ডোবার অানন্দ থেকে বঞ্চিত ফারুকী

 প্রকাশিত: ২০১৭-১০-৩১ ০১:৩৩:৩৭

শুভাশিস সিনহা:

'ডুব' দেখতে দেখতে প্রথম প্রায় অাধঘন্টা পর নান্দনিকতার উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে না পেরে পাশে বসা জ্যোতিকে (অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা) ফিসফিসিয়ে বলেছিলাম, দেখো! একটা মানুষ (ফারুকী) কোথায় তার ভিশন রেখেছিল! অসাধারণ!

ভাবছিলাম, ব্যাচেলর চড়ুইভাতি মেড ইন বাংলাদেশ-এর সেই ফারুকীই অাজ এসে বানাচ্ছে 'ডুব'। বিস্তর তফাত। গভীরতা, পলিশনেস, সংহতি, পরিমিতি সব দিক দিয়েই। ফারুকী যে কিয়ারোস্তামি কপচান কথায় কথায়, তার ছিটেফোঁটাও তার কাজে না পেয়ে হতাশ হতাম। হাসতাম। এবার যেন তারও একটা দেশীয় সিনথেসিস পাওয়া গেল। অামার সম্প্রতি মনোযোগ কেড়ে নেয়া ইরানিয়ান ফিল্মমেকার অাসগর ফরহাদির কথাও মনে অাসছিল (বিশেষত 'সেপারেশন')। খানিকটা রাশিয়ান তারকোভস্কিও। বিশেষ করে অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি। গাড়ির ওপর বৃষ্টির ফোঁটা, মায়ের সাথে সাবেরী (তিশা)-র ফোনালাপে বাতাস, ক্রমে বাড়তে থাকা বেগ... মনে থাকবে।

জীবন যথার্থ চরিত্র অার পরিপার্শ্ব নিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠছিল পর্দায়। কিন্তু যখনই দারুণ তৃষ্ণায় চাচ্ছিলাম একজন বয়সী ফিল্মমেকারের (অসম) নারী-সম্পর্কের একটা মানবিক দার্শনিক অভিব্যক্তি, টানাপোড়েন কিংবা এক তরুণীর 'অস্বাভাবিক' প্রেমের তীব্রতার দোহাই, অাশা করছিলাম দানা বেঁধে ওঠা মানবিক-সামাজিক দ্বন্দ্বমধুর সংকটকে ক্ষণে ক্ষণে ঝিলিক দেয়া সংলাপে, ইংগিতে, ইমেজে, ঘটনায় বা ক্রিয়ায় কোনো না কোনোভাবে চূর্ণ করে করে চিনিয়ে দেবে দ্যুতিময় জৈবনিক রহস্যের সদর-অন্দর, তখনই শুরু হলো সিনেমাটিক পতনের যাত্রা। সুস্পষ্ট উল্লম্ফন, বাখানবয়ানহীন পরিণতির দিকে শিল্পযাত্রা, একটি কি দুটি চরিত্রের সপ্রাণ সকর্মক ইচ্ছাকে জীবন্ত রেখে বাকিগুলোর লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া। যেন 'ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল'। মুখ গোমড়া করে থাকা ছাড়া রোকেয়া প্রাচীর চরিত্রটির অার কিছু করার ছিল না।

বিচ্ছেদকৃত স্বামীর মৃত্যুসংবাদ শোনার পর তার সংলাপটি - 'অামি অাজ সত্যি খুশি, অাজ তুমি কারো অধিকারে নেই...অাজ চোখ বন্ধ করলেই অামি তোমাকে দেখতে পাব।' - তাকে শেষদিকে খানিকটা অার্টিস্টিক অস্তিত্ব দিয়েছে, যেটা কোনোভাবেই পেলেন না পার্নো মিত্র। একটা পুরোদস্তুর ভীলেন। একটা ডায়ালেক্ট অার ডাইমেনশনলেস 'অমানবিক' উটকো চরিত্র। স্বামীর মৃত্যুতে ঝরা তার চোখের পানিও তাই দর্শকমনের ঘায়ে এসিড। হয় শাওন, নয় পার্নো মিত্র - দুজনের কেউ ফারুকীকে কৈফিয়তের কাঠগড়ায় দাঁড় করাক, চাইব। হয় সামাজিক নয় শৈল্পিকতার কাঠগড়ায়। অার ইরফান খানের চরিত্রটার অাদি-অন্ত সেল্ফ আইসোলেটেড বা এলিয়েনেটিক এপিয়ারেন্স-এর কোনো গূঢ় মর্ম উন্মোচিত হয় নাই। সেটা না হলেও জীবন চলে, শিল্প চলে না। শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, বাস্তবে ঘটনার ক্রিটিক্যাল সময়ে হঠাৎ ভীলেন সাপের কামড়ে মরে গিয়ে সব ফয়সালা করে দিতে পারে। গল্প উপন্যাসে সেটা হতে পারে না।

নৈঃশব্দ্য, একাকিত্ব, বিষাদ অার নির্জনতার যে অসামান্য ছবিমালা পর্দায় অাছড়ে পড়ছিল ক্যামেরার গুণে (শেখ রাজিবুল ইসলামকে হেমন্তের একরাশ শুভেচ্ছা), শেষ অর্ধেকে থেমে গেল তাও। শুরু হলো দৃশ্যের নিরেট ম্যাটেরিয়াল চলন। ভারসাম্য রইল না সিনেমাটোগ্রাফিরও, ব্যাহত হলো রিদম, হারমোনি।

বাংলাদেশের সিনেমায় সর্বসুষম, সংহত, অর্গানিক ইউনিটির কোনো পিস এখনও পাওয়া গেল না। ফারুকী ডুবে যেতে ভয় পেয়ে ঝটিকায় ভেসে উঠলেন, অার ডোবালেন শিল্প।

তবু বেঁচে থাকবে - হয়তো বা - সহসাই গতিহারা স্থিরজলে ভেসে থাকা অদ্ভুত সুন্দর কচুরিপানার মতো কয়েকটি ইমেজ, তিশা কিবা ইরফান খানের অভিনয়ের কয়েকটি মুহূর্ত, ক্ষরণের অতলান্ত ছুঁতে গিয়ে থেমে পড়া শৈল্পিক খোদাইয়ের অাঙুল।
একটা দীর্ঘশ্বাস!

লেখক: কবি, নাট্য নির্দেশক।

আপনার মন্তব্য