সত্যের সাথে এর কোনো সংশ্রব নেই

 প্রকাশিত: ২০১৭-০১-০২ ১৩:৪৭:৫২

 আপডেট: ২০১৭-০১-০২ ১৩:৫২:১১

ফরিদ আহমেদ:

For these hypotheses need not be true nor even probable. On the contrary, if they provide a calculus consistent with the observations, that alone is enough. - Andreas Osiander

২৪ মে, ১৫৪৩ সাল।

পোল্যান্ডের ফ্রাউয়েনবার্গ শহরের প্রধান গির্জায় অন্তিম শয়নে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। বৃদ্ধের বয়স সত্তর বছর। ধর্মপরায়ণ এক যাজক তিনি। সেই সাথে চিকিৎসাবিদ, আইনজ্ঞ, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদ তিনি। তাঁকে ঘিরে বসে আছে তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বৃদ্ধ গত কয়েকদিন কোমাতে ছিলেন। আজই হঠাৎ করে সজাগ হয়েছেন তিনি। সজাগ হবার পর থেকেই অস্থির আচরণ করছেন তিনি। কীসের যেনো প্রতীক্ষা। শুধু তিনি নন, তাঁর বন্ধুবান্ধবরাও প্রতীক্ষার অস্থিরতায় ভুগছেন।

মৃত্যুর প্রতীক্ষা নয়, একটা বইয়ের প্রতীক্ষায় অস্থির আচরণ করছেন সকলে। বইটা মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধেরই লেখা। ছাপতে দেওয়া হয়েছে জার্মানির নুরেমবার্গে। সেখান থেকে ছাপা হয়ে চলে আসার কথা যে কোনো মুহূর্তেই। একটা বইয়ের জন্য এমন উদগ্রীব প্রতীক্ষা পৃথিবী আগে কখনো দেখেনি। দেখবেই বা কী করে? এই বইয়ের মধ্যে যে লুকোনো রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে যুগান্তকারী সত্যের কথা। যে সত্যকে এই বৃদ্ধ আবিষ্কার করেছেন, সেই সত্যকে ছাপার হরফে দেখার আগেই কি তাঁকে চলে যেতে হবে এই পৃথিবী ছেড়ে?

না, মৃত্যু আসার আগেই বই এলো। নীচের পাথুরে আঙিনায় ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেলো। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে মানুষের এতকালের প্রচলিত চিন্তাধারায় বিপর্যয় ঘটাবে যে বই, যে বই শতাব্দীর পর শতাব্দী জেঁকে বসা এক ধর্মীয় অনড় বিশ্বাসকে টলিয়ে দেবে, সেই বই এসে গেছে নুরেমবার্গ থেকে।

বই হাতে ঘরে এসে ঢুকলেন ওসিয়ান্ডার। তাঁর দায়িত্বে ছিলো এই বই ছাপা হবার। মৃত্যু পথযাত্রী ব্যগ্র বৃদ্ধের শীর্ণ হাতে ওসিয়ান্ডার গুঁজে দিলেন তাজা ঘ্রাণের বইখানা। পরম আদরে বইটার দিকে তাকালেন বৃদ্ধ। চোখের জীর্ণ আলো জ্বলে উঠলো শেষবারের মতো। প্রচ্ছদে লেখা আছে বইয়ের নাম, ডে রেভলুশনিবুস অরবিয়ুম কিলেস্টিয়ুম। তার নীচেই লেখকের নাম জ্বলজ্বল করছে, নিকোলাস কোপার্নিকাস। এইটুকু দেখতে দেখতেই চোখের আলো নিভে গেলো কোপার্নিকাসের।

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যিকে তিনি তিরিশ বছর পরে মুক্ত করে দিতে পেরেছেন, এই প্রশান্তি নিয়ে পরম শান্তিতে চিরঘুমে তলিয়ে গেলেন তিনি।

যে সত্যকে কোপার্নিকাস মুক্ত করে দিয়ে গেলেন মৃত্যুশয্যায়, সেই সত্যের পূর্ণ আবিষ্কার তিনি করেছিলেন তিরিশ বছর আগে। আবিষ্কার করে অত্যন্ত সংগোপনে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি এই জ্ঞানভাণ্ডারকে। যে সত্য আবিষ্কার হবার পরে সাথেই সাথেই তা প্রকাশ করার কথা, সেই সত্যকে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। পাক্কা তিরিশ বছর। এটা না করে তাঁর উপায়ও ছিলো না। প্রকাশ করতে গেলে মৃত্যুবরণ করতে হতো তাঁকে। শত শতাব্দীর প্রচলিত ধর্ম-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আঘাতের অভিযোগে বিচার হতো তাঁর। ধর্মদ্রোহিতার শাস্তি হিসাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হতো। সেই মৃত্যুও সুখকর কিছু নয়। খুঁটিতে বেঁধে জ্বলন্ত আগুনে পোড়ানো হতো তাঁকে সত্য প্রকাশের দায়ে।

মৃত্যুভয়ে চরম এই সত্যকে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি এতোকাল। জীবনচক্রে স্বাভাবিক মৃত্যুর সময়ে এসে মৃত্যুভয়কে জয় করতে সক্ষম হন তিনি। সকল বিচার আর সকল শাস্তির নাগালের বাইরে পা দিতে যাচ্ছেন তিনি। গির্জা আর বিচারকেরা আর নাগাল পাবে না তাঁর। যে মহাসত্যকে লুকিয়ে রেখেছেন তিনি, যে ঘোষণা একদিন বিপ্লব ঘটাবে, এটা জানার পরেও প্রাণভয়ে সেটা প্রকাশ করতে পারেননি তিনি। এই অপ্রকাশের যে যন্ত্রণা, সেটা মৃত্যু যন্ত্রণা হয়ে পুড়িয়েছে তাঁকে দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে। আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে, সেই সত্যের প্রকাশ দেখে গেলেন তিনি। হয়তো মলাটটাই দেখেছেন তিনি, মলাটের ভিতরে লুকিয়ে থাকা বারুদ সত্যকে দেখা হয়নি তাঁর। দেখা না হলেও অসুবিধা নেই, এর প্রতিটা শব্দ তাঁর চেনা, তাঁর নিজের রচনা, তাঁর তিল তিল করে করা গোপন গবেষণার ফসল।

টলেমি তাঁর তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন খৃস্টিয় দ্বিতীয় শতকে, আলেকজান্দ্রিয়ায় বসে। তাঁর গ্রন্থে গ্রহ-নক্ষত্র সম্বন্ধে তৎকালীন ধারণাটিই তিনি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। তারপর তেরো শো বছর ধরে সেই ধারণা অখণ্ড, অভ্রান্ত এবং অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। সেই গ্রন্থ তখন জ্যোতিষশাস্ত্রের বাইবেলে পরিগণিত। গির্জার কর্ণধারেরা এবং শিক্ষিত সমাজের লোকেরা টলেমির সংকলনকেই একমাত্র প্রামাণিক গ্রন্থ বলে ধরে নিয়েছে। সেই তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। একে বেস্টন করেই আবর্তিত হয় সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহ ও নক্ষত্র।

কোপার্নিকাস জন্মেছিলেন যে যুগে, সে যুগটা ছিলো চিন্তা-বিপ্লবের যুগ। আবার একই সাথে ধর্মান্ধতারও যুগ। আইন, ভেষজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রকৃতিবিজ্ঞান, পৌরবিজ্ঞান, গণিত, সাহিত্য, এ সকল বিষয়ে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তবে, তাঁর সেরা আগ্রহ ছিলো জ্যোতির্বিজ্ঞানে। এই জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়েই দীর্ঘকালের প্রচলিত ধারণার বাইরে চলে যান তিনি। ভাবেন, আচ্ছা ধরা যাক, আমাদের এই পৃথিবীটাই অবিরাম ঘুরছে লাট্টুর মতো। তাহলে কেমন হবে?

শুরুর দিকে তাঁর এইসব কথা শুনে লোকে হেসেই খুন হতো। সিরিয়াসলি কেউ নিতো না তাঁর কথা। পৃথিবী ঘুরলে টের পাওয়া যেতো না? মানুষ কি তাহলে এভাবে চলাফেরা করতে পারতো স্থিরভাবে? ছিটকে পড়ে গড়াগড়ি খেতো না?

সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির আবিষ্কার তখনো হয়নি। সে কারণে নিজের আবিষ্কৃত পন্থাতেই গবেষণায় ডুব দিলে কোপার্নিকাস। তাঁর চাচা ছিলেন ধর্মাধ্যক্ষ। তাঁর কারণে একটা চাকরিও জুটে গেলো তাঁর। ফলে ইচ্ছামতো পড়াশোনা এবং গবেষণার প্রচুর সময় পেয়ে গেলেন তিনি। উঁচু গির্জার বাসস্থানের দেয়ালে গোপন ফুটো করে নিলেন তিনি। সেই ফুটো দিয়ে গ্রহ, নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন। তথ্যের পর তথ্য সাজাতেন, হিসাবের পর হিসাব কষতেন। এসবই হতো গভীর গোপনীয়তায়। যদিও বা কখনো প্রবল উচ্ছ্বাসের ফলে আপনজন কারো কাছে ফাঁস করতেন তাঁর গবেষণালব্ধ জ্ঞানের কথা। তাঁরা হাসতো এই উদ্ভট কল্পনার কথা শুনে। সূর্য, চন্দ্র, অন্যান্য গ্রহ এবং নক্ষত্র ঘুরছে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে, এটাতো স্বতঃসিদ্ধ কথা।
মানুষের খালি চোখ দিয়েও এ সত্যকে দেখা যায়। বাইবেলেও একই কথা আছে। টলেমির ভাষ্যকে মেনে নিয়েছে গির্জার ধর্মাধ্যক্ষরাও। এরকম একটা শক্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দ্বিধা আসে কী করে? দ্বিধা-সংশয়ের জায়গাটাই বা কোথায় এখানে?

কোপার্নিকাসের বই লেখা শেষ হয় ঊনচল্লিশ বছর বয়সে। কিন্তু, প্রকাশ করার সাহস তাঁর হয় না। পৃথিবীকে বিশ্বজগতের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়ে সূর্যকে এর কেন্দ্রে বসিয়ে দেওয়াটা সহজ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবার কথা না মানুষের।

দীর্ঘকালের প্রচলিত বিশ্বাস, বিজ্ঞান এবং ধর্মগ্রন্থকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয় এই তত্ত্বের মাধ্যমে। লোকজনের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, সেটা দেখার জন্য তাঁর তত্ত্বের সামান্য একটু আভাস শুধু ছাপেন তিনি একবার। এই ছাপানোর ফলাফল হয়েছিলো অভিনব। না, তিনি কোনো বিপদে পড়েন নাই। তাঁর দাবি এতোই উদ্ভট ছিলো যে, এটাকে কেউ সত্য বলে মনে করেনি, মনে করেনি তাদের প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এটা একটা বিপদ। এর বদলে সবাই এটাকে মজার বিষয় হিসাবেই নেয়। হাসি-ঠাট্টা করে এটাকে উড়িয়ে দেয় সবাই। এমনকি পোপ লিও (দশম)-ও এটাকে গুরুত্ব না দিয়ে মজাদার কৌতুক হিসাবে নিয়ে আনন্দ পেয়েছিলেন। কোপার্নিকাসের দাবি এতোই উদ্ভট, প্রচলিত সত্যের এতোই বিপ্রতীপ অবস্থানে যে, এটা সত্য হতে পারে, এই ভাবনা কারো মাথাতেই আসেনি। সবাই এটাকে কোপার্নিকাসের এক ধরনের পাগলামি হিসাবেই বিবেচনা করেছিলো। এটাকে সত্যি হিসাবে তাদের সামনে উপস্থাপন করা হলে যে, এই আনন্দমুখর কৌতুক আচরণ বদলে কঠোর কঠিন রূপ দেখাবে সবাই, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ জাগে না কোপার্নিকাসের মনে। ফলে, এই গ্রন্থ প্রকাশের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি।

কেটে যায় অনেকগুলো বছর। এর মধ্যে মারা যান তাঁর ধর্মাধ্যক্ষ চাচা। তাঁর বদলে যিনি আসেন, তিনি কোপার্নিকাসের শত্রুভাবাপন্ন মানুষ। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিই সহ্য করেন না তিনি, কোপার্নিকাসের এই বাইবেল বিরোধী গবেষণা থেকে প্রাপ্ত সত্যের কথা জানতে পারলে, তাঁর পরিস্থিতি ভয়াবহ করে দেবেন তিনি, এ নিয়ে কোপার্নিকাসের মনে কোনো সন্দেহ ছিলো না। ফলে, তিনি আরো গোপন করে ফেলেন তাঁর পাণ্ডুলিপিকে।

এর মধ্যেই হঠাৎ করে কোপার্নিকাসের পরিচয় ঘটে ওসিয়ান্ডারের সাথে। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ধূর্ত একজন মানুষ ওসিয়ান্ডার। তিনি প্রস্তাব করেন, বইখানা ছাপানো হোক, তবে ভূমিকায় লিখে দিতে হবে, সত্যের সাথে এর কোনো সংশ্রব নেই। তাহলে আর গির্জার রোষ নেমে আসার সুযোগ থাকবে না কোপার্নিকাসের উপরে। এই প্রস্তাবে রাজি হন না কোপার্নিকাস। দীর্ঘ গবেষণায় যে সত্যকে তিনি আবিষ্কার করেছেন ,সেটাকে মিথ্যা বলে প্রচার করার ইচ্ছা বিন্দুমাত্রও জাগে না তাঁর মনে। বরং এই শেষ বয়সে এসে সত্য প্রকাশের তাড়নাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। মৃত্যুভয় পরাস্ত হয় সত্য প্রকাশের তীব্র আকুতির কাছে। ভূমিকার ব্যাপারে রাজি করাতে না পেরে, কোপার্নিকাস ঠিক যেভাবে চান, সেভাবেই বইটা প্রকাশ করার ব্যবস্থা করতে রাজি হয়ে যান ওসিয়ান্ডার।

বই ছাপা হলো নুরেমবার্গে, সেখান থেকে এনে তুলে দেওয়া হলো এর স্রষ্টার হাতে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বইটাকে ছুঁয়ে দেখলেন তিনি। দুনিয়া কাঁপানো মহাসত্যকে অর্গল খুলে মুক্ত করে দিয়েছেন তিনি, এই পরম প্রশান্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করলেন তিনি চিরতরে। জানলেন না, ধূর্ত ওসিয়ান্ডার তাঁকে না জানিয়ে, তাঁর আদেশ অমান্য করে সেই ভূমিকাটা জুড়ে দিয়েছেন বইটাতে।

পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্য প্রকাশের বইটা প্রকাশিত হয়ে গেলো ‘সত্যের সাথে এর কোনো সংশ্রব নেই’ ওসিয়ান্ডারের এই মিথ্যা ঘোষণাকে বুকে জড়িয়ে।

আপনার মন্তব্য