস্যটুকু নিয়েছিলেন, কিন্তু কেউই তা খেয়াল করেন নি। আমাদের পাঁচশো বছর লেগেছে তা উদ্ধার করতে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কেন অন্য শিল্পীরা এটা নকল করতে পারেননি। মোনালিসার খুব ভাল নকল করতে হলে যা করতে হবে তা হচ্ছে আঁকার সময় এর মুখের থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে নিতে হবে। এতো সহজ জিনিসটা অন্যেরা যে কেন পারে নি সেটাও এক রহস্য।"

আপনার মন্তব্য