যাবার বেলা

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৬-১৬ ১৫:৪৮:৩৪

 আপডেট: ২০১৭-০৬-১৬ ১৫:৫৫:০৫

মৌসুমী ভট্টাচার্য:

তখনও পুরোপুরি অন্ধকার নামেনি। রোজকার মত আজও অনেকক্ষণ ধরে স্তব্ধ হয়ে দোতালার বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধ শোয়া হয়ে বসে ছিলেন শর্মিলা দেবী।

তবে অন্যদিনের বসা আর আজ বসার মধ্যে অনেকখানি তফাৎ আছে। আজ মন খুব বিষণ্ণ হলেও কোথায় জানি একটা মুক্তির আনন্দও পাচ্ছেন। যখন থেকে এই ডিসিশনটা পাকা ভাবে নিতে পেরেছেন, তখন থেকেই মনটা অনেক শান্ত হয়ে এসেছে। আজ তাঁর তিপ্পান্নতম বিবাহবার্ষিকী।

কাল সকালেই ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা এই বাড়ি। ভাবতেই এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল শর্মিলা দেবীর বুক ঠেলে।

শহর প্রান্তে, প্রায় সত্তর বছর পুরোনো, বাগান ঘেরা দোতলা বাড়িটি তৈরি করেছিলেন শর্মিলা দেবীর শ্বশুর। বিয়ে হয়ে এ বাড়িতেই এসে উঠেছিলেন শর্মিলা দেবী। স্বামী, শ্বশুর দু'জনেই ছিলেন নাম করা উকিল। যদিও বাড়ির নাম 'আনন্দ ভবন', তবে 'উকিল বাড়ি' নামেই শহরের সবাই চিনত এই বাড়িটি। শ্বশুরের আমলে এদিকে একদম জনবসতি ছিল না বলতে গেলে। দু'দিকে ফাঁকা মাঠ আর ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে লাল মাটির রাস্তাটা এসে এই বাড়ির গেটেই তখন শেষ হত। ধীরে ধীরে শহর বড় হতে লাগল, কল-কারখানা বেড়েই চলল, আর বাড়ির আশেপাশের ফাঁকা মাঠগুলো ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে ভরা শুরু হয়ে গেল।

তবুও শর্মিলা দেবীর স্বামী মারা যাওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত শহরের হই-হট্টগোল থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বেই ছিল বাড়িটা। তখনও এখানে ছিল শান্তি। আম, জাম, লিচু গাছের ডালে তখনও শোনা যেত বসন্তের কোকিলের ডাক। বাগান জুড়ে ফুটত কত রঙিন মৌসুমি ফুল। বাড়ির পেছনে ছিল সবজি ক্ষেত। আলু, বেগুন, লাউ, মূলা এসব হত সেখানে। শর্মিলা দেবীর ছিল বাগানের শখ। উনার হাতের যত্নের ছোঁয়া ছিল বাগানের প্রতি কোনে।

শর্মিলা দেবীর দুই ছেলেই স্বামীর মৃত্যুর অনেক আগে পড়াশোনা করতে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর চাকরি-বাকরি, বিয়ে-শাদি করে ওরা দু'জন এখন দুই বড় শহরে সেটেল্ড, বড় ছেলে কোলকাতা আর ছোটছেলে ব্যাংগালুরুতে।

যতদিন স্বামী বেঁচেছিলেন, দু'জনে মিলে মাঝে মাঝে গিয়ে ছেলেদের সাথে থেকে আসতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর একাকিত্ব সহ্য না করতে পেরে পাকাপাকিভাবেই ছেলেদের সাথে থাকতে গিয়েছিলেন শর্মিলা দেবী। ছেলেরাও এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিল। বাড়ি বিক্রি করার পরিকল্পনাটাও তখনই মাথায় আসে।

কিন্তু কিছুদিন থাকার পরেই শর্মিলা দেবী বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন, ছেলেদের সংসারে তিনি অবাঞ্ছিত। সব সময়ই থাকত পরাধীনতার বাধা। প্রকাশ্যে না হলেও কোথায় যেন সবার ব্যবহারে পাচ্ছিলেন সূক্ষ্ম একটা অবহেলার আভাস। আর দেরি না করে আবার নিজের পুরানো বাড়িতেই ফিরে এসেছিলেন তিনি। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। নিজের মানুষের অবহেলা পাওয়া থেকে একাকীত্বই ভাল, বুঝে নিয়েছিলেন সেদিন। তারপর থেকে দুই পুরোনো কাজের লোকের সাহায্যে একাই থাকতেন শর্মিলা দেবী।

বছর তিনেক আগে, শর্মিলা দেবীর বড় ছেলে অনেক টাকা ধার করে একটি বিশাল বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনে কোলকাতায়। একসঙ্গে এতগুলো টাকার প্রয়োজন হতেই আবার নিজেদের বাড়ি বিক্রির কথাটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ছোট ছেলেরও তখন টাকার দরকার।

ততদিনে ছোট্ট শহরটাও বিশাল আকার ধারণ করেছে। কল-কারখানায় ভরে গিয়ে হয়ে উঠেছে এক আধুনিক ইনডাস্ট্রিয়াল হাব। জমির দামও হয়ে গেছে আকাশ ছোঁয়া। এমন অবস্থায় শহরের এত ভাল জায়গা জুড়ে এত বড় বাগানওয়ালা বাড়িটা শুধু শুধু ফেলে রাখা খুবই বোকামি।

দুই ছেলে আর বৌমারা এসে নানাভাবে শর্মিলা দেবীকে বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার জন্যে বোঝাতে লাগল। প্রথম দিকে ভাল কথায় বোঝানোর চেষ্টা, নানা প্রলোভন দেখানো আর শেষের দিকে রীতিমত ধমকিয়ে চাপ সৃষ্টি করতেও ওদের একটুও বাঁধছিল না। অবাক হয়ে শর্মিলা দেবী দেখেছিলেন ওদের চোখের নির্লজ্জ লোভ। নিজেকে এদের গর্ভধারিণী ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল খুব।

বুড়ো বয়সে বাড়ি বেচে কোথায় যাবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে "তুমি তো আমাদের সঙ্গেই থাকবে" জাতীয় বৌমাদের গদগদে ভাবটা একদম অসহ্য লাগছিল। এতদিনে চিনেছেন তো সবাইকে। কাজ উদ্ধার হয়ে গেলেই যে অন্য মূর্তি ধরবে এরা, সেটা তো স্পষ্টই বুঝতে পারছিলেন।

কিছুদিন এভাবেই চলছিল। কিন্তু দিনে দিনে ছেলে-বৌদের সাথে অশান্তি বেড়েই চলছিল। মাঝে মাঝে ছেলেরা এসে হাজির হয়। চলে তর্কাতর্কি, ঝগড়াঝাঁটি, কান্নাকাটি। আর যেন পারছিলেন না শর্মিলা দেবী। ক্লান্ত হয়ে পড়ে একসময় হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ঠিক করেছিলেন নিজের যা কিছু সঞ্চয় আছে, তা নিয়ে কোন বৃদ্ধাশ্রমেই চলে যাবেন বাড়িটা ছেলেদের হাতে তুলে দিয়ে।

আজ থেকে ছয় মাস আগে সেই সিদ্ধান্ত জানাতেই ছেলে-বৌদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তারপরে কি সমস্ত কাগজপত্রে সই সাবুদও করে দিয়েছিলেন। এরপরেই বাড়িটা তুলে দেওয়া হয় প্রমোটারের হাতে। কালই বাড়ি খালি করার শেষ দিন।

কাল সকালে ছোট ছেলে আসবে তাঁকে নিয়ে যেতে। গোছগাছ করে তৈরি হয়ে থাকতে বলে গেছে। কাজের লোক দু'জনকে আজ সকালেই বেশ কিছু টাকা, কাপড়-চোপড় দিয়ে বিদায় দিয়েছেন শর্মিলা দেবী।

তারপর বিকেল গড়াতেই চুপচাপ এসে বসেছেন বারান্দায় প্রিয় আরাম চেয়ারে। চলে যেতে হবে, সব ছেড়ে চলে যেতে হবে- ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেন জানি দুমড়ে দুমড়ে উঠছিল। না, আর ভাবনা নয়, আর কোনো দুঃখ নয়। এবার শুধু যাওয়ার প্রস্তুতি।

পঞ্চমীর চাঁদটা কি সুন্দর। শর্মিলা দেবী ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলেন। একটু পরেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল।

সকালবেলা ছেলে এসে দেখে, মা আধশোয়া অবস্থায় বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে আছেন। শরীর প্রাণহীন, ঠাণ্ডা। পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ে আছে ঘুমের ওষুধের খালি বোতলটা।

বধূবেশে কোন এক গোধূলি লগনে, সানাইয়ের মূর্ছনায় স্বপ্ন সাজিয়ে এ বাড়িতে প্রথম পা রেখেছিলেন অষ্টাদশী শর্মিলা। আজ তিপ্পান্ন বছর পর যাবার বেলায় মরণের হাত ধরে এ বাড়ি থেকে নিলেন চিরবিদায়।

আপনার মন্তব্য