প্রকাশিত: ২০১৬-০৬-১০ ১৭:৪৯:০৬
আপডেট: ২০১৬-০৬-১১ ১৬:৫২:৪৭
ফরিদ আহমেদ:
বাংলার নারীদের এন্ট্রান্স পাশের গল্প করার আগে, একজন এন্ট্রান্স ফেলের গল্প দিয়ে শুরু করি। এই ভদ্রলোকের নাম দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। জন্মেছিলেন ১৮৪৪ সালে, ঢাকার বিক্রমপুরের মাগুরখণ্ড নামক গ্রামে।
এখন আমরা যেটাকে এসএসসি বলি, আগে সেটাকে ব্রিটিশ আমলে এন্ট্রান্স পরীক্ষা বলা হতো। দ্বারকানাথ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করতে পারেন নি। কয়বার ফেল করেছিলেন, সে বিষয়ে অবশ্য তথ্যটা সঠিকভাবে জানা যায় না। যাই হোক, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করে গ্রাম ত্যাগ করেন তিনি। শিক্ষকতার চাকরি শুরু করেন ফরিদপুরের লোনসিং গ্রামে।
তাঁর সময়ে সমাজ মোটেও নারীবান্ধব ছিল না। পুরুষদের মধ্যে নারী-বিদ্বেষ এবং নারীদের হেয় চোখে দেখাটা ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। মেয়েদের অবস্থা সে সময় পশুর চেয়ে খুব একটা উন্নত কিছু ছিল না। দ্বারকানাথও বাল্য এবং কৈশোরে চাণক্য শ্লোক পাঠ করে প্রবলভাবে নারী-বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। কিন্তু, তাঁর এই নারী-বিদ্বেষ মানসিকতা হঠাৎ করে ধাক্কা খায় এক মর্মান্তিক ঘটনায়।
তখন তাঁর বয়স মাত্র সতেরো। তাঁদের গ্রামের পরিচিত এক কুলীন কন্যাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে তার আত্মীয়স্বজনরা। এর কারণ অনুসন্ধানে কৌতূহলী হন সদ্য তরুণ দ্বারকানাথ। এর অনুসন্ধানে নেমে তিনি অবাক হয়ে জানতে পারেন যে, এই কুলীন কন্যা হত্যা বিচ্ছিন্ন কিছু না। তাঁদের গ্রামেই বছরে বত্রিশ-তেত্রিশজন কুলীন কন্যাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু, কলেরার আক্রমণে এরা মারা গিয়েছে, এই মিথ্যা বলে হত্যাকারীরা নিষ্কৃতি পেয়েছে। কুল হারানোর ভয়ে অকুলীন কারো কাছে কন্যা সম্প্রদান তখন করা হতো না। ফলে, বহু কুলীন কন্যাকেই অবিবাহিত জীবন যাপন করতে হতো, কিংবা বহু সতীনের সাথে সংসার করতে হতো। কাউকে কাউকে আবার অতি বৃদ্ধ কারো কাছেও সম্প্রদান করা হতো। এই মেয়েরাই বয়সের দোষে কলঙ্কময় পথে পা বাড়াতো। সামাজিক এই কলঙ্ককে ধামাচাপা দিতেই পরিবারের লোকেরা তাদের হত্যা করতো।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এমনভাবে দ্বারকানাথের মনে দাগ কাটে যে, তিনি নারীদের দুঃখ, দুর্দশা দুর করার জন্য কঠিন ব্রত গ্রহণ করেন। সেই উদ্দেশ্যে নারীর কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে একটা পত্রিকা বের করেন। এর নাম‘অবলাবান্ধব’।
দ্বারকানাথের নিজের ভাষাতেই এই ঘটনা শুনি আমরা:
“এদেশীয় কুল কন্যাগণ জীবনে যে বিষম দুঃখ দুর্গতি ভোগ করিয়া থাকেন, তাহা যাহাদিগের চক্ষু আছে, তাঁহাদের অগোচরে নাই। কিন্তু যাঁহারা চক্ষু থাকিতে অন্ধ, তাঁহারা ইহা দেখিতে পান না। যদি একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা আমাদিগের চক্ষু প্রস্ফুটিত না করিত, হয়ত আমরাও আজীবন অন্ধই থাকিতাম। একটি পরমা সুন্দরী যুবতী কুলীন কন্যাকে তাঁহার আত্মীয়েরা বিষ প্রয়োগ করিয়া হত্যা করেন। তখন আমাদিগের বয়স সপ্তদশ বর্ষ। লোক পরম্পরায় এই ঘটনা আমাদিগের শ্রুতিগোচর হইল। এইরূপে যাহার অপমৃত্যু ঘটিল, আমরা তাহাকে জানিতাম, সুতরাং আমাদিগের হৃদয়ে দারুণ আঘাত লাগিল। আমাদিগের জনৈক সমবয়স্ক ব্যক্তির নিকট শুনিতে পাইলাম, এরূপ ঘটনা বিরল নহে, প্রায় প্রতি বর্ষেই ঘটিয়া থাকে। অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া জানিলাম, তাঁহার কথা সত্য; তৎপূর্ব্ব সপ্তদশ বৎসরে একটি গ্রাম হইতে ৩২/৩৩টি স্ত্রীলোকের এইরূপে মৃত্যু হইয়াছে। মানুষের হৃদয় এককালে পাষাণ না হইলে, এই অবস্থায় দ্রব না হইয়া পারে না। আমরা বাল্যকালে চাণক্য পণ্ডিতের শ্লোক সকল পাঠ করিয়া স্ত্রীজাতির ঘোরতর বিদ্বেষী হইয়া উঠিয়াছিলাম। তাহাদিগকে সর্ব্বদা বিদ্রূপ ও উপহাস করিতে আমাদিগের আমোদ বোধ হইত। কিন্তু, তখন বুঝিলাম, ইহারা উপহাসের পাত্র নহে, কৃপার সামগ্রী। এই সময় হইতে স্ত্রীজাতির প্রতি আমাদিগের মমতা জন্মিল। তখন ভাবিলাম, যদি বিন্দু পরিমাণেও ইহাদের দুঃখ দুর্গতি দূর করিতে পারি, জীবন সার্থক হইবে। এই অভিপ্রায়ে অবলাবান্ধবের জন্ম হয়।”
অবলাবান্ধব পত্রিকা প্রকাশিত হয় ফরিদপুর থেকে। তখন তাঁর বয়স পঁচিশ। কিন্তু, ফরিদপুরে যাবার আগেও কুলীন বিপন্ন নারীদের উদ্ধারকাজ শুরু করেন তিনি। তাঁর সাথে বিক্রমপুরের আরো কয়েকজন তরুণ এসে যোগ দেন। এঁরা হচ্ছেন সারদাকান্ত, বরদাকান্ত, নবকান্ত, শীলাকান্ত, নিশিকান্ত এবং অঘোরনাথ। এঁরা বিপন্ন কুলীন কন্যাদের উদ্ধার করে কোলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। সেখানে সেই সব কন্যাদের সুপাত্রে অর্পণের ব্যবস্থা করতো অন্য একটা দল। এগুলো করতে গিয়ে এঁরা বহুবারই নিজেদের জীবন বিপন্ন করেছেন, কেউ কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন নারী অপহরণের মামলা হবার কারণে।
‘অবলাবান্ধব’এক পাক্ষিক পত্রিকা ছিল। এই পত্রিকায় নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দ্বারকানাথ অনল বর্ষণ করতে লাগলেন। ফরিদপুরের মতো প্রত্যন্ত একটা শহর থেকে প্রকাশিত পত্রিকার আগুনের তাপ গিয়ে লাগলো কোলকাতা এবং ঢাকার মতো বড় শহরের তরুণ ছাত্রদের গায়ে।‘অবলাবান্ধব’দিয়ে দারুণভাবে আন্দোলিত হলো তারা। কোলকাতা থেকে সংস্কৃত কলেজের ছাত্র শিবনাথ ভট্টাচার্য (ইনিই পরে পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী হয়েছিলেন) ও উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (ইনি পরে লেফটেন্যান্ট উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হয়েছিলেন) দ্বারকানাথকে কোলকাতায় আসার জন্য চিঠির পর চিঠি লিখতে থাকলেন। যে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য দ্বারকানাথ লড়ছেন, তা কোলকাতা থেকে করলে আরো অনুকূল হবে, এটাই ছিল তাঁদের বক্তব্য। তাঁদের অনুরোধে ১৮৭০ সালের এক বর্ষাকালে ফরিদপুর থেকে কোলকাতায় এসে হাজির হন দ্বারকানাথ।
দ্বারকানাথের এই কোলকাতা আগমন সম্পর্কে পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন:
“একদিন কলেজে পড়িতেছি, এমন সময় উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আসিয়া আমাকে বলিল, “ওরে ভাই অবলা-বান্ধবের এডিটার কলিকাতায় এসেছে, আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এখানে এসেছে। অমনি আমাদের‘হিরো’কে দেখিবার জন্য বাহির হইলাম। গিয়া দেখি এক দীর্ঘাকৃতি একহারা পুরুষ, স্কুল মাস্টারের মত লম্বা চাপকান পরা, দাঁড়াইয়া আছে। তিনিই দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় …….. কিছুদিন পরেই তিনি অবলাবান্ধব লইয়া কলিকাতায় আসিলেন এবং পূর্ব্ববঙ্গের যুবকদিগের নেতা স্বরূপ হইয়া ব্রাহ্মসমাজে স্ত্রী স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করিলেন।”
দ্বারকানাথ কোলকাতায় একটু স্থির হয়ে বসেই দুর্গামোহন দাস, অন্নদাচরণ খাস্তগির, গুরুচরণ মহলানবিশ, ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষদের মতো ব্রাহ্ম প্রগতিবাদীদের সহায়তায় অত্যন্ত শক্তিশালী একটা সংঘ গঠন করলেন। এই সংঘের মাধ্যমে‘অবলাবান্ধব’পরিচালনা শুরু করলেন। সেই সাথে নানা ধরনের কার্যকলাপ শুরু করলেন যা নারীদের জন্য মঙ্গলকর।
এই সময় বিক্রমপুরের আরেক তরুণ নবকান্ত চট্টোপাধ্যায় ঢাকা থেকে ‘মহাপাপ বাল্যবিবাহ’নামে একটা পত্রিকা বের করে নারীমুক্তি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি এবং তাঁর সহযোগীরা অনেক কুলকন্যাকে উদ্ধার করে কোলকাতায় দুর্গামোহনের আশ্রয়ে পাঠাতে শুরু করলেন। এজন্য তাঁদের নানাভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে, বিপদের মুখেও পড়তে হয়েছে। বিধুমুখী নামের এক মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে সারদানাথ এবং বরদানাথ নারী অপহরণ মামলায় গ্রেফতারও হয়েছিলেন। ঢাকা হাইকোর্টের জাজ জ্যাকসন সাহেব এবং অনুকুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই অপহরণ সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং বিধুমুখীর জন্য হিতকর বলে তাঁদের মুক্তি দেন।
দুর্গামোহনের কাছে যে সব মেয়েরা এসে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের শিক্ষার জন্য প্রগতিবাদী দল চিন্তায় পড়ে গেল। এই সময় ব্রাহ্ম সমাজের নেতা কেশবচন্দ্রও নারীদের মুক্তির জন্য কাজ করছিলেন। নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য নারী শিক্ষালয়ও গড়েছিলেন তিনি। এখানেই মেয়েগুলোকে ভর্তি করানো যেত। কিন্তু, কেশবচন্দ্রের ধীরগতিতে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তাঁদের অপছন্দ ছিল। এছাড়া কেশবচন্দ্র নারী শিক্ষালয় গড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নারীদের অঙ্ক এবং বিজ্ঞান শিক্ষা দেবার মোটেও পক্ষপাতী ছিলেন না।
এই সমস্যা দূরীকরণে প্রগতিবাদী দলের সদস্যরা নিজেরাই একটা স্কুল খোলার পরিকল্পনা করলেন। ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষ এগিয়ে এলেন আর্থিক সাহায্য নিয়ে। দুর্গামোহনের বাড়িতে আশ্রয় পাওয়া কুলকন্যারা, সেই সাথে দুর্গামোহনের কন্যা সরলা ও অবলাকে (সরলা পরে আচার্য পি,কে রায়ের স্ত্রী হয়েছিলেন, আর অবলা স্যার জগদীশচন্দ্র বসুকে বিয়ে করেছিলেন) নিয়ে বালিগঞ্জে‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’স্থাপন করলেন।ব্যারিস্টার মনোমোহনের বাসায় মিস অ্যানেট অ্যাক্রয়েড নামের একজন শিক্ষানুরাগী মহিলা বাস করতেন। কেশবচন্দ্র সেনের কথায় মুগ্ধ হয়ে এই ইংরেজ তরুণী নারীশিক্ষা দেবার জন্য কোলকাতায় এসেছিলেন। এসে দেখেন যে, কেশবচন্দ্র সেন নারীদের শিক্ষা দেন ঠিকই, তবে তা খণ্ডিত শিক্ষা। এর মাধ্যমে নারীদের প্রথাগত নারী করে রাখাই হচ্ছে তাঁর মূল উদ্দেশ্য। কেশব সেনের সঙ্গে অ্যানেটের প্রকাশ্যেই কলহ বেঁধে যায়। কারণ, একজন চান‘ভদ্রমহিলা’তৈরি করতে আর আরেকজন চান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীর জন্ম দিতে। তিনি এবং দ্বারকানাথ এই স্কুলের শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন।
এই স্কুল চললো মাত্র আড়াই বছর। মিস অ্যাক্রয়েডের বিয়ের কারণে তিনি স্কুল ত্যাগ করেন। উঠে যায় হিন্দু মহিলা স্কুল। হিন্দু মহিলা স্কুলের মৃত্যু ঘণ্টা বাজলেও দ্বারকানাথ হাল ছাড়েন না। ১৮৭৬ সালে তিনি‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’স্থাপন করেন। দুর্গামোহন দাসের স্ত্রী একে টিকিয়ে রাখতে এগিয়ে আসেন। তিনি প্রতি মাসে স্কুলে একশো টাকা করে দিতেন।
এবার স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা আরো বাড়লো। এদের মধ্যে ছিল জগদীশচন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণপ্রভা বসু, সরলা দাস, হরসুন্দরী দত্ত, স্বর্ণময়ী দত্ত, স্বর্ণময়ী চ্যাটার্জি, বিনোদমণি বসু, কাদম্বিনী বসু, গিরিজাকুমারী সেন ও অবলা দাস।
মেয়েদের অঙ্ক, ভূগোল, স্বাস্থ্যতত্ত্ব এগুলো শেখানোর জন্য ভালো বাংলা বই না থাকাতে দ্বারকানাথ নিজেই এই সমস্ত বিষয়ে বই লিখে ফেললেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সরলা দাস এবং কাদম্বিনী বসু এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু, সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। এন্ট্রান্স পরীক্ষা তখন হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ভারতবর্ষ তো অনেক দূরের কথা, ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়েও মেয়েদের পরীক্ষা দেবার অনুমতি ছিল না।
দ্বারকানাথ যখন তাঁর ছাত্রীদের নিয়ে কোলকাতায় লড়াইয়ের মাঠে প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন সবার অলক্ষ্যে ভারতের আরেকপ্রান্তে আরেক বাঙালি খৃস্টান নারী একাকী এই লড়াইয়ে এর মধ্যেই নেমে পড়েছেন। এই নারীর নাম চন্দ্রমুখী বসু।
চন্দ্রমুখী দেরাদুনের‘ডেরা স্কুল ফর নেটিভ ক্রিশ্চান গার্লস’নামের একটা মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করতো। এন্ট্রান্সের পড়া সমাপ্ত হবার পরে, ওখানেই সাধারণত মেয়েরা থেমে যেতো। যেহেতু তাদের পরীক্ষা দেবার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু, চন্দ্রমুখী অন্য ধাতুতে গড়া মেয়ে। তিনি পরীক্ষা দেবার জন্য আবেদন করে বসলেন। স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল রেভারেন্ড ডেভিড হিরন পড়ে যান বিপদে। তাঁকে ঘুষ হিসাবে বেশ কিছু বই দিয়ে পরীক্ষা দেবার সংকল্প থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু, চন্দ্রমুখী অনড়। তিনি পরীক্ষা দেবেনই। ফলে বাধ্য হয়ে রেভারেন্ড হিরন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন জানালেন চন্দ্রমুখীর পরীক্ষা নেবার জন্য।
১৮৭৬ সালের ২৫শে নভেম্বর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এ বিষয়ে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হয়। চন্দ্রমুখী বসুকে প্রাইভেটলি পরীক্ষা দেবার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে সেখানেও নানা ধরনের শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। পাশ করলেও অফিসিয়াল পাশ লিস্টে তাঁর নাম থাকবে না, এটাও বলে দেওয়া হয়। সহজ কথায় চন্দ্রমুখী এন্ট্রান্স পাশ, এটা অফিসিয়ালি কোথাও দাবী করতে পারবে না।
সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তটা ছিল এরকম:
“এই শর্তে চন্দ্রমুখীকে মুসৌরী শহরে পরীক্ষা দেবার অনুমতি দেওয়া হলো যে, তাঁকে নিয়মিত পরীক্ষার্থী বলে গণ্য করা হবে না এবং পরীক্ষকগণ তাঁর উত্তর পরীক্ষা করে পাশের যোগ্য নম্বর দিলেও উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশ হবে না।”
দ্বারকানাথ তাঁর ছাত্রীদের এন্ট্রান্স পরীক্ষার বিষয়ে অগ্রসর হতে গিয়ে চন্দ্রমুখীর ঘটনা জানতে পারলেন, কিন্তু দমে গেলেন না। কারণ, তাঁর কাজ বরং অনেকখানি সহজ করে দিয়ে গিয়েছেন চন্দ্রমুখী। চন্দ্রমুখীর দেখানো পথ ধরে এগিয়ে গেলেন। প্রভাবশালী লোকজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার আর্থার হবহাউজের সাথেও দেখা করলেন তিনি। সৌভাগ্যক্রমে ইনিও নারী হিতৈষী ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় এই সিদ্ধান্তে এলো যে, এদের পরীক্ষা নেওয়া হবে, তবে তার আগে এদেরকে একটা প্রারম্ভিক পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
১৮৭৭ সালে এই পরীক্ষা নেওয়া হলো। পোপ সাহেব ইংরেজির, গ্যারেট সাহেব অঙ্কের, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাসের এবং পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার বাংলার পরীক্ষক নিযুক্ত হলেন। সরলা এবং কাদম্বিনী দুজনে পরীক্ষা দিলেন। এই পরীক্ষকদের সকলেই তাঁদের পরীক্ষা পর্যালোচনা করে তাঁরা যে পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত এই সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন।
১৮৭৮ সালের ২৭শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে মার্কবি সাহেব এই ঐতিহাসিক প্রস্তাব দিলেন, “That the female candidates be admitted to the University examination, subject to certain rules.”
সিণ্ডিকেটের সভায় সিদ্ধান্ত হলো যে, পুরুষ ও নারী পরীক্ষার্থীদের পাঠ্য পুস্তকে ও পরীক্ষা প্রশ্নে কোনো তারতম্য থাকবে না, তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মনোনীত একজন মহিলা তত্ত্বাবধায়িকার তত্ত্বাবধানে মহিলা প্রার্থীরা পরীক্ষা দেবে। এর জন্য স্বতন্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হবে।
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখনও ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নেই। ভারতবর্ষের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তো বলাই বাহুল্য।
সরলা দাস এবং কাদম্বিনী বসু প্রারম্ভিক পরীক্ষা দিলেও মূল পরীক্ষায় অংশ নেন শুধুমাত্র কাদম্বিনী বসু। সরলার ইতোমধ্যে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে তিনি ঢাকা চলে যান। কাদম্বিনী দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ মিস করেছিলেন তিনি।
কাদম্বিনী এন্ট্রান্স পাশ করার ফলে বেথুন স্কুলে, স্কুলের পাশাপাশি কলেজ খোলার দাবি উঠলো। কলেজ খোলাও হলো। এই সময় দৃশ্যপটে এসে হাজির হলেন আবার চন্দ্রমুখী বসু। তিনিও কাদম্বিনীর সাথে কলেজে পড়ার আবেদন জানালেন। কিন্তু, তাঁকে যেহেতু সরকারীভাবে সনদ দেওয়া হয় নি, তাঁর ভর্তি হওয়ার আবেদন নাকচ হয়ে যায়। চন্দ্রমুখীও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে দাবী জানালেন তাঁকে কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ করে দেবার জন্য, কারণ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তিনিও পাশ করেছেন। তাঁর এ দাবি সিনেটে উঠলো এবং সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তাঁকেও কলেজে ভর্তি হবার অনুমতি দেবার। অর্থাৎ, তাঁর এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফলাফল বেসরকারি থেকে সরকারী হয়ে গেলো।
১৮৮৩ সালে চন্দ্রমুখী বসু এবং কাদম্বিনী বসু দুজনেই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁরা দুজন শুধু ভারতবর্ষের নয়, সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম স্নাতক ডিগ্রিধারী মহিলা।
চন্দ্রমুখী বসু ১৮৮৪ সালে এমএ পাশ করেন। মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম এমএ। পড়ালেখা শেষে বেথুন কলেজেই লেকচারার হিসাবে যোগ দেন তিনি। এই কলেজেই প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে পেশাগত জীবন শেষ করেন। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাওয়া নারী তিনিই প্রথম।
অন্যদিকে, কাদম্বিনী চিকিৎসাবিদ্যায় ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে জিবিএমসি (গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ) ডিগ্রি অর্জন করেন। ভারতবর্ষের প্রথম নারী ডাক্তার তিনি। পরবর্তীতে চিকিৎসাশাস্ত্রে উন্নত ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিলেত গমন করেন তিনি। এর আগে, তাঁর বয়স যখন একুশ, তিনি তাঁর শিক্ষক দ্বারকানাথকেই বিয়ে করেন।
আপনার মন্তব্য