‘সত্যের জন্য আমি মরতে ভয় পাইনি’

 প্রকাশিত: ২০১৭-০১-২৩ ০২:৩৫:০৯

ফরিদ আহমেদ:

Perhaps your fear in passing judgment on me is greater than mine in receiving it. - Giordano Bruno.

তিনি ছিলেন একজন সন্ন্যাসী। মঠেই বসবাস ছিলো তাঁর। কিন্তু, যে সত্যকে তিনি বুকের মাঝে লালন করতেন, তার সাথে পরিষ্কার বিরোধ ছিলো ধর্মবিশ্বাসের। তাই চব্বিশ বছর বয়সে একদিন তিনি পালিয়ে যান মঠ থেকে। না পালিয়ে উপায়ও ছিলো না তাঁর। যে বৈপ্লবিক বিশ্বাসকে তিনি লালন করতেন বুকে, সেটা প্রকাশ করতে গেলে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হতো নিশ্চিতভাবেই। কী সেই বিশ্বাস যা তিনি লালন করতেন বুকে?

তাঁর জন্মের সাতবছর আগে মারা গিয়েছিলেন নিকোলাস কোপারনিকাস। তিনি তাঁর মৃত্যুর দিনে প্রকাশ করে গিয়েছিলেন দুনিয়া কাঁপানো এক অবিস্মরণীয় সত্যকে। এই সত্যকে তিনি প্রাণভয়ে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন তিরিশ বছর ধরে। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থেকে মৃত্যুভয়কে অতিক্রম করেন তিনি। আর তখনই প্রকাশ করে যান যুগান্তকারী এক সত্যকে। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে পুরো সৌরজগত বা মহাবিশ্ব আবর্তিত হচ্ছে, টলেমির এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের এই পৃথিবীও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের মতোই সূর্যের চারিপাশে আবর্তিত হচ্ছে।

টলেমি তাঁর তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন খৃস্টিয় দ্বিতীয় শতকে, আলেকজান্দ্রিয়ায় বসে। তাঁর গ্রন্থে গ্রহ-নক্ষত্র সম্বন্ধে তৎকালীন ধারণাটিই তিনি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। তারপর তেরো শো বছর ধরে সেই ধারণা অখণ্ড, অভ্রান্ত এবং অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। সেই গ্রন্থ তখন জ্যোতিষশাস্ত্রের বাইবেলে পরিগণিত। গির্জার কর্ণধারেরা এবং শিক্ষিত সমাজের লোকেরা টলেমির সংকলনকেই একমাত্র প্রামাণিক গ্রন্থ বলে ধরে নিয়েছে। সেই তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। একে বেস্টন করেই আবর্তিত হয় সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহ ও নক্ষত্র।

এই ধারণাকেই মৃত্যুশয্যায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিদায় নেন নিকোলাস কোপারনিকাস। জীবিত অবস্থায় তাঁর সাহস ছিলো না প্রচলিত ভুল ধারণা, যা পরিণত হয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাসে, তার বিরুদ্ধে কথা বলার।

কিন্তু, তাঁর মৃত্যুর সাত বছর পরে জন্ম নেওয়া জিওরডানো ব্রুনোর সাহসের অভাব ছিলো না। তিনি কোপারনিকাসের তত্ত্বের আরো বিস্তৃতি ঘটালেন এবং একই সাথে সাথে এই সত্যকে প্রকাশ এবং প্রচারে নামলেন।

মঠ থেকে পালিয়ে গিয়ে সারা ইউরোপ চষে বেড়াতে লাগলেন তিনি। রোম, জেনেভা, প্যারিস, অক্সফোর্ড, ভেনিস, উইটেনবার্গ, শহর থেকে শহরে ঘুরে ঘুরে নিজের বিশ্বাসকে ঘোষণা করে বেড়াতে লাগলেন তিনি। সব জায়গাতে গির্জা চোখ রাঙিয়েছে তাঁর উপর। সেই রোষকে উপেক্ষা করে গেছেন এই অকুতোভয় যুবক। কোপারনিকাসের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন তিনি, সমস্ত জটিলতা ভেদ করেছেন, তারপর অন্ধকার ফুঁড়ে বের হয়ে আসা বিদ্যুতের ফলার মতো লকলকে সত্যের আগুন ছুড়ে দিয়েছেন বিশ্বাসে অন্ধ গির্জার বুকের উপরে।

ফলাফল যা হবার তাই হলো। গির্জা এগিয়ে এলো নিজের অন্ধবিশ্বাসকে বাঁচাতে তার প্রবল শক্তিমত্তা নিয়ে। ভেনিসে ধরা পরলেন ব্রুনো। সেখান থেকে রোমের কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো তাঁকে। দুঃসহ শারীরিক অত্যাচার করে তাঁর অপরাধ স্বীকারের প্রচেষ্টা চালানো হলো। ব্রুনো অটল। নিজের বিশ্বাস করা সত্যে অনড় এবং অবিচল হয়ে রইলেন তিনি। তাঁকে দিয়ে ভুল স্বীকারে ব্যর্থ গির্জা তাঁর বিচারের ব্যবস্থা করলো। ধর্মদ্রোহিতার কারণে আগুনে পুড়িয়ে মারার রায় হলো তাঁর।

১৬০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি খুঁটির সাথে বাঁধা হলো তাঁকে। তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো তাঁর গায়ে। গায়ে যখন আগুন জ্বলছে, তাঁর হত্যাকারীদের একজন তাঁর মুখের সামনে তুলে ধরলো ক্রুশকে। চুম্বন করতে বলা হলো তাঁকে। এতে করে বিভীষিকা থেকে মুক্তি পাবেন তিনি। আগুনে দগ্ধ ব্রুনো ক্রুশের কাছ থেকে সরিয়ে নিলেন মাথা। বললেন, "তোমরা যারা আজ আমার বিচার করলে, তারা আমার থেকেও অনেক বড় বিভীষিকায় আচ্ছন্ন।"

এর আগে বিচারকদের কাছেও ব্রুনো বলেছিলেন, “আমি সংগ্রাম করে গেলাম - সেটুকুই সার্থকতা আমার। হারজিৎ ভবিষ্যৎই জানে। হারজিৎ যাই হোক, আগামীকালের মানুষেরা আমাকে অস্বীকার করবে না। তারা এটুকু অন্তত জানবে, সত্য বিশ্বাসের জন্য আমি মরতে ভয় পাইনি”।

আপনার মন্তব্য