সুকান্ত ভট্টাচার্য : মানব মুক্তির জন্য কবিতায় জ্বালিয়েছিলেন বিদ্রোহের মশাল

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৫-১৩ ১৬:১৩:৩০

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

আল আমিন হোসেন মৃধা:

'শোন রে মালিক, শোন রে মজুতদার!
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়-
হিসাব কি দিবি তার?
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
কখনো ভুলতে পারি?
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই।
শোনরে মজুতদার,
ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ
করব তোকে এবার।'

কৃষক-শ্রমিক-মজুরদের পক্ষে আর শোষক-মালিক-মজুতদারদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরা, রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর যুগের সমাজতন্ত্রের আদর্শের বিপ্লবী, গণজাগরনের তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। কবিতায় সমাজতন্ত্রের ধারার প্রবর্তক ও সাম্যবাদী এ কবি অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেমন রাজপথে প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন মালিক শ্রেণী ও বৃটিশদের অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মুক্তির নিশান। তিনি দেখিয়েছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পথ সংকীর্ণ হলেও এ পথেই মুক্তি।

কবি লিখেছেন,
'তোমাদের পথ যদিও কুয়াশাময়,
উদ্দাম জয়যাত্রার পথে জেনো ও কিছুই নয়।
তোমরা রয়েছ, আমরা রয়েছি, দুর্জয় দুর্বার,
পদাঘাতে পদাঘাতেই ভাঙব মুক্তির শেষ দ্বার।
আবার জ্বালাব বাতি,
হাজার সেলাম তাই নাও আজ, শেষযুদ্ধের সাথী।'

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে কলমে বিদ্রোহের মশাল জ্বালানো কবি সুকান্তের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে মাতুলালয়ে। পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার উনাশিয়া গ্রামে।

পরাধীন দেশের দুঃখ দুর্দশাজনিত বেদনা এবং শোষণ মুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন, শোষিত মানুষের কর্ম জীবন এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম কবিতায় তুলে ধরা এ কবি কৈশোর থেকেই যুক্ত হয়েছিলেন সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। কার্ল মার্ক্স ও লেনিন ছিলেন তাঁর আদর্শের প্রেরণা। রুশ বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন তাঁকে বিপ্লবের জন্য এতই প্রণোদিত করেছিলেন যে তিনি তাঁর কবিতায় বলতে বাধ্য হয়েছেন- 'যেন আমিই লেনিন'।

তিনি লিখেছেন,
'লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ।
মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস
মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।
লেনিন ভুমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।'

পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজ ব্যবস্থায় আজ নারীরা অত্যাচারিত, নির্যাতিত ও ধর্ষিত। নারীকে আজ উপস্থাপন করা হয় পণ্য রূপে। নারীকে মানুষ ভাবা হয় না, তারা যেন শুধুই নারী। কবি সুকান্ত নারীদেরকে আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন।

তিনি লিখেছেন,
'মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী,
অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি;
‘আ’কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার
চেষ্টা হাসির। তাই ভূমিকা ছড়ার।
‘গুপ্ত’ ‘গুপ্তা’ হয় মেয়েদের নামে,
দেখেছি অনেক চিঠি, পোষ্টকার্ড, খামে।
সে নিয়মে যদি আজ ‘ঘোষ’ হয় ‘ঘোষা’,
তা হলে অনেক মেয়ে করবেই গোসা,
‘পালিত’ ‘পালিতা’ হলে ‘পাল’ হলে ‘পালা’
নির্ঘাৎ বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা।'

রাত জেগে জেগে কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করতে গিয়ে শীতকালে অতিমাত্রায় ঠান্ডায় ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন কবি। 'আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি/আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।' আর এই আঠারো বছরের মাত্র তিন বছর পর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪৭ সালের আজকের এই দিনে মাত্র ২১ বছর বয়সে কলকাতার যাদবপুরের একটি ক্লিনিকে মারা যান।

'এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।'

এ বিশ্ব শিশুদের-নারীদের সবার বাসযোগ্য হয়ে উঠুক, মানবতার মুক্তি ঘটুক- এই আমাদের প্রত্যাশা ও প্রত্যয়। আজ কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ৭০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আপনার মন্তব্য