বাংলা ভাষা বিশ্ব বাংলা পরিমণ্ডলের অন্যতম সমৃদ্ধশালী ভাষা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১৭ ১১:২২:২০

মনোজিৎকুমার দাস:

পৃথিবীর কোন জাতিগোষ্ঠীর ভাষাই একদিনে জন্ম হয়ে বর্তমান অবস্থায় আসেনি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বাঙালি ও তার ভাষা বাংলা ক্রমবিবর্তনের ধারায় এক হাজারের বেশি সময় ধরে নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। হাজার বছরেরও আগে আজকের বাংলা ভাষা শুনতে আজকের মতো ছিল না, বর্ণমালাও কিন্তু এ রকম ছিল না। শত শত বছর ধরে পরিবর্তিত হতে হতে আজকে বাংলা ভাষা বৈচিত্রময় ও সমৃদ্ধশালী হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভাল, প্রত্যেকটা জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সত্তার প্রধান বাহক হল তার মুখে বলার ভাষা।  দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া মুখে বলা ভাষাই এক সময় লেখ্য রূপ নেয়, । বাঙালি জাতির মুখের ভাষা হল বাংলা ভাষা।                              

বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মুখের ভাষা বাংলার বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য ঐশ্বর্যমণ্ডিত। এ ভাষার উৎপত্তি , বিবর্তন ও বিকাশ সম্পর্কে মতভেদ  আছে। বাংলা ভাষার উৎপত্তি চর্যাপদ থেকে এসেছে বলে কোন কোন ভাষাবিদ মত প্রকাশ করেন। তবে  কোন কোন ভাষাবিদ বাংলা সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে দাবী করলেও স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন ও ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন যে বাংলার উৎপত্তি কোনভাবেই সংস্কৃত থেকে নয় বরং প্রাকৃত থেকে।এই প্রাকৃত ভাষা মূলত প্রাচীন কথ্য ভারতীয় আর্য ভাষারই শাখা। ড. চট্টোপাধ্যায় তার The Origin and Development of Bengali Language  বইতে প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তির মতকে সমর্থন করেছেন। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ । তাঁর মতে, 'গৌড়ী প্রাকৃত' থেকেই নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ  ঘটেছে। আমাদের দেশের সবচেয়ে পুরনো ভাষার নাম 'প্রাচীন  প্রাকৃত'। কালক্রমে 'প্রাচীন প্রাকৃত' অভিহিত হয় 'আধুনিক প্রাকৃত' রূপে। আধুনিক প্রাকৃত ভাষা থেকে শাখা-প্রশাখা গড়ে উঠে 'গৌড়ী  প্রাকৃত', 'মাগধী প্রাকৃত' ইত্যাদি নামে আরো কয়েকটি প্রাকৃত ভাষার জন্ম হয়। কালের বিবর্তনে প্রাকৃত ভাষার আরো পরিবর্তন ঘটে  নাম হয় অপভ্রংশ। এই অপভ্রংশ থেকে জন্মলাভ করে আসামের 'অহমিয়া' ভাষা, উড়িষ্যার 'উড়িয়া' ভাষা, ভারতের 'হিন্দি' ভাষা এবং এতদঞ্চলের 'বাংলা' ভাষা ইত্যাদি।

প্রাচীন বাংলার মানুষের কথ্য ও লেখ্য ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক চড়াই উৎরাই করে। সত্যি কথা বলতে --- প্রাচীন বাংলার পাল ,সেন ইত্যাদি রাজাদের রাজত্বকালে বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটেনি বরং বাংলা ভাষার উপর পুরোপুরি আগ্রাসন চালানো হয়েছে। ভারতের দক্ষিণ কর্ণাটক থেকে আগত সংস্কৃতভাষী সেন শাসকরা বাংলা ভাষা নিষিদ্ধ করেন। সংস্কৃতকে রাজভাষা করা হয়। অধিকন্তু ‘রৈবব’ নামক নরকের ভয় দেখিয়ে বাংলা ভাষাকে  সাধারণ মানুষ থেকে দূরে রাখার কৌশল করেন তারা। এই ভয়ে রাজকর্মচারী ও উঁচুবর্ণের মানুষেরা বাংলা ভাষা চর্চা বাদ দিলেও সাধারণ মানুষেরা তাতে কর্ণপাত করেননি। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে ১২০৩  সনে সেন শাসনের অবসান হলে  বাংলার রাজভাষা করা না হলেও এ দেশীয়রা আবার নতুন করে বাংলা ভাষা চর্চা করার সুযোগ পান।  বাংলায় নবাবদের শাসনামলেও কিন্তু বাংলা রাজ ভাষার মর্যাদা লাভ করতে পারেনি। রাজ দরবারের ভাষা উর্দু কিংবা ফার্সি ।   

সুলতানি শাসনামলের প্রথম দিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত ছিল বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী। হাজি শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ সনে বঙ্গ, রাঢ়, গৌড়, পুণ্ড্রবর্ধন, লক্ষণাবতী, হরিকেল, সমতট ইত্যাদি বাংলাভাষী অঞ্চলকে একত্রিত করে 'সুবহি বাঙ্গালা' নাম দেন। আর এর অধিবাসীদের নাম দেন 'বাঙালি'। এতে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায় এবং বাংলা ভাষার পুনর্জন্ম হয়। এ সময় বড়ু চণ্ডীদাস 'শ্রী কৃষ্ণকীর্তন' (১৩৫০) কাব্য রচনা করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বন্ধ্যত্ব ঘুচান। শাহ্‌ মুহাম্মদ সগীর 'ইউসুফ জুলেখা' (১৩৮৯-১৪১০) রচনা করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে রোমান্টিকতার আবির্ভাব ঘটান। পরবর্তীতে গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ, জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ্‌, রুকনুদ্দীন বারবাক শাহ্‌, আলাউদ্দীন হুসেন শাহ প্রমুখ মুসলিম নৃপতিদের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় মালাধর বসু, জৈনুদ্দীন, বিজয় গুপ্ত, কৃত্তিবাস,  বিপ্রদাস পিপিলাই প্রমুখ কবি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। মূলত পাঠান বংশের স্বাধীন সুলতানদের শাসনামলে (১৩৩৮-১৫৭৫) বাংলা ভাষার পুনর্জাগরণ হয়। এরপর মোঘল আমলে সৈয়দ সুলতান, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, আব্দুল হাকিম, দৌলত উজীর বাহারাম খান, কোরেশী মাগন ঠাকুর, সৈয়দ আলাওল, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর প্রমুখের সাহিত্য সাধনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি লক্ষ করা যায়।

কিন্তু ১৭৫৭ সনে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার শাসকের পরিবর্তনের সাথে ভাষা-সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হয়। এতে মুসলিম শাসনামলের বাংলাভাষার পুনর্জাগরণ স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং নিম্ন মানের মিশ্রভাষার 'পুঁথি সাহিত্য' ও 'কবিয়াল গানে'র আর্বিভার ঘটে। এ সময় ফার্সি পরিবর্তে ইংরেজিকে করা হয় রাজভাষা। উল্লেখ্য মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষায় আরবি, ফার্সি, উর্দু, পর্তুগিজ, হিন্দিসহ অনেক বিদেশি শব্দের সমাবেশ ঘটে। আর ইংরেজ শাসনামলে বাংলা ভাষায় যোগ হয় ইংরেজি, সংস্কৃত, ফরাসি, স্পেনিশসহ বিভিন্ন ভাষার অনেক শব্দ। এতে বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার, সৌন্দর্যও বৈচিত্র্য বেড়ে যায়। ইংরেজ শাসনামলের প্রথম দিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাঘাত ঘটলেও পরে উন্নতি সাধিত হয়। ইংরেজ শাসনামলেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব হয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শুধু কাব্য সাহিত্য পাওয়া যায়, এ সময় বাংলা ভাষায় কোনো গদ্য সাহিত্য রচিত হয়নি। অন্যদিকে ইংরেজ শাসনামলে বাংলা ভাষায় গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি গদ্য সাহিত্যের সূচনা হয়। যদিও এ সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম,  রজনীকান্ত সেন,অতুলপ্রসাদ , দ্বিজেন্দ্রনাথ রায়, জীবনানন্দ দাশ, মীর মশাররফ হোসেন  জসীম উদ্দীন, প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর কাব্যচর্চার প্রারম্ভ কালপর্বে ইংরেজি ভাষায় ‘ক্যাপটিভ লেডি’ লিখে সাফল্য লাভ করতে না পেরে এক সময় বুঝতে পারেন সমৃদ্ধশালী বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে তিনি অনুতপ্ত, তাই তিনি লেখন- হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;/ তা সবে , (অবোধ আমি) অবহেলা করি,/------ স্বপনে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে,- “ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,/ ----------

বৈচিত্র্যময়, সৌন্দর্যে ঋদ্ধ বাংলা ভাষায় কাব্যচর্চা করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক সময় তাঁর মাস্টার পিস‘ মেঘনাদ বধ ’ কাব্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যে নিজের আসন পাকাপোক্ত করলেন। পঞ্চকবির অন্যতম কবি অতুলপ্রসাদ বাংলা ভাষার গুণকীর্তন করলেন এক সময় এ ভাবে: “আ মরি বাংলা ভাষা/মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা ।।/মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা ।।/আ মরি বাংলা ভাষা!/মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা/কি যাদু বাংলা গানে! গান গেয়ে দাঁড়িমাঝি টানে ।।গেয়ে গান নাচে বাউল ।। /গান গেয়ে ধান কাটে চাষা ।। /আ মরি বাংলা ভাষা!/মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!/ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা,/আনল দেশে ভক্তি-ধারা।।/আছে কৈ এমন ভাষা ।। / এমন দুঃখ-শ্রান্তিনাশা ।।/আ মরি বাংলা ভাষা! /মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! /বিদ্যাপতি, চণ্ডী গোবিন, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন :/ঐ ফুলেরই মধুর রসে ।।/বাঁধলো সুখে মধুর বাসা ।।/আ মরি বাংলা ভাষা! /মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!/বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনলো মালা জগত জিনে ।।/তোমার চরণ-তীর্থে আজি ।।/ জগত করে যাওয়া-আসা ।।/আ মরি বাংলা ভাষা!/মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! /ঐ ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে ‘মা, মা’ ব’লে ।।ঐ ভাষাতেই বলবো হরি, আমি ঐ ভাষাতেই বলবো হরি সাঙ্গ হ’লে কাঁদা হাসা ।। /আ মরি বাংলা ভাষা! /মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!” অতুলপ্রসাদের এই গানের মধ্যে বাংলা ভাষার  বৈচিত্র্য, সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা নিহিত আছে এ কথা নির্দ্বিধার বলা যায়।
 
১৯১৩ সনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যে নোবেল বিজয় বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্যের মর্যাদা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা,গান, গল্প, উপন্যাস , প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বিশ্বজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর গীতাঞ্জলী ও গীতবিতানের কবিতা ও গান বাংলার ভাষার অমূল্য সম্পদ । কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা ও গানে বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ করেছেন , যা আমাদের বাংলা ভাষার  সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা প্রতীক হিসাবে চিরন্তন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে বলা শুরু করলে নজরুলের গানকে সম্মানিত করতে হয় দুর্দান্ত শক্তির একটা মাধ্যম হিসেবে। নজরুলের লেখা গান আর কবিতা ‘চল চল চল’ কিংবা ‘দুর্গমগীরি কান্তার মরু’,  ‘কারার ওই লৌহ কপাটের মতো জাগানিয়া সব গান। চারণকবি মুকুন্দ দাস তাঁর গানে বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ করেছেন। তাঁর গান ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে’ মতো  গানগুলো আজও বাংলা ভাষার অপূর্ব সম্পদ। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্বের শহীদ ক্ষুদিরামের আত্মবলিদানকে স্মরণ করে  বাঁকুড়ার লোক কবি পিতাম্বর দাসের ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।’ ‘একবার বিদায় দে মা/ হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’।  দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তার ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটির জন্য বাংলা ভাষার দেশাত্মবোধক গান বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের উদ্দীপনার উৎস ।

ব্রিটিশ ভারতবর্ষের  ইংরেজ শাসনামল ও তার পূর্ব থেকে বৈচিত্র্যময় বাংলা ভাষা সাহিত্য , সঙ্গীতে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করলেও তা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়নি। ’৪৭ সালের দেশভাগের পর দ্বিজাতিতত্ত্বে ভিত্তিতে প্রায় হাজার মাইলে ব্যবধানে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ববাংলা ( পরে পূর্ব পাকিস্তান) নামের দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি  হলে পূর্ব বাংলার অধিবাসীরা বাংলা ভাষা পূর্ববাংলার রাষ্ট্র ভাষা হবে বলে স্বপ্ন দেখল। তারা বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুললে কিন্তু উর্দুভাষী শাসকেরা বাঙালিদের দাবি উপেক্ষা করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করল। এতে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ। জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন উপেক্ষা করে আন্দোলন করেন তারা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সনের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন, ১৩৫৮ বাংলা) তারিখে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাম, বরকত, জব্বার, শফিক, রফিক, শফিউদ্দীনসহ অনেকে। বাংলা ভাষার অনেক কবি বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণে মর্মস্পর্শী গান রচনা করেন। সে সব গানের মধ্যে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা ও আলতাফ মাহমুদের সুরের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো’ গান ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করে।  তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৫৬ সনে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হলেও প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন পাকিস্তানী নামে মাত্রই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করে।

২৯ ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে নির্মিত হয় ঢাকায় 'শহীদ মিনার'। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র বার শহীদ মিনারকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।

বায়ান্ন ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসকচক্র তাদের বর্বর সেনাবাহিনী নিরস্তর বাঙালিদেরকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তি সংগ্রামে তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ’৭১ এর ১৬  ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম লাভ করায়  বাংলা ভাষা যথার্থ ভাবে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ করে। ফলে বৈচিত্র্যময় সমৃদ্ধশালী বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির দুয়ার খুলে যায়।

বায়ান্ন ভাষা আন্দোলনের ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ জাতিসংঘের  ইউনেস্কো  ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখকে  'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ’'  ঘোষণা করে ১৯৯৯ সালে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় দুই শতাধিক রাষ্ট্র প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়েও বিশ্ব দরবারে বাংলাভাষার অবস্থান আজ সুসংহত হয়েছে। আর এ ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অর্জনের জন্য আত্মত্যাগ করে বিশ্ববরণীয় হয়ে আছেন বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান ভাষা শহীদেরা।
 
বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধশালী বাংলা ভাষা আজ বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, আসাম  ইত্যাদি  প্রদেশে স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রায় ৩০ কোটি  বাংলাভাষাভাষী মানুষ আজ বিশ্ব বাংলার বাসিন্দা, তারা বাংলা ভাষাকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির দুয়ারে পৌঁছে দেবে।

আপনার মন্তব্য