টমাস ট্রান্সট্রোমার ও তাঁর একগুচ্ছ কবিতা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-২৯ ০১:২৯:০০

ভূমিকা ও অনুবাদ- মনোজিৎকুমার দাস:

টমাস ট্রান্সট্রোমার (জন্ম: ১৫ এপ্রিল ১৯৩১-- মৃত্যু: ২৬ মার্চ ২০১৫) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সুইডিশ কবি ও মনস্তত্ত্ববিদ।

সুইডিশ ভাষায় লেখা তার কবিতায় প্রকৃতি , ইতিহাস, মৃত্যু, স্মৃতি ইত্যাদির অনুষঙ্গ বিশেষ ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তাঁকে মরমীবাদের নিপুণ শিল্পী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তিনি তাঁর কবিতায় প্রকৃতিচর্চা, মানুষের আত্মপরিচয়, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় অনুষঙ্গের সন্ধান করেছেন।

১৯৩১ সালের ১৫ এপ্রিল সুইডেনের স্টকহোমে টমাস ট্রান্সট্রোমার জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পুরো নাম টমাস গোস্টা ট্রান্সট্রোমার  ১৯৫৪ সালে তাঁর প্রথম  কবিতা সংকলন ১৭ পোয়েমস প্রকাশিত হয়। তিনি স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন, অতিরিক্ত বিষয় হিসাবে ইতিহাস, ধর্ম  ও সাহিত্যও অধ্যয়ন করেন।  

১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ট্রান্সট্রোমার  মনোবিজ্ঞানী হিসাবে রক্সটুনা সেন্ট্রারে কিশোর অপরাধীদের মঙ্গলের জন্যে কাজ করেন। ট্রান্সট্রোমারের  ১৫ টি নির্বাচিত কাব্যসংকলন বিশেষ ভাবে সারাবিশ্বে সমাদৃত হয়ে আসছে। এগুলো  ৬০টির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়।

তাঁর কাব্যসংকলনগুলোর মধ্যে ‘দ্য হাফ ফিনিশড হেভেন’, ‘উইন্ডোস অ্যান স্টোন’, ‘বালটিকস’, ‘ফর দি লিভিন দি ডেথ’,  ‘দ্য সরো গোন্ডলা’ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । টমাস ট্রান্সট্রোমার ২০১১ সালে  সুইডিশ নোবেল একাডেমী কর্তৃক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়ে বিশ্বসাহিত্যাঙ্গণে ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ২৬ মার্চ ২০১৫ এ  ৮৩ বছর বয়সে লোকান্তরিত হন।

তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ সুইডিশ ভাষায় লেখা টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতার রবিন ফুলটনের ইংরেজি ভাষান্তর থেকে ৫ টি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করা হলো।

মুখোমুখি
ফেব্রুয়ারিতে বসবাস এখনো চলছে
পাখিরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও উড়েছিল, আর মন
উদীপ্ত হয়েছিল ভূদৃশ্যের বিপরীতে-
যেহেতু তা একটা নৌকা উত্তাল স্রোতে ভাসমান-
ব্রিজটির বিপরীত দিকে শুয়ে আছে আদ্রভূমি,
গাছগুলো আমার দিকে পিঠ দিয়ে দাড়িয়ে,
পুরু বরফ শুকনো খড়ের সাথে মিশে আছে।
পদচিহ্নগুলো কঠিন বহিরাবরণের নিচে মিশে গেছে।
একটা ত্রিপলের নিচে ভাষা পিনবদ্ধ।
একদিন কিছু একটা জানালার দিকে এগিয়ে আসে,
কাজ রেখে আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখি।
রঙের ছটা ছাড়িয়ে পড়ে। সবকিছু বদলে গেছে।
পৃথিবী ও আমি একে অপরের দিকে তাকাই।

শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় জুলাই
লোকটি গাছের নিচে উপরে দিকে মুখ করে শুয়ে
পত্রপল্লবের দিকে তাকিয়ে আছে ,
তাকিয়ে থাকতে থাকতে লোকটার চোখে জল আসে।  
লোকজনের থেকেও তাড়াতাড়ি থামগুলো পুরনো হয়ে গেছে,
সিলভার - গ্রে কাঠের গুড়ি ও পাথরগুলো ওদের পাকস্থলীতে।
নিষ্প্রভ আলো পড়েছে ডান দিকে-
লোকটি সারাদিন একটা খোলা নৌকায় ভ্রমণ করেছে
উদ্বেল উপসাগরের বুকে,
অবশেষে একটা নীল ল্যাম্পে ভেতরে সে ঘুমাবে
দ্বীপপুঞ্জ যেন হামাগুড়ি দেয়
কাচের উপর দিয়ে চলা বড় মথটার মতো।

দম্পতি
তারা আলো নিভিয়ে দিলে বাতির সাদা সেড
কয়েক মুহূর্তের জন্যে জ্বল জ্বল করে  
অন্ধকারে রাখা একটা গ্লাসের মতো।
হোটেলটির দেওয়ালগুলো কালো আকাশের দিকে উঠে গেছে।
ভালবাসার আলোড়নগুলো স্থিতু হয়েছে, তারা ঘুমাচ্ছে
কিন্তু তাদের সবচেয়ে গোপন ভাবনাগুলোর মিলন ঘটেছে
যেহেতু দুটো রঙ মিলে গিয়ে পরস্পরের দিকে বয়ে যায়
ওয়েট পেপারের ওপরে একটা স্কুল বালকের পেন্টিংয়ে।
অন্ধকার ও নীরবতা। শহরটি টানাটানি করে ঘনিষ্ঠ হয়েছে
আজ রাতে । জানালাগুলো বন্ধ। বাড়িগুলো কাছাকাছি এসেছে।
তারা শ্বাসরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে, যেন অপেক্ষা রত,
একটা কাক,  যার মুখে একটুও অভিব্যক্তির চিহ্ন নেই।

মধ্যরাতের সন্ধিকাল
কাঠপিঁপড়ে নীরবে পাহারা দেয়, তাকায় না
কোন কিছুর দিকেই। কোন কিছুই শোনে না,
কিন্তু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে পত্রপুঞ্জের থেকে-
রাতের মরমর ধ্বনি গভীর হয় গ্রীষ্মের প্রহরে।

পাইন গাছ দাঁড়িয়ে থাকে ঘড়ির কাটার মতো,
পিঁপড়েটা দীপ্ত হয়ে উঠে পাহাড়ের ছায়ায়।
পাখি চিৎকার করে! অবশেষে মেঘপুঞ্জ
ধীরে ধীরে মোড়াতে শুরু করে।

শহরতলি
মোটের উপর মানুষেরা একই রঙের যেহেতু
পৃথিবীটা একটা গর্তের বহি:প্রকাশ।
এটা একটা মধ্যস্থল, নগরী নয়, নয় দেশ,
দিগন্তের উপরের কনসট্রাকশন ক্রেন  
যেন একটা লাফ দিতে যাচ্ছে , কিন্তু ঘড়িগুলো তা চায় না।
সিমেন্টের পাইপ চারদিকে ছড়ানো ছিটানো
শুকনো জিবে দিয়ে যেন আলো চাটছে।
মেরামত চলছে সাবেক গোলাঘরগুলোতে,
পাথরগুলো তাদের ছায়া ছড়িয়েছে এলোমেলো
চাঁদের জমিনের বস্তুর মতো,
আর এ দিকটা প্রায় গড়ে উঠছে।

আপনার মন্তব্য