পদ্মিনী

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-১৯ ০২:০৪:৩০

মনোজিৎকুমার দাস:

কমলের বউয়ের নাম পারমিতা। ফুলসজ্জার বাসররাতে কমলের বড়বৌদি বলে,“ কমলের বউয়ের নাম পারমিতা হলে কী মানায় কমলিনী হলে কেমন মানায় ভেবে দেখেছো, ঠাকুরপো? কমল ও কমলিনী নামের মধ্যে একটা ছন্দের যাদু আছে। ” কমলের বড়বৌদি মৃণালিনী বাংলায় এম.এ.।

কলেজের বাংলার শিক্ষয়িত্রী হবার শত চেষ্টা করেও আজও মৃণালিনীর ভাগ্যে বাংলার মাস্টারনী হয়ে ওঠা হয় নি। মৃণালিনীর কথা শুনে কমলের ছোটবোন সৌদামিনী বড়বৌদিকে বলে, “যত সব আদিখ্যেতা বড়বৌদি! মৃণালদাকে বাগিয়ে তুমি তো মৃণাল - মৃণালিনী নামে ছন্দের যাদু -----” ছোট ননদ সৌদামিনীর কথা শেষ করতে না দিয়ে মৃণালিনী বলে ওঠে,“ তোর জন্যেও সৌদামকে খুঁজে বের করবো। দেখিছ, সৌদামিনী। ”

মানব মানবীর জীবনে ফুলসজ্জার বাসররাত একবারই আসে। পারমিতার অন্তরঙ্গ বান্ধবীদের মধ্যে একমাত্র কঙ্কনাই বিবাহিতা। বিয়ের আগে থেকেই বিয়ে বাড়ির বাসররাত ও ফুলসজ্জার বাসররাতে সম্বন্ধে পারমিতাকে জ্ঞান দিতে কঙ্কনা কার্পণ্য করে নি।
বিয়ের লগ্ন ছিল শেষ রাতের দিকে, বিয়ে পড়িয়ে বাসরঘরে যেতে না যেতেই সকাল হয়ে যায়, ফলে পারমিতা বিয়ের রাতের বাসর বৃথাই যায়। এ নিয়ে পারমিতার মাথা ব্যথা না থাকলেও কঙ্কনার কিন্তু আফসোসের অন্ত ছিল না। সে আফসোস করে পারমিতাকে বলেছিল,“ প্রথম বাসররাতের আনন্দটা থেকে তুই বঞ্চিত হলি, এ কথা ভেবে বড়ই দু:খ হয়রে, পারমিতা। আমার এখন একটাই ভাবনা বরের বাড়ির ফুলসজ্জার বাসররাতটা ননদ, বৌদিদের পাল্লায় পড়ে তোরা আবার রাত কাবার করে না দিস। ফিফটি পার্সেন্ট হারিয়েছিস , বাকী ফিফটি পার্সেন্ট হারালে কিন্তু সব মাটি হয়ে যাবে। ননদ , বৌদিরা তোদের নিয়ে মজা করবে, তুই কিন্তু তাদের সঙ্গে মজায় মেতে উঠিস না, ঘুমের ভান করে শুয়ে পরবি তখন দেখবি ওরা কেটে পড়েছে। ” পারমিতা জানে কঙ্কনা জীবন সম্বন্ধে একটু বেশিই ভাবে। সে তাকে শুধুমাত্র বলে, “তোর সব কথা মাথায় রাখব।”

ফুলসজ্জার বাসররাতে তার নাম নিয়ে মজা করার মধ্যে তেমন কোন আনন্দ খুঁজে পায় নি পারমিতা। কঙ্কনার উপদেশ মত তাকে ঘুমের ভানও করতে হয় নি। রাত একটু গভীর হলে ননদ বৌদিরা তাদের রুম থেকে কেটে পড়ে। সে রাতে সবাই সেখান থেকে চলে গেলে কমল পারমিতার নামটা ছেঁটে মিতা করে দেয়। সে বলে, ফুলসজ্জার রাতে এমন গোমরা মুখে থাকে নাকি কেউ ! তুমি হয়তো বড়বৌদিও কথায় মাইন্ড করেছ। তার কথা রাখ--- আমিও কিন্তু তোমার নাম নিয়ে একটু কাটাছেড়া করব। আমি সবার সামনে না ডাকলেও আড়ালে আবডালে তোমাকে মিতা বলে ডাকব।” স্বামীর সোহাগ ভরা কথায় পারমিতার ভালই লাগে। কঙ্কনা যতই বলুক পারমিতার বড় ভয় ছিল গোঁফওয়ালা স্বামীটির মেজাজ না জানি কেমন হয়।

নীলাভ ডিম লাইটের আলোয় রজনীগন্ধা ও গোলাপ ফুলে ফুলে সাজানো রুমে স্বামীর সাথে প্রথম রাত কাটনো অভিজ্ঞতার কথা পারমিতা পনেরটা বছর পরেও ভুলতে পারে না। কমল হয়তো ভেবেছিল পারমিতা তাকে কাছে টেনে নেবে। পারমিতার দিক থেকে কোন সারা না পেয়ে কমল উসখুস করছিল তা বুঝতে পেরেও সে পাশ ফিরে শুয়েছিল। ঠাকুমার কথাই ঠিক সে তো পদ্মিনী নারী,আগেভাগে এই শ্রেণির নারীরা পুরুষ সান্নিধ্য পাওয়া মাত্রই যৌন উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয় না। পুরুষই এই শ্রেণির নারীকে উদ্দীপ্ত করে জাগিয়ে তোলে। ঠাকুমার বলা কথাগুলো পারমিতার মনে পড়ে। কমলই প্রথম বেহুশের মত তাকে কাছে টেনে নেয়। সে তার চিবুকে চুমু দিতে থাকে একের পর এক। স্তন দুটোয় কমলের হাতের প্রথম আলতো ছোঁয়ায় পারমিতা লাজে রাঙা হয়ে উঠে। এক সময় সে তার স্তন দুটোকে নিয়ে যেন খেলায় মেতে ওঠে। তারপর কমল তার সারা শরীরের আনাচেকানাচেয়------- পারমিতা পুলক আর শিহরণের আত্মহারা হয়ে ওঠে। সেও তার স্বামীকে উদ্দীপ্ত করে তোলে নিজেকে তার স্বামীর হাতে সম্পূর্ণ রূপে সঁপে দিয়ে। জীবনের প্রথম এই অভিজ্ঞতায় পারমিতা অনাস্বাদিত এক আনন্দের সাগরে ডুবে যায়।

প্রথম রাতেই পারমিতা বুঝতে পারে তার স্বামী একজন পাকা সাঁতারু। গহীন সাগরে সাঁতার কেটে সাগরকে উথালপাতাল করার ক্ষমতা সে রাখে। ফুলসজ্জার বাসররাতে কমল পারমিতাকে এক সময় চরম উত্তেজনার স্তরে পৌঁছে দেয়। এক সময় পারমিতার মনে হয় তার স্বামী তাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যাচ্ছে, সেই জগতে তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ কোথায় নেই। পারমিতা ভোরের দিকে জেগে উঠে ঘোরের মাঝে ভাবে , ঠাকুমার কথা কি ঠিক না,সে কি পদ্মিনী নয়! তার স্বামী হয়তো অশ্ব নাকি বৃষ শ্রেণির পুরুষ!

বিয়ের আগে স্বামীকে মানিয়ে নেবার কথা পারমিতা সবচেয়ে বেশি ভেবেছিল । বিয়ের পর স্বামীর ঘরে গিয়ে এক সময় তার বেশি করে মনে পড়ে ঠাকুমার কথা। ঠাকুমা বলতেন,“ তোর নাম পারমিতা না রেখে পদ্মিনী রাখা উচিত ছিল। তুই সত্যি সত্যিই পদ্মিনী।”প্রথম প্রথম পারমিতা ঠাকুমার এ কথা বুঝতো না। তাই একদিন কেন তিনি তার নাম পদ্মিনী রাখতে চেয়ে ছিলেন তা সে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। ঠাকুমা কুষ্টিয়ার মেয়ে। লালনের দেশ! তিনি প্রায় প্রায়ই সুর করে লালনের গান গাইতেন। তিনি পারমিতার প্রশ্নে লালনের গান গেয়ে জবাব দিয়েছিলেন: ‘ চিন্তামণি পদ্মিনী নারী এরাই পতিসেবার অধিকারী। হস্তিনী শঙ্খিনী নারী তারা কর্কশ ভাষায় কয় বচন। শশক পুরুষ সত্যবাদী মৃগ পুরুষ উর্ধ্ধভেদী। অশ্ব বৃষ বেহুশ নিরবধি তাদের কুকর্মেতে সদাই মন।’

গান শেষে তিনি বুঝিয়ে বলেছিলেন, “ লক্ষণ ভেদে নারী জাতি চার রকমের পদ্মিনী, চিত্রিণী, শঙ্খিনী ও হস্তিনী, আর অন্যদিকে পুরুষও চার রকমের শশক, মৃগ,অশ্ব ও বৃষ। লালন তার গানে এদের বৈশিষ্ঠের কথা ভালভাবেই বুঝিয়েছেন। বিদ্যা,জ্ঞানবুদ্ধি, চলন বলন , স্বভাব চরিত্রে নারীর লক্ষণ অনুযায়ী তুই পদ্মিনী নারী। আমি বেঁচে থাকলে তোর বিয়ে শশক শ্রেণির পুরুষের সঙ্গে দেব।” দু:খের বিষয় তার বিয়ের আগেই ঠাকুমা মারা যাওয়ায় তিনি তার ইচ্ছে পূরণ করতে পারেন নি ।

পারমিতারা দু’বোন এক ভাই। বোন দু’জনের মধ্যে পারমিতাই ছোট, দিদি জয়িতার বিয়ে হয় স্কুলে গণ্ডি পেরোনোর পরপরই। তখন বাড়ির কাছাকাছি কলেজ না থাকায় ইচ্ছে থাকলেও দিদি জয়িতার আর পড়াশোনা করা সম্ভব হয় না। দিদির বিয়ের আগে পারমিতা ক্লাস এইটে পড়ত। ঠাকুরদা অকালে গত হবার পর ঠাকুমা সংসারের হাল ধরেন। তখন বাবা, কাকা, আর পিসিকে মানুষ করার দায়িত্ব ঠাকুমা নিজ হাতে তুলে নেন। ঠাকুমার সাথে পারমিতার ভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। পারমিতা এখন ভালভাবেই বুঝতে পারে তার নিজের এত বড় পোস্টে চাকরী করার মূলে ঠাকুমার অবদানের কথা। পারমিতা এসএসসি পাশ করার পর মা জয়তি দিদির মত তাকে বিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু বাদ সাধলেন ঠাকুমা।“ বৌমা , জয়িতার মত পারুকে জলে ফেলে দিতে আমি দেব না।”

ঠাকুমা লেখাপড়া জানতেন ভালই। রামায়ণ , মহাভারত থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র,বঙ্কিম এর গল্প উপন্যাস পড়ে পড়ে তিনি কণ্ঠস্থ করেছিলেন। ছোটবেলা ঠাকুমা উপেন্দ্র কিশোর, সুকুমার রায়ের লেখা গল্প ও ছড়া শোনাতেন, গাইতেন লালনের গান। বিয়ের পর ঠাকুমার কথা পারমিতার প্রায় প্রায়ই মনে পড়ত।

পারমিতার ইচ্ছে ছিল বিয়ের আগেই এম.এ. টা পাশ করার। অনার্সে সে ভাল রেজাল্ট করে ছিল, তাই সে এম.এ.তেও ভাল করবে বলে তার আশা। কিন্তু পারমিতার বাবা মা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে ভাল চাকুরে কমলকে হাত ছাড়া করতে চায় নি।

বিয়ের পর পরই কমল একটা প্রমোশন পেয়ে ফরিদপুর জোনাল অফিস থেকে থেকে ঢাকার হেড অফিসে বদলি হওয়ায় পারমিতার আশা পূরণ হবার পথে বাঁধা থাকল না। পারমিতা প্রীতিলতা হলে থাকত, কমল ঢাকায় বাসা নিলে তাকে আর হলে থাকতে হবে না। জামাই ষষ্ঠীতে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কমল পারমিতাকে বলল, “ তোমার পড়াশোনার সুবিধার জন্যে ভার্সিটির কাছাকাছি কলাবাগানের দিকে বাসা খুঁজছি, তা নইলে মিরপুরের বাসা নিতে পারতাম।” স্বামীর কথা শুনে পারমিতার ভাল লাগে। সে ভাবে, সে হয়তো তার পড়াশোনার পাঠ শেষ করতে পারবে।

সত্যি সত্যি পারমিতার আশা পূর্ণ হয়। মাস্টারে ভাল রেজাল্ট করায় পারমিতা নামডাকওয়ালা একটা প্রাইভেট ব্যাংকে সরাসরি এক্সিকিউটিভ অফিসার হওয়ায় কমল সবচেয়ে বেশি খুশি হয়। এবার পারমিতার ঘাড়ে একরাশ দায়িত্ব এসে পড়ে।

তারপর একে একে বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়। তাদের একমাত্র ছেলে কুনাল এখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। পারমিতার কাজের পরিধি আরো বেড়েছে। অফিসের কাজের সাথে সাথে স্বামী ও সন্তানের দেখভাল করতে গিয়ে তাকে সব সময়ই ব্যস্ত থাকতে হয়। পারমিতা অফিস থেকে ফিরে নিজে একটু ফ্রেশ হয়ে প্রতি সন্ধ্যায় কুনালকে নিয়ে বসে, যদিও ছেলের জন্য দু’জন প্রাইভেট টিউটর আছে। কমল আরো প্রমোশন পেয়ে উপরের পদে বহাল হওয়ায় তার কাজের পরিধি আগের চেয়ে কম। সে অফিসার ক্লাবে সন্ধ্যার পর পরই বের হয়ে যায়। ফিরে আসে ডিনারের আগে রাত নয়টা সাড়ে নয়টার দিকে। কাজের মেয়েটি রান্নাবান্না করে বাড়ি ফিরে যায়। ফলে ডিনারের আয়োজন পারমিতাকেই করতে হয়। প্রতি রাতেই ক্লান্ত হয়ে বিছানায় যায় পারমিতা।

পনের বছরের দাম্পত্য জীবনে পারমিতা স্বামী কমলের ইচ্ছের কাছে পরাস্ত হয় নি কোন দিনই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে যেন তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। এখনো সে রাতে তাকে আগের মতোই পেতে চায়। কিন্তু পারমিতা অফিস থেকে ফিরে খুবই ক্লান্ত হয়ে পরে , ফলে তার পক্ষে নিজেকে স্বামীর ইচ্ছাকে পূরণ করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। কমল জোরাজুরি করতে কম করে না। এক এক রাতে পারমিতা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে স্বামীর কাছে সঁপে দেয়। সে বুঝতে পারে কমল তাকে ভোগ করে আগের মত পরিতৃপ্ত হতে পারে না। পারমিতার মনেও আগের মত শিহরণ জাগে না।

দিনের পর দিন এ অবস্থা চলতে থাকে। কমল পারমিতাকে বুঝতে চায় না। এক সময় পারমিতার মনে হয় তার স্বামী অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। সব কিছু বুঝেও সে কী করে তার স্বামী কমলকে বেঁধে রাখবে?। তার মনে পড়ে ঠাকুমার কথা--- সে সত্যি সত্যি পদ্মিনী শ্রেণির নারী, আর তার স্বামী কমল অশ্ব কিংবা বৃষ শ্রেণির পুরুষ। পারমিতা ভাবে সে পদ্মিনী -- আর সে পদ্মিনীই থাকবে।

আপনার মন্তব্য