তাহমিমার পুরস্কার: ১ বর, ৩ বধূর আষাঢ়ে গল্প!

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৬-১৩ ১৭:৫১:০৩

 আপডেট: ২০১৭-০৬-১৩ ২৩:০৩:৪৫

লেখক তাহমিমা আনাম

আলমগীর শাহরিয়ার :

ইংরেজি ভাষায় লিখে সুনাম কুড়ানো ব্রিটিশ-বাংলাদেশি লেখক তাহমিমা আনাম ‘গার্মেন্টস’ নামে একটি গল্প লিখেছেন। গেল শুক্রবার দেশের একটি প্রধান দৈনিক গল্পটি অনুবাদ করে ছেপেছে। আমেরিকার ও কানাডার সাময়িকীতে প্রকাশিত এ গল্পের জন্য লেখক ও' হেনরি পুরস্কার পেয়েছেন। ছোটগল্পের বিখ্যাত আমেরিকান কারিগর উইলিয়াম সিডনি পোর্টার। যিনি ও' হেনরি নামেই সমধিকখ্যাত। উল্লেখ্য, তাঁর নামেই এ পুরস্কার প্রবর্তিত। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে চালু হওয়া এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে ছোট গল্পের অনেক দিকপালেরাই পেয়েছেন। ২০১৩ সালে সাহিত্যে  নোবেলজয়ী কানাডিয়ান লেখক এলিস মুনরোও এ তালিকায় আছেন। তাহমিমার জন্য এ পুরস্কার প্রাপ্তি নিশ্চয়ই গৌরবের। দেশের ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত এক পরিবারের উত্তরাধিকার প্রবাসী বাঙালি এ লেখকের 'এ গোল্ডেন এজ' উপন্যাসটি পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এ উপন্যাসের মাধ্যমেই ইংরেজি লেখিয়ে একজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ লেখক হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর পরিচিতির সূত্রপাত। পরে 'গুড মুসলিম' নামে তাঁর আরেকটি উপন্যাসও বোদ্ধা মহলের দৃষ্টি কেড়েছে।

তাই ‘গার্মেন্টস’ নামের গল্পটি পড়ে তাঁর লেখনিশক্তি সম্পর্কে আমার চিড় ধরেনি। তবে গল্পের অবাস্তবতা, নিজ সমাজ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিয়ে সাফল্যের সিঁড়ি মাড়ানোর অভিলাষ ভাবিয়েছে। তিনি যে গল্প লিখেছেন সেটা গল্পের অধিক, আষাঢ়ে গল্প। গল্পকার আষাঢ়ে গল্প লিখতেই পারেন। গাঁজার নৌকা পাহাড় বেয়ে যেতে পারে, সমস্যা নেই। সমস্যা বা আপত্তি হলো, যখন নিজ সমাজ ও দেশকে অযাচিতভাবে, অন্যায়ভাবে বিশ্বমঞ্চে ছোট করে, ডুবিয়ে কেউ আন্তর্জাতিক পুরস্কার বগলদাবা করেন এবং সেই ব্যক্তি ও পুরস্কারকে আমাদের গণমাধ্যম জাতির কারো অর্জন হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টা করে।

'গার্মেন্টস' একুশ শতকীয় নগর সমাজের প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষজনকে নিয়ে লেখা একটি গল্প। যেখানে গার্মেন্টেসে কর্মরত লাখ লাখ বস্ত্র বালিকাদের সংগ্রামকে, জীবন ও স্বপ্নকে খাটো করে দেখানো হয়েছে। এ গল্পের শুরুতেই গার্মেন্টস শ্রমিক মালা তার সহকর্মী জেসমিনকে জানায়, তার নাগর তাকে বিয়ে করতে চায়। মালা, জেসমিন, রুবি ও দুলাল- প্রধানত এই চার চরিত্রকে ঘিরে এ গল্পটির প্লট। গল্পে মালা তার নাগরের আকাঙ্ক্ষা এতোটা সাবলীলভাবে সহকর্মী মেয়েটিকে বলে এবং শুধু জেসমিন না, রুবি নামে আরেক মেয়েকেও রাজি করিয়ে মালাসহ তারা তিনজন দুলাল নামের একজন লোভী, যৌনউত্থান সমস্যাজনিত সেলসম্যানকে কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে করে। চারজনই পরস্পরকে মুশকিল আসানের হাতিয়ার ভাবে। মানুষ মানুষকেই মুশকিল আসানের মাধ্যম ভাববে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উদ্ভট ঠেকেছে সব জেনে শুনে তাদের এরকম নির্বিরোধ যৌথ বিবাহের আয়োজন, যা মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি ও স্বভাববিরুদ্ধ। তাছাড়া প্রবল ধর্মানুভূতির এ সমাজে একদম অভাবনীয় ও অকল্পনীয়। স্বাভাবিক মূল্যবোধ বিরোধী তো বটেই। বহু বা যৌথ বিবাহের এমন মহোৎসব আফ্রিকার গভীর জঙ্গলের বিলুপ্তপ্রায় আদিবাসীদের মধ্যেও এখন আর নাই। কিন্তু তাহমিমা আনাম তার গল্পে এটি দেখিয়েছেন, যা দৃষ্টিকটু ও বেখাপ্পা ঠেকেছে।

গল্পের অন্যতম একটি চরিত্র জেসমিন। গ্রাম থেকে পালিয়ে যে শহরে আসতে বাধ্য হয়। আসলে তাকে গ্রাম ছাড়া করা হয়। বিবাহিত নয় বলে যার বাসা ভাড়া নিতে সমস্যা হচ্ছিল। নারীবান্ধবহীন এ শহরে বিয়েকেই মেয়েটি মুক্তির হাতিয়ার ভাবে। জেসমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সে তার গ্রামে আমিন মাস্টারের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে মাস্টারকে ফুসলিয়েছে। শাস্তিস্বরুপ তাকে গ্রাম্য সালিসে মাতব্বরের সাজাখানায় ঢুকতে হয়। সাজাখানায় মাতব্বরের দ্বারা ধর্ষিত হয় মেয়েটি- গল্পে এমন ইঙ্গিতও আছে। কথিত সাজাখানার শাস্তি শেষে হাস্যোজ্জ্বল আমিন ও গ্রামের সবার সামনে তাকে বিবস্ত্র করে ঘুরানো হয়।

পুরুষতন্ত্রের দোর্দণ্ড প্রতাপে আমাদের সমাজে এখনো নারীরা নানভাবে নিপীড়িত, বঞ্চিত, নির্যাতিত। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও মোল্লাতন্ত্রের ফতোয়ার শিকার হয়ে মধ্যযুগীয় শাস্তির বিধান পালন হওয়ার অনেক ঘটনা এখনো কালেভদ্রে গ্রাম-গঞ্জে শোনা যায়। নূরজাহানের আত্মা এখনো কাঁদে। শহরের চেয়ে আমাদের গ্রামসমাজ আরো বেশি নারীবান্ধবহীন ঠিক, কিন্তু এতোটা বর্বর নয় যে একটা মেয়েকে শাস্তিস্বরূপ এভাবে নগ্ন করে, উলঙ্গ করে দিনদুপুরে গ্রামের সবার সামনে ঘুরিয়ে আদিম আনন্দ নেবে। একুশ শতকে পৃথিবীর কোথাও সামান্যতম বিচার ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে এমন কোন সমাজে নারীকে বিবস্ত্র করে প্রদর্শনীর বস্তু বানানো অবিশ্বাস্য ঠেকে। যৌন আনন্দদানকারী সার্কাসেও এরকম ঘটনা ঘটে না। এটা লেখকের শিকড় বিচ্যুত দেশ-গ্রাম সম্পর্কে অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা ও নেতিবাচক ধারণার ফসল। নারী শিক্ষাবৃদ্ধি, বাল্যবিবাহ রোধ, মাতৃমৃত্যু হার কমা বাংলাদেশের গ্রামসমাজ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে এ গল্প ভুল বার্তা দেবে। আমরা যারা গ্রামে বেড়ে ওঠা, এখনো নিয়মিত গ্রামে যাই- গ্রাম সমাজ সম্পর্কে এমন উদ্ভট নেতিবাচক ধারণা আমাদের মূল্যবোধকে আহত করে।

তাহমিমা আনাম, আমরা চাই বাংলাদেশের গ্রাম ও সমাজ নিয়ে আপনি আরও লিখুন। বিশ্ববাসী আপনার লেখনির মাধ্যমে এ দেশকে জানুক। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সরলতা ও কুটিলতা আপনার লেখায় আসুক। কিন্তু একরৈখিক অবাস্তব, কল্পনাপ্রসূত নেতিবাচক উপস্থাপন পৃথিবীর মানুষের সামনে আমাদের হেয় করে। এরকম গল্প লিখতে বিলেতে থেকে সেকেন্ডারি তথ্য নয়, ফার্স্ট হ্যান্ড তথ্যে লেখার জন্য হলেও তাহমিমা আপনার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ময়মনসিংহের ধানিখোলা গ্রামে হলেও অন্তত কিছুদিন কাটিয়ে যেতে পারেন। এ অভিজ্ঞতা আপনার ভবিষ্যৎ লেখালেখির জন্য কাজ দেবে। গরীবদের নিয়ে আরো গল্প লিখুন, কিন্তু অসংবেদনশীল অবাস্তব গল্প ফেঁদে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করে বাহবা কুড়ানো বড় বেমানান। আপনার লেখক সত্ত্বা ও শক্তির কাছে আমাদের প্রত্যাশা এখনো আকাশচুম্বী।

আপনার মন্তব্য